জীবনের জলছবি
পর্ব ৯
টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। সামনেই মাধ্যমিক। পড়াশুনা মোটামুটি শেষের পথে সবারই। রিভিশন চলছে। কয়েকদিন পরেই সরস্বতী পুজো। স্কুল জীবনের শেষ সরস্বতী পুজো। মাধ্যমিক এর পরে এই ছোট্ট শহর টা ছেড়ে যেতে হবে কলকাতায়। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তাই ওরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছে এই বছর সবাই মিলে স্কুল এ যাবে শাড়ি পরে। পুজোর দিন সকাল থেকেই বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। টুসি দের স্কুল টা কো এড। ছেলে মেয়েরা সকাল থেকেই পাঞ্জাবি আর শাড়িতে সেজে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে। ওরাও দল বেঁধে স্কুল এর গেট এ আড্ডা দিচ্ছে। পিওন কাকু ডাক দিয়ে গেলেন, অঞ্জলী শুরু হচ্ছে। সবার মধ্যে একটা তাড়াহুড়ো পড়ে গেলো।
অঞ্জলী শেষ করেই প্রসাদ খাওয়া। প্রসাদ খেয়েই ওরা বেরিয়ে পড়লো অন্য স্কুল গুলোতে। পুজোর দিনের এই দল বেঁধে ঘোরার মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। এই বয়সে সব বন্ধুদেরই মোটামুটি একজন করে পছন্দের ছেলে আছে। কিন্তু এই ছোট্ট মফস্বল শহরে সবাই সবাইকে চেনে। তাই আলাদা করে কথা বলাটা অন্য সময় সম্ভবপর হয়না। কেউ দেখে ফেলবে সেই ভয় থেকেই যায়। আর বাড়িতে সেই কথা জানাজানি হলে কি হবে সেটা সবাই জানে।
কিন্তু আজকের দিনটা একদম অন্যরকম। পুজোর ভিড়ে কেউ কাউকে লক্ষ্য করেনা। তাই এই দিনটা র জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকে। এদের মধ্যে টুসি র অবস্থাই খুব খারাপ। বন্ধুদের দেখে ওর মন খারাপ লাগে, তনুর জন্য। ইস, যদি তনুর বাড়িও এখানেই হতো, টুসি মনে মনে ভাবে।
ছেলেদের স্কুল এর সামনে গিয়ে ওদের দল টা হালকা হতে থাকে ক্রমশ। সবাই নিজেদের মতো করে গল্পো করতে শুরু করে। মাম ও ওকে ছেড়ে এগিয়ে যায়। একা দাঁড়িয়ে থাকে টুসি। হটাৎ করেই পাশে এসে দাঁড়ায় বাপী। হাসি মুখে তাকায় ওর দিকে,
বন্ধুরা কোথায়? তুমি একা কেনো?
ওর প্রশ্নে বিব্রত হয় টুসি। সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে ওর। চিঠিতে কি লেখা আছে না দেখেই বাড়ি ঢুকে গিয়েছিলো ও। পরেরদিন সকালে ব্যাগ থেকে বার করে পড়েছিলো। অদ্ভুত এক দোলাচলে ভুগছিল ওর মন। কেমন যেনো অপরাধী মনে হচ্ছিলো নিজেকে।
ও কি অজান্তে তনু কে ঠকাচ্ছে, বেচারা জানতেও পারছে না। না, এটা ঠিক করছি না একদম, নিজের মন কে নিজেই বলেছিলো টুসি। তারপর কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো চিঠি টা। সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলেছে ও সবটাই। ভুলেও গিয়েছিলো ঘটনাটা। হটাৎ আজ নতুন করে বাপী কে সামনে দেখে একটু বিরক্তই লাগে ওর।
কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
চিঠির উত্তর পেলাম না তো কোনো,
বাপীর প্রশ্নে এবার সোজাসুজি তাকায় ও।
উত্তর দেওয়ার মত কিছু ছিলনা তো,
কড়া গলায় জবাব দেয়।
ঠিক আছে, পরীক্ষা শেষ হলে না হয় জবাব দিও,
বলেই চলে যায় বাপী। কাউকে কিছু না বলেই বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে টুসি। সারা দিন কেনো জানিনা মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। আর পড়তে পড়তেও সকালের ঘটনা টা মনে পড়তে থাকে শুধু। মানুষের মনের দোলাচল মানুষ বোধহয় নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা সব সময়।
কোন ফাঁকে দূরত্ব তৈরি হয় কার সঙ্গে, আর কোন সময় সেই ফাঁক দিয়েই কোনো নতুন মানুষ ঢুকে পড়ে তার জায়গায় কেও জানেনা। কোন কারণ ছাড়াই হটাৎ করে এবার মামার বাড়িতে গিয়ে তনুর করা ব্যবহার গুলোর কথা মনে পড়তে থাকে টুসির। খুব কষ্ট পেয়েছিল ও, তনুর কাছ থেকে এরকম কোনো দিনও আশা করেনি।
শেষ মুহূর্তে হাতে ধরিয়ে দেওয়া একটা চিঠির জন্য কি সব কিছু ক্ষমা করা যায়, ভুলে যাওয়া যায় ওই দুর্ব্যবহার, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজতে থাকে ও। হটাৎ করেই আবার নিজেই ভাবে এসব কথা ভাবছি কেনো, তবে কি দুর্বল হয়ে পড়ছি আমি। মনের মধ্যে শুধুই কাটাছেঁড়া চলতে থাকে, বই সামনে খোলাই থেকে যায়, একবর্ণ ও পড়া হয়ে ওঠেনা আর।
ক্রমশ
(দীপাবলির শুভেচ্ছা সবাই কে, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবাই ❤️)