জীবনের জলছবি
পর্ব ২৭
যাবনা বলে জেদ ধরে থাকলেও শেষ পর্যন্ত শুভ দার বিয়ের দিন সকালে যেতেই হলো টুসি কে। বাবার অফিসে জরুরী কাজ আছে, তাই বরযাত্রী যেতে পারবেনা, বাবা যাবে না বলে মাও বাড়িতে থাকতে বাধ্য হলো। অগত্যা বরযাত্রী যাওয়াটাও টুসির ঘাড়েই বর্তালো। সকাল বেলা গায়ে হলুদের সময় মা আর টুসি শুভ দাদের বাড়ি পৌঁছালো, মা সন্ধ্যে বেলায় ফিরে যাবে, টুসি বরযাত্রী যাবে কাকিমার সঙ্গে।
এসে থেকেই রাজা কে দেখেই অন্য দিকে সরে গেলো টুসি, যাতে তপু দার বিরাগ ভাজন না হতে হয়। কিন্তু তপু দা ওর দিকে ফিরেও তাকালো না, বরং অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো সীমা কে নিয়ে। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সীমার সঙ্গে বসে গল্প করছিলো, টুসি যে ওখানে বসে আছে সেটা যেনো দেখতেই পাচ্ছিলো না তপু। টুসির মন টা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, ভীষণ অপমানিত লাগছিলো, বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর কাছে বরযাত্রী না যাওয়ার মতো কোনো অজুহাত ছিলো না।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে সবাই বরযাত্রী যাবার জন্যে তৈরী হতে লাগলো। মা ও এবার বেরোনোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, অনেকটা পথ ফিরতে হবে। এখান থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব বেশ অনেকটাই, মা বেরিয়ে যাওয়ার পরে তৈরি হয়ে নিয়ে নিচে কাকিমার সঙ্গে বসেছিলো টুসি। কাকিমা তৈরি হচ্ছিলেন, টুসি সাহায্য করছিলো, তপু দা এসে ঢুকলো।
আমার নাইট ডিউটি আছে, আমাকে বেরিয়ে এসে হসপিটালে যেতে হবে। অতো তাড়াতাড়ি তো বরযাত্রীর গাড়ি ছাড়বে না, তাই আমি গাড়ি নিয়ে যাবো, তুমি বাসে চলে যেও,
কথাগুলো বলেই টুসির দিকে একবারের জন্যেও না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো তপু। যাহ! তপু দা বাসে যাবেই না! তারমানে তো একসঙ্গে বরযাত্রী যাওয়াই হবে না আর! অথচ ও কতো কিছু ভেবে রেখেছিলো, তপু দার সঙ্গে গল্প করতে করতে যাবে ভেবেছিলো! সেসব কিছুই হবে না আর! ক্রমশ যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছিলো ওর।
একটু পরে ওরা সবাই যখন তৈরি হয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো, তখন শুভ দার গাড়ি টা আগে ছেড়ে দিলো। শুভ দার গাড়ি টা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তপু দাও নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তপু দার গাড়িটা ফাঁকা যাচ্ছে শুধু সীমা পাশে বসে আছে দেখতে পেলো টুসি। গাড়ি নিয়ে তপু দা যখন ওদের পাস দিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন কাকিমা হাত দেখিয়ে থামালো,
তোর গাড়ি তো খালি একদম, আমরা তাহলে উঠে পড়ি,
আয় টুসি,
বলে টুসি কে ডেকে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়লো কাকিমা, টুসির খুব খারাপ লাগছিলো, নিজেকে যেনো কেমন অপাংক্তেয় মনে হচ্ছিলো। তপু দা সীমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিলো, টুসি চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিলো।
ওখানে পৌঁছে তপু দা গিয়ে শুভ দার সঙ্গে বসে পড়লো, শুভ দার বন্ধুরা তপু দারও বন্ধু, ওরা নিজেদের মতো গল্প করতে লাগলো। আর কাউকে না পেয়ে একা একা আর বসে থাকতে না পেরে শেষে রাজার কাছে গিয়েই বসলো টুসি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড়ও বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে, টুসি একাই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো।
তোর বন্ধু তোকে ছেড়ে কোথায় গেলো? একা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
বিদ্রুপের গলায় ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো তপু, টুসির রাগ হয়ে যাচ্ছিলো।
ছেড়ে যাবে কেনো! আমার বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই আমি এখানে উঠে এসেছি!
রাগের গলায় জবাব দিলো ও।
তাই নাকি! সব গল্প এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! অবশ্য কতই বা আর গল্প করবি, এখন তো প্রতিদিনই অনেক গল্প করছিসই তাই না! সেদিন দুজনে বাসে করে কোথায় গিয়েছিলি?
তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে নাকি আমাকে! বন্ধুর সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করবো কিনা সেটা কি তুমি ঠিক করে দেবে নাকি! তাও জিজ্ঞেস করলে যখন তখন বলি, দুজনে নয় অনেক বন্ধুরা মিলে সেবক গিয়েছিলাম, আরও অনেকেই ছিলো বাসে, তুমি সেটা বুঝতে পারোনি!
