__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১৬___________
অন্ধকারে লাইট অফ করে শুয়ে আছে মনি। বালিশে মুখ গুঁজে চাপা কান্না করছে সে। আঁধারের সাথে যেন কষ্টগুলো ভাগ করে নিচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে তার। এত অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাবে তার, এর চেয়ে বড় কষ্ট রাজকে হারাতে হচ্ছে। এখনও তার ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে, এখনও স্বপ্নগুলো একটু একটু করে বুনে যাচ্ছিল সে, রাজকে নিয়ে ভালোবাসার মহল সাজাচ্ছিল কেবল, এরই মধ্যে বৈশাখী ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। রাজকে আর বলা হলো না তার মনের কথা। না বলে ভালোই করেছে সে। নয়তো সে যে কষ্ট পাচ্ছে, তা রাজের ভাগ্যেও থাকতো। সে চায় না রাজ কষ্ট পাক। সে চায় না রাজের জীবনটা নষ্ট হোক। সে জানে তার ভালোবাসা কেউ কখনও মেনে নেবে না। তবুও কী করার? মন তো আর এসব বোঝে না। কখন কীভাবে কার প্রেমে পড়ে, মন তো জানে না। তবে ভুল করে যেহেতু সে রাজের প্রেমে পড়েছে, রাজকে নিজের সত্ত্বার সাথে মিশিয়ে ফেলেছে, ভুলের মাসুলটুকু তাকেই দিতে হবে। যতই কষ্ট হোক সে মেনে নেবে।
.
ঘরের লাইটটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো। মনি চোখ মুছে তাকালো। দেখলো তার মা এসেছে ঘরে। এসেই মনির পাশে বসলো মা। মেয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এতক্ষণ কান্না করেছে সে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলে গেছে তার। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললো,
-মেয়ে হয়ে জন্মালে সবারই একদিন না একদিন পরের ঘরে যেতে হয় মা। এটাকে মানতে হবে। আর কাদিস না মা।
-তাই বলে আমার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে মা?’ মাকে জড়িয়ে ধরে ‘হু হু’ করে কেঁদে উঠলো মনি। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আমার বয়সী সবাই মাঠে খেলা করে, দৌড়াদৌড়ি করে, স্কুলে যায়, আর আমি সংসার করবো মা?
-কী করবি আর মা? তোর যদি বাপ থাকতো, তাহলে এত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে দিতাম না। তুই তো পোড়াকপালি, আমার চেয়েও পোড়াকপালি। তাইতো বাচ্চা বয়সেই তোর বাপকে হারিয়ে ফেলেছিস। এই ঘরে তোর মাকেও ভরণপোষণ দিচ্ছে, তোকেও দিতে হচ্ছে, চিরদিন কি এরকম থাকবে মা বল? তোর দাদুর যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, আমরা মা মেয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?
-আচ্ছা মা আমার সাথেই কেন এমন হয়? আল্লাহ কি পারতো না, আমার বাবাটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে? অল্প বয়সেই আমার বাবা ডাকার অধিকারটা কেড়ে নিলো। সবার বাবা কত আদর করে ছেলেমেয়েদের, আর আমার বাবাটা আমার থেকে কতদূরে!
-আল্লাহ যা করে, ভালোর জন্যেই করে মা।’ মনির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো মা। মনি মাকে জড়িয়ে ধরে পুরো আবেগে কাঁদতে লাগলো। কেঁদে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়, কেঁদে যদি একটু বাবার আদর না পাওয়ার কষ্ট ভুলা যায়, কেঁদে যদি নিজের দুর্ভাগ্যের পরিণতি মেনে নেওয়া যায়।
.
.
পাত্রকে সবার বেশ পছন্দ হয়েছে। টাকাপয়সা, বয়স, ঘরবাড়ি সব ঠিক আছে। পাত্র দেখতেও সুন্দর। আশরাফ সাহেবসহ কয়েকজন গিয়ে দেখে এসেছেন গত পরশু। এঁদের ভালোই খাতিরদারি করেছিল ওরা। আজ ওদের পক্ষের লোক দেখতে আসবে মনিকে। সকাল থেকেই মন খারাপ মনির। আড়ালে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুধু। পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে জেনেও একটুও সাজেনি সে। একধারে বসে তাকে কাঁদতে দেখে বীথি এসে পাশে বসলো তার। বাসার সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। পাত্রপক্ষ আসছে বলে সবাই খাবার দাবারের আয়োজন করছে। বীথি উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এলো। মনি ওড়নায় চোখ মুছতে লাগলো। বীথি তার কাঁধে হাত রেখে নিচুকণ্ঠে বললো,
-কাঁদিস না মনি। পাত্রপক্ষ এলে সব খুলে বলিস।’
মনি বললো,
-না রে, বললেও কিছু হবে না।
-কেন তুই দাদুকে তোর প্রেমের কথা খুলে বলছিস না? তুই না একজনকে ভালোবাসিস?’
