জীবনের জলছবি
পর্ব ৩১
সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্যদিনের থেকে অনেক টা আগেই কলেজে বেরিয়ে পড়লো টুসি। বাবা অফিসে গেলেই হয়ত ভদ্রলোকের কাছে কিছু জানতে পারবেন, শুধুই মনে হচ্ছিলো ওর।
কাল অঞ্জন নামের ছেলেটা সবার সামনে কিছু না বললেও বাড়িতে গিয়ে নিশ্চয়ই বলবে সবটাই, মনে মনে জানে ও, আর তার এফেক্ট যে আজ বাবা অফিস থেকে ফিরলেই দেখতে পাওয়া যাবে, সেটা মনে করেই বুকের ভেতর টা ধড়াস ধড়াস করছিলো টুসির।
তপু দার সঙ্গে কথা বলতে হবে, কিন্তু কিভাবে বলবে কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না। নিজে থেকে বলে উঠতে পারবে তো? বেশ কয়েকদিন ধরে তো কথাও বলেনি ও তপু র সঙ্গে, আজ কি করে নিজে মুখে বলবে সেটাই ভেবে যাচ্ছিলো শুধু।
সকালে তপু দার ব্যস্ততা থাকে জানে ও, তাই ফেরার পথে দেখা করবে ঠিক করে নিয়ে কলেজে ঢুকে গেলো টুসি। সারা দিন একটা অস্থিরতা কাজ করছিলো মনের মধ্যে, বাবার মুখটা ভেসে উঠছিল শুধু, তপু দা কে বলার পর, বাবাকে কি ভাবে ম্যানেজ করবে ঠিক করতে পারছিলো না ও। বাবার রাগ ও জানে, রেগে গেলে ঠিক কি কি করতে পারে বাবা, এই মুহূর্তে সেগুলোই মাথায় আসছিল।
কলেজ থেকে বেরিয়ে তপু দার কোয়ার্টারে পৌঁছে গেলো ও একটু তাড়াতাড়িই। দরজা খুললো তপু দাই, ওকে দেখেই বললো
মা নেই মামার বাড়ি গেছে, পরে আসিস,
শুনেই নিজের মধ্যে একটা কনফিডেন্স এলো ওর। কাকিমা থাকলে কি ভাবে কথা বলবে সকাল থেকে অনেক রকমভাবে ভেবেছিলো, সেখানে একটা সমস্যার এত সহজ সমাধান কে ওর যেনো ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই মনে হচ্ছিলো। ভগবান বোধহয় ওর সুবিধার জন্যই কাকিমা কে আজ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আমি তোমার কাছেই এসেছি, তোমার সঙ্গে আমার কথা ছিল একটু,
তপু দা কে সোজাসুজি বললো টুসি।
হ্যাঁ, বল কি বলবি? আমার কাছে এসেছিস যখন তখন প্রয়োজনেই এসেছিস নিশ্চয়ই!
হ্যাঁ, সত্যিই তোমাকে খুব প্রয়োজন আমার, আমি কদিন ধরেই বলতে চাইছিলাম, কিন্তু তুমি তো রেগে ছিলে আমার ওপর, বলা হয়ে ওঠেনি তাই। কিন্তু আর আমার হাতে একদম সময় নেই তপু দা,
তপুর বিদ্রুপটা একদম গায়ে না মেখেই বললো ও,
কাল একটা ছেলে দেখতে এসেছিলো আমাকে, কিন্তু আমি এখন বিয়ে করবো না বলে দিয়েছি ছেলেটা কে, তপু দার মুখের পরিবর্তন দেখতে চাইছিলো ও।
কেনো করবি না? কাকুর শরীর খারাপ, করে নেওয়াই তো উচিত!
তপু দার উত্তরে অবাক হয়ে গেলো ও। তাহলে কি ও ভুল ভেবেছে সবটাই, তপু দার কোনো ফিলিংস নেই ওর জন্য! ভাবতে ভাবতেই তপু দা বললো,
এই কথাগুলো আমাকে বলছিস কেনো? এবার কি অন্য কোনো কাজে ইউজ করবি আমাকে? কাকু কে কিছু বলতে হবে তোর হয়ে?
আর কোনো কথা আসছিলো না টুসির। যা বলবে ভেবে এসেছিলো, সেগুলো বলার যে আর কোনো মানে নেই বুঝতে পারছিল ও। ওর এতদিনের কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। ভীষণ অপমানিত লাগছিলো টুসির, যার জন্য ও সম্বন্ধ টা ফিরিয়ে দিল তার মুখ থেকে এই কথা গুলো শোনার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলো না টুসি।
অথচ দিনের পর দিন তপু দার বলা কথা গুলো শুনে ওর মনে হয়েছে, তপু দা ওকে ভালো বাসে, কিন্তু আজ আসল সময়ে ও বুঝতে পারছিলো সবটাই ওর ভুল ধারণা ছিল।
তোর কি মনে হয়, তোর ইচ্ছেতেই হবে সব কিছু? যখন দরকার পড়বে ছুটে আসবি, যখন মনে হবে ছুঁড়ে ফেলে দিবি, আমার কথার কোনো মূল্য নেই না?
