জীবনের নানা রং পর্ব-৩

0
830

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-তিন
মাহাবুবা বিথী

রমজান শিউলিদের বাসায় এসে রাহেলা বেগমকে বললো,
—-মা সর্বনাশ হয়ে গেছে
শাশুড়ী বললো
—-ওদের মেয়ে পছন্দ হয়নি
—-মেয়ে পছন্দ হয়েছে মা তবে শেফালীকে না ওরা শিউলিকে পছন্দ করেছে।এখন আপনি কি শেফালীকে রেখে শিউলিকে আগে বিয়ে দিবেন?
—–আমি মা হয়ে এই সিদ্ধান্ত কিভাবে নেই।বাহিরের মানুষ তো ভিতরের খবর জানবে না।ওরা আমার নিখুঁত মেয়েটার গায়ে খুঁতের তকমা লাগিয়ে দিবে।
—-এতো ভাল পাত্র হাত ছাড়া করা কি ঠিক হবে মা?
—-আচ্ছা ছেলের ভাই নাকি পাগল।আমার মেয়েটাকে আবার মারধর করবে নাতো।
শাশুড়ীর দোদুল্যমান ভাব দেখে রমজান একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
—-আপনি আগে সিদ্ধান্ত নেন শিউলির বিয়ে এখানে দিবেন কিনা।পাগলের মামলা পরে বুঝবো।

পাশের রুম থেকে শেফালী আর শিউলি সব শুনতে পেলো।শেফালী আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো শিউলিকে পছন্দ করেছে শুনে ওর মুখটা লাজ রাঙ্গা হলো।আসলে প্রস্তাবটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।শেফালী ভাবে, বাবা মার দাম্পত্য জীবন দেখে ওরতো ছোটো বেলা থেকেই বিয়ের প্রতি অনাগ্রহ। প্রতিটি মানুষ রঙ্গমঞ্চে নয় জীবনমঞ্চে নিপুন অভিনয় করে যায়।ওর মাকে দেখে ওর তাই মনে হয়।কাল থেকে বাবা নামের লোকটাও বাড়িতে নেই।রাশেদ বাজার থেকে শুনে এসেছে কাকে নাকি বিয়ে করে বাজারের দিকে ঘর ভাড়া করে আছে।একান দুকান হতে যদি ছেলে পক্ষের কানে চলে গেলে বিয়েটা যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে মা অসুস্থ হয়ে পড়বে।শিউলিও তো বিয়ে করে সংসারী হতে চায়।ওর নাকি পড়াশোনা ভাল লাগে না।