মুহূর্তেই কোনো জবাব দিলো না মনি। জানালা দিয়ে দূরাকাশ পানে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
-না রে, আমি কাউকে ভালোবাসি না। তোর সাথে দুষ্টুমি করেছিলাম।’ বলেই মনি আবার চোখ মুছলো ওড়না দিয়ে। কথাটার ওজন যে এত ভারী হবে তা বুঝতে পারেনি সে। খুব কষ্ট হয়েছে তার কথাটি বলতে। কিন্তু বীথিও ওর কথাটা বিশ্বাস করেছে। তাই শুধু উচ্চারণ করলো,
-ওহ…’
-হুমম… আমাদের মতো মেয়েদের জন্য ভালোবাসা না। পোড়াকপালিদের কপালে ভালোবাসা নেই, কাউকে ভালোবাসতে নেই।
-আচ্ছা বোন, কষ্ট পাস না আর। ওরা হয়তো একটুপর এসে পড়বে। তুই রেডি হ…’
-এভাবেই যাবো আমি ওদের সামনে, পছন্দ করলে করবে, না করলে নাই।
-ছিঃ, কী মনে করবে ওরা? দাদুও কষ্ট পাবে। একটা শাড়ি পর। আর একটা টিপ পর। দাঁড়া, আমার তেলটা নিয়ে আসি তোর মাথায় দেওয়ার জন্য।’ বলেই উঠে বের হয়ে যাচ্ছিল বীথি, পেছন থেকে মনি ডাক দিলো,
-বীথি…
-হুমম…’ ঘুরে তাকালো বীথি। মনি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
-রাজ কোথায়?
-আছে হয়তো কোথাও। কেন?’
-না, এমনি। ও খুব খুশ হয়ছে না রে? আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলে?’
-কী জানি… নাও হতে পারে। একসাথে বড় হয়ছে কিনা।
-ওহ্।’
বীথি বের হয়ে গেল। আর মনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। বাঁ চোখের নিচে এক ফোঁটা অশ্রু জমে আছে। বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিলো সে। তারপর ওড়নাটা রেখে, একটা শাড়ি টেনে নিলো আলনা থেকে।
কিছুক্ষণ পর বীথি এলো আবার। হাতে একটা তেলের বোতল। মনি ততক্ষণে শাড়িটা পরে কপালে একটা টিপ লাগিয়েছে। বীথি এসে তার হাত ধরে খাটে বসালো। তারপর নিজ হাতে ওর চুলে তেল মাখিয়ে আঁচড়ে দিতে লাগলো।
.
.
পাত্রপক্ষকে রিসিভ করে সামনের কক্ষে বসালেন আশরাফ সাহেব এবং রাজ। পাত্রের মা বাবা, আর একটা ছোটবোন এসেছে পাত্রের সাথে। মনিকে যখন পাত্রের সামনে আনা হলো, সে অসহায় মেয়ের মতো বসে পড়লো। আড়চোখে খেয়াল করলো সে রাজকে। রাজ পাত্রের ছোটবোনটার সাথে চোখে চোখে কথা বলছে। দেখে এইমুহূর্তেও রাগে জ্বলে উঠলো মনির শরীর। ইচ্ছে করছে এখনই পাত্র পাত্রের বোনকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। নিয়তির খেলা দেখে মনে মনে বিদ্রুপ করে হাসে মনি। যাকে সে ভালোবাসে, ঐ মানুষটা ওকে এড়িয়ে চলে, ওকে নিয়ে হয়তো কোনো অনুভূতি নেই তার মনে।
-নাম কী তোমার মা?’
পাত্রের বাবার কথায় চমকে উঠে মনি,
-এ্যা! আশফাতুন জান্নাত মনি।
-বাহ্। খুব সুন্দর নাম।’ নামের প্রশংসা করলো পাত্রের বাবা। এবার পাত্রের মা জিজ্ঞেস করলো,
-মা, তুমি রান্না-বান্না করতে পারো?’
