#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-দশ
মাহাবুবা বিথী
জাবেদ গোসল করে ওর পরনের কাপড় বাথরুমে ধুয়ে রেখেছে।রোদে মেলে দেওয়ার সময় পায়নি।শিউলি বাথরুমে গিয়ে কাপড়গুলো রোদে মেলে দিলো।শিউলি খেয়াল করেছে জাবেদ ওর আন্ডার গার্মেন্টেস গুলো নিজে ধুয়ে দেয়।এটাও শিউলির খুব ভাল লাগে। হঠাৎ জাবেদের আধভেজা তোয়ালের গন্ধটা নাকে লাগলো।শিউলির মনে হলো জাবেদ যেন পাশে দাড়িয়ে আছে।অথচ বিয়ের আগে ভাইদের তোয়ালে হাত দিয়ে ধরতো না।ওদের তোয়ালে, ব্যবহারের কাপড়, শিউলি কখনও হাত দিয়ে ছুঁয়ে ও দেখতো না।এই নিয়ে প্রায় রাশেদ আর শাহেদের সাথে ঝগড়া হতো।
রান্না ঘরে গিয়ে শিউলি সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলো।নিজেও শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে বসে নাস্তা করলো।তারপর রান্না ঘরে বসে সবজি কুটতে লাগলো।শাশুড়ী এসে বললেন,
—-রান্না ঘরে বাজার থেকে আনা সবজি কুটবে না।ময়লা ছড়াবে।উঠোনে বসে কুটে নাও।
—-আম্মা উঠোনে অনেক রোদ।
—-তোমার সোনার অঙ্গ কি পুড়ে যাবে?আমি এই উঠোনে সবজি কুটে জোয়ান থেকে বুড়া হইলাম।আমার অঙ্গতো পুড়লো না।
শিউলি আর কথা না বাড়িয়ে সবজিগুলো নিয়ে উঠোনে বসে কুটতে লাগলো।
মনে মনে শিউলি ভাবতে লাগলো কাল থেকে রোদ উঠার আগেই সবজি কুটে ফেলবে।যত তাড়াতাড়ি এই পরিবেশেই নিজেকে খাপখাইয়ে নিতে পারবে ততই মঙ্গল।তা না হলে এখানে টিকে থাকতে পারবে না।
তাড়াতাড়ি দুপুরের রান্না শেষ করে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে নিজে দুটো মুখে দিয়ে শিউলি রুমে আসলো।মনটা কিছুতেই কাজে বসাতে পারছে না।দুপুরে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।জাবেদকে ফোন দিলো।ও ফোন ধরলো না।ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।মিটিং এ ব্যস্ত আছে।
শিউলি ভেবে পাচ্ছে না জাবেদের জন্য ওর এত খারাপ লাগছে কেন?এক সপ্তাহ আগেও এই মানুষটা ওর কেউ ছিলো না।অথচ এতদিনের চেনা আপনজন ছেড়ে এই মানুষটার হাত ধরে সম্পূর্ন অপরিচিত পরিবেশে চলে এসেছে। নিজের রক্তের বন্ধনের মানুষগুলোর জন্য ওর বেশী খারাপ লাগার কথা।কিন্তু জাবেদের জন্য বুকের ভিতরে চিন চিন ব্যথা হচ্ছে। জাবেদের জাদুমাখা ভরাট কন্ঠস্বরটা কানে বাজছে। তবে এটাই কি ভালবাসা?ভালবাসার ভিতরে মনেহয় একটা মায়া বাস করে।আর ঐ মায়াটা দুটো কায়ার ভিতর ছড়িয়ে যায়।হয়তো এই কারনে মানুষটার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে।
আসরের আযান হচ্ছে।শিউলি বিছানা ছেড়ে উঠে আসরের নামাজ পড়ে নিলো।এমন সময় কে যেন দরজা নক করছে।দরজা খুলে দেখে শায়লা দাঁড়িয়ে আছে।
—-কেমন আছো নতুন বউ? এ কয়দিন আর আসিনি।তোমরা নিজেদের মতো করে একটু সময় কাটাও।ছুটি ফুরিয়ে গেলে তো জাবেদ ঢাকা চলে যাবে।
—-আমি ভালো আছি।শায়লা তুমি কেমন আছো?
—আমিও ভাল আছি।নতুন বউ তোমার বাপের বাড়ি থেকে কোনো ফার্নিচার দেয়নি?
