__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১৯___________
সেদিন রাতেই আমান তার বাবার সাথে কথা বলে বিষয়টা নিয়ে। আশরাফ সাহেব তখন চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। আমান গিয়ে ইতস্তত করে বললো,
-বাবা, একটা কথা বলার ছিল…’
-বল…’ চোখ না খুলেই বললেন আশরাফ সাহেব।
-বাবা, এসব আর ভালো লাগছে না আমার। ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি। কিছুদিন পর রায়হান আসবে, ও বিয়ে করলে তখন হয়তো দেখা যাবে আরও বেশি ঝগড়া হচ্ছে।
-তো এখন তুই কী বলতে চাস?’
-বাবা আমি চাই, বিষয়টা এখানেই শেষ হোক। জমিগুলো আমাদের ভাইবোনকে ভাগ করে দিন। আমার ভাগের জমিতে আমি আলাদা ঘর তুলবো। হয়তো একটু শান্তি পাবো তখন।’
আমানের প্রস্তাবটা পছন্দ হলো না আশরাফ সাহেবের। চোখ খুলে একবার দেখে নিলেন তিনি ছেলেকে। তারপর বললেন,
-তুই যা, আমি ভেবে দেখবো।’
আমান চলে আসে বাবার সামনে থেকে।
এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। আশরাফ সাহেব বিষয়টা নিয়ে কোনো মতামত জানাননি ছেলেকে। কিন্তু ঝগড়াও কমে না দুই জা এর। সবসময় লেগে থাকে ওদের ঝগড়া। বাধ্য হয়ে একদিন কথাটা আবার তোলে আমান। এবারও আশরাফ সাহেব বললেন,
-আমি ভেবে দেখবো।’
কিন্তু এবার আমান নাছোড়বান্দা। সে গলায় জোর দিয়ে বলে,
-বাবা, এটা খুব জরুরি। নয়তো আরও বাড়বে এসব ঝগড়া।’
আশরাফ সাহেব রেগে উঠে বললেন,
-আমি এখনও শক্ত সামর্থ্য আছি। এখনই তোরা জমিজমার ভাগ চাস? জমিজমার কখন কী করতে হবে এটা তোর চেয়ে আমি ভালো বুঝবো।
-কিন্তু বাবা, আমার এসব ভালো লাগছে না।
-তুই তোর বউকে শাসনে রাখ। তাইলেই হবে।’
আড়াল থেকে ওদের কথা শুনছিল আয়েশা বেগম। সে এবার ভেতরে ঢুকলো। ঘোমটাটা টেনে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে সে বললো,
-আপনি শুধু আমার দোষ দেখেন, আর কারও দোষ দেখেন না?’
-দেখেছিস, কত বড় বেয়াদব মেয়ে। আমার মুখের উপর কথা বলতে এসেছে। এরকম বউ ঘরে থাকলে তো ঝগড়া হবেই।’ আশরাফ সাহেবের রাগ বেড়ে গেল। আমান তখন আয়েশার দিকে চোখ লাল করে তাকালো। মেজাজ দেখিয়ে বললো,
-তোমাকে কে কথা বলতে বলছে এখানে? আমি কথা বলছি দেখছো না? যাও এখান থেকে…’
আয়েশা বেগম চলে গেলেন। আমান তখন বললো,
-ঠিক আছে বাবা। জমিজমা ভাগ করতে হবে না। আমরাই অন্য জায়গায় জমি কিনে ঘর তুলবো।’
এবার পদ্মাবতী এলেন রেগেমেগে,
-কী বললি তুই, কী বললি? এই বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় জমি কিনে ঘর তুলবি? খুব টাকা হয়েছে না তোর?
-মা এখানে এসব অশান্তির মধ্যে আর পারা যায় না।
-যা চলে যা। তোর বউকে নিয়ে যেখানে খুশি চলে যা। তারপর এ বাড়ির মুখো হস না আর।’
আমান আর কথা বাড়ালো না। ওখান থেকে সরে এলো।
.
.
