#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_১৯
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
দুর্বল পায়ে সেলিনা ছেলের ঘরে ঢুকলেন। দরজাটা চাপানো ছিল। তুষার ঘরে নেই। সেলিনা জানেন, ছেলে কোথায়। তিনি সোজা গিয়ে ঢুকলেন ঝুল বারান্দায়। এখন মধ্যাহ্ন। খানিক আগেই দুপুরের খাবার সেড়ে ফেলা হয়েছে। তুষার সে সময়ে অনুপস্থিত ছিল। বেশ কয়েকদিন ধরেই ও খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করছে। সেলিনা চোখে দেখলেও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এখন গুরুত্ব না দিয়ে পারছেন না। তার মন কামড়ে খাচ্ছে চিন্তের পোকা। এত আদরের ছেলেটার কি এমন হলো?
“তুষার…”
মায়ের গলা পেয়ে তুষার চট করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলল। সেলিনা বারান্দায় পা রাখলেন।
“তুই এখানে!”
তুষার মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করল।
“কিছু বলবে?”
“দুপুরে খেলি না…”
“সকালের নাশতাই তো পেট থেকে সরেনি। ক্ষিদে লাগলে খেয়ে নেবো। তুমি অসুস্থ শরীরে কেন আসতে গেলে?”
বারান্দাটি তুলনামূলক মাঝারি আকৃতির। এক পাশে বেশ কিছু ফুলের গাছ,পাতাবাহার রয়েছে। মেঝেতে বিছিয়ে রাখা একটি শীতলপাটি। তার উপর দুটো চতুর্ভুজাকৃতির বালিশ। এদিকটায় রোদ পড়ে ভালো। শীতের প্রহরে এখানে এসে শুয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। সেলিনা ছেলের পাশে পাটির উপরে বসলেন। তুষার হৈহৈ করে উঠে,
“আহ মা! নিচু হয়ো না। চলো বিছানায় বসি।”