সরাসরি শায়লার এই প্রশ্নে শিউলি বিব্রতবোধ করলো।তারপরও মুখে ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে বললো,
—-উনি নিতে চাননি।তাই দেওয়া হয়নি
শায়লা বললো,
—-তুমি কিছু মনে করো না নতুন বউ।এসব ফার্নিচারের কয়টাকাই বা দাম।কিন্তু শ্বশুর বাড়ির মানুষ তো খোটা দিতে ছাড়ে না।আমার উনি তো জাবেদ ভাইয়ের মতো নন।উনার কথা হচ্ছে পেটে ক্ষিদে রেখে মুখে লাজ করে লাভ নেই।
মাগরিবের ওয়াক্তের সময় হলো।শায়লা চলে যাওয়ার পর নামাজ পড়ে নিয়ে শিউলি মায়ের বাড়িতে ফোন দিলো।
—–হ্যালো আপু কেমন আছো।
—-আমি ভালো আছি।শিউলি তুই কেমন আছিস।বড় আপার শরীরটা ভাল না।ডাক্তার বলেছে, জরায়ু থেকে টিউমার তাড়াতাড়ি রিমুভ করতে।দুলাভাই আর একটা বাচ্চা নিয়ে তারপর অপারেশন করবে।এতে যদি আপুর ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়।দুলাভাইয়ের তো কোনো সমস্যা নেই।বউ গেলে তো আবার বউ পাওয়া যায়।সুতরাং মেয়ে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নাই।আপুটাও বলিহারী।সংসারের চিন্তায় শরীর ক্ষয় করে কি লাভ?সবার আগে নিজেকে ভালরাখতে হয়,নিজেকে ভালবাসতে হয়।
—-আপু মা কোথায়।আম্মাকে একটু দাও কথা বলি
—-হ্যালো আম্মা কেমন আছো।
—-ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?তোর শ্বশুর শাশুড়ী তোকে আদর করে ভালবাসে।
—-হ্যা আম্মা ওরা আমাকে আদর করে।আমি ভাল আছি।তুমি নিজের শরীরের দিকে যত্ন নিও।এখন রাখছি।
ফোনটা রেখে সবাইকে সান্ধকালীন চা দিলো।এরপর শিউলি ডিনারের ব্যবস্থা করলো।এখানে সবাই রাতের খাবার দ্রুত খেয়ে নেয়।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়ে।পুরো পৃথিবীটা একসময় নিরব হয়ে যায়।জেলা শহরগুলি রাতে খুব দ্রুত নিশ্চুপ হয়ে যায়।শিউলির চোখের ঘুমটা হারিয়ে যায়।ফোনটা বেজে উঠলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা বাজে।জাবেদ ফোন দিয়েছে।অভিমানে শিউলির গলা বুঁজে আসছে।সারাদিন পর সাহেবের এখন সময় হলো ফোন দেওয়ার,
—-হ্যালো,এখনও ঘুমাওনি।আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলে বুঝি(দুষ্টমির হাসির শব্দ)
—-আমার সময়ের অনেক দাম।আমার রাতের ঘুম কামাই করে তোমার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় আমার নেই।
—-আমার রানীর খুব মান হয়েছে আমার উপর।আসলে সাতদিন পর অফিসে এসে দম ফেলার সময় পায়নি।বাসায় আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেলো।তারপর দুটো ভাত ডাল ফুটিয়ে ডিম ভাজি দিয়ে খেয়ে এখন ফ্রি হলাম।রাত হয়েছে।তোমারও ভোর থেকে সংসারের কাজ করতে হয়।আমারও অফিস আছে।শুয়ে পড়ো।
এভাবেই শিউলির বিবাহিত জীবনের দিনকাল পার হতে লাগলো।এর মধ্যে একদিন দুপুরে খাওয়ার পর শাশুড়ী তার রুমে ডাকলেন,
—-বৌমা আমার পিঠে একটু পাউডার দিয়ে দাও।অনেক ঘামাচি হয়েছে
শিউলি ও সুন্দর করে ওনার পিঠে পাউডার দিতে লাগলো,উনি শিউলিকে বললেন,তোমাকে একটা গল্প বলি,এই কথা শুনে শিউলির সপ্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হলো।
—–অনেক আগে এক শাশুড়ি তার বৌমাকে পিঠ চুলকিয়ে দিতে বললেন।বৌমার হাত দিয়ে চুলকে দিতে ঘেন্না লেগেছে তাই পা দিয়ে চুলকিয়ে দিয়েছে।সাথে সাথে বৌটা কেউন্না পোকার রুপ ধারণ করে।ঐ পোকা গুলির অনেক পা দিয়ে কিলবিল করে হেঁটে বেড়ায়।
শিউলি বললো,
