জীবনের নানা রং পর্ব-৯

0
614

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-নয়
মাহাবুবা বিথী

খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় শিউলির।পাশ ফিরে দেখে জাবেদ ঘুমিয়ে আছে।বিছানা থেকে উঠতে যাচ্ছে হঠাৎ আচমকা জাবেদ ওকে জড়িয়ে ধরে শুইয়ে দেয়।শিউলি জাবেদকে বলে,
—-ছেড়ে দাও। আমাকে গোসল করতে হবে।এরপর উঠলে দেরী হয়ে যাবে।
—-ঠিক আছে।আর দশ মিনিট থাকো।কাল থেকে তো ঢাকায় গিয়ে অফিস করতে হবে।তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।বিয়ের আগে তো এমন লাগতো না।বরং ঢাকায় গিয়ে অফিস করতে ভাল লাগতো।এখন তোমায় ছেড়ে ঢাকায় যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
শিউলি বললো,
—-আমরা সবাই মিলে তো ঢাকায় থাকতে পারি।
জাবেদ বললো,
—-তা পারি।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভাইয়াকে নিয়ে।ভাইয়ার মাথা বেশি খারাপ হলে জিনিস পত্র ভেঙ্গে ফেলে।জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে।যে বাসায় ভাড়া থাকবো ওরা তো এধরণের পরিবারকে ভাড়া দিতে চাইবে না।তাই আমি কুমিল্লায় আমাদের কিছু জমি বিক্রি করেছি।ব্যাংক থেকে কিছু লোন নিয়েছি।সবাই মিলে একসাথে থাকার জন্য দুহাজার স্কয়ার ফিটের ফ্লাট বুকিং দিয়েছি।তুমি মায়ের সাথে কিছুদিন মানিয়ে চলার চেষ্টা করো।আমাদের সন্তান হলে ওদেরকে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি করে দিবো।তখনতো ঢাকায় থাকতে হবে।আর ভাইয়ার কাছ থেকে একটু সাবধানে থেকো।

শিউলি বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গোসল করে নিলো।ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনী করার সময় গলার কাছে জাবেদের সোহাগের চিহ্নটা দেখতে পেলো।শাড়ির আঁচলে ঢেকে রান্না ঘরে গিয়ে চুলায় চায়ের হাড়ি চাপিয়ে দিলো।শাশুড়ি একসময় এসে শিউলির আপাদমস্তক দেখে গেলো।সবাইকে চা দিয়ে নাস্তা বানানো শুরু করলো। কাজের খালাও চলে এসেছে।তুলি এসে বললো,
—ভাবি আমাকে তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও।বিয়ের ঝামেলায় কলেজে যেতে পারিনি।আজ যেতে হবে।সামনে পরীক্ষা আছে।
—তুমি টেবিলে বসো আমি নাস্তা দিয়ে দিচ্ছি।
জাবেদও এসে টেবিলে বসলো।শিউলি টেবিলে নাস্তা দিলো।জাবেদের বাবা শিউলিকে ডেকে বললো,
—-তুমিও আমাদের সাথে বসে যাও
—-হ্যা বাবা আসছি।
শিউলি রান্নাঘরে গিয়ে কাজের খালাকে নাস্তা দিয়ে সবার সাথে বসে নাস্তা করে নিলো।

শিউলির দুপুরের রান্না শেষ করে দুটোর মধ্যে টেবিলে খাবার দিয়ে দিলো।শিউলিও ওদের সাথে খেতে বসলো।শাশুড়ি খাবার মুখে তুলে বললেন,
—-শিউলি তরকারীর লবনটা দেখে দাওনি?
—আন্দাজ করে লবন দিয়েছি।কেন মা লবন কম হয়েছে?
—-তরকারী নামিয়ে ফেলার আগে দেখে নিতে হয়।লবন ঠিক আছে কিনা।লবন কম হলে খাবারের স্বাদ হয় না।কথায় আছে”আল্লির নেই স্বাদ আর পরের নেই দয়া”
—কথাটা শিউলির বুকে বিঁধলো।নিজের চেনা আপন জগত ছেড়ে শ্বশুর বাড়িটাকে ও আপন করে নিলো।ওকেই প্রতিনিয়ত সবার সাথে মানিয়ে চলতে হচ্ছে।তারপরও হয়তো সারাজীবন ভর এবাড়িতে ওর পরিচয় পরের বাড়ির মেয়ে। এটাই নারীর কপালের লিখন।

