জীবনের গল্প পর্ব-৩০

0
438

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-৩০___________
নিজের রুমের মধ্যে পায়চারি করছে রাজ। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে সে। চাঁদনির ভাবীর সাথে ওভাবে কথা বলাটা তার উচিত হয়নি। ফোনটা বের করে সে চাঁদনির নাম্বারে কল দিলো। চাঁদনি ফোন রিসিভ করতেই রাজ বললো,
-হ্যালো…
-হুমম… বলো।
-কী করছো?
-কিছু না, বসে আছি।
-মন খারাপ?
-আরে না, মন খারাপ হবে কেন?
-আসলে তোমার ভাবীর সাথে ওভাবে কথা বলাটা আমার উচিত হয়নি। ভাবীকে আমার হয়ে সরি বলে দিও।
-আচ্ছা বলে দিবো…
-তোমার ভাইয়ের কানে গেছে এসব? তোমার উপর কোনো প্রেশার আসেনি তো?
-না, ওসব নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি। ভাইয়াকেও কিছু বলেনি।
-আর তোমার মা?
-মা আর কী বলবে? মা তো তোমাকে পছন্দ করে। আর মা কী বললো জানো?
-কী বললো?
-বললো, তুমি নাকি উচিত কথা-ই বলেছো। অনেক প্রশংসা করলো মা তোমার।’
রাজ হাসলো। চাঁদনি আবার বললো,
-আমিও মনে করি তুমি ঠিকই বলেছো। আসলেই ভাবী পরিবার পাইনি, স্বামী পেয়েছে। মামার এমন একটা বিয়ে গেল, অথচ ওরা স্বামী স্ত্রীর একটু সময় হয়নি। বাদ দাও ওসব কথা। কী করছো তুমি?
-আমি তো এতক্ষণ চিন্তা করছিলাম তোমার জন্য। তোমাকে তোমার ভাই কিছু বললো নাকি…’
চাঁদনি হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-খেয়েছো রাতে?
-হুমম… তুমি?
-আমিও খেয়েছি। ঘুমাবা কখন?
-এইতো একটু পর ঘুমাবো। সকালে ইন্টার্ভিউ আছে চাকরির। দোয়া করো।
-আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে। ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেও, কেমন? ঘুমাও তুমি।
-ঘুমাবো? ঘুমানোর আগে কিছু বলবে না?
-কী বলবো?
-কিছু বলার নেই? তাহলে রাখছি…
-এই দাঁড়াও, দাঁড়াও…’ উত্তেজিত হয়ে কথাটি বলে চাঁদনি ফিসফিস করে বললো,
-আই লাভ ইউ…’
চোখ বুজলো রাজ। চাঁদনির কথাটা ফিল করলো সে বুকে। চাঁদনি যেন কথাটা তার কানের কাছে এসেই ফিসফিস করে বলেছে। ওর কথার জবাবে রাজও ফিসফিস করে বললো,
-আই লাভ ইউ টু…’
তারপর ফোন রেখে দিলো।
.
.
ইন্টার্ভিউ দিয়ে বের হয়েছে রাজ। ভালোই হলো ইন্টার্ভিউ। চাকরিটা এবার হবে আশা করা যায়। চাকরিটা পেলে বাবার মুখেও হাসি ফুটবে। ওদের পরিবারেও আর অভাব অনটন থাকবে না। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে সে, বাবাকে অনেক পরিশ্রম করতে, মাকে ঘরের সবকিছু সামলাতে। চাকরিটা পেলে বাবাকে আর কাজ করতে দেবে না, বোনকে ভালোভাবে বিয়ে দেবে, আর মাকে সহযোগীতা করার জন্য চাঁদনিকে বিয়ে করে আনবে। তবে সমস্যা হচ্ছে গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে যদি ওর ভাবী সমস্যা করে?
