__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-২৬___________
-প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাকে বলে? বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় করণীয়। প্রশ্নটা দাগিয়ে দিয়েছি কতটুকু শিখতে হবে। ধরো, এটা শিখে দাও এখন।’ বলেই ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইটা এগিয়ে দিলো রাজ রিজভির দিকে। রিজভি দাগানো অংশটা দেখে নিয়ে শব্দ করে পড়তে লাগলো। রাজ ওর পড়াগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর নিজের দেখা বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়গুলোর কথা ভাবতে লাগলো। আগে যখন গ্রামে থাকতো, প্রায় বন্যার পানিতে ডুবে যেতো ওদের বাড়িটা। রাস্তাঘাটসুদ্ধ পানির নিচে চলে যেতো। তখন ওরা সবাই মিলে সাইক্লোন সেন্টারে গিয়ে অবস্থান নিতো। একবার বন্যার সময় পুরো গ্রামটাই ডুবে গিয়েছিল। তখন বাড়ির পুরুষরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে জানমাল বাঁচাতে। রাজ তখন ছোট। ৬/৭ বছর বয়স হবে। বন্যার পানি যখন আস্তে আস্তে বসতভিটা ডুবিয়ে দিচ্ছিল, তখন ওর দাদু সবাইকে সরে যেতে বলে বাড়ি থেকে। সামনের রাস্তাঘাট সব ডুবে গেছে। দাদু তখন একটা নৌকা যোগাড় করে আনে। ওখানেই সবাই ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে জিনিসপত্র নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের দিকে যায়। নৌকা চালায় রায়হান চাচ্চু। আর পেছন পেছন গলা পানিতে অনেক কষ্টে মহিষগুলো নিয়ে আসছিল দাদু, বাবা আর মেজো চাচ্চু। পানিতে তাদের মাথাটায় দেখা যাচ্ছিল শুধু। মহিষগুলোরও একই অবস্থা। তবে একটা ছোট মহিষের বাচ্চা ছিল। ওটা বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হঠাৎ একটা যখন ঢেউ আসে, নৌকাটা হেলে যায়। তখন ছিটকে পড়ে রাজ নৌকা থেকে। সবাই চিৎকার করে উঠে রাজের জন্য। দাদু আর বাবা মিলে উদ্ধার করে সেদিন রাজকে। আরেকটু দেরি হলে হয়তো সেও হারিয়ে যেতো চিরতরে বাচ্চা মহিষটার মতো। রাজ যখন আবার নৌকায় ফিরে আসে, সবাই তাকে ধরে কাঁদতে থাকে। সেদিন মনির কান্নাটা ছিল একটু আলাদা। বাচ্চা মেয়েটা সেদিন কী কান্নাটাই না করেছিল রাজের জন্য। এখনও সেই সুর কানে বাজে রাজের।
হঠাৎ গুড়ুম গুড়ুম শব্দে চমকে উঠলো রাজ। ভেতর থেকে চা-নাস্তা নিয়ে এলো রিজভির দাদিমা। রাজ উনাকে দেখে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন আছেন আন্টি?’
-ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো?’
-হ্যাঁ ভালো আছি। বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? মেঘের আওয়াজ শুনলাম।
-হ্যাঁ, বৃষ্টি হচ্ছে তো।’ বলেই ভেতরে চলে গেলেন উনি। রাজ চায়ের কাপটা নড়াচড়া করলো। প্রকৃতির হাবভাব বোঝা বড় মুশকিল। আসার সময় রোদ ছিল, এখন বৃষ্টি হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে সে চা নাস্তা শেষ করতে লাগলো।
-স্যার, শেখা শেষ। পারবো।’ হঠাৎ পড়া থামিয়ে বললো রিজভি।
-আচ্ছা, এ অধ্যায়ের সৃজনশীল প্রশ্নটা শিখে রেখো। কাল নেবো ওটা। প্রত্যেকটা বইয়ে পড়া শিখে রাখবা, কেমন?’
