__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-২০___________
♥ষোলো♥
ভার্সিটির চত্বরে বসে কয়েকজন স্টুডেন্ট আড্ডা দিচ্ছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হাসছিল ওরা। হঠাৎ একটা মেয়ে হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো ভার্সিটির গেইটের দিকে। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে এদিকে। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, চোখে একটা কাঁচের চশমা, স্পাইক করা চুল। হাঁটার স্টাইলটাও কী দারুণ! কিছুক্ষণ হা করে ছেলেটার দিকে চেয়ে থেকে মেয়েটা বলে উঠলো,
-সাদিয়া, দেখ দেখ… কী হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আসছে।’
সাদিয়া নামের মেয়েটাও এবার তাকালো। তাকিয়েই অস্ফুটে শব্দ করলো সে, ‘ওয়াও।’ তারপর মন্তব্য করলো,
-তাইতো, আসলেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা। লম্বা, চওড়া দেখতে। কিন্তু কাঁচের চশমাটা মানাচ্ছে না ওর চোখে।
-নাহ্, চশমাটাতেই বেশি মানাচ্ছে ওকে।’ বললো আগের মেয়েটা।
-ধুর! তুই বেশি বুঝিস! এই শুন বৃষ্টি, দুলাভাইরা কিন্তু ভাই হয়। তাই ওকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখবি। তোর নজর আবার ভালো না।’
বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে,
-কার দুলাভাই? কে ভাই?
-ঐ যে যিনি আসছেন উনি যদি আমার বর হয়, তোর তো দুলাভাই হবে তাই না?
-পাগল হয়েছিস?
-সবে তো শুরু পাগলামি। চল, ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখি। এই, উঠ সবাই…’ সাদিয়া সবাইকে তুললো। তারপর এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে। হাঁটার ভঙ্গিমা একটু চেঞ্জ করেছে সে, যেন ছেলেটাকে আকৃষ্ট করতে পারে। কাছে গিয়েই সে গলাটা পরিষ্কার করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো ছেলেটাকে, কিন্তু ছেলেটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিছুটা অপমানবোধ করলো সাদিয়া। দাঁতে দাঁত ঘেষে হাত ছুড়তে লাগলো সে। তখন দেখলো ছেলেটা তাদের ক্লাসের দিকেই যাচ্ছে। সাদিয়া বলে উঠলো,
-এই সবাই ক্লাস করতে চল…’
বৃষ্টি কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করলো ওর কথা শুনে। ভ্রু কুঁচকে সে বললো,
-আজ না ক্লাস না করার কথা? তুই-ই তো আমাদের সবাইকে রাজি করালি ক্লাস না করতে।
-আরে তখন বুঝতে পারিনি।’ বৃষ্টির হাত ধরে টানলো সাদিয়া।
-কী বুঝতে পারিসনি?’ জিজ্ঞেস করলো অন্য একটা মেয়ে।
-আজকের ক্লাসটা গুরুত্বপূর্ণ হবে, বুঝতে পারিনি। চল তো সবাই, চল…’ দ্রুত পা চালালো সাদিয়া। সাথে সাথে চললো সবাই। বৃষ্টি আবার জিজ্ঞেস করলো,
-কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? স্যারের ক্লাস? নাকি ছেলেটা?
-দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।’
ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে সাদিয়া ক্লাসে ঢুকার অনুমতি চাইলো,
-স্যার, আসতে পারি?’
কাঁচের ফ্রেম দিয়ে স্যার সবাইকে একবার দেখে নিলেন। তারপর বললেন,
-আসো…’
-থ্যাংক ইউ স্যার…’ বলেই সাদিয়া সবাইকে নিয়ে পেছনে গিয়ে বসলো। পাশেই ছেলেটা বসা। মনোযোগ দিয়ে স্যারের ক্লাস করছে সে। আর সাদিয়া ছেলেটার মনোযোগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। মুখে বিভিন্ন শব্দ করছে। কিন্তু ছেলেটা ফিরেই না তার দিকে। এ কেমন ছেলে রে! কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠলো সাদিয়া। তারপর সে দৃষ্টি নিচু করে বই পড়ার মতো করে নিচুস্বরে বললো,
-এই ছেলে, ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না? এতো ভাব কীসের তোমার? হুহ।’
ছেলেটা এবারও তাকালো না। সাদিয়া এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত ঘেষে এবার ছেলেটার পিঠে জোরে চিমটি দিলো সে। ছেলেটা তখন দাঁড়িয়ে স্যারের কাছে অভিযোগ করলো,
-স্যার, এই মেয়েটা আমাকে ডিস্টার্ব করছে।’
ছেলেটাকে অভিযোগ করতে দেখে হা করে চেয়ে থাকলো সাদিয়া ওর দিকে। ছেলেটা সরাসরি স্যারের কাছে অভিযোগ করে দিবে তা সে ভাবতে পারেনি। স্যার এবার দাঁড় করালো সাদিয়াকে। সাদিয়া কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে দাঁড়ালো। ঠোঁটে লজ্জাভাব স্পষ্ট। স্যার তাকে কড়া গলায় বললো,
-বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে। কোনো শব্দ করবে না।’
মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল সাদিয়া। এইজন্য এই স্যারকে পছন্দ না তার। সবকিছুতে কড়াকড়ি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে কী হয় তা একটু বুঝলে কী হতো? তা না, অমনিই বের করে দিতে হয় ক্লাস থেকে। পঁচা স্যার একটা, খরগোশ স্যার। রাগে হাত পা ছুড়তে লাগলো সে আবার। তারপর যতক্ষণ স্যারের ক্লাস শেষ হয়নি, ততক্ষণ ক্যান্টিনে বসে থাকলো সে। ক্লাস শেষে যখন সবাই ক্লাস থেকে বের হয়ে এলো, সাদিয়া বৃষ্টিকে দেখে ডাক দিলো,
-এই বৃষ্টি…’
বৃষ্টি হাসিমুখে এগিয়ে এলো সাদিয়ার দিকে। সাদিয়া তাকে একটা ধমক দিয়ে বললো,
-একদম হাসবি না। ছেলেটা কই রে?
