#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৫
মাহাবুবা বিথী
কিছুদিন আগে জরিনার বিষয়টা শেফালী অনেক ঝামেলা করে টাকাপয়সা দিয়ে কোনরকমে মিটিয়ে ফেলছে।বাচ্চটাকে বাঁচানো যায়নি।এখন আবার আপুর টিউমার অপারেশন হবে।এতো রিক্স নিয়ে আপু আবার কনসিভ করেছে।ঈদের পরদিন সরুপাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।আল্লাহপাক জানে মেয়ে হবে না ছেলে হবে।মেয়ে হলে আপুর সংসারে আগুন লেগে যাবে।একটা ঝামেলা শেষ হতে না হতে শেফালীর জীবনে আর এক ঝামেলা শুরু হয়।
ঈদের দিন শেফালী সরুপাদের বাসায় রওয়ানা দেয়।খালামনিকে পেয়ে সরুপার দুই মেয়ে খুশীতে ডগমগ।বড় মেয়েটা ক্লাস ফাইভে পড়ে।আর ছোটোটা ওয়ানে পড়ে।শেফালী ফ্রেস হয়ে সরুপার কাছে গিয়ে বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আপু সনোগ্রাফি করার সময় ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলি ছেলে হবে না মেয়ে হবে।
সরুপা বললো,
—-জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি।যা কপালে লেখা আছে তাই হবে।জানাজানি হলে বাসায় অশান্তি হবে।
তারউপর প্রথম থেকেই পেটে ব্যথা হতো।আমার শ্বাশুড়ীর ধারণা কাজ না করার ছলে মিথ্যা বাহানা করি।উনি বাচ্চা পয়দা করেছেন কোনদিন ওনার একটু ব্যথাও হয়নি।বমিও হয়নি।
শেফালী বললো,
—-আপু দুলাভাই কিছু বলতো না।
সরুপা বলে
—-উনি তো এক অদ্ভূত মানুষ।মায়ের সামনে মুখে একটা বিরাট তালা ঝুলিয়ে রাখে।আর আমি কিছু বললে আমাকে আবার ঘটা করে ওর মার কাছে গিয়ে মাফ চাইতে হয়।অন্যায় করবেন আমার শ্বাশুড়ী মাফ চাব আমি। এতো অশান্তি ভালো লাগে না।তাই মুখ বুঝে সয়ে নেই।
রাতে খাবার টেবিলে সরুপার শ্বাশুড়ী শেফালীকে বলে,
—-আইবুড়ো হয়ে আর কতদিন মা ভাইদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে।বিয়ে থা করে সংসারী হও।তোমার মাও শান্তি পাবে আর তোমার ও একটা হিল্লে হবে।শোন মেয়ে বুড়া বয়সের কথা চিন্তা করেও তোমার বিয়ে করা উচিত।তুমি আবার কিছু মনে করো না।আপনভেবেই কথাগুলো বললাম।
শেফালী সরুপার শাশুড়ীকে বললো,
—মিষ্টি কথার ছুড়িতে আপনভেবে আমায় ভালোই কথা বললেন।বুড়ো বয়সের কথা ভেবে যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে বাবা মা বুড়ো বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে যান কেন?
শেফালী রমজানের দিকে তাকিয়ে দেখলো আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে।ওর মা যে এতোগুলো কথা শুনালো রমজানের যেন কোনো বিকার নেই।অথচ শেফালী নিজের প্রয়োজনে বোনের বাড়িতে আসেনি।রমজান ওকে সাহায্য করার জন্য আসতে বলেছে। তাই এ বাড়িতে ও এসেছে।আর ওর মা একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো।
সরুপার শ্বাশুড়ী বললো,
—–আমি অনেক সাদাসিদে মানুষ।আমি কারও কথা ধরি না।সবার সাথে আমি মন খুলে কথা বলি।তুমি আমার কথায় কষ্ট পেলে আমারে মাফ করে দিও।তোমরা এযুগের মেয়ে। তোমাদের সাথে হিসেব কষে কথা বলা দরকার।এযুগের মেয়েরা আবার বুঝে বেশী।
সরুপা শেফালীর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় থামতে বললো।
শেফালী ও খাওয়া শেষ করে সরুপার দুই মেয়ের সাথে রুমে চলে গেলো।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে।কাল সকালেই আপুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে।
এসব দেখে শেফালীর বিয়ে করার সাধ মিটে যায়।ছেলের বাড়ির মানুষ গুলির ভাব দেখলে মনে হয় মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসে এরা উদ্ধার করেছে।আরে উদ্ধার তো তোরা হয়েছিস।দেখেশুনে এমন বাড়ি থেকে মেয়ে আনিস যাতে সারাজীবন মুখ বুঁজে তোদের অত্যাচার সহ্য করে নেয়। আর তোরা ঐ সুযোগে মেয়েটার ঘাড়ের উপর পুরো সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিস।আর এদের ছেলেগুলো এতো মূর্খ হয় কিভাবে?সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এর দায়তো স্ত্রীর উপর বর্তায় না।আল্লাহ পাক এই ব্যাপারটা ছেলেদেরকে দান করেছেন।অথচ যুগ যুগ ধরে কন্যা সন্তান জন্মদানের জন্য নারীদের দায়ী করা হয়।এই মূর্খ ছেলেগুলো এই বিষয়টা বুঝেও না বুঝার ভান করে।আর কন্যা সন্তান জন্মের অজুহাতে বউকে অত্যাচারের ফায়দা লুটে।