-জ্বী স্যার…’
খালি কাপটা রেখে উঠে দাঁড়ালো রাজ। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বের হতে পারলো না। বাইরে ছোট্ট উঠানে দুহাত মেলে দিয়ে ভিজছিল চাঁদনি। অপূর্ব লাগছে তাকে। বৃষ্টির পানি ওর মুখ বেয়ে বেয়ে পড়ছে। ওর অকৃত্রিম রূপ আরও বেশি প্রেমের জোয়ার বয়ে দিলে রাজের বুকে। চুলগুলো ঝেড়ে সে খেয়াল করলো রাজকে।
-ভিজবা?’ জিজ্ঞেস করলো চাঁদনি।
-নাহ্।’ মৃদু হাসলো রাজ।
-আশেপাশে কেউ নেই কিন্তু।’ চাঁদনির চোখেমুখে দুষ্টুমির ভাব।
-না, তুমি ভিজো। আমাকে আরেকটা টিউশনিতে যেতে হবে।
-চান্সটা হারাবে কিন্তু…
-কীসের চান্স?’
রাজের দিকে এগিয়ে এলো চাঁদনি। কপালের চুলগুলো পেছনে নিয়ে গিয়ে আওয়াজটা কমিয়ে বললো,
-বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমাকে জড়িয়ে ধরার চান্স। মিস করবা কিন্তু।
-সুযোগ পেলে সুদেআসলে শোধ করে নেবো।
-ইশ! সাহস থাকলে এখন ধরো।’ দুষ্টুমি করে হাসলো চাঁদনি। রাজ ওর কান টেনে ধরলো। চাঁদনি কান ছাড়ার চেষ্টা করে বললো,
-এই ছাড়ো, লাগছে তো…’
-ভেজা ঠোঁট দুটো কাছে নিয়ে আসো আগে।
-ইশ! জড়িয়ে ধরে ভিজিয়ে দিবো কিন্তু। ধরছি কিন্তু….’ দুহাতে রাজকে জড়িয়ে ধরার ভান করলো চাঁদনি। রাজ ওর কান ছেড়ে দিলো। চাঁদনি হাতে বৃষ্টির পানি নিয়ে রাজের মুখে ছুড়ে মারলো। তারপর হাসতে হাসতে আবার দুহাত মেলে দিয়ে ভিজতে লাগলো বৃষ্টিতে। রাজের খুব ইচ্ছে হলো ওর পাশে গিয়ে প্রেমের বৃষ্টিতে ভিজতে, আর ওর ভেজা শরীরে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছেটাকে খুন করতে হলো।
-একটা ছাতা পাওয়া যাবে?’ জিজ্ঞেস করলো রাজ।
-না, আমাদের বাসায় কোনো ছাতা-পাতা নাই। আগে পাশে এসে ভিজো।’
রাজ হাসলো চাঁদনির কথা শুনে। হেসে বললো,
-ইচ্ছে তো হচ্ছে, তোমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এখন যদি একটু ভিজতে পারতাম।
-থাক থাক মাস্টার মশায়, আমার বুকে আর প্রেমের জোয়ার আনবেন না। আপনি পারবেন না জানি।’ বলেই ভেতরে রিজভির উদ্দেশ্যে ডাক দিলো চাঁদনি,
-রিজভি, তোর স্যারের জন্য একটা ছাতা নিয়ে আয়…’
একটুপর রিজভি এসে ছাতা দিয়ে চলে গেল। রাজ ছাতাটা খুলে চলে যাচ্ছিল, চাঁদনি দৌড়ে এসে ভেজা শরীরটা একটু দূরে রেখে রাজের গালে চুমু খেলো ভেজা ঠোঁট দিয়ে। রাজ ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। চাঁদনি বললো,
-তোমারটা পাওনা রইলো কিন্তু। পরে শোধ করে নেবো।’
রাজ হেসে বের হয়ে গেল গেইট দিয়ে। চাঁদনি আবার মনের আনন্দে ভিজতে লাগলো বৃষ্টিতে। বৃষ্টি নামলে সে নিজেকে সামলাতে পারে না। ভিজতে ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে। দুহাত পাখির মতো মেলে দিয়ে ঘুরতে লাগলো সে ভিজতে ভিজতে।
.
.
(চলবে….)