এঁটোবাসন রান্নাঘরে গুছিয়ে রেখে শিউলি বেড রুমে আসলো।জাবেদ শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো।শিউলিও এসে খাটের একপাশে বসে জাবেদকে বললো,
—-কালকে তো ঢাকায় যেতে হবে।তোমার কাপড়গুলো গুছিয়ে দেই।
জাবেদ বললো,
—–আমি নিজেই গুছিয়ে নিয়েছি।আমার নিজের কাজ আমি নিজে করতেই ভালবাসি। আমি আমার এই অভ্যাস বজায় রাখতে চাই।একবার তোমার উপর নির্ভর হয়ে গেলে তোমাকে কষ্ট দেওয়া হবে আর আমারও স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে।এমনি তো রান্না করা, সাংসারিক দায়িত্বের চাপ তোমার উপরে আছে।
একটু আবেগ মিশ্রিত গলায় জাবেদ শিউলিকে বললো,

—-শিউলি মার কথায় তুমি কষ্ট পাও জানি কিন্তু
মার জীবনটাও স্বাভাবিক গতিতে চলেনি।আমার বাবারা দুই ভাই।বাবা আমার দাদা দাদীর বড় ছেলে।দাদা দাদী বাবার কাছেই থাকতো।ভাইয়া বংশের বড় নাতী।ছোটবেলা থেকেই ভাইয়া মাঝে মাঝে পাগলামী আচরণ করে।পাগল ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য দাদী মাকে খোটা দিতো। অথচ ভাইয়া ছোটোবলায় পাগল ছিলো না।আস্তে আস্তে ভাইয়া অসুস্থ হয়।দাদী প্রচন্ড বদরাগী ছিলো।মাঝে মাঝে মার কাজে একটু ভুল হলে চড় থাপ্পড় দিতো।আর তখনকার সময়ে বউয়ের গায়ে চড় থাপ্পড় দেওয়া সমাজের চোখে দোষের ছিলো না।আমার মা গরীব ঘরের মেয়ে ছিলো।আর বাবাও প্রতিবাদ করতে পারতো না।প্রতিবাদ করলে দাদী বাবাকে স্ত্রৈন বলে গাল দিতো।দাদী আমাকে খুব ভালবাসতো।আমার জন্মের পর থেকে মাকে দাদী একটু আদর করতো।আমি ছোটোবেলা থেকেই মেধাবী ছিলাম।যার কারণে দাদী আমাকে খুব পছন্দ করতো। তবে দাদী মারা যাবার পর মা দাদীর মতো আচরণ করা শুরু করে।তবে দাদীর মতো আমার মার হাত চলে না তবে মুখে কটু কথা বলে।
শিউলি জাবেদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আর ভাবছিলো,
সংসার মানেই মনে হয় মানিয়ে নেয়া।ওর বাপের বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ।এখানে ঠিকে থাকতে না পারলে মা ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে হবে।লেখাপড়ার দৌড় খুব একটা নেই।শেফালী আপু অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে নেয়।এতো কষ্ট করে শিউলির লেখাপড়া চালানো সম্ভব না।তাই এই সংসারে ওকে ঠিকে থাকতে হবে।শিউলি নিজেকে যুক্তি দিয়ে বোঝায় ও যদি ওর শাশুড়ী ননদের খেয়াল রাখে তাহলে জাবেদের উচিত শিউলির মার ভাইয়ের খেয়াল রাখা।দুনিয়াটা তো দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে চলে।নিঃস্বার্থ ভাবে এই দুনিয়ায় কেউ কারো জন্য করে না।
জাবেদের ডাকে শিউলি সম্বিত ফিরে পায়।কি ব্যাপার কোথায় হারিয়ে গেলে।শিউলি জবাব দেয়
—-তুমি তোমার মার কথা বলছিলে তো তাই আমার মার কথা মনে পড়ে গেলো।আমার মাও অনেক দুঃখী। স্বামীর ভালবাসা কোনদিন তার কপালে জোটেনি।সৎমার সংসারে খেয়ে না খেয়ে
বড় হয়েছে। আমাদের বাড়িতে মার খাওয়াপড়ার অভাব হয়নি তবে ভালবাসাও পায়নি।মার সংসারের অশান্তি দেখে শেফালী আপুর বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।মার পাশে ও ছায়ার মতো থাকে।হয়তো এই কারণে বয়সের থেকে ওর ম্যাচিউরিটি অনেক বেশী।কিন্তু ভাই দুটোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়।সামনে শাহেদের এইচএসসি পরীক্ষা।
জাবেদ শিউলিকে বললো,
—-ওদেরকে নিয়ে চিন্তা করো না।আমারতো ছোটো ভাই নেই।ওদেরকে আমি আমার ছোটো ভাইয়ের মতো দেখবো।আমি আর আমার এক বন্ধু ট্রাভেলএজেন্সির ব্যবসা শুরু করবো।শাহেদ লেখাপড়া শেষ করে চাইলে আমার সাথে ব্যবসায় থাকতে পারে।
আসরের আযান দিলাে।দরজায় কে যেন নক করছে।শিউলি দরজা খুলে দেখলো তুলি দাঁড়িয়ে আছে।
—–ভাবি টেবিলে ভাতটা বেড়ে দাওনা।
শিউলি বললো
—–তুমি ফ্রেস হয়ে টেবিলে বসো।আমি আসছি।
শিউলি নামাজ পড়ে টেবিলে ভাত বেড়ে দিলো।ছাদ থেকে কাপড় তুলে ফেললো।কাজের খালাটাকে বিদায় দিলো।