তপুর প্রশ্নের উত্তরে বিরক্ত হয়ে বললো টুসি, সারাদিন ওর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি, আর এখন কৈফিয়ত চাইতে এসেছে! নিজের ওপরেও রাগ হচ্ছিলো ওর, ওই বা কেনো জবাব দিতে গেলো! দুজন গিয়েছে কি দশ জন, সেটা তপু দা কে বলতে কি ও বাধ্য নাকি! তাও যদি ভালো ভাবে জিজ্ঞেস করতো! তারমানে বাসে যে ওর পাশে রাজা বসেছিলো সেটা ছাদ থেকে দেখতে পেয়েছিলো তপু দা, আর তাতেই রাগ হয়ে গেছে!
আর কোনো কথা না বলেই ফিরে গিয়ে রাজার পাশে বসে পড়লো ও, ইচ্ছা করেই আরও বেশি করে কথা বলতে লাগলো রাজার সঙ্গে। তপু দাও কম যায়না, টুসি কে দেখিয়ে দেখিয়ে সীমার সঙ্গে গল্প করছে!
শুভ দার বিয়ে শেষ হবার আগে বরযাত্রী দের বাস ছাড়বে না, তাই টুসি রাজার সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। বেশ রাত হয়ে যাচ্ছে, যদিও মাত্র ঘন্টা খানেক এর রাস্তা, তাও বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, কাল সকালে পড়তে যেতে পারবে কিনা ভাবছিলো টুসি।
চল, বেরিয়ে যাবো এবার, আমার তাড়া আছে, পরে আবার গল্প করিস,
টুসির সামনে এসে বললো তপু, শেষ কথাটার মধ্যে যে বিদ্রুপ টা লুকিয়ে ছিলো সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারলো ও।
তুমি চলে যাও, আমি তো বাসে ফিরবো,
যদিও গাড়িতেই যেতে ইচ্ছে করছিলো, তবু বললো টুসি।
কার সঙ্গে বাসে ফিরবি? মা তো আমার সঙ্গেই ফিরছে, আর আমি তোকে ডাকতে আসিনি, মা ডাকছে চল,
কাকিমা চলে যাচ্ছে! তাহলে তো ওকে যেতেই হবে,
রাজা এলাম রে, কাল কলেজে দেখা হবে,
ইচ্ছে করেই তপু কে শুনিয়ে বললো ও, কথাটা শুনেই যে তপু দার মুখটা আরো থমথমে হয়ে গেলো সেটা লক্ষ্য করলো টুসি।
গাড়িতে উঠেও চুপ করেই বসেছিলো ও, বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো, চারিদিক মোটামুটি শুনশান হয়ে এসেছে। কাকিমা আর তপু দুজনে বিয়ে বাড়ির গল্প করছিলো। ওকে এতো চুপ চাপ দেখে কাকিমা কারণ জানতে চাইলেন,
ওর বন্ধু কে ছেড়ে আসতে হয়েছে না তাই,
টুসি কিছু বলার আগেই তপু উত্তর দিয়ে দিলো, কাকিমা খুব অবাক হয়ে গেলেন,
বন্ধু! এখানে আবার তোর বন্ধু কোথা থেকে এলো! তুই মেয়ের বাড়ির লোকদের চিনলি কি করে?
টুসির খুব রাগ হচ্ছিলো, তপু দা ও ওকে ইচ্ছে করে রাগাতে চাইছে!
তুমিও যেমন! মেয়ের বাড়ির লোক হবে কেনো? ও তো সাথে করে বন্ধু কে বরযাত্রী করে নিয়েই এসেছে ওখান থেকে, এখন তোমার জন্যে ও বাসে ফিরতে পারলো না তার সঙ্গে। তাই মন টা খারাপ হয়ে গেছে!
তপুদা র উত্তরে কাকিমা একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন!
এমা! তাই নাকি! আমি তো বুঝতেই পারিনি। আসলে তোর মা তো আমার ভরসায় পাঠিয়েছে তোকে, তাই তোকে বাড়িতে না পৌঁছে দিয়ে যাই কি করে বলতো!
কাকিমার যে খুব খারাপ লাগছে সেটা বুঝতে পারছিলো টুসি। তপু দা যে ওকে অপমান করার জন্যেই এসব বলছে সেটা তো আর কাকিমা বুঝতে পারছেন না!
না না কাকিমা, মা আমাকেও তোমার সঙ্গেই ফিরতে বলে গেছে, তাই আমি এমনিও চলে আসতাম। আর আমার বন্ধুর সঙ্গে আমার রোজ কলেজে দেখা হয়, আর বৌভাতের দিন তো আবার দেখা হবে,
তড়িঘড়ি করে জবাব দিলো টুসি। শেষের কথাটা যদিও ও শুধু তপু কে শোনানোর জন্যেই বললো, আর সেটা শুনেই যে তপু আরও রেগে যাবে সেটা জানতোই ও।
তুমি চিন্তা কোরো না মা, ওর যা গল্প বাকি আছে, বৌভাতের দিন সবটাই ও করে ফেলবে,
এবার গম্ভীর গলায় বললো তপু, কাকিমা হেসে ফেললেন। টুসির খুব আনন্দ হচ্ছিলো, সব সময় শুধু ওই অপমানিত হবে নাকি!
ক্রমশ
(কাল পোস্ট করা হয়নি ব্যস্ততার কারণে, তাই আজ পর্বটা বড়ো করার চেষ্টা করেছি, সবাই একটু কমেন্ট করবেন প্লিজ, দু একদিন ঠিক থাকছে, তার পরেই রিচ কমে যাচ্ছে ভীষণ)