খুব কেটে কেটে বললো তপু, কোনো লাভ নেই বুঝেও সব টুকু ক্ষমতা এক জায়গায় এনে,
আমি তোমাকে ভালোবাসি তপু দা, বিশ্বাস করো এবার অন্য কোনো ইন্টেনসন নেই আমার, শুধু এই কথা গুলোই বলতে চেয়ে ছিলাম,
বলে কেঁদে ফেললো টুসি। ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তপু বললো
অনেক দেরি করে ফেলেছিস তুই, অনেক দিন আগেই তোর কাছ থেকে এগুলো শুনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন তুই তো বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলি, আমার জন্য সময় ছিলো না তোর। এমনকি কদিন আগেও তো সঙ্গে কথা বলতে তোর কলেজে গিয়েছিলাম আমি, তুই একটা কথাও বলতে চাসনি আমার সঙ্গে। সেদিন রাস্তায় কি রকম ব্যবহার করলি, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেছিস? কি মনে করিস, আমার কোনো সম্মানবোধ নেই তাই না? এখন আর কিছু করার নেই আমার, অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আর আসিস না এখানে। চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
না, লাগবে না, আমি চলে যেতে পারবো,
বলেই আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে এলো টুসি। তপু গাড়ির চাবিটা হাতে তুলে নিয়েছে দেখেও আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না ও।
বাড়িতে গেলেই ওর জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে বুঝতে পারছিল ও, কিন্তু এই মুহূর্তে সে সব কিছুই আর স্পর্শ করছিলো না ওকে। অন্য জায়গায় মানে কি! তবে কি সীমার সঙ্গে! তপু দার বলা কথাগুলো যেনো থমকে দিয়েছে ওকে, ও যে তপু দা কে এত ভালবেসে ফেলেছে কবে নিজেই বুঝতে পারছিল না আর।
তুমি এতো আসো কেনো তপু দের বাড়ি?
মাথা নিচু করে হসপিটালের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছিলো টুসি, ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, গলার স্বর টা শুনে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়েই সীমা কে দেখতে পেলো ও।
তুমি কি জানো তপু আমাদের বাড়িতে আমার জেঠিমার সঙ্গে কথা বলেছে আমাকে বিয়ের ব্যাপারে?
আগে না জানলেও এখন তো ও তপু র কথা থেকে বুঝে গেছে সবটাই, তপু দা তো নিজেই বলেছে ওকে, তাই সীমার কথার কোনো উত্তর না দিয়েই স্ট্যান্ডের দিকে নিজেকে শক্ত করে হাঁটতে লাগলো টুসি।
বাড়িতে ফিরতেই বাবার মুখোমুখি হলো ও,
হাত মুখ ধুয়ে আমার ঘরে এস, কথা আছে তোমার সঙ্গে,
বাবা কি বলবে ও জানেই, তবু বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, ভেতরে ভেতরে একটা কাঁপুনি হচ্ছে, বাবার বলা কথা গুলো ঠিক করে কানে ঢুকছিল না ওর।
কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনো এই বাড়িতে দেখতে না পাই তোমাকে,
সরাসরি ওকে বলে দিলো বাবা।
আমি জানতেও চাইনা কাকে তুমি বিয়ে করতে চাও, কিন্তু সকালে উঠে আর তোমার মুখ দর্শন করতে চাইনা। আজ রাতেই বেরিয়ে যেতে বলতাম, কিন্তু তোমার মা চাননা, এই রাতে তুমি ঘর থেকে বেরও, তাই রাতটুকু থাকতে দিলাম তোমাকে। আজ তোমার জন্য আমি অফিসে যা অপমানিত হয়েছি, তারপরে আর তোমাকে আমার মেয়ে বলে ভাবতে আমার লজ্জা হচ্ছে। নিজের বাবার সম্মানের কথা ভাবে না যে মেয়ে, যার কাছে বাবার দেওয়া কথার কোনো দাম নেই, তাকে আমি নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করিনা আর,
বলেই উঠে চলে গেলো বাবা। এরপর মা ঢুকে এলো,
কাল আমাকে মিথ্যে বললি তুই! একবারের জন্যেও তোর বাবার শরীরের কথা মনে হলো না! শুধু নিজের ভালোলাগাটাই বড়ো হলো তোর কাছে? একবারও ভাবলি না, তোর জন্যে কতোটা অপমানিত হতে হবে আমাদের? কে সেই ছেলে যার জন্যে তুই আমাদের কথাও ভুলে গেলি? বল, আমি জানতে চাই কে সে!