কয়েকদিন ঠিকঠাক চললো, কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি আশরাফ সাহেবের বাড়িতে। রাজের মেট্রিক পরীক্ষাটাও শেষ হয়েছে তখন। একদিন একটা পিকআপ গাড়ি এসে থামলো বাড়ির উঠানে। গাড়িটাতে নিজেদের সব জিনিসপত্র তুলতে লাগলো আমান এবং কয়েকজন ভাড়া করা লোক মিলে। আগে থেকেই ঘরের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এখন একটা একটা করে গাড়িতে তুলছে ওরা। সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে খাড়া হয়ে আছে। সূর্যের গরমে সবাই ঘেমে গেছে কাজ করতে করতে। গোয়ালঘরে বসে পদ্মাবতী সব দেখছিলেন। তাঁর ছেলে যে সত্যি সত্যি চলে যাবে এটা সে ভাবতে পারেনি। খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর এসব দেখে। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। আচলে মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদছেন শুধু। বাহির থেকে তখন ছাতা মাথায় দিয়ে ঘরে আসলেন আশরাফ সাহেব। উঠানে পিকআপ দেখে, আর বড় ছেলের কাজকাম দেখে অবাক হলেন তিনি। কিছু না বলে তিনি ছাতাটা বন্ধ করে গোয়ালঘরে স্ত্রীর পাশে এসে বসলেন। পদ্মাবতী কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
-ওরা চলে যাচ্ছে।
-কোথায় যাচ্ছে কিছু জানো?’ আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
-না, আমাকে কিছু বলেনি।’
চুপ হয়ে গেলেন আশরাফ সাহেব। গাড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। সব জিনিসপত্র তোলা শেষ হয়ে গেছে। এবার রশি দিয়ে বাঁধছে যাতে পড়ে না যায়।
রাজ এবং বীথি মন খারাপ করে বসেছিল একপাশে। ওখান থেকে উঠে রাজ গোয়ালঘরে দাদাদাদির পাশে এসে দাঁড়ালো। আশরাফ সাহেব নাতিকে বললেন,
-আয় দাদু ভাই, বস এখানে।’ বলেই তিনি গোয়ালঘরের বেঞ্চে একটু সরে বসে নাতিকে বসতে দিলেন। রাজ বসতেই পদ্মাবতী তাকে আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’
-শহরে…’
-ওখানে জায়গা নিয়েছে তোর বাবা?
-না, ওখানে নাকি বাবার পরিচিত একজন লোক আছেন। উনি ভাড়া বাসা ঠিক করে দিয়েছেন।
-ভাড়া বাসায় থাকবি তোরা?’
রাজ জবাব দেয় না। বীথিও এসে পদ্মাবতীর কোলে বসলো। পদ্মাবতী তাকে দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। বিদায়ের মুহূর্তে নাতি-নাতনি দুটোর প্রতি খুব মায়া হচ্ছে। নাক দিয়ে বীথির শরীরের গন্ধ নিলেন পদ্মাবতী। এ গায়ের গন্ধ আর কখনও নিতে পারবে কি না তা তাঁর অজানা। একহাত দিয়ে রাজকেও বুকে টেনে আনলেন তিনি। একসাথে দুজনের শরীরের গন্ধ নিতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ ‘হু হু’ করে কেঁদে উঠলেন। পাশে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন আশরাফ সাহেব। তাঁর চোখ দুটোও ভিজে এসেছে। তবে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। পদ্মাবতী দুহাতে দুই নাতি-নাতনিকে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-এখান থেকে চলে গেলে আমাদের কথা মনে থাকবে তোদের?
-হুমম…’ মুখের ভেতর শব্দ করলো রাজ। কথা বলতে গেলেই কান্না বের হতে চাইছে। তাই সে চেষ্টা করছে কথা না বলতে। মুখটা লাল হয়ে গেছে তার। বীথি কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখ বেয়ে জল ঝরছে তার, ঠোঁট কাঁপছে। ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফুঁপাচ্ছে। সেই মুহূর্তে আমান এসে দাঁড়ালো, গোয়াল ঘরের বাইরে। পুরো শরীর ভিজে গেছে তার ঘামে। হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে সে আশরাফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
-বাবা, আমরা চলে যাচ্ছি…’
আশরাফ সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। আমান আবারও বলে উঠলো,
-শহরে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি আমরা। ওখানেই থাকবো। রাজ আর বীথিকে ওখানেই পড়াবো।’
এবারও কোনো জবাব দিলেন না আশরাফ সাহেব। রাজ উঠে কোথায় যেন চলে যাচ্ছিল। আমান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কোথায় যাচ্ছিস আবার? একটুপর গাড়ি ছাড়বে।
-বাবা আমি একটু খালের ওখানে যায়, একটুপর চলে আসবো।’