পরদিন খুব ভোরে সরুপার ঘুম ভাঙ্গে।ফজরের নামাজটা পড়ে নেয়।শেফালীও ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে সবার জন্য চা বানায়।সবাইকে চা দিয়ে চা নিয়ে সরুপার ঘরে আসে।শেফালী সরুপার দিকে তাকিয়ে দেখে বুকের ভিতরটা ব্যথায় ভরে উঠে।আপুর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়।আপুকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন ফাসির আসামী।শেফালী সরুপাকে বলে,
—-আপু জীবনে শক্ত হতে শেখো।প্রবাদ আছে “নরম মাটি পেলে বিড়ালও পায়খানা করে”।তুমি শক্ত হও।জানি না তোমাকে আল্লাহ ছেলে দিবে না কন্যা দিবে।এটা সম্পূর্ন আল্লাহ পাকের এখতিয়ার।তবে তোমার মেয়েদের জন্য তোমাকে অনেক লড়াই করতে হবে।তোমার মতো করে তুমি ওদের তৈরী করো না।মাটির উপর নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে ওদের দাঁড়াতে শিখতে হবে।লেখাপড়া শেষ করে জবে ঢুকার পর তুমি তোমার মেয়েদের বিয়ে দিবে।আর এই দীর্ঘ লড়াইটা মেয়েদের সাথে তোমাকেও করতে হবে।তুমি হবে তোমার মেয়েদের জীবনের গতি।
শেফালীর কথাগুলো সরুপার মনে দাগ কাটলো।ওর মনে হলো শেফালী অনেক ম্যাচিউর।জীবন থেকেই ওর ম্যাচিউরিটি এসেছে। ও যদি পরিবার থেকে একটু সাপোর্ট পেতো শেফালীর জীবনটা হয়তো অনেক বদলে যেতো।এই সমাজে আজ ওর একটা identity তৈরী হতো।তারপরও শেফালী অনেক কষ্ট করে ড্রিগ্রী পাশ করেছে।ফ্যাশন ডিজাইনার হিসাবে ছ, মাসের কোর্সটাও শেষ হয়েছে।লড়াই করতে গেলে নিজের মানসিক জোরের খুব দরকার হয়।সরুপা শেফালীর জন্য দোয়া করে ওর যেন এই জোরটা সবসময় থাকে।
নাস্তা করে রমজান শেফালী আর সরুপা হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো।স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হলো।শেফালী আর সরুপাকে কেবিনে রেখে রমজান ডাক্তারের কাছে গেলো।শেফালী রমজানের চেহারা দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মুখটায় মনে হয় কালি মাখানো হয়েছে।দুলাভাই ধরেই নিয়েছে আপুর আবার মেয়ে হবে।সরুপা শেফালীকে বললো,
—যদি ছেলে হয়তো রক্ষা। আর যদি মেয়ে হয় তাহলে হাসপাতালে যতটাকা খরচ হবে শাশুড়ী কথার ছোবল দিয়ে সব উঠিয়ে নিবে।এ আমার আর এক অশান্তি।
শেফালী বললো,
—তুমি প্রশ্রয় দাও কেন?কথা শুনিয়ে দিতে পারো না।
সরুপা বলল,
—-তোর দুলাভাই চন্ডাল আছে।হঠাৎ করে রেগে গিয়ে গায়ে হাত তুলতে পারে।আমার বাচ্চাদের মনের উপর চাপ পড়বে।এইজন্য কিছু বলি না।ছোটো বেলায় বাবা যখন মাকে মারতো আমাদের মনের উপর কেমন চাপ পড়তো।তোরতো মনে আছে।এইজন্য দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করে নেই।
দরজায় নক করে রমজান কেবিনে ঢুকলো।ডাক্তার আবারো সনোগ্রাফি করাতে বলেছে।সরুপাকে হুইল চেয়ারে করে শেফালী নিয়ে গেলো। রমজানও সাথে সাথে গেলো।সরুপা ডাক্তারের রুমে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো।ডাক্তার আরিফা পেঠে যন্ত্র বসিয়ে সরুপাকে বললো,
—– আপনার ছেলে হবে।
সরুপা বললো,
—আপনি কি ঠিক দেখেছেন ম্যাম?
ডাক্তার বললো
—-আপনার কি মনে হয় আমি আপনার সাথে ফাজলামো করছি
সরুপা বললো,
—-আমার আগের দুটো মেয়ে হয়েছে।এ নিয়ে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে এইজন্য আপনাকে এইভাবে বলেছি।
ডাক্তার বললো,
—তবে সংসারের এই পরিবেশগুলো হ্যান্ডেল করতে হলে মাকে শক্ত হতে হয়।আপনাকে অনেক শক্ত হতে হবে।এবার টিউমারের কারনে আপনার ইউটেরাস ফেলে দিতে হবে।
সরুপা আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া জানালো।হয়তো এতদিনে ওর সংসারে শান্তি ফিরে আসবে।
ছেলে হওয়ার কথা শুনে সরুপার শাশুড়ী লাফাতে লাফাতে হাসপাতালে চলে আসলো।বাচ্চা সবার আগে উনি কোলে তুলে নিলো।আনুশা আর মাইশাও খুব খুশী।ওদের সবার ন্যাকামি দেখে শেফালী সরুপার শাশুড়ীকে বললো,
—-এবার আমার বোনটাকে আপনারা একটু শান্তি দিয়েন।যার উপরে পুরো সংসারের দায় চাপিয়ে দেন সে নিজে যদি ভালো না থাকে তাহলে আপনাদের পুরো পরিবারকে ও ভালো রাখবে কিভাবে?
চলবে