জীবনের গল্প পর্ব-২২

0
331

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-২২___________
♥সতেরো♥
সেদিন আর বের হয়নি রাজ। বিষণ্ণতা ভর করেছিল ওর মনে। বিকেল হতেই বিষণ্ণতার সাথে যোগ দেয় অলসতা। তাই বাকি টিউশনিগুলোতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সেদিন।
পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লাল আভা এসে পড়ে রাজের মুখের উপর। জানালা দিয়ে তাকায় সে বাইরে। উঁচু বিল্ডিং ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। এ সময় খুব মিস করছে সে তার গ্রামের প্রকৃতিটাকে। যেদিকে তাকায়, শুধু সবুজের সমারোহ চোখে পড়তো গ্রামে। দেখে চোখগুলোও জুড়িয়ে যেতো। কিন্ত শহরের কোথাও তাকালেই পাশের বিল্ডিংটা দৃষ্টি আটকে দেয়। ছোট কয়েকটা বাচ্চা পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ব্যাট/বল নিয়ে খেলছে। দেখে হাসি পায় রাজের। বাচ্চাগুলোর জন্য আফসোসও হয়। এরা কখনও খোলা মাঠে খেলার সুযোগ পাবে না। বিল্ডিংয়ের ছাদের ছোট্ট সীমানাটাই এদের খেলার মাঠ।
ফোনটা বেজে উঠলো রাজের। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠলো, ‘চাঁদনী।’ কিছুক্ষণ দ্বিধায় ছিল সে ফোনটা ধরবে নাকি ধরবে না। তারপর কী মনে করে যেন রিসিভ করলো ফোন। কানে দিতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এলো,
-হ্যালো…
-হুমম…
-আজ রিজভিকে পড়াতে আসোনি যে?
-এমনি…
-অসুস্থ?
-না…
-তাহলে?
-এমনি ভালো লাগছিল না, তাই…
-কী হয়ছে আমাকে বলো?
-তেমন কিছু না। আজ একটা টিউশনি চলে গেছে তাই একটু মন খারাপ।
-একটা গেছে, আরেকটা আসবে। এতে মন খারাপ করার কী আছে?
-আসলে হুট করেই গেছে তো, তাই…
-চিন্তা করো না।
-হুমম…’
কিছুক্ষণ চুপ থাকলো দুজন। তারপর চাঁদনী বললো,
-হ্যালো…
-হুমম…
-চুপ করে আছো যে?
-কী বলবো?
-অনেক মিস করছি আজ তোমাকে।
-মিস ইউ টু…
-কী করছো?
-বসে আছি, জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। তুমি?
-আমি আর কী করবো? একা একা শুয়ে আছি। মা মায়ের মতো কাজ করছে। রিজভি মোবাইলে গেইম খেলছে। আর আমি একা একা…
-ভাবি নেই?
-নাহ্। ভাবী আর আর ভাইয়া তো ফিরে সেই সন্ধ্যার পর।
-হুমম, মাঝেমাঝে কী মনে হয় জানো?
-কী?
-তোমার ভাবী আর ভাইয়া হয়তো তোমার নামটাও ভুলে গেছে কাজকে আপন করতে গিয়ে।
-যাহ্, কীসব বলছো তুমি?
-সত্যি। আরে সারাক্ষণ কাজের পেছনে কীভাবে ছুটতে পারে এরা দুজন? বাসায় এসেও অফিসের কাজ নিয়ে পড়ে থাকে। নিজের সন্তানটাকেও তেমন সময় দেয় না। রিজভির বয়স কতো হবে? দশ বছর হবে? এই বয়সেই সে বাবা মার সংস্পর্শ থেকে দূরে আছে। অথচ এই বয়সেই তার বাবা মার কাছাকাছি থাকা উচিত ছিল।
-বেশ তো আছে সে। মোবাইলে গেইম খেলে দিব্যি সময় কাটছে তার…’
বিদ্রূপ করে হাসলো রাজ চাঁদনির কথা শুনে। তারপর বললো,
-দিব্যি সময় কাটছে তাই না? ওর বয়সে আমাদের সময় কেটেছে বন্ধুদের সাথে মিশে, মাঠে খেলা করে। আর ও মোবাইলে গেইম খেলে সময় কাটাচ্ছে। একটা রুমের মধ্যেই সে নিজের পুরো পৃথিবীকে পেতে চাইছে।
-তোমারই তো স্টুডেন্ট। তুমি কিছু করতে পারো না?
-আমি কী করবো? আমার যা করার, যতটুকু করার আমি তাই করি। বাকিটা আমার অনাধিকাচর্চা হবে।
-কীসের অনাধিকার? আমাকে বিয়ে করলে তো তোমারও অধিকার হবে আমাদের পরিবারে কথা বলার।’
-গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল।’ হাসলো আবার রাজ। চাঁদনি জিজ্ঞেস করলো,
-হাসছো কেন?
-তোমার আর আমার সম্পর্ক মানবে তো তোমার ভাই আর ভাবী?
-সেটা পরে দেখা যাবে।
-মানবে না জানি। ওদের কাছে এসব প্রেম ভালোবাসার হয়তো কোনো মূল্য নেই।
-থাকবে না কেন? সময় করে একদিন বলে দেবো আমাদের ভালোবাসার কথা, তখন ঠিকই মানবে।
-দেখা যাবে। আচ্ছা এখন রাখি…
-আর কিছুক্ষণ কথা বলি? আমারও একা একা ভালো লাগছে না।
-ভালো লাগবে কী করে? তোমার তো কথা বলারও কেউ নেই। তোমার ভাবীকে চাকরি না করে ঘরে থাকতে বলতে পারো না? তাহলে অন্তত একটা সঙ্গী মিলতো তোমার।
-না, ভাবী চাকরি ছাড়বে না কখনও। বলে লাভ নেই…’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো চাঁদনি। রাজ বললো,
-তোমার ভাবীকে একটা প্রশ্ন করো সময় করে, “পরিবার জিনিসটা কী?”
-পরিবার কী?
-হুমম… প্রশ্নটা করার পর তোমার ভাবীর উত্তরটা আমাকে জানাবে।
-আচ্ছা জানাবো। এখন ওসব কথা বাদ দাও, একটু মিষ্টি কথা বলো।
-মিষ্টি কথা আসবে না মুখ থেকে এখন…
-কেন?
-টেনশনে আছি…. বিবিএ শেষ করেছি সেই দুইবছর আগে। এখনও একটা চাকরি জুটলো না কপালে। এভাবে টিউশনি করে আর কতদিন চলবো?
-এখন তো আবার এমবিএ করছো তুমি। এমবিএ শেষ করো, দেখবে ভালো একটা চাকরি পাবে।
-নাহ্, কিছু একটা করতেই হবে এখন।
-কী করবা? আমাকে বিয়ে করে নাও। তারপর যৌতুকের যা টাকা পাবে, তা দিয়ে একটা ব্যবসা করবা।’ বলেই হাসলো চাঁদনী।
-চুপ করো।’ রাজ তাকে একটা ধমক দিলো। চাঁদনি হাসি থামিয়ে বললো,
-ও ভালো কথা। শুনেছি, কোন একটা মেয়ে তোমার পেছনে লেগেছে ভার্সিটিতে?
-কই? কোন মেয়ে? কোনো মেয়ে পিছু লাগেনি।
-সত্যি তো?
-হুমম…
-আই লাভ ইউ…’ বলার সময় কণ্ঠটা ছোট করে ফেললো চাঁদনী। রাজও নিজের কণ্ঠটা ছোট করে বললো,
-লাভ ইউ টু… আচ্ছা এবার রাখি।’
-হুহ্, যাও রাখো। আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে থাকে না তোমার। সব সময় রাখি, রাখি, রাখি…’ রাগ করে ফোন রেখে দিলো চাঁদনি। রাজ আর ব্যাক করলো না ফোন। ও জানে, চাঁদনি রাগ করলেও বেশিক্ষণ থাকে না ওর রাগ। রাজকে সে বুঝে। রাজকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে। রাজও ভালোবাসে ওকে। প্রায় দু বছর হতে চললো ওদের সম্পর্ক। নতুন নতুন রিজভিকে পড়াতে গিয়ে পরিচয় হয় চাঁদনির সাথে। তারপর ধীরে ধীরে ভালো লাগা। তারপর ভালোবাসা হয়। চাঁদনি এখন অনার্স ফাইনাল বর্ষের ছাত্রী। যেদিন ভার্সিটিতে ক্লাস থাকে, সেদিন একটু ঠিকঠাক সময় কাটে তার। কিন্তু যেদিন ক্লাস থাকে না, সেদিন খুব একাকী সময় কাটে। বাসায় ওর ফ্যামিলি মেম্বার বলতে ভাই, ভাবী, রিজভি আর মা। বাবা মারা গেছে অনেক আগে। বাবার চেহারাটা ভালো করে মনে পড়ে না ওর। বাসায় কথা বলে সময় কাটানোর মতো কেউ নেই বলে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে বেচারি। রাজের সাথে সচরাচর কথা হয় রাতের বেলায় ফোনে। মাঝেমাঝে রাতের বেলায় রাজ চুরি করে দেখা করতে যায় ওর সাথে। তখন সব বিষণ্ণতা ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে ও চাঁদনির।
.
.
সন্ধ্যার পর রাজ বাসা থেকে বের হতে চাইলে, তখন বাড়িওয়ালার লোকটা আবার এসে হাজির হয়। রাজ দেখে, তার বাবা চশমার ফাক দিয়ে দুই টাকার নোটসুদ্ধ গুণছে লোকটাকে দেয়ার জন্য। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলো না রাজ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে গেল সে। আগে কখনও এরকম পরিস্থিতে পড়তে হয়নি তাদেরকে। গতমাস থেকে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করায় এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বাসা থেকে বের হয়ে রাজ তার বন্ধু রাফিকে ফোন দেয়। এই শহরে আসার পর থেকেই রাফির সাথে রাজের বন্ধুত্ব হয়। তবে রাফি ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর আর পড়েনি। মার্কেটে ছোটখাটো একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে সে। রাজ ফোন করে জানতে পারে, দোকানেই আছে রাফি। তাই রাজ সোজা চলে এলো রাফির দোকানে। একজন কাস্টোমারকে বিদায় করতে করতে রাফি রাজের দিকে তাকায়। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,
-কীরে, কী খবর তোর?’
-এইতো… আছি।’ হাসার চেষ্টা করলো রাজ।
-বস এখানে।’ রাজকে একটা টুল এগিয়ে দিলো রাফি। বসার পর রাজ বন্ধুর পুরো দোকানটাতে একবার চোখ বুলালো। এরকম একটা দোকান দিতে পারলেও নিজের পরিবারটা ভালোভাবে চলতে পারবে। ভাবনাটা চক্কর দিতে লাগলো রাজের মাথায়।
-কীরে, কী ভাবছিস?’ রাজকে ভাবতে দেখে জিজ্ঞেস করলো রাফি।
-অ্যা? কিছু না। তোর কী খবর বল। ব্যবসা কেমন চলছে?
-আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে। দাঁড়া, তোর জন্য চায়ের অর্ডার করি…’
-আরে থাক, থাক… চা খাবো না আমি।’
রাজের কথা না শুনে রাফি চায়ের অর্ডার দিতে বের হয়ে গেল। রাজ একা একা বসে আনমনা হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো। তখন চোখে পড়লো একটা যুবতী মেয়েকে। কোলে একটা দুই বছরের বাচ্চা নিয়ে একটা যুবক ছেলের পাশাপাশি হাঁটছে। মনে হয় মেয়েটার স্বামী ও। মেয়োটাকে দেখে খুব পরিচিত মনে হলো রাজের। ছোটবেলায় দেখা সেই রিতার চেহারার সাথে এই মেয়েটার চেহারার খুব মিল। রিতা না তো এই মেয়েটা? কথা বলার জন্য গেল রাজ। মেয়েটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কথা বলতে গিয়েও বললো না। যদি রিতা না হয়ে অন্য কেউ হয়, তাহলে লজ্জায় পড়তে হবে। মেয়েটা নিজের জন্য একটা বোরখা দেখছে। আর স্বামীর সাথে কী যেন বলে হাসছে। হঠাৎ মেয়েটা রাজের দিকে তাকালে, রাজ অন্যদিকে ঘুরে যায়….’
.
.
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here