-ঠিক আছে যা।’ শেষ সময়ে ছেলেকে বাধা দিলো না আমান। রাজ তখন খালের কাছে চলে এলো। রাজের প্রিয় জায়গা এটা। মন খারাপ হলেই সে এখানে এসে বসে থাকতো। আর নৌকার ছঁইয়ের উপর শুয়ে থাকতো। খালের পাড়ে বসলো রাজ। এই খালটাকেও খুব মিস করবে সে। খালের ধারে বাঁধা নৌকাটাকেও মিস করবে। আর কখনও মন খারাপ হলে এগুলোর সঙ্গ পাবে না সে। আশেপাশে তাকালো রাজ। কাউকে দেখা গেল না। রাজ এবার মুখে হাত চেপে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। এতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে খুব কষ্ট হয়েছে তার। অনেকক্ষণ এভাবে কাঁদার পর খালের পানিতে মুখ ধুয়ে সে ঘরের দিকে চললো। পুকুরটার পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো। পুকুরের পানিতে আর গোসল করা হবে না তার। পানির উপর তুলা গাছের ছায়া পড়েছে। খুব মায়া লাগছে পুকুরটার প্রতি। তুলাগাছটার দিকে তাকালো এবার সে। মৃদু বাতাসে দুলছে গাছের পাতাগুলো। গাছটাকেও ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে তার। মাঝেমাঝে গাছের ডালে বসে একা একা গান গাইতো সে। ওসব আর করা হবে না। যাবার বেলায় বুঝি সবকিছুর মায়া আঁকড়ে ধরে এভাবে। বাড়ির পেছনে সম্রাটের কবরটার মায়াও পিছু ছাড়তে চাইছে না। সম্রাট হয়তো এতদিনে মিশে গেছে মাটির সাথে। তবুও মায়া হয়। কবরটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ আনমনে চেয়ে থেকে সে বলে উঠে,
-সম্রাট, যাইরে। আবার কবে দেখা হবে বলতে পারি না।’
আনমনে হেঁটে এলো রাজ উঠানে। মা বাবা, বীথি সবাই রেডি হয়ে আছে গাড়িতে উঠার জন্য। আয়েশা বেগম গোয়াল ঘরে গিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো,
-আমরা যাই। কষ্ট দিয়ে থাকলে মাপ করে দিয়েন।’
তার কথার জবাবে শ্বশুর শাশুড়ি কিছু বললেন না। একধ্যানে তাঁরা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। আয়েশা বেগম সরে এলো গাড়ির পাশে। রাজ এবং বীথি আবার দাদাদাদির কাছে এলো বিদায় নিতে। দুজনকে তখন জড়িয়ে ধরলেন দাদাদাদি। তারপর আশরাফ সাহেব রাজকে বললেন,
-ভালো থাকিস। ঠিকমতো লেখাপড়া করিস। নতুন জায়গায় গিয়ে দুষ্টামি করিস না, কেমন?
-হুমম…’ মাথা নাড়লো রাজ।
-যা…’ আশরাফ সাহেবের গলা কেঁপে উঠলো। রাজ এবং বীথি এবার ঘরে ঢুকে মেজো চাচা আর মেজো চাচির কাছে বিদায় নিলো। চাচা-চাচি দুজন ওদের জন্য দোয়া করে দিলো। তারপর ওরা ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। ট্যাক্সিটা একটু আগে ডেকে নিয়েছে আমান। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো। ওটার পিছু পিছু পিকআপটাও আসতে লাগলো। গাড়ি যখন রাস্তায় চলে এলো, তখন ঘর থেকে পদ্মাবতীর কান্নার শব্দ শোনা গেল। জোরে জোরে কাঁদছেন তিনি। ট্যাক্সি থেকে মুখ বের করে তাকালো রাজ ও বীথি। দেখলো, দাদি কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে গোয়াল ঘরে। কান্না করতে করতে দাদি চিৎকার করে বলছে,
-ও ভাইরে, কোথায় যাচ্ছিস তোরা আমাদের ছেড়ে? ও ভাইরে…’
আর দেখতে পারলো না রাজ এই দৃশ্যটা। মুখ ঢুকিয়ে নিলো ভেতরে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। বীথিও মুখ ঢুকিয়ে নিলো। পেছনে দাদির কান্নার শব্দটা ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো। গাড়ি এবার তাদের স্কুলের পাশে চলে এলো। রাজ ও বীথি একসাথে তাকালো তাদের স্কুলের দিকে। বাংলা ম্যাডামকে দেখা গেল মাথায় ছাতা ধরে স্কুল থেকে বর হতে। ম্যাডামকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না রাজ। বীথি তাকালো স্কুলের পাশে বড় বটগাছটার দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে আকাশ তাঁর জন্য অপেক্ষা করতো, আর লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতো। কিন্তু কখনও কথা হতো না তাদের। অনেকদিন ধরে আকাশকে আর দেখা যায় না, স্কুলেও আসতো না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ছেলেটা, তা বীথি জানে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল স্কুলটাকে। ধীরে ধীরে দূরে সরতে লাগলো এবার প্রিয় গ্রামটা….
.
.
(চলবে….)
.
.
(১৯ পর্ব পর্যন্ত ছিল গ্রামের জীবন নিয়ে কাহিনী। এবার শুরু হবে শহরের জীবনের কাহিনী।)