জীবনের নানা রং পর্ব-১৮

0
986

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৮
মাহাবুবা বিথী

রাহেলা বেগম শিউলির সংসার থেকে ঘুরে আসার পর শেফালি মাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-মেয়ের সংসার কেমন দেখলে?
রাহেলা বেগম বললো,
—শাশুড়ীটার একটু সমস্যা আছে।বেশীরভাগ শাশুড়ী যেমন হয় শিউলির শাশুড়ী ও তেমন।তবে জাবেদ শিউলির দিকে খেয়াল রাখে।মেয়ে মানুষের এটাই শান্তি।নীলকন্ঠের মতো সংসারের সব বিষ পান করে নারীরা অকাতরে হজম করে নেয় যদি স্বামীরা পাশে থাকে।আল্লাহর কাছে দোয়া করি জাবেদ যেন সারাজীবন এভাবেই শিউলির পাশে থাকে।

রাশেদ সিজিপিএ 4 পেয়ে কমার্স থেকে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলো।শাহেদ 3’5 পেয়ে এইচএসসি পাশ করে কোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে নিজের জায়গা করে নিতে পারলো না।ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আন্ডারে একটা সরকারি কলেজে মার্কেটিং এ অনার্স কোর্সে ভর্তি হলো।
শেফালীদের বাসায় এর মাঝে আর এক ঘটনা ঘটলো।শাহেদ ওদের এলাকার এক নামকরা ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে পালিয়ে বিয়ে করলো।
ঐ মেয়ের নাম নীলা।

মেয়ের বাবা বড় ধুরন্ধর। মেয়ের সাথে বাবা ফোনে যোগাযোগ করে বললো,
—-নীলা তোদের বিয়েটা আমি মেনে নিয়েছি।তুই মা বাড়ি চলে আয়।আর জামাইকে ওদের বাড়ি চলে যেতে বল।পরে অনুষ্ঠান করে তোদের আবার বিয়ে দিবো।
নীলা বাবার কথা বিশ্বাস করে বাড়ি চলে যায়।শাহেদ ও বাড়ি ফিরে আসে।শেফালী শাহেদের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়।সংসারের চর্তূমুখী ঝামেলায় শেফালীর নাভিশ্বাস।তারউপর নতুন করে আর এক ঝামেলা।নীলার বাবা রতন মোল্লাকে শেফালী ভালো করেই চেনে।এতো সহজে শাহেদকে উনি ছেড়ে দিবেন না। সেইদিন রাত দুইটায় শেফালীদের বাসায় পুলিশ এসে দরজায় নক করে। শেফালী দরজা খুলে পুলিশকে বললো,
—–কাকে চাই
পুলিশ বললো
—-শাহেদ বাসায় আছে। শাহেদের নামে নারী অপহরনের মামলা হয়েছে।ওর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে।
শাহেদ শেফালীর হাত ধরে বললো,
—-আপু আমি আর নীলা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি।নীলাকে আমি জোর করে বিয়ে করিনি।আর ওতো সাবালিকা।
পুলিশ সব শুনে বললো,
—-আপনি যা বলার আদালতে বলবেন
শাহেদ শেফালীকে বললো,
—-আপু তুই কিছু একটা ব্যবস্থা কর।তা না হলে আমাকে জেলে পঁচে মরতে হবে।
এসব দেখে রাহেলা বেগম হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। শাহেদকে ভ্যানে উঠিয়ে পুলিশ থানায় নিয়ে গেলো।শেফালী কি করবে কার কাছে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না।
সারারাত শেফালী আর রাশেদ ঘুমাতে পারলো না।রাহলা বেগম শেফালীকে বললো
—-শেফালী আমার ছেলেটার কি হবে?ওরা তো মনে হয় আমার ছেলেটাকে অনেক অত্যাচার করবে।
শেফালী রাহেলা বেগমকে বললো,
—-মা এখন তো অনেক রাত।সকাল হোক আমি থানায় যাবো।তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।তোমার শরীর সুস্থ থাকা দরকার।
শেফালী রাহেলা বেগমকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

সকাল হওয়ার পর শেফালী ভাবলো, ওর বড় দুলাভাই রমজানকে শাহেদের বিষয়টা জানানো যাবে না।উনি সাথে সাথে উনার মাকে জানিয়ে দিবেন।ছোটোবেলায় বাবা মারা যাওয়াতে রমজানের মায়ের সাথে সখ্যতা বেশী।সে ক্ষেত্রে জাবেদকে জানালে বিষয়টা গোপন থাকবে।শেফালী জাবেদকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বললো।জাবেদ ঢাকাতেই ছিলো।খুব দ্রুত শেফালীদের বাসায় পৌঁছে গেলো।শেফালী ওকে শাহেদের পুরো বিষয়টা জানালো।তারপর দুজন মিলে থানায় গেলো।থানার ওসি ওদেরকে জানিয়ে দিলো শাহেদকে কোর্টে চালান করা হবে।কোর্ট থেকে ওদের জামিন নিতে হবে।
রাহেলা বেগম বাসায় কান্নাকাটি করতে লাগলো।শেফালী মাকে কিছু বললো না।মনে মনে ভাবলো মা কোনোদিন তার ছেলেদের শাসন করেনি।শেফালী যখনি কিছু বলতে গিয়েছে মা ছেলের দিকে ঝোল টেনেছে।মার এই আচরণে শেফালী খুব আহত হতো।এসব বিষয়ে কথা বললেই মন কষাকষি হয়।তাই শেফালী কিছু বলতো না।এখন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় সেই চিন্তায় শেফালীর নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।জাবেদ আশ্বাস দিয়েছে ভালো একটা উকিল যোগাড় করবে।দেখা যাক কি হয়?

