#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৭
মাহাবুবা বিথী
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের রুটিন মাফিক ফ্রেস হয়ে শিউলি রান্নাঘরে চলে যায়।ডাইনিং এ বসে শাশুড়ী মরিয়ম শিউলির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করছেন আর ভাবছেন।শরীরটা অনেক ভাঙ্গছে।চেহারাটাও খারাপ হইছে।গায়ের রংটা একটু কালো হইছে।মনে হয় পেটের সন্তানটা ছেলে হতে পারে। মরিয়ম চুলায় একটা ডিম সিদ্ধ দিল।তারপর নাস্তার টেবিলে শিউলির প্লেটে তুলে দিয়ে বললো,
—-পোয়াতি মানুষ তুমি।প্রতিদিন একটা করে ডিম খাবে।সময় তো আগাইয়া আসতেছে।তোমারে দেইখা মনে হইতেছে তোমার ছেলে হবে।
জাবেদ দেখে মনে মনে খুব খুশী হলো।মা মনে হয় এবার শিউলিরে স্বাভাবিক ভাবে নিবে।শিউলি অবাক হয়ে শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
মরিয়ম জাবেদকে বললো,
—–বাজারে গিয়া একটা তিনকেজি ওজনের রুইমাছ কিনে নিয়ে আয়।
জাবেদ বললো,
—কোনো মেহমান আসবে!
মরিয়ম বললো
—-না,পোয়াতি মানুষকে বড় মাছের মাথা খাওয়াতে হয়।তাহলে বাচ্চার ব্রেন ভালো হয়।শিউলির জন্য আনতে বলছি।
দুপুরে খাবার টেবিলে মাছের মাথাটা মরিয়ম শিউলির প্লেটে তুলে দিলো।শিউলির মনের ভিতরে অস্বস্তি হতে লাগলো।যদি ছেলে হয় হয়তো শিউলি এই মাছের মাথা হজম করতে পারবে।আর যদি মেয়ে হয় হজম তো করা যাবেই না বরং শাশুড়ী মাকে শিউলি সামলাবে কিভাবে এই টেনশনে শিউলির গলা দিয়ে মাছের মাথা নামছে না।
রাতে খাবার পর শিউলি রুমে গিয়ে জাবেদকে বললো,
—–মা হয়তো ভাবছেন আমার ছেলে হবে।আমরা তো জানি না আমার ছেলে হবে না মেয়ে হবে।এটার উপর কারও হাত নেই।আল্লাহপাক রিযিকে যা রেখেছেন তাই হবে।কিন্তু মা যদি আশা নিয়ে বসে থাকেন আমার ছেলে হবে পরে যদি মেয়ে হয় মাকে সামলানো কঠিন হবে।তোমার উচিত হবে মাকে এই বিষয়টা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা।
জাবেদ শিউলির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো কিন্তু জাবেদ এও জানে মাকে বুঝাতে চাইলে ও মা বুঝতে চাইবে না। আরও উল্টা বুঝবে।ভেবে নিবে আমরা হয়তো জেনে গিয়েছি আমাদের মেয়ে হবে।
শিউলিকে হয়তো আরও যন্ত্রণা পোহাতে হবে।এর থেকে সময়ের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
অসুস্থ শরীরে শিউলি ঈদের ধাক্কাটা কোনোরকমে সামলে নিলো।মরিয়ম ঈদ উপলক্ষ্য আবেদকে বাসায় নিয়ে আসলো।আবেদ এখন আগের মতো পাগলামী করে না।তবে কড়া ওষুধের কারণে দিনের অনেকটা সময় ঘুমিয়ে থাকে।
শিউলিও আবেদকে মানিয়ে নেয়।আবেদএখন নিজের হাতে গুছিয়ে খেতে পারে।শিকল দিয়ে এখন বেঁধে রাখতে হয় না।শাশুড়ী মরিয়ম বৌমার উপর বেশ খুশী।শিউলি আবেদের দিকে খেয়াল রাখে।সকালের চা থেকে শুরু করে রাতের খাওয়া সময়মতো আবেদকে তৈরী করে দেয়।
এমনি করে ওদের জীবনের সময়গুলি পার হয়ে যায়। শিউলি আর জাবেদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তটা এগিয়ে এলো।ওদের সন্তানের পৃথিবীতে আগমনের ক্ষণ ঘনিয়ে এলো।
সেদিন ছিলো শুক্রবার।