মাগরিবের নামাজ পড়ে সবাইকে সান্ধকালীন চা দিলো।এরপর ডিনারের ব্যবস্থা করলো। কাল খুব সকালেই জাবেদ ঢাকার পথে রওয়ানা হবে।তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিতে হবে।চা খেয়ে জাবেদ আবেদের ঘরে গেলো।আবেদকে নিয়ে বাহিরে বের হলো।ঘন্টাখানিক আবেদ নিয়ে বাহিরে ঘুরে ঘরে আসলো।আবেদ খুশী হয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।
তাড়াতাড়ি ডিনার করে জাবেদ আর শিউলি শুয়ে পড়লো।রাতের মূহুর্তের কথা নাই বা জানা হলো।

পরদিন খুব ভোরে উঠে শিউলি গোসল করে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো।জাবেদের জন্য নাস্তা রেডী করে টেবিলে দিলো।নাস্তা খেয়ে জাবেদ রুমে আসলো।শিউলির কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে মা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছটার মধ্যে বাসা থেকে বের হলো।
জাবেদ চলে যাওয়ার পর শিউলি ভাবছে,এই সাতদিন বিছানাটা শেয়ার করে গুটিসুটি মেরে শুইতে একটু কষ্ট হয়েছে।আজকে পুরো বিছানাটায় হাত পা
ছড়িয়ে ঘন্টাখানিক শুয়ে থাকবে।কিন্তু ঘরে এসে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।জাবেদ ঘরে থাকলে ও একটা মিষ্টি সুবাসে অনুভব করে।সেই সুবাসের অভাবে ঘরেই মনটা বসলো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here