বাইরে প্রচণ্ড বাতাস হচ্ছে। রাজ বেশ কয়েকটা রিকশা ডাকলো বাসায় ফেরার জন্য। কেউ যেতে রাজি না। একটা রিকশাতে করে একজন মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করছে ঘূর্ণঝড়ের ব্যাপারে। সচেতন করছে আট নাম্বার বিপদ সংকেতের ব্যাপারে। তাই যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছে, রিকশাওয়ালারাও। বাধ্য হয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসার পথ ধরলো রাজ। ঠিকমতো হাঁটাও যাচ্ছে না। প্রচণ্ড বাতাসে ধুলাবালি এসে চোখে লাগছে। কোনোমতে হাতের ফাইলটা দিয়ে ধুলোবালি থেকে চোখকে রক্ষা করে হাঁটছে সে। একটু একটু করে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তে লাগলো তার। বাতাসের তীব্রতার কারণে হয়তো এতক্ষণ বৃষ্টি আসতে পারেনি। বাতাসের তীব্রতা কাটতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো আকাশ থেকে। একটা কার এসে থামলো রাজের পাশে। কারের দরজা খুলে মুখ বের করলো সাদিয়া। তারপর বললো,
-আয়, ভেতরে আয়…’
রাজ কিছুটা অবাক হলো, খুশিও হলো সাদিয়াকে দেখে। তারপর উঠে বসলো ওর পাশে।
-কেমন হলো ইন্টার্ভিউ?’ জিজ্ঞেস করলো সাদিয়া।
-আলহামদুলিল্লাহ! খুব ভালো।’ জবাব দিলো রাজ।
-আল্লাহ ভরসা। টেনশন করিস না।’ মৃদু হাসলো সাদিয়া।
-ধন্যবাদ। হঠাৎ এভাবে এসে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
-বন্ধু তো। বন্ধুর বিপদে না এসে পারি বলো? এতে ধন্যবাদ দেয়ার কী আছে?
-কিন্তু তুই হঠাৎ এখানে?
-আমি এদিক দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম। তোকে দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে আনতে বললাম ড্রাইভার আঙ্কেলকে।’
মৃদু হাসলো রাজ। মনে মনে কৃতজ্ঞ হলো সে সাদিয়ার প্রতি। সাদিয়া রাজকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। রাজ ওকে ভেতরে আসতে বললে, অন্য একদিন আসবে বলে চলে গেল সে।
রাজ বাসায় ঢুকে ড্রেস চেঞ্জ করলো। তারপর ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। ওখানে সবাই বসে টিভিতে ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ দেখছে। কোথায় কোথায় ঘূর্ণঝড় আঘাত হেনেছে তা দেখাচ্ছে নিউজে। রাজ বসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলো,
-কী রে, কেমন হয়েছে ইন্টার্ভিউ?
-আলহামদুলিল্লাহ বাবা, খুব ভালো। আশা করছি এবার চাকরিটা পেয়ে যাবো। চাকরিটা পেলে তোমাকে কিন্তু আর বাইরে কাজ করতে দেবো না।’
ছেলের কথা শুনে আমান সাহেব গর্ববোধ করলো। হেসে ছেলের পিঠ চাপড়ে দিলো আলতো করে। আয়েশা বেগম এসে ছেলের কপালে চুমু খেলো। তারপর বুকের সাথে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরলো ওর মাথা। চাকরি এখনও হয়নি, তবুও ছেলের আত্মবিশ্বাস দেখে চোখে জল চলে এলো তার। চোখ মুছে ছেলেকে বললো,
-তোর জন্য খাবার দিচ্ছি, খেতে আয়…’ বলেই আয়েশা বেগম কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। রাজের পাশে এসে বসলো বীথি। ওর কাঁধে কনুইয়ের ভর দিয়ে বীথি বললো,
-চাকরি পেলে আমাকে কিছু দিবি না?
-হুমম দেবো, যা চাস এনে দেবো।’
বীথি রাজের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-চাঁদনি ভাবীকে এনে দিবি?’
-ওরে শয়তান।’ বলে রাজ কান টেনে দিলো বোনের।
-উফফ!’ শব্দ করে হেসে দিলো তখন বীথি। তারপর ভাইয়ের হাত ধরে বললো,
-চল, খাবি আয়…’
.
খেতে বসার পর হঠাৎ রাজের ফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো সে স্ক্রিনের দিকে। রাজ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,
-রাজ, আমি রিতা বলছি…
-হ্যাঁ রিতা, বলো…
-খবর কিছু শুনেছো? গ্রাম একদম ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। এই মাত্র ইয়াসমিন ফুফি ফোন করে জানালো।
-হোয়াট? দাদু, দিদিমণি, বাকি সবার কী অবস্থা?