শিউলিকে সকাল দশটার মধ্যে ঢাকায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।খবর পেয়ে শেফালীও চলে আসলো।ডিসেম্বর মাসের বিশ তারিখ।জেলাশহর গুলিতে ভালোই শীত পড়েছে।ঢাকায় একটু কম।জাবেদের মাও হাসপাতালে চলে এসেছে।শেফালী শিউলিকে বললো,
—-কোনো টেনশন নিস না।তোদের প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসছে।ছেলে হোক আর মেয়ে হোক সেটা বড় কথা নয়।একটা সুস্থ সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর।
জাবেদও শেফালীর কথাতে একমত হয়ে বললো
—-আসলেই সবার আগে একটা সুস্থ সন্তান। এটাই আল্লাহ পাকের অনেক বড় নেয়ামত।
জাবেদ ওর মাকে বললো,
—–মা দোয়া কর আমাদের জন্য।আল্লাহপাক আমাদের যেন একটা সুস্থ সন্তান দান করেন।দেখ মা আবেদ ভাই তো তোমার ছেলে সন্তান।কিন্তু অসুস্থ হওয়ার কারণে সারাজীবন তুমি অশান্তিতে থাকলে।
তাই ছেলে হোক আর মেয়ে হোক আল্লাহপাক আমাদের যেন একটা সুস্থ সন্তান দান করেন।
মরিয়ম মুখে কিছু বললো না।তবে খুব আশাহত হলো।মুখটা খুব গম্ভীর হয়ে গেলো।মরিয়ম শেফালীকে বললো,
—-প্রথম সন্তানের জন্মের সময় মেয়েরা তো বাপের বাড়িতে চলে যায়।হাসপাতাল থেকে শিউলিকে কটা দিনের জন্য তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাও।শিউলির মায়ের যত্নে কদিন থাকা হবে আর নাতনির যত্ন তোমার মা নিজের হাতে করতে পারলে তোমার মার ও অনেক ভালো লাগবে।
শেফালী মনে মনে ভাবলো কদিন আগে মার একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেছে।রাশেদের সামনে এসএসসি পরীক্ষা।শাহেদেরও পড়াশোনার ব্যস্ততা বেড়েছে।তারপর ও বললো,
—-জাবেদ আর শিউলি যদি যেতে চায় আমাদের সবার খুব ভালো লাগবে।মা অনেক খুশী হবে।
মরিয়ম মনে মনে ভাবলো,সিজার করে নবাবজাদীর বাচ্চা হবে।ওর খেদমত আমি করতে পারবো না।যার মেয়ে সে ঠেলা সামলাক।
সনোগ্রাফি করে জানা গেলো শিউলির মেয়ে হবে।রাত আটটায় সিজার করে শিউলির কন্যা সন্তান হলো।প্রথম মা হওয়ার অনুভূতীতে শিউলি খুব খুশী।পরীর মতো ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান হয়েছে।জাবেদ ওকে টাওয়েল দিয়ে বুকে পেঁচিয়ে নিলো।জাবেদ মেয়েকে ওর মায়ের কোলে দিলো।আসলে এতো সুন্দর হয়েছে মরিয়ম মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলো না।তবে খুব একটা উচ্ছাস ও প্রকাশ করলো না।সারারাত শেফালী মরিয়ম আর জাবেদের কোলে বাচ্চাটা থাকলো।পরদিন সকাল আটটায় শিউলিকে কেবিনে দিলো।তুলি ও হাসপাতালে এসেছে নতুন অতিথিকে বরন করে নিতে।জাবেদের মা জাবেদকে বললো,
—তুই ও আমার সাথে বাড়ি চল।কাল থেকে তোর উপর যা ধকল গেলো।শেফালীতো এখানে আছে।কোনো কিছুর দরকার পড়লে ও সামলে নিতে পারবে।
—-মা এটা কি করে সম্ভব। সন্তানতো আমার।আমি ওকে হাসপাতালে ফেলে রেখে কিভাবে যাই।তুমি তুলির সাথে বাড়ি চলে যাও।
মরিয়ম মনে মনে জাবেদের উপর খুব বিরক্ত হলো।তারপর তুলিকে সাথে নিয়ে বাসার পথে রওয়ানা হলো।গাড়িতে উঠে তুলিকে বললো,
—-তোর ভাইয়ের আদিখ্যেতা দেখ।দুনিয়াতে উনি একাই যেন বাচ্চার বাপ হলেন।আরে হয়েছে তো মেয়ে সন্তান। সারাজীবন টাকার শ্রাদ্ধ হবে।
তুলি বললো,
—-মা আমি কি সারাজীবন তোমার টাকার শ্রাদ্ধ করেছি?
