জীবনের গল্প পর্ব-২৩

0
330

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-২৩___________
আড়চোখে আবার তাকায় রাজ মেয়েটার দিকে। নাহ্, দেখেনি মেয়েটা তাকে। রাজ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবছে কথা বলে দেখবে, পরক্ষণে মত পাল্টে নিচ্ছে। তখন রাজের পেছন থেকে রাফি এসে বললো,
-কীরে রাজ, তুই এখানে? আর আমি তোকে খুঁজছি।’
রাফির কথা শুনে রাজ ইতস্তত করে তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও তাকালো রাজের দিকে। তারপর এগিয়ে এলো মেয়েটা,
-আরে রাজ ভাই না?’
মেয়েটার কথা শুনে রাজ শিওর হলো এটাই রিতা। রিতাও রাজের সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে শিওর হয়ে বললো,
-হ্যাঁ, রাজ ভাই তো। বাহব্বাহ! কতো বড় হয়ে গেছো?’
হঠাৎ করে কী বলবে রাজ দ্বিধায় পড়ে গেল। ইতস্তত করে বললো,
-তুমিও তো ছোট থেকে যাওনি। বিয়ে করে বাচ্চাও হয়েছে।
-হুমম… বুড়ি হয়ে যাচ্ছি, তো বিয়ে করবো না?’
রিতার স্বামী এসে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-কে উনি?’
-আমার ইয়াসমিন ফুফির ভাসুরের ছেলে। সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তারপর ওরা শহরে চলে আসে শুনলাম। আর দেখা হয়নি…’
রিতার স্বামী হ্যান্ডশেক করে পরিচিত হলো রাজ ও রাফির সাথে। রিতা বললো,
-রাজ ভাই, তোমাকে যখন পেয়েছি, আর ছাড়ছি না। চলুন, বাসায় চলুন। এখানেই আমরা থাকি। এইতো পাশেই।
-না, না, অন্যদিন যাবো।’ রাজ অমত দেখালো। যদিও অনেকবছর পর রিতাকে দেখে সহজে ছাড়তে ইচ্ছে হলো না। রিতা বললো,
-না, না বললে কাজ হবে না। কত কথা জমে আছে জানো? সব বলবো।’
রিতার আবার কী কথা থাকতে পারে। সে তো বিয়ে করে বাচ্চার মা হয়ে গেছে।
-চলো তো…’ রাজের হাত ধরে টানলো রিতা। বাধা দেওয়ার শক্তি নেই যেন রাজের শরীরে। হঠাৎ পুরোনো কাউকে পেয়ে আবেগ বেড়ে গেল তার। রিতার সাথে সাথে চললো সে। পেছন পেছন রিতার স্বামী আসতে লাগলো শপিংয়ের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে।
.
.
বাসায় এসে বসতে দিলো রিতা রাজকে। রাজ ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-নিজস্ব বাসা?’
-আরে না। ভাড়া বাসা। আমার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে। আমার স্বামী এখানে চাকরি করে। তাই আমিও স্বামীর সাথে থাকি।
-ওহ্, ভালো।’
রিতা তার বাচ্চাটাকে স্বামীর কোলে দিয়ে শপিংয়ের প্যাকেটগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। ওর স্বামীও পেছন পেছন গেল ভেতরে। রাজ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো নতুন পরিবেশে। পুরো ব্যাপারটা এখনও বাস্তব ভাবতে কষ্ট হচ্ছে তার। প্রায় দশ বছর পর হঠাৎ করে দেখা রিতার সাথে!
-কী ভাবছো?’ হাসিমুখে এলো রিতা। ট্রেতে করে বিস্কিট-শরবত নিয়ে এসেছে। গায়ের বোরখাটাও খুলে ফেলেছে। একটা কফি কালারের সিল্কের শাড়ি পরে আছে কালো ব্লাউজের সাথে। এখন আরেকটু স্লিম মনে হচ্ছে ওকে। বড় হয়ে যেন দ্বিগুণ সুন্দরি হয়েছে মেয়েটা। কিছুক্ষণ রিতার দিকে চেয়ে থাকলো রাজ। রিতা ক্ষীণ একটা কাশি দিয়ে বললো,
-শুধু কি চেয়ে থাকবে? নাকি শরবতটা খাবে?’ রাজের সামনে শরবতের গ্লাসটা ধরে আছে রিতা।
-এ্যা? ওহ্…’ সম্বিত ফিরে পেয়ে রিতার হাত থেকে গ্লাসটা নিলো রাজ। একটা বিস্কিট শরবতে ভিজিয়ে মুখে পুরে দিলো সে। তারপর বিস্কিটটা চিবোতে চিবোতে বললো,
-তারপর, কী খবর? ভাবতেই পারিনি হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে যাবে।’
রাজের পাশের সোফাতে বসলো রিতা। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
-আমিও ভাবতে পারিনি। আমাদের শেষ কবে দেখা হয়েছে মনে আছে?