-সবাই সাইক্লোন সেন্টারে সরে এসেছে।’
রাজ আর কিছুই বলতে পারলো না। মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না। ফোনটা নামিয়ে নিলো কান থেকে।
-কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলো আয়েশা বেগম। রাজ মাকে জানালো সব। শুনে তারও মুখটা মলিন হয়ে গেল। রাজ বললো,
-মা, আমি গ্রামে যাবো একবার। এভাবে আর না। হঠাৎ যদি দাদু, দিদিমণির কিছু হয়ে যায়, তাহলে সারাজীবন আফসোস করতে হবে… মা, তোমরা কেউ না যাও, অন্তত আমাকে বাধা দিও না।’
-দাঁড়া, তোর বাবা কী বলে দেখি…’ বলেই আয়েশা বেগম স্বামীর সাথে কথা বলতে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার এসে রাজকে ডেকে নিয়ে গেল। রাজ বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা বললো,
-হ্যাঁ, গ্রামে যেতে চাইলে যা। তবে আজ না। কাল যাস। এখন পানিতে ডুবে গেছে গ্রাম। তুই গিয়ে কোথায় থাকবি। আর শুন, ওখানে গিয়ে ফোন করে জানাস সবাই কেমন আছে, বাবা-মা কেমন আছে…’ শেষ কথাটা খুব অসহায় শুনালো বাবার। রাজ কেবল মুখের ভেতর শব্দ করলো,
-হুমম…’ কণ্ঠটা ভারী হয়ে আসছে তার। বীথি এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত রাখলো ওর কাঁধে। রাজ ওর চোখের দিকে তাকালো। চোখ দুটো তার ভেজা। বীথি কণ্ঠটা নরম করে বললো,
-আমাকে নিয়ে যাবি তোর সাথে?’ খুব করুণ শুনালো ওর কণ্ঠটা।
-হুমম…’ মাথা ঝাকালো রাজ।
.
.
♥একুশ♥
গ্রামের মাটিতে পা রাখতেই কেমন যেন ভালো লাগা শুরু হলো রাজ আর বীথির। রাজের কাঁধে একটা ব্যাগ। ওটাতে দুজনের কাপড়-চোপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র আছে। ইটের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললো ওরা দাদুবাড়ির দিকে। পানি কমে এসেছে, ঝড়ও থেমে গেছে। সাইক্লোন সেন্টার থেকে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছে মানুষ। গাড়ি থেকে নেমেই ওরা আগে সাইক্লোন সেন্টারে খোঁজ নিয়েছে, ওখানে দাদুবাড়ির কেউ আছে কি না। কেউ নেই, হয়তো ঘরে ফিরে গেছে।
রাজ ও বীথি খুব উত্তেজিত। কতদিন পর হারানো প্রিয়জনগুলোর মুখ দেখবে। দুই ভাইবোন পাশাপাশি হাঁটছে। হাঁটার সময় চারপাশে তাকাচ্ছে। চারদিকে খাল আর বিলের মাঝখানে একটা দ্বীপের মতো গ্রামটা। গ্রামে ঢুকতে শুরুতেই পড়ে স্কুল। এখনও আগের মতোই আছে স্কুলটা। ওখানেও আশ্রয় নিয়েছে কিছু মানুষ। স্কুলের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওরা দুই ভাই বোন। তারপর আবার ইটের রাস্তায় পা ফেলতে থাকে। গ্রামের অনেক কিছুই বদলে গেছে। বিল্ডিং উঠেছে কিছু কিছু। নতুন নতুন ঘর উঠেছে আরও। সবকিছু দেখতে দেখতে হাঁটছে দুই ভাইবোন। ওদের দিকে হা করে চেয়ে থাকে অনেকে। হয়তো শহরের মানুষকে প্রথম গ্রামে দেখে অবাক হচ্ছে। হয়তো ওরা জানে না যে এরা দুইজন এই গ্রামেরই ছেলে মেয়ে। এই গ্রামেই রয়ে গেছে তাদের নাড়ির টান। অবশেষে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ওরা এসে পৌঁছলো দাদু বাড়ির সামনে। দুজনের বুক টিপটিপ করছে। প্রথম কার সাথে দেখা হবে, কী বলবে, ওদের দুজনকে দেখে সবার কী অবস্থা হবে ভাবছে রাজ। বোনের হাত ধরে উঠোনে পা রাখলো সে। কাউকে দেখা গেল না। সবাই হয়তো ভেতরে। দাদু বাড়িটাও আর আগের মতো নেই। বাড়ির সামনে কয়েকটা আমগাছ হয়েছে এখন। আগে ওগুলো ছিল না। ইটের আরেকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। কে তুলেছে ঘরটা? বুঝতে পারলো না ওরা। দুজনে গিয়ে দাঁড়ালো পুরনো ঘরের দরজায়।
.
.
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here