মরিয়ম বললো,
—তা নয়তো কি?এইতো ইন্টার পাশ করলে একগাদা টাকা খরচ করে তোমায় বিয়ে দিতে হবে।
মরিয়ম চলে যাবার পর শেফালী শিউলিকে বললো,
—-তুই বাড়ি যেতে চাইলে কোনো সমস্যা নেই।মাকে বলবো আমার রুমটা গুছিয়ে রাখতে।আমি আর মা একরুমে থাকবো।আর যেতে না চাইলে মাকে তোর সাথে পাঠিয়ে দিবো।তোর একটু আরাম হবে।আমি বাড়ির সব কিছু সামলে নিবো।
শিউলি মনে মনে ভাবলো, মাকেই বরং সাথে করে নিয়ে গেলে ভালো হয়।মা তো কখনও কোথাও বেড়াতে যেতে চায় না এই সুযোগে মার একটু বেড়ানো হবে।
শিউলি ওর মাকে নিয়ে কুমিল্লায় যেতে চাইলে জাবেদ ও খুশী হয়।শিউলির মা কখনও মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাননি এই সুযোগে যদি ওনার যাওয়া হয় জাবেদের অনেক ভালো লাগবে।
অবশেষে শিউলি আর জাবেদ হাসপাতালের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শিউলির মাকে সাথে করে নবজাতক সহ ওরা কুমিল্লায় রওয়ানা হলো।শিউলির মাকে দেখে মরিয়ম মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।তারপরও কাষ্ঠ হাসি উপহার দিয়ে বললেন,
—বেয়াইন আসছেন খুব খুশী হইছি।মেয়ের সংসারটা দেখা হবে। নিজ হাতে মেয়ের সেবাযত্ন করতে পারবেন।
শিউলির মা সাদাসিদা মানুষ।জাবেদের মার কূটকচাল ধরার সাধ্য উনার নাই।জাবেদ শাশুড়ীকে ওদের বেডরুমে শিউলির সাথে থাকতে বললেন।জাবেদের ও ছুটি ফুরিয়ে আসছে।অফিসে জয়েন করতে হবে।প্রায় নয় দিন ছুটি কাটানো হলো।শাশুড়ী আসাতে ভালোই হলো।শিউলিকে সঙ্গ দিতে পারবে।
আজ রবিবার।জাবেদ খুব ভোরে বউ বাচ্চার কাছে বিদায় নিয়ে অফিসের পথে রওয়ানা হলো।সকালে শিউলির শাশুড়ী সবাইকে চা বানিয়ে দিলো।শিউলির মাও ওর শাশুড়ীকে সাহায্য করলো।দুদিন পর শিউলির ননদ অস্টেলিয়া থেকে মেয়ে নিয়ে একাই চলে আসলো।জামাই পরে আসবে।
সবাইমিলে বেশ পিকনিকের আমেজে দিন পার হতে লাগলো।সকালের চা নাস্তা শিউলির ননদ আর শাশুড়ী বানায়।দুপুরের রান্নাটা শিউলির মা একাই সামলে নেয়।যদিও খাবার সময় শিউলির শাশুড়ী নানা বাহানা করে।শিউলির শাশুড়ী শিউলির মাকে বলে,
—-বেয়াইন তরকারীতে এতো তেজপাতা দারচিনি এলাচ দেন কেন।এতে তো অনেক খরচ হয়।
জুলি বলে,
—মা ভালোই তো লাগে।আন্টির রান্না আমার কাছে খুব মজা লাগে।আন্টির কাটামশলার রান্না বেশ স্বাদ।পিয়াজ রসুন কেটে দিয়ে শুধু আদাটা একটু বাটা দেয়।এছাড়া দারচিনি এলাচ তেজপাতা ঝিরা ভেজে বেটে দিয়ে একবারেই চুলায় চাপিয়ে দেয়।তারপর আস্তে আস্তে মাংসটা সিদ্ধ হয়। মশলাটাও সিদ্ধ হয়ে যায়।আন্টি এভাবেই রান্না করেন।আমার খুব ভালো লাগে।
