জীবনের জলছবি (পর্ব ৪)

জীবনের জলছবি
পর্ব ৪
গত কয়েক দিন ধরে মন টা বিরক্ত হয়ে আছে টুসির। এবারই প্রথম পুজো, যেবার কোথাও যাওয়া হলোনা তার। কিছু করারও তো নেই। পুজোর ছুটি খুলেই মাধ্যমিক এর টেস্ট, তার আগে পুজোতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবা মানেও পাপ।শেষ বার গরমের ছুটিতে যখন মামার বাড়ি গিয়েছিল তখন বেড়াতেও শেষ গিয়েছিল।

মামার বাড়িতে ভালো কাটেনি, এখনও ভাবলেই কান্না পায় টুসি র। তবু শেষ মুহূর্তে ক্ষমা চেয়ে ট্রেনের কামরায় গলিয়ে দেওয়া তনু র চিঠি টা অবশেষে মন কে শান্ত করেছিলো। যত্ন করে রেখে দিয়েছে টুসি, তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। যখন একঘেয়েমি আসে পড়তে পড়তে, মাঝে মাঝেই খুলে পড়ে। তনু যে এত রোমান্টিক একটা চিঠি লিখতে পারে জানতোই না। ভাগ্যিস ঝগড়া টা হয়েছিলো, তাইতো এটা পেলো, মন কে সান্তনা দেয় নিজেই।

আর ঠিক দুদিন বাকি পুজোর, কিন্তু কোনো আনন্দই অনুভব করে না টুসি। তার প্রাণের বন্ধু ডাকতে আসে, পাড়ায় ঠাকুর এসেছে চল দেখে আসি। নিতান্ত অনিচ্ছায় তার সঙ্গী হয়।

অষ্টমীর সকাল। এই দিন টা মায়ের শাড়ি পরে সবাই মিলে অঞ্জলী দিতে যাবার পরিকল্পনা করেছিল টুসির বন্ধুরা। সকাল থেকেই তাড়া। অঞ্জলীর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

দল বেঁধে ওরা মণ্ডপে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্র পড়া চলছে মাইকে, সবাই ফুল ছুঁড়ছে মন্ত্রের শেষে, টুসি লক্ষ্য করে কেউ পেছন থেকে প্রতিবার তার গায়েই ছুঁড়ে দিচ্ছে ফুলগুলো। পেছন ফিরে তাকায় সে, প্রচুর মানুষ, কে করছে এই ভিড়ে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না আর। কিছুক্ষন পর অঞ্জলী শেষ হলো, মণ্ডপে রাখা চেয়ার এ গোল করে বসে তারা।

আজকের দিন টা পড়ার ছুটি, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। ভোগ খেয়ে ফিরবে সবাই। একটু পরে ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ টুসির নাম ধরে ডেকে ওঠে। বন্ধুরাও শুনেছে, সবাই তাকায় কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়না তাকে। হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে,মজা করার এই সুযোগ ছাড়তে চায়না কেউই। বিরক্ত লাগে টুসির।

আরে বাবা, সাহস থাকে তো সামনে এসো না, মনে মনে বলে ওঠে। কিন্তু কেউ আসে না। ভোগ খাবার লাইন শুরু হয়। প্রচণ্ড ভিড়, বসার জায়গায় ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। ওরা বন্ধুরা মিলে থতমত খায়। সবাই প্রথম শাড়ি পরেছে প্রায়, এই অবস্থায় ওই ভিড়ে ঢোকা ঠিক হবে কিন্তু বুঝতে পারেনা।

হটাৎ করেই পাড়ার একটি ছেলে এগিয়ে আসে ওদের দিকে,

এই দিকে এসো তোমরা, বলে ডেকে নিয়ে যায় ওদের।

ওরা ভেতরে ঢুকে দেখে ওদের জন্য ফাঁকা রাখা বেশ কয়েকটা চেয়ার। ওরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে। ওদের বসিয়ে দিয়ে চলে যায় ওই ছেলেটি। সবাই একটু অবাক, নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলে। কিন্তু আর দেখা যায়না তাকে। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে আসে ওরা, মণ্ডপ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ওদের দেখে এগিয়ে আসে, ওরা ধন্যবাদ জানায় সবাই মিলে, মুচকি হাসি তার মুখে,