শেফালী আর জাবেদ মিলে উকিল জমির ভুঁইয়ার সাথে দেখা করতে যায়।শেফালী উকিলকে বলে
—-জমির সাহেব শাহেদের জামিনটা করানো যাবে না
উকিল বললো,
—নারী অপহরনের মামলা দিয়েছে।বেশ শক্ত মামলা।আদালতে নীলার স্বাক্ষীর উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।তবুও আমি আমার সর্ব্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো।
শেফালী উকিলের সাথে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাসায় চলে আসলো।জাবেদ অফিসে চলে গেলো।এই দুঃসময়ে শেফালীর একেকটা দিন একটা বছরের মতো দীর্ঘ মনে হতে লাগলো।

দুদিন পর কোর্টে জাবেদ আর শেফালী হাজির হলো।শেফালীর শাহেদকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হলো। পুলিশ কি ওকে না পিটিয়ে রেখেছ?আল্লাহপাক জানে ওর কি হাল হয়েছে।আদৌ আজকে জামিন হবে কিনা শেফালী জানে না।

কোর্টে মামলার শুনানীর সময় নীলা বলে ও শাহেদের বিবাহিতো স্ত্রী।শাহেদ ওকে অপহরন করেনি।ও স্বেচ্ছায় শাহেদের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে।ওর বাবা শাহেদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।

নীলার স্বাক্ষীর কারনে শাহেদের মামলা খারিজ হয়ে যায়।আদালত থেকে নীলা আর শাহেদকে সাথে নিয়ে জাবেদ আর শেফালী বাসায় ফিরে আসে। রাহেলা বেগম ছেলেকে আর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।শাহেদ মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–মা,নীলার স্বাক্ষীর কারণে আমি কোর্ট থেকে ছাড়া পেলাম।
রাহেলা বেগম বললেন,
—–ওতো আমার ঘরের বউ।এ বাড়ির মান সম্মান রক্ষা করা তো ওর দায়িত্ব।
শেফালী অবাক হয়ে মা ছেলের কথপোকথন শুনলো আর অবাক হয়ে ভাবলো,আজকে কয়েক রাত্রি ওর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলো।মা, শাহেদ বেমালুম ভূলে গেলো।এতকাল ওর মায়ের সম্মান এ বাড়ির সম্মান ও বুক দিয়ে আগলে রাখলো সেটাও আজ নতুন বউয়ের আগমনে মূহুর্তে চাপা পড়ে গেলো।

যাক বুকের কষ্ট বুকে পাথর চাপা দিয়ে
শেফালী ওর জন্য বানানো বিয়ের গয়না দিয়ে রাহেলা বেগমকে বউ বরণ করে নিতে বললো।এই অল্প সময়ে শেফালী শাহেদের রুমটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেয়।রমজানকেও ফোন দিয়ে ডেকে আনে।শাহেদ আর নীলা গিয়ে শাহেদের দাদার কাছে দেখা করে দোয়া নেয়।শাহেদের দাদার শরীর খুব অসুস্থ ।

শিউলি আর সরুপার বাচ্চা ছোটো।ওরা আসতে পারেনি।শেফালী রাহেলা বেগমের তরফ থেকে সবাইকে জানিয়ে দেয় শাহেদ আর নীলার বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় সবাইকে দাওয়াত দিবে।সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জাবেদ কুমিল্লায় রওয়ানা হয়। আগামীকাল জুলির জামাই অস্টেলিয়া থেকে কুমিল্লায় আসার কথা।জাবেদকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
জাবেদ মনে মনে শাহেদের উপর বিরক্ত হয়।সংসারের সব দায়িত্ব শাহেদ সুকৌশলে শেফালীর উপর চাপিয়ে দেয় নিশ্চিন্তভাবে জীবন যাপন করে।একটা বিয়ে করলো সে ঝামেলাও শেফালীকে বয়ে বেড়াতে হলো।মনে মনে জাবেদ শেফালীকে শ্রদ্ধা করে।শেফালী পুরো পরিবারের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে মাকে সাহায্য করা, বিবাহিতো দুবোনের বিপদে পাশে দাঁড়ানো, সব সময় ছায়ার মতো ভাইদের পাশে থাকা।অনেক পূন্যে এরকম বোন পাওয়া যায়।

আজকে পূর্ণ শশীর জোৎস্না।ছোটো ভাই শাহেদের ফুলশয্যা।বড় বোন শেফালী নিজের হাতে সাজিয়েছে ফুলশয্যার খাট।যদিও ওর জীবনে ফুলশয্যার রাত কোনদিন আসবে কিনা ও জানে না।কষ্ট পেলে শেফালী ছাদে এসে আকাশের ঐ বিশালতার কাছে নিজেকে মেলে ধরে।তখন ওর বেদনাগুলো হারিয়ে যায়।জীবন বড়ই বিচিত্রময়।জীবনের গতিও খুব অদ্ভূত। প্রয়োজনে শেফালীর মতো মেয়েদের সবাই ব্যবহার করে।প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পাশ কাঠিয়ে চলে যায়।শেফালীর মতো মেয়েরা সেই কষ্টগুলো বুকের গহীনে লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে অভিনয় করে যায়।সৃষ্টিকর্তা নারীদেরকে কষ্ট সহিবার ক্ষমতা অনেক বেশী দিয়েছেন।তাই জীবনভর কষ্ট সয়েও আপনজনের সুখের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়।দিনশেষে এদের আপনজন কেউ হয় না।এরা বড় নিঃসঙ্গ বড্ডো একা ওদের জীবন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here