মরিয়ম বেয়াইনের রান্নার প্রশংসায় মনে মনে বেয়াইনের উপর ক্ষেপে গেলেন।
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার।জাবেদ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসে দুপুরের খাবার খেতে বসলো।শিউলির মা গরুর মাংস ভূনা, পটল ভাজি,পুটি মাছের ঝাল চচ্চড়ি দিয়ে খুব মজা করে ভাত খেলো।খুশীতে গদগদ হয়ে শাশুড়ীকে বললো,
—-মা আপনার হাতে জাদু আছে।রান্নার এতো স্বাদ।
মরিয়ম ঘর থেকে ছেলের কথা শুনতে পেলো।এর শোধ তো ওনাকে তুলতে হবে।
শিউলিদের বাসায় চা বিস্কিট মেহমানদের দেওয়া হয়।ওরা খাওয়ার পর অবশিষ্ট যেগুলো থাকে সেগুলো কাজের খালাকে চা দেওয়ার সময় দিয়ে দেওয়া হয়।বিকালে চা দেওয়ার সময় শিউলি দেখতে পেলো শাশুড়ী ওই বিস্কিট দিয়ে শিউলির মাকে রুমে চা দিয়ে যায়।শিউলি রাগে অপমানে বিস্কিটগুলো ফেলে দেয়।আর জাবেদকে বলে কালসকালেই মাকে যেন লালবাগ পৌছে দিয়ে আসে।জাবেদও কিছু বুঝতে পারলো না।তবে ঝামেলা একটা হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে।
শিউলির মা যেতে চাচ্ছে।সংসার ফেলে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।তাই উনিও মনে মনে খুশী হলেন।
পরদিন খুব ভোরে জাবেদ শাশুড়ীকে নিয়ে লালবাগে রওয়ানা হলো।মা চলে যাওয়ার পর শিউলি শাশুড়ীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-মা আপনি আমাকে কারনে অকারনে অপমান করেন আমি সয়ে নিয়েছি।কিন্তু আমার মায়ের সাথে এমনটা কেন করলেন?
শিউলি জুলিকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—আপু মা উচ্ছিস্ট খাবার গুলো আমার মাকে কিভাবে দিলো? মা নিজে তো ঐ খাবার গুলো খান না।কাজের খালা চা খেতে চাইলে খালাকে বিস্কিট গুলো দেওয়া হয়।আর সেই বিস্কিটগুলো মা আমার মাকে কিভাবে দিলেন?আজকে যদি আপনার শ্বশুর বাড়িতে মার সাথে এরকম করা হতো মার কেমন লাগতো?
জুলি মাকে বললো,
—–মা তুমি কাজটা ঠিক করো নাই।আন্টি জানলে তুমিই আন্টির কাছে ছোটো হয়ে যেতে।
তবে এই পৃথিবীতে যারা অন্যকে অপমান করে আনন্দ পায় সে নিজের অজান্তে আল্লাহর দরবারে তার অপমানের পথটা তৈরী করে নেয়।এই কথা বলে শিউলি নিজের রুমে গিয়ে শপথ নেয়,ও ওর মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলবে যাতে ওর মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ওর মেয়েকে অপমান করার সাহস যেন কেউ না পায়।
চলবে