মায়ের কথার কোনো উত্তর দেবার ক্ষমতাও ওর ছিলো না, কি করে বলবে ও নাম! তাই মায়ের হাজার অপমানজনক কথাতেও মুখ খুললো না টুসি।
অনেক রাত পর্যন্ত চুপ করে বিছানায় বসেছিলো টুসি। এর আগে কতো বকাবকি করেছে মা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাতে খেতে ডেকেছে ওকে।আজ জীবনে প্রথম বার রাতে মা ওকে খেতেও ডাকেনি আর, বাবা মনে হয় বলে দিয়েছে মা কে। সকাল থেকে ঘটা ঘটনাগুলো ফিরে ফিরে আসছিলো ওর মনের মধ্যে, তপু দা র করা অপমান টা মেনে নিতে পারছিলো না কিছুতেই। তপু দা ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এটা ভাবলেই ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে যেনো, তনু কেও এত বছরে ও এইরকম ভালো বাসেনি কোনোদিনও, বাবাও বেরিয়ে যেতে বললো আজ।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর, যাদের কাছে ছোটো থেকে শুধু ভালোবাসা পেয়েই বড়ো হয়েছে, তাদের এই কড়া কথাগুলো ভীষণ আঘাত দিচ্ছিলো ওকে। মা বললে কিছু মনে হয় না ওর, মায়ের কাছ থেকে এরকম শুনে ছোটো থেকে অভ্যস্ত টুসি, কিন্তু বাবার কাছ থেকে এত কড়া মনোভাব ও আশা করেনি কোনো দিনও।
কাল বেরিয়ে গিয়ে কার কাছে যাবে ও, তপু দার কাছে তো যেতে পারবে না, তাহলে? নিজের ওপর ভীষন আস্থা ছিলো ওর, তপু দা যে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারে এটা এক মুহূর্তের জন্যও মাথায় আসেনি, এবার কি করবে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলো না টুসি। বুঝতে পারছিলো এমন একটা ভুল ও করে ফেলেছে, যেটা শুধরে নেবার কোনো উপায় ওর জানা নেই! মা ওকে নাম না জেনে ছাড়বে না, আজ নাহলেও কাল এই প্রশ্নটার মুখোমুখি ওকে হতেই হবে আবার। আর তপু দার নাম বলার মতো সাহস ওর নেই আর। যদি বলে তাহলে মা শীলা কাকিমার সঙ্গে কথা বলবে, আর সেটা জেনে তপু দা আর সীমা ওকে হাসির খোরাক করবে। আর শীলা কাকিমার কাছে তপু দার মনোভাব জেনে মাও ওকে ছাড়বে না, আরও বেশি করে অপমানিত হতে হবে ওকে!
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছিলো রাতটা, পাশের ঘরে বাবা, মা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো ওকে খেতে না দিয়েই, টের পাচ্ছিল ও। ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছে চারপাশ, শুধু রাস্তার কুকুরগুলোর ডাক ছাড়া চার দিকে আর কোনো আওয়াজ নেই। টুসির মনের মধ্যে যুদ্ধ চলছিলো যেনো, চারপাশের নিস্তব্ধতা ওকে আরো বেশি করে গিলে খেতে আসছিলো।
একবার বাবা, একবার তপু দা, সবার মুখগুলো ঘুরে ফিরে আসছিলো মনের মধ্যে, ভালোবাসার মানুষগুলোর এইরকম অভাবনীয় পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না টুসি। একদম বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না, কার জন্যেই বা বেঁচে থাকবে, ওর থাকা না থাকা তে তো কারোর কিছুই যায় আসেনা বুঝে গেছে ও! বেঁচে থাকা মানেই তো আরো বেশি করে নিজেকে অপমানিত করা! সবাই জেনে যাবে ও যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো, সে ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে! সোমাও জিজ্ঞেস করবে ওকে, ওকে দেবার মতো কোনো উত্তরও থাকবে না ওর কাছে!
কাল যখন সকালে বাবা ওকে বার করে দেবে বাড়ি থেকে তখন পাড়ার লোকেরাও সবটাই জেনে যাবে। সীমা এখন ওদের কলেজেই ভর্তি হয়েছে, তাই এই কথাগুলো কলেজে ছড়াতেও দেরি লাগবে না একটুও। চারদিক থেকে ও হাসির খোরাক হবে সবার! এমন কেউ নেই যে ওকে বুঝবে আজ! মাথা কাজ করছে না আর, ভালো, মন্দ, ঠিক, বেঠিক সবটা ভুলে গিয়ে ওর বায়োলজি বক্স থেকে স্ক্যালপেলটা বার করে কাঁপা কাঁপা হাতে বাঁ হাতের কব্জির ওপর চালিয়ে দিলো টুসি।
ক্রমশ
(চারিদিকের অসম্ভব চাপ এই বয়সে কোনো কোনো সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, আমি এটা কে সাপোর্ট করি না, কিন্তু বাস্তবটা তুলে ধরতে চেয়েছি শুধু। কেমন লাগলো আজকের পর্ব? অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন সবাই, আর কাল একটু ব্যস্ত থাকবো, তাই পরবর্তী পর্ব পরশু🙏)