শেফালী রুম থেকে বের হয়ে মাকে বললো,
—-মা,দুলাভাই ঠিকই বলেছে।এই প্রস্তাব হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।যে সব পরিবারের চালচুলো নেই সে সব বাড়ির মেয়েদের জন্য পাত্র খোঁজা অনেক কঠিন ব্যাপার।
—শেফালী তুমি খোঁচা ছাড়া কথা বলতে পারো না।
—-দুলাভাই এটা কি আপনার কাছে নতুন?আমি তো এভাবেই কথা বলি।তবে বিয়েটা তাড়াতাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
আসলে শেফালীও টেনশনে আছে বাপের কুকীর্তি যদি ওদের কানে চলে যায় তাই যত তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয় ততই মঙ্গল।শেফালী চলে যাওয়ার পর রমজান মিয়া শাশুড়ীকে বললো,
—-মা আপনার এখন আর চিন্তা নেই।বিয়ের পাত্রীর লেটাতো চুকলো। বিয়ের আয়োজন শুরু করতে হয়।আমি ছেলে পক্ষকে জানিয়ে দেই আপনার শিউলির বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।
শেফালী রুমে গিয়ে শিউলিকে বললো,
—-বিয়ের বয়স না হতে বোন তুই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছিস।নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করিস।অল্প বয়সি আবেগ গুলো নিয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলোর খেলতে সুবিধা হয়।আর একটা কথা জেনে রাখিস যে সব মেয়েদের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকে না তারা শ্বশুর বাড়িতে হয় চাকরানী
আর যাদের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকে তারা হয় রাজরানী।এই কথা বলে শেফালী শিউলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।শিউলি ও কাঁদতে কাঁদতে বোনকে বললো,
—-মেজো আপু নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে।তোর কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভাবলাম।
—ধূর পাগলী এসব কথা মাথায় আনবি না।আমার আশে পাশের মানুষগুলি বিয়ে করে কেউ সুখী না।আর বিয়ের প্রতি আগ্রহ তো আমার কোনোকালেই ছিলো না।তুই বিয়ে করে সুখী থাক আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি। বিবাহিত জীবন সামলাতে পারবি কিনা এটা ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে।
রমজান ছেলের বাড়িতে ফোন দিয়ে ওর শাশুড়ীর মতামত জানিয়ে দিলো।
আফসার মিয়া মানে জাবেদের বাবা ওর মাকে বললো,
—-জাবেদের মা ওরা বড় বোনকে রেখে ছোটো বোনকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে।
—-আমি বলেছিলাম না ওরা ঠিক রাজি হবে।ওর বাপের যা কেচ্ছা ওই বাড়ি থেকে কে মেয়ে আনবে বলো?আমার আবেদটা পাগল বলে আমরা ও বাড়িতে গিয়েছি।পাগলের বাড়িতে কেউ মেয়ে দিতে চায় না।
—-এ কথাটা সব সময় মাথায় রেখো।তোমার তো মুখের জবান চেঞ্জ হতে এক মূহুর্ত লাগে না।মেয়েটাকে বউ করে এনে আবার কষ্ট দিও না।ও এমনিতেই কষ্টে পোড়া মেয়ে।
—-তোমার দরদ মনে হয় এখনি উথলে উঠছে জাবেদের বাবা
—-জাবেদের মা তোমাকেতো আমার চেয়ে কেউ ভালো চেনে না।
আফসার মিয়া জাবেদকে জানিয়ে দিতে ফোন দিলেন
—-জাবেদ ওরা মত দিয়েছে।তুই তো মেয়েটাকে দেখিসনি মেয়েটাও তোকে দেখেনি।কুমিল্লা থেকে বার বার যাওয়া সম্ভব না।তুই বরং মতিজিল থেকে কোনো রেস্টুরেন্টে মেয়েটার সাথে দেখা কর।
—-মাকে বলেছো।
—–এতো মা মা করিস না।তাহলে বিবাহিত জীবন চালিয়ে নিতে তোর কষ্ট হবে।এখন থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিবি।
—-তবুও বাবা মাকে ফোনটা দাও আমি কথা বলে নেই।
আফসার মিয়া জাবেদের মাকে ডেকে ফোন হাতে ধরিয়ে দিলেন
—-হ্যালো মা,বাবা বলছিলো শিউলির সাথে দেখা করতে।তুমি কি বলো?
—-আবেদকে বাড়িতে রেখে আমাদের বারবার যাওয়া সম্ভব না।তুইতো মেয়েটাকে দেখিসনি।ওর দুলাভাইকে বলো একটা রেস্টুরেন্ট ঠিক করে শিউলিকে নিয়ে আসতে।তুই গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আয়।
—-ঠিক আছে মা,আমি রাখছি।
জাবেদ ফোনটা রেখে রমজান মিয়াকে ফোন দিয়ে শিউলিকে দেখানোর বিষয়টা জানিয়ে দিলো।