—-মা এই গল্প কি আপনি আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন।শোনেন মা আমি আমার পরিবার থেকে শিখে এসেছি বয়স্ক মানুষকে সম্মান করতে হয়।মা বা শাশুড়ীতো আলাদা কথা,একটা বয়স্ক মানুষ যদি আমার বাসায় কাজ করে কিংবা রাস্তার ভিক্ষুক হয় তাকেও সম্মান করতে হয়।
—-তা ভাল, তোমার বাবার তো আবার চালচুলো ছিলো না। তারপরও তোমার মা তোমাকে ভাল শিক্ষা দিয়েছেন।
—–মা আমার বাবা মারা গেছে।উনার চালচুলো ছিলো কি না ছিলো আপনি কখনও দেখেননি।সুতরাং একজন মৃত মানুষ নিয়ে আপনার এভাবে কথা বলা ঠিক না।
শিউলি শাশুড়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
জাবেদ এতো ভালো অথচ ওর মা মানুষকে আঘাত না দিয়ে কথা বলতে পারেন না।কি অবাক ব্যাপার।আর জাবেদকেই বা এতো ভালভাবছি কিভাবে?আজ হয়তো আমাকে জাবেদের ভাল লাগছে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ও যে বদলে যাবে না এ গ্যারান্টি কে দেবে।মানুষ প্রতিনিয়ত তার জীবনের রং বদলে ফেলে।
দুসপ্তাহ পর পর জাবেদ বাড়িতে আসে।শিউলিও প্রতিনিয়ত এই পরিবারটাকে আপন ভেবে সব কিছুর
সাথে আনন্দ দুঃখ বেদনায় নিজেকে মানিয়ে নিতে লড়াই চালিয়ে যায়।বিয়ের দেড়মাস পার হলো।শিউলির পিরিয়ড হয়নি।কনসিভ করলো কিনা বুঝে উঠতে পারছে না।এই সপ্তাহে জাবেদ বাড়ি আসলে ডাক্তারের কাছে যাবে।
এর মধ্যে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।শিউলি সেদিন উঠোনে বসে সবজি কুটছিলো।আবেদের মা আবেদকে নাস্তা খাইয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে ভূলে যায়।এর মাঝে হঠাৎ করে আবেদ ঘর থেকে বের হয়ে আসে।শিউলি আবেদকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যেতে চায়।আবেদ উঠোনে শিউলিকে দেখে রেগে গিয়ে বলে তুই আমাকে মারতে আসছিস তোকেই আমি মেরে ফেলবো।এই কথা বলে শিউলিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।শিউলি পড়ে গিয়ে তলপেটে ব্যথা পায়।সাথে সাথে ব্লিডিং শুরু হয়।শিউলির শ্বশুর এসে আবেদকে ঘরে নিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলে।আবেদের মার উপর রেগে গিয়ে গালাগাল করে।তারপর জাবেদকে ফোন দিয়ে শিউলির কথা জানায়।তুলি এসে শিউলিকে ঘরে নিয়ে যায়।কিন্তু শিউলির অস্বাভাবিক ব্লিডিং হতে থাকে।
জাবেদ এই খবর পেয়ে দ্রুত বাড়ি চলে আসে।শিউলিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যায়।ডাক্তার শিউলিকে হাসপাতালে ভর্তি করে।শিউলির মিসক্যারেজ হয়ে যায়।জাবেদ শিউলিকে বলে,
—-তুমি জানতে না তুমি কনসিভ করছো?
শিউলি বলে,
—এ মাসে পিরিয়ড বন্ধ ছিলো।ভাবছিলাম তুমি আসলে তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
জাবেদ শিউলিকে জিজ্ঞাসা করে,
—-তুমি উঠোনে কেন সবজি কুটছিলে?
শিউলি বললো,
—-মা বললো ঘরে কুটলে ঘর নোংরা হবে। উঠোনে গিয়ে সবজি কুটতে বলেছে
—-শোন শিউলি,এই পৃথিবী বড় কঠিন জায়গা।নিজের ভালোটা সবার আগে বুঝে নিতে হয়।তোমার ভালো তোমাকে কেউ করে দিবে না।নিজের সুবিধা নিজেকে আদায় করে নিতে হয়।তুমি রোদে উঠোনে কেন সবজি কুটবে?মাকে তুমি বলতে পারতে ঘর ময়লা হলে সবজি কুটার পর ঘর পরিস্কার করে দিবে।
জাবেদ আরো বলে
সব সময় সবাইকে ভালো রাখা যায় না।সকলকে ভালো রাখতে গেলে নিজের আর ভালো থাকা হয় না।এই পৃথিবীতে বেশী ভালো হওয়া ভালো নয়।
শিউলির চোখ দিয়ে বড় বড় ফোটায় বৃষ্টির পানি পড়তে লাগলো।জাবেদ শিউলিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো।শিউলি মনে মনে ভাবে এতো কষ্ট বেদনার পরেও জীবন নামক রেলগাড়িটা ভালবাসা নামক স্টেশনটা মিস করে।
চলবে