আমাকে নয় আমার বন্ধু কে জানাও, আমি তো শুধু ডেকে দিয়েছি তোমাদের,

বলেই পিছন দিকে ফিরে হাত নেড়ে ডাকে কাউকে। ভিড়ের মধ্যে থেকে লাজুক হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে একটি ছেলে, টুসির দিকে তাকিয়ে বলে

কোনো অসুবিধা হয়নি তো আর?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটি কে লক্ষ্য করে টুসি। এক মাথা কোঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দোহারা চেহারার তরুণটি সোজা তাকিয়ে থাকে টুসির দিকেই। পাশ থেকে আগের ছেলেটি বলে ওঠে

ও বাপী, আমার বন্ধু,

আস্তে করে মাথা হেলায় টুসি, জানায় কোনো অসুবিধা হয়নি তাদের।

ভোর বেলায় পুজো মণ্ডপের সানাই এর আওয়াজ এ ঘুম ভাঙলো টুসির। আজ দশমী। মন টা খারাপ লাগে, আবার এক বছর। কে জানে, কি রেজাল্ট হবে তার, পারবে তো সামনের বছর পুজোয় আনন্দ করতে? হাবিজাবি চিন্তা করতে থাকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে।

গতকাল সন্ধ্যে বেলা ধুনুচি নাচ হয়েছিলো মণ্ডপে। প্রতিবারই নাকি নবমী তে হয় বন্ধু মাম বলেছিলো। আসলে কোনও বছর তো থাকেনা ও, জানবে কি করে? নতুন কেনা সালওয়ার কামিজ আর ওড়নায় সেজে ও আর মাম গিয়েছিল মণ্ডপে। ধুনুচি নাচ শুরু হবার আগেই ভর্তি হয়ে গিয়ে ছিলো সব কটা চেয়ার।

ভিড়ের মধ্যে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না ওরা। তাই অবশেষে ফুচকার দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হটাতই পাশে এসে দাঁড়ালো কালকের ছেলে দুটি।

ফুচকা খাওয়াবে নাকি? মুচকি হাসি প্রথম ছেলেটির মুখে।

দ্বিতীয় ছেলেটি যার নাম কালই জেনেছিল টুসি, অনেক চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির। তার হয়ে সব কথা বন্ধুটি ই বলে দিচ্ছিলো। ফুচকা খাওয়ানোর প্রস্তাবে না বলা সম্ভব ছিলনা তাদের পক্ষে, কাল অতো কষ্ট করে সিট জোগাড় করে দিয়েছে ছেলেটি, চক্ষু লজ্জা বলেও তো একটা জিনিষ আছে নাকি। অগত্যা, মাথা নাড়ে তারা।

যদিও তাদের কাছ থেকেই একটা করে ফুচকা তুলে নেয় ছেলে দুটি, হেসে বলে ধন্যবাদ।

মাম একটু কথা বলতে ভালোবাসে, টুসির মতো চুপচাপ নয় সে। ঝট করে আলাপ জমিয়ে ফেলে । প্রথম ছেলেটির নাম আশীষ, সে আর বাপী দুজনেই কলেজ এ পড়ে একসঙ্গে, ক্রমশ জানতে পারে ওরা। আস্তে আস্তে জড়তা কাটতে থাকে তাদের, টুকটাক গল্পো শুরু হয়।

রাত প্রায় দশটা বাজে, বাড়ি ফেরার তাড়া লাগায় টুসি। একটু হলেও বসতে হবে বই নিয়ে, মাম ও এবার যেতে উদ্যোগী হয়। ছেলে দুটি গল্পো করতে করতে এগিয়ে আসে তাদের সঙ্গে, টুসির মনে ভয় কাজ করে। মা দেখে ফেললে প্রচণ্ড অশান্তি হবে, মাম ও একই কথা ভাবে।

মাম বলে আর এগিও না, এবার আমরা একাই চলে যাবো।

বুঝতে পারে ওরা, টা টা, বলে পেছন ফেরে।

কিরে, এখনও ঘুম থেকে উঠলি না, পড়তে বসবি কখন, মায়ের কথায় চমকে ওঠে টুসি।

কি তখন থেকে শুয়ে শুয়ে হাবিজাবি ভাবছিলো, ইস কত দেরি হয়ে গেলো, লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ে সে। বেলা গড়ায় আস্তে আস্তে। পাশের বাড়ির কাকিমা খবর নিয়ে আসেন সন্ধ্যে ছটায় ভাসান, তার আগে সিঁদুর খেলা। মা তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সারতে থাকে। আজ মায়েদের দিন, ওরা দর্শক মাত্র।