রমজান মিয়া শাশুড়ি রাহেলা বেগমকে ফোন দিলো
—-হ্যালো আম্মা,জাবেদ তো শিউলির সাথে দেখা করতে চায়।আগামীকাল বৃস্হপতিবার।কোনো সমস্যা না থাকলে শিউলিকে কালকে দেখানোর ব্যবস্থা করি।
—-ঠিক আছে রমজান।যেটা ভালো হয় সেটা করো।
—আমি সরুপার সাথে কথা বলে রেস্টুরেন্ট ঠিক করি।
রমজান কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলো।

রাহেলা বেগম ফোন রেখে বাহিরে হাঁকডাক শুনতে পেলো।শেফালীর বাবার গলার আওয়াজ মনে হয়

—–ওই মাগী বাড়িত থেকে বাহির হ।আমার বাপের সম্পত্তি আমি ভোগ করুম।তুই কোন বান্দীর মাইয়া আমার সম্পত্তি ভোগ করতে আইছোস।আমার বাপেরে ভূলাইয়া সম্পত্তি নিজের নামে লেইখা নিছোস।আমার ভাগ না পাইলে বাড়ি ঘরে আগুন লাগাইয়া দিমু।

বাপের গলার আওয়াজ পেয়ে শেফালী বের হয়ে আসলো।
—-এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।চিৎকার চেঁচামেচী করবা না।আমার মাকেও গালি গালাজ করবা না।তোমার সন্মান না থাকতে পারে আমাদের বংশের একটা সন্মান আছে।সম্পত্তি তোমার বাবা লিখে দিয়েছে।তােমার পাওনা তোমার বাবার কাছে বুঝে নাও।আর একবার ঝামেলা করলে আমি ভূলে যাবো তুমি আমার বাবা।তোমার মতো এই একটা মানুষের জন্য আমরা ছয়টা জীবন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি।

আক্কাস মিয়া তার এই সন্তানটাকে একটু সামজে চলেন।গজগজ করতে করতে শেফালীর দাদার কাছে চলে গেলো।টাকা ছাড়া তার তো জীবন চলে না।

শেফালীরা প্রতিদিন বাবা নামক আতন্কের সাথে বসবাস করতে হয়।শেফালী ভাবে,প্রতিদিন এতো মানুষের মরণ হয় এই মানুষটার মরণ হয় না কেন?

বিকেল বেলা শেফালী মাকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে শিউলির জন্য খুব সুন্দর একট থ্রীপিচ কিনলো।আগামীকাল জাবেদের সাথে ওর প্রথম দেখা হবে।জামার সাথে ম্যাচ করে স্যান্ডেল কিছু জুয়েলারী কিনে সন্ধের আগেই রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। যাবার পথে বাজারে নিজেদের দোকান হয়ে গেলো।দোকানে ভালোই ভীড়।অথচ রমিজ টাকা দেয় না।