-ওদিকে চলে যেতে দেখলাম। ঐ তো গেইট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
-চল…’ বৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সাদিয়া। বৃষ্টি হেসে ওঠে বললো,
-আস্তে টান একটু, ব্যথা পাচ্ছি তো।’
-ব্যথা পেলে একটু পা। আগে ছেলেটাকে খোঁজ।’
দুজনে বের হয়ে এলো ভার্সিটি থেকে। আশেপাশে খোঁজ করলো ছেলেটার। দেখলো ছেলেটা একটা সি.এন.জিতে উঠে চলে যাচ্ছে।
-ধ্যাত! মিস হয়ে গেল। কালকে আসুক, বুঝাবো মজা!’ বিরক্ত প্রকাশ করে বললো সাদিয়া।
-চল, বাসায় চল এবার। কী আর করা…’ বলেই হাঁটতে লাগলো বৃষ্টি। পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো সাদিয়া। মাঝেমাঝে পেছনে ফিরেফিরে তাকাচ্ছে সে, যদি ছেলেটা নামে আবার গাড়ি থেকে। কিন্তু নামলো না সে। দূরে চলে গেল গাড়িটা।
.
.
পরদিন ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে সাদিয়া আর বৃষ্টি নাস্তা করছিল। একটা চিকেন ফ্রাই ভেঙে মুখে দিয়ে চাবাচ্ছিল সাদিয়া। তখন পাশ থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ শোনা গেল,
-স্মাইল প্লিজ…’
সাদিয়া ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা তার ফোনে ছবি তুলে নিলো। তারপর ছবিটা জুম করে দেখে বললো,
-বাহ্, সুন্দর ছবি। শুধু মুখটা একটু ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে মুখের ভেতর একটা ছোটখাটো ইঁদুর বসে আছে।’
সাদিয়া কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো হা করে। তারপর মুখের খাবারটা গিলে বললো,
-তুমি! তুমি এখানে? ভালো হয়েছে এসেছো। তোমাকেই খুঁজছিলাম।’
ছেলেটা সাদিয়ার মুখোমুখি বসে তার চিকেন ফ্রাইয়ে ভাগ বসালো। সাদিয়ার মুখটা আরও হা হয়ে গেল তখন। ছেলেটা খেতে খেতে বললো,
-তা আমাকে কেন খুঁজছিলে জানতে পারি?’
-তুমি স্যারের কাছে অভিযোগ করলে কেন?
-ওটা অভিযোগ ছিল না।
-তাহলে?
-বন্ধুত্বের প্রথম স্টেপ ছিল।
-মানে?
-মানে আমি এই ভার্সিটিতে নতুন। একটা ভালো মিশুক টাইপের বন্ধু চেয়েছিলাম। তখন তোমাকেই খুঁজে পেলাম। তাই সারাজীবন আমাকে মনে রাখার জন্য প্রথম দিনেই এমন কিছু করলাম যাতে তোমার মনে সারাজীবনের জন্য দাগ কাটতে পারি।
-হুমম বুঝলাম। কিন্তু ওসব বন্ধুত্ব আমার দ্বারা হবে না। অন্য কাউকে খুঁজো বন্ধু লাগলে।
-না, তোমাকেই বানাবো বন্ধু।’
এবার বৃষ্টি সাদিয়াকে বললো,
-উনি যখন বলছে, রাজি হয়ে যা না?’
সাদিয়া মুখটা বৃষ্টির কানের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত ঘেষে আলতোস্বরে বললো,
-শালি ওকে বন্ধু বানালে, তুই দুলাভাই ডাকবি কাকে? চুপ থাক। মাঝখানে কথা বলিস না।’
কথাটি বলেই সাদিয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ‘হে হে হে’ করে হেসে বললো,
-ওসব বন্ধুত্ব হবে না বাবু, আমার অনেক বন্ধু।
-হবে হবে। তুমি না চাইলেও হবে। বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম আহসানুল হক। তোমার নাম নিশ্চয়ই সাদিয়া?
-আশ্চর্য, তুমি আমার নাম জানলে কী করে?
-সেটা না হয় রহস্যই থাক।
-না, না, না… বলো বলো।’ চিকেন ফ্রাইয়ের শেষাংশটুকু মুখে পুরে দিলো সাদিয়া। ছেলেটা বললো,
-ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট মেয়েটা সম্পর্কে সবাই জানে। আমিও এসেই জেনে গেলাম।
-কী! আমি দুষ্ট মেয়ে? হুহ! আমি লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আমার মা বলে।’ নিজের প্রশংসা নিজে করে নিজেই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো সাদিয়া। ছেলেটা তখন বললো,
-বাহ! লজ্জা পেলে তো দারুণ লাগে তোমাকে। চলো, ক্লাসে যাবে এখন।
-নাহ্, যাবো না।
-কেন?
-ইচ্ছে…’
-ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। যাওয়ার আগে বললো,
-আমার আরেকটা ছোট্ট নাম আছে। রাজ। আমাকে রাজ বলেই ডাকতে পারো।’
সাদিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। রাজ হেঁটে গেল ক্লাসের দিকে।
.
.
(চলবে….)