খেয়ে উঠে বই নিয়ে বসে টুসি। দশমী র সানাই এর আওয়াজ এ বিষাদ এর সুর ছড়িয়ে থাকে বাতাসে। এই সব মন খারাপ করা দিনগুলোতে কেনো জানিনা খুব করে তনুর কথা মনে পড়ে টুসির। কত দিন দেখা হয়নি। কেমন আছে সে, কেমন কাটলো তার পুজো টুসি কে ছাড়াই, মনের মধ্যে উথাল পাথাল করতে থাকে টুসির।

চারটে নাগাদ সেজেগুজে টুসিকে ডাকতে আসে মাম। মা ও তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় পাশের বাড়ির কাকিমার সঙ্গে। রেডি হয়ে মাম আর টুসি বেরিয়ে পড়ে পুজো মণ্ডপের দিকে। হটাতই থমকে দাঁড়ায় দুজনে, কাল যেখান থেকে আলাদা হয়েছিলো তারা, ঠিক সেখানেই দাড়িয়ে আছে বাপী আর আশীষ।

কাল বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারেনি বলে চিনে উঠতে পারেনি বাড়িটা, তাই এখানেই দাঁড়িয়ে আছে তারা, জানায় আশীষ।

কিন্তু কেনো? মাম জানতে চায়।

এই যে আমার বন্ধুর জন্য, বাপীর দিকে আঙুল তুলে দেখায়। কথা বলতে চায় সে তোমার বন্ধুর সঙ্গে, মাম কে জানায় আশীষ।

চমকে ওঠে টুসি। লাজুক হেসে টুসির দিকে তাকায় বাপী।

টুসি কিছু বলার আগেই মাম বলে ওঠে, কি কথা বলার আছে আমাকে বলো, ও কারুর সঙ্গে কথা বলবে না।

একটু বিরক্ত দৃষ্টি তে তাকায় বাপী, আমি শুধু তোমার সঙ্গেই কথা বলবো আর কারুর সঙ্গে নয়।

দুজনের মাঝে পড়ে চুপ করে থাকে টুসি।

তুমি আলাদা করে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না তো, প্রশ্ন করে বাপী।

নিশ্চুপ টুসির মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা পিছন ফিরে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় সে, বন্ধু কে ফেলে রেখেই। অগত্যা আশীষও সঙ্গী হয় তার। তার পরে সব কিছু কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যায়, মাম রেগে যায় আচমকা,নষ্ট হয়ে যায় পুরো সন্ধ্যেটা।

ঠাকুর ভাসান এ বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে ওরা, কিন্তু আর কোথাও বাপীদের দেখা যায়না, ক্লাব এর ভাসানে ও আসেনা তারা। সব কিছুর তাল কেটে যায় আচমকা, ফেরার পথে মাম আর টুসির সঙ্গে কথা বলেনা, কিন্তু ওর রাগের কোনো কারণ খুঁজে পায়না টুসি।

তোর কি হলো সেটা তো বল? আমি কি করলাম?

বারবার মাম এর কাছে জানতে চায় টুসি। কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধুর সঙ্গে মন কষাকষি ভালো লাগে না ওর। ওর কি দোষ? ও তো আর ওদের ডেকে আনে নি ওদের। এমনকি মাম চায়নি বলেই তো ওদের সঙ্গে বাপী চাওয়া সত্বেও কোনো কথা বলে নি টুসি। তাহলে কেনো রেগে আছে মাম? মামের মুখে অভিমানের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু এই অভিমানের কারণ টুসির জানা নেই।

এ এক অন্যধরনের অভিমান, যে অভিমানে বন্ধুর প্রতি অধিকারবোধ জড়িয়ে থাকে। সেই অভিমান বোঝা বা বোঝানোর মত কোনো ক্ষমতাই দুটি কিশোরীর কারোরই নেই। তাই তারা নিজেদের মতো করেই চুপ করে থাকে, কেউ নিজেদের ক্ষণিকের দূরত্ব কাটিয়ে কিছুতেই সহজ হতে পারে না।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here