ছোটো বেলা থেকেই বাবা মার ঝগড়াঝাটি দেখেছি।বাবার লাটির আঘাতে মাকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছি।সেই পরিবারের মেয়ে শেফালী।স্বপ্ন দেখতে বড্ডো ভয় পায়।শেফালী বিয়ে করতে চায় না মায়ের সংসারটা আগলে রাখার জন্য।ও খুব অবাক হোলো রাশেদ শাহেদও কিছু বললো না।ওর আগে শিউলির বিয়ে হচ্ছে।এটাই মনে হয় হওয়ার ছিলো ওরা আগেই ভেবে নিয়েছে।ভাই হলেও ওরাও তো পুরুষ মানুষ।ঘাড় থেকে যত তাড়াতাড়ি বোঝা নামানো যায় ততই ওদের রাস্তা পরিস্কার হয়ে যায়।এই বর্তমান দুনিয়ায় কটা ভাই বোনকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।আমার ফুফুরাই তো সম্পত্তির ন্যায্য হক বুঝে পায়নি।বোনকে বেশির ভাগ ভাই বোঝা মনে করে।তবুও ভাই বোনদের শেফালী বুক দিয়ে আগলে রাখবে। আখেরে কি প্রাপ্তি হবে সে হিসেব শেফালীর মতো মেয়েরা রাখে না।রিকশাটা মাগরিবের আগেই বাসায় পৌছে গেলো।
—মামা ভাড়াটা রাখেন
শেফালী বাসায় পৌছে মাগরিব পড়ে নিলো।তারপর মার ঘরে গিয়ে শিউলিকে ডেকে পাঠালো।
—–আপু আমাকে ডেকেছো
—-হ্যা,দেখতো জামাটা পছন্দ হয়েছে কিনা
—-খুব সুন্দর জামা।আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
—আর এই নে জুয়েলারী আর স্যান্ডেল
শিউলি জামা কাপড় নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
—মা রাশেদ বাসায় ফেরেনি
—-না এখনও ফেরেনি।চলে আসবে চিন্তা করিস না।
কোচিং করে আসবে বলেছে।
—-শাহেদ কলেজ থেকে ফিরেছে মা।
—-ও কোচিং করে বাসায় ফিরবে।
ভাইদের নিয়ে শেফালীর খুব চিন্তা হয় ভয় ও হয়।যদি ওরা বাবার মত পশুর স্বভাব পায় শেফালী কি করে এই সংসার আগলে রাখবে।ঘরে কোনো যুবতী কাজের মেয়ে রাখে না।সবসময় বয়স্ক খালা রাখে।যদিও বেশির ভাগ কাজ শেফালী আর শিউলি মিলে করে ফেলে।ভাই দুটোকে মানুষের মতো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।এজন্য প্রচুর টাকার দরকার।বাজারের দোকানটা নিয়ে শেফালী খুব চিন্তায় আছে।শাহেদকে বলবে ছুটির দিনগুলিতে দোকানে বসতে।ইদানিং রমিজ টাকাপয়সা আগের থেকে কম দেয়।জিজ্ঞাসা করলে বলে বিক্রী হয় না।অথচ আজ বাজারে গিয়ে আড়াল থেকে দেখেছে দোকানে ভালো ভীড় ছিলো।

আটটার দিকে দুই ভাই বাসায় ফিরে আসলো।শেফালী ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলো
—–কিরে তোদের এতো দেরী হলো কেন।সন্ধার আগেই তো বাসায় ফেরার কথা।
রাশেদ বললো
—-আপু স্যার কোচিং এ আসতে দেরী করেছে।
শেফালী শাহেদকে বললো,
—-ছুটির দিনগুলিতে তুই দোকানে বস।রমিজ যা শুরু করেছে দুদিন পর দোকান লাটে উঠবে।শিউলির বিয়েতে অনেক খরচ আছে।গয়নাটা যদিও বানানো আছে তারপরও বিয়ে শাদিতে খরচের কোন হিসাব থাকে না।
—-ঠিক আছে আপু।ক্ষিদে লেগেছে খেতে দাও।
শেফালী ওদের কে খেতে দিয়ে শিউলির কাছে গিয়ে বসলো।শিউলিকে দেখতে এখন যেন আরও বেশি সুন্দর লাগে।বিয়ের পানি গায়ে পড়লে মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায়।পাশাপাশি ভয় ও হয় শিউলি শ্বশুর বাড়িতে নিজেকে আগলে রাখতে পারবে তো?কারন অল্প বয়সি মেয়েদেরকে শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলো নিজেদের মতো গড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এতে যদি মেয়েটার জীবনটা পুড়ে খাক হয় তাতেও কোন সমস্যা নেই।
জীবনের পথ কাঁটায় মোড়ানো থাকে।তাই শেফালী ভাবে ও যদি বিয়ে করে মা ভাই ওদের কে দেখবে।ভাই দুটো এখনও অনেক ছোটো।মাতো সারাজীবন লড়াই করে জীবনযুদ্ধের ময়দানে পরিশ্রান্ত এক যোদ্ধা।মার পাশে থাকাটা ওর খুব দরকার।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here