-হুমম… ঐদিনই আমরা দাদুর বাড়িতে আলাদা খাওয়া শুরু করি।
-কীভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলে তুমি, আমার খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। গাড়িতে উঠার আগে একবার তোমার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু কী যেন আমাকে বাধা দিলো সেদিন। আমাদের সম্পর্কটা আরও অনেকদূর গড়াতে পাড়তো…’ শেষ কথাটা বলেই চোখ নামিয়ে ফেললো রিতা। রাজ ওর দিকে তাকালো। ওর শেষ কথাটার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলো। যদিও সে জানে রিতার কথাটার মানে কি। সেদিন হয়তো এতকিছু বুঝতো না। এখন অনেক কিছুই বুঝে।
রিতা আবার মুখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হলো রাজের সাথে। দৃষ্টিটা একটু সরিয়ে সে বললো,
-শুনেছি তোমরা আর যাওনি গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের কথা মনে পড়ে না?’
শরবতের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে ঠোঁট মুছলো রাজ। তারপর বললো,
-তা আবার পড়ে না? খুব মনে পড়ে কিন্তু যাওয়া হয় না। আসলে অভিমান। আমার বাবা আর মায়ের অনেক অভিমান জমে আছে দাদু বাড়ির উপর। তার উপর দাদুর একটা কথা বাবার অভিমানটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দাদু বলেছিল, আর কখনও যাতে ফিরে না যায়। গেলে একাবারেই যেন চলে যায়।
-মাঝেমাঝে আফসোস হয় জানো? কী পরিবার কী হয়ে গেল এটা ভেবে।
-হুমম… গ্রামে একটা দেখার মতো পরিবার ছিল আমাদেরটা। সবাই যার যার জায়গায় ঠিক ছিল, শুধু কেউ কাউকে বুঝতে চাইতো না। তাই আজ হয়তো আমরা এত দূরে। বাদ দাও ওসব কথা। গ্রামের কোনো খবর জানো?
-না, আমার বিয়ের আগে একবার গিয়েছিলাম। তাও তো তিন/চার বছর হবে।
-কেমন ছিল তখন? দাদু, দিদিমা সবাই কেমন ছিল?
-তখনও মনে হয়নি সুখে ছিল। আমার ফুফিরাও আলাদা হয়ে যায়। ছোট বউয়ের সাথে ঝগড়া হতো শুধু।
-ছোট চাচ্চু বিয়ে করেছে?
-হ্যাঁ, একটা বাচ্চাও ছিল তখন। এখন কয়টা হয়েছে জানি না।
-আর ফারিয়া খালা? ওর কী খবর?’ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো রাজ। রিতার চেহারাটা হঠাৎ মলিন হয়ে গেল। রাজ কিছু একটা হয়েছে আঁচ করতে পারলো রিতার চেহারা দেখে। রিতা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
-ফারিয়া ফুফি আর বেঁচে নেই… আত্মহত্যা করেছিল।
-হোয়াট?’ রাজ যেন বিশ্বাস করতে পারলো না কথাটা। রিতা আবার বললো,
-হুমম… বিদেশ থেকে এসে রায়হান মামা যোগাযোগ করেছিল ফারিয়া ফুফির সাথে। তখন ফুফির বয়সটাও বেশি হয়েছিল, আর একটু মুটিয়ে গিয়েছিল। তাই ফুফি ফিরিয়ে দেয় রায়হান মামাকে। তখন রায়হান মামা রাগ করে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে। আর ফুফি খবরটা শুনে আত্মহত্যা করে ফেলে।’
রাজের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল রিতার বর্ণনা শুনে। ফারিয়ার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলো না। শুধু ধূসর একটা ছবি ভেসে উঠলো সামনে। ফারিয়ার মৃত্যুর কথা উঠায় হঠাৎ পরিবেশটা চুপচাপ হয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। স্বাভাবিক করতে রিতা প্রসঙ্গ পাল্টালো,
-বীথি কেমন আছে? নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে?
-হুমম…’ মুখের ভেতর শব্দ করলো রাজ।
-এখন তো আমার ঠিকানা জানলে তুমি। একই শহরে থাকি। মাঝেমাঝে এসো। আর বীথিকেও নিয়ে এসো।
-হুমম… আসবো। আচ্ছা, মনির খবর কিছু জানো?’ অনেকক্ষণ ধরে মনির ব্যাপারে প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল রাজ। এবার ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেললো। কিন্তু রিতার উত্তরে তেমন কিছু জানা যায়নি। রিতা বললো,
-নাহ্, ওর সাথে আর দেখা হয়নি। তবে শুনেছি ও শ্বশুরবাড়িতে ভালোই আছে। ওর মাও থাকে ওর সাথে।
-বড় ফুফি আর দাদু বাড়িতে থাকে না?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো রাজ
-না… মেয়ের সাথেই থাকে।’
-ও…’ কী বলবে বুঝতে পারলো না রাজ। দাদু বাড়ির সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে জেনে কষ্ট পেল ও। এখন হয়তো আরও বেশি ওলটপালট হয়ে গেছে। রিতার কাছ থেকে যা জেনেছে, তাও তো কয়েক বছর আগের।
-মনি তোমাকে ভালোবাসতো, জানো?’