-হ্যাঁ, একটু একটু পারি।
-তাতেই চলবে। শ্বশুরবাড়ি গেলে সব শিখে নেবে।’
উনার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না মনি। মাথা নিচু করে রইলো সে। তখন আশরাফ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-আমার বড় আদরের নাতি। অল্প বয়সে বাপটাকে হারিয়ে ফেলেছে, বাবার আদর কী বুঝেনি।’
আশরাফ সাহেবের কথা শেষ না হতেই পাত্রের বাবা বললো,
-আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। মনিকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। আমাদের বাড়িতে তার কোনো অনাদর হবে না। আমাদের মেয়ের মতোই থাকবে সে।’
পাত্রের মা বলে উঠলো,
-আমাদের ছেলেটা আসলে তার ব্যবসাটা দাঁড় করাতে করাতে সময় লেগে গেছে, নয়তো আরও অনেক আগে ওর বিয়ে দিতাম। এখন যেহেতু পাত্রী পছন্দ হয়েছে, আমরা আজকেই আন্টি পরাতে চাই, আর কয়েকদিনের মধ্যেই ঘরে তুলতে চাই আমাদের বউকে।’
হবু বেয়ানের কথা শুনে মনির মা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-তা আপনারা যেটা ভালো মনে করেন। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
-আলহামদুলিল্লাহ!’ পাত্রের বাবা বলে উঠলো। তারপর ছেলের উদ্দেশ্যে উনি আবার বলে উঠলেন,
-মিলন, বউমাকে আন্টি পরিয়ে দে।’
কথাটা শুনেই মনির ভেতরের সবকিছু যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে কোনো সর্বনাশা ঝড়ে। কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা নেই তার। অসহায় সে। মিলন ইতস্তত করে পকেট থেকে একটা আন্টির বক্স বের করলো। তারপর আন্টিটা ডান হাতে নিয়ে অন্যহাতে মনির বামহাতটা তুললো। মনে হঠাৎ কেঁপে উঠলো ওর স্পর্শ পেয়ে। তবে রাজের স্পর্শে সে যেভাবে কেঁপে উঠতো এর অনুভূতি কিন্তু সেরকম না। এখনকার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাউকে হারানোর অনুভূতি, যা সে চায় না। মিলন আন্টিটা পরানোর আগে মনি আরেকবার মুখ তুলে তাকালো রাজের দিকে। রাজের মুখে হাসি দেখতে পেল সে। নিজেও বিদ্রুপ করে হাসলো মনে মনে। তবে ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে। মুখ নিচু করে ফেললো সে। মিলন তাকে আন্টি পরিয়ে দিলো তখন। আর সে চোখ বন্ধ করে ফেললো সাথে সাথে। অশ্রু আটকাতে চাইছে সে। তবুও এক ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এলো সবার অলক্ষ্যে।
এক সপ্তাহ পরই মনির বিয়ে। একটু তাড়াহুড়া করে ফেলেছে পাত্রপক্ষ। তবুও এমন ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে রাজি হতে হয়েছে। পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর মনি আন্টিটা খুলে ফেলে রাখে। তারপর বদ্ধ ঘরে নিজেকে আটকে রেখে চোখের জলের সাথে সন্ধি করে নেয়। এখন তার কিচ্ছু ভালো লাগে না। শুধু কাঁদতে ভালো লাগে। কাঁদলেই শুধু একটু শান্তি পাওয়া যায়।
.
.
আরও পাঁচদিন কেটে গেল। মনির বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি। ঠিকমতো না খেয়ে খুব শুকিয়ে গেছে সে। এজন্য বাড়ির সবাই তাকে কতো বকাবকি করেছে। কিন্তু মন যদি না চায়, খাওয়া কি যায়?
এই পাঁচদিন শুধু কান্না করেছে সে। রাজের সাথেও কোনো কথা হয়নি তার। রাজও কোনো কথা বলেনি। মনির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তবুও সে তার জেদ ধরেই বসে আছে। পাষাণ ছেলে একটা। মনি চায় না রাজের সাথে কথা বলে আর মায়া বাড়াতে। কিন্তু পারে না। সময় যতো গড়াতে থাকে, ততো কষ্ট বাড়তে থাকে তার। বুকের বামপাশটা কেউ যেন ছিড়েছিড়ে খাচ্ছে তার। শেষে আর থাকতে না পেরে সে রাজের সাথে কথা বলতে যায় রাতে। বাসার সবাই তখন বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। রাজ তার ঘরে একা শুয়েছিল। মনি ঢুকে দরজা আটকে দেয়। তারপর দৌড়ে গিয়ে রাজকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে রাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?’
মনি কোনো জবাব দেয় না। শক্ত করে রাজকে জড়িয়ে ধরে কান্নার বেগ বাড়িয়ে দেয়। রাজকে জড়িয়ে ধরার শেষ সুযোগটা হারাতে চায় না সে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কান্না করার পর মনি নিজেকে সামলে নেয়। তারপর চোখের জল মুছে নিজের শাড়ি খুলতে থাকে। রাজ অবাক হয়ে দেখতে থাকে শুধু। মনির পাগলামির কিছুই বুঝছে না সে। মনি সম্পূর্ণ শাড়ি খুলে এবার ব্লাউজটা খুলতে শুরু করে। রাজ তাকে বাধা দিতে চাইলে ধাক্কা দেয় সে রাজকে। তারপর ব্লাউজ খুলে ব্রাতে হাত লাগায় খোলার জন্য। রাজ উঠে এসে তার হাত আটকায়।
-কী পাগলামি করছিস তুই?’ চিৎকার করে ওঠে রাজ। তারপর ব্লাউজটা আবার পরিয়ে দিয়ে শাড়িটা ঠিকঠাক করে দেয়। মনি আবার কাঁদতে থাকে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে,
-তুই তো ঐদিন আমার পুরো শরীর দেখতে চেয়েছিলি। দেখতে দিইনি বলে আমার সাথে ঠিকঠাক কথা বলিস না। তাই এখন এসেছি তোকে সবকিছু দেখাতে। তবুও বিদায়ের আগে একটু সুন্দর করে কথা বল আমার সাথে…’
রাজের আবেগটাও বেড়ে গেল হঠাৎ। জড়িয়ে ধরে সে মনিকে।
.
.
(চলবে…)