হঠাৎ রিতার কথাটা শুনে চমকে তাকালো রাজ। মনির কথা শুনলেই আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু মনির এবারের প্রসঙ্গটা একটু বেশি নাড়া দিলো ওর শরীরে। হ্যাঁ, মনি ওকে খুব ভালোবাসতো। ওর ভালোবাসাটা তখন বুঝেনি রাজ। কিন্তু বড় হওয়ার পর ঠিকই বুঝেছে ওর ভালোবাসা। আর বোঝার পর পুরোনো মুহূর্তগুলো ঘেটে ঘেটে অনুভূতি নিয়েছে সে। এখনও সুযোগ পেলে সে মনির কথা ভাবে। একটা পাগলি ছিল সে। অনুভূতিতে এখনও হাজারও দাগ কেটে আছে। কে জানে পাগলিটা এখন কেমন আছে। এখনও কি তার স্বপ্নে বিভোর থাকে? নাকি মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে বাস্তবতার সাথে?
-কী হলো? কী ভাবছো? মনির কথা বুঝি?’ রাজকে ভাবনায় ডুবে যেতে দেখে প্রশ্ন করে রিতা। নিজেকে সামলিয়ে রাজ বলে,
-নাহ, কিছু না।
-কখনও কি ফিল করোনি ওর ভালোবাসা?
-করেছি। তবে অসময়ে…
-আর আমারটা?
-তোমার আবার কি?
-কিছু না…’
রাজের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে দেখলো চাঁদনির নাম। রিতার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করলো সে। তারপর ফোনটা কেটে দিলো।
-কে? গার্লফ্রেন্ড?’ প্রশ্ন করলো রিতা।
-ওরকমই আর কি…’ কথাটা কাটানোর চেষ্টা করলো রাজ। কিন্তু রিতা একই প্রসঙ্গের জের ধরে বললো,
-কয়টা আছে গার্লফ্রেন্ড? এ্যা? সে ছোটবেলায় তো মেয়েদের পিছু পিছু থাকতে?
-সেই ছোটবেলা কি এখন আর আছে? কৈশোরে পা দিলে সব ছেলেরাই একটু আধটু ওরকম হয়। মেয়েদের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। কিন্তু প্রেম কী বুঝে না।
-এখন কী অবস্থা? জব করো নাকি এখনও স্টাডিতে?
-স্টাডিতে আছি। এমবিএ করছি।
-ভার্সিটিতে পটাওনি কাউকে? বা পটায়নি কেউ তোমাকে? চেহারা তো কম সুন্দর করোনি।
-আরে না। ওরকম কিছু হয়নি। তবে একটা বান্ধবী আছে ভার্সিটিতে। সাদিয়া নাম ওর।
-আর গার্লফ্রেন্ডের নাম?
-চাঁদনি।
-বাহ্! বেশ তো।
-আচ্ছা, আমি এখন উঠি।
-আরে উঠবে মানে? ডিনার করে যাবে একেবারে।
-না, না। তোমার স্বামী আবার অন্য কিছু ভাবতে পারে।
-মোটেও ভাববে না। আমার স্বামী ওরকমই না। ও নিজেই বলেছে তোমাকে ডিনার করে যেতে।
-থাক, থাক। অন্যদিন করবো। এখন উঠি।’ রাজ উঠে দাঁড়ালো। রিতা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রিতাকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে এলো রাজ। রিতার গা থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ এসে লাগলো তার নাকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে রিতা বললো,
-বীথিকে নিয়ে এসো কিন্তু…’
জবাব না দিয়ে নেমে এলো রাজ। মোবাইলটা বের করে ফোন ব্যাক করলো চাঁদনিকে। কয়েকবার রিং হতেই ফোন ধরলো চাঁদনি,
-হ্যালো…’
-হুমম চাঁদনি বলো…’
-কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ফোন ধরোনি কেন?’
-পরিচিত একজনকে পেয়ে গেলাম হঠাৎ। আমাদের গ্রামের খোঁজ খবর নিলাম ওর কাছ থেকে। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।
-আচ্ছা শুনো না? আমার খুব একা লাগছে আজ। তুমি একটু আসবে?
-এই সময়ে? না, না, না…
-আরে কিচ্ছু হবে না। কেউ টের পাবে না… আসো না প্লিজ একটু। খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে। একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
কিছুক্ষণ ভেবে রাজ জবাব দিলো,
-আচ্ছা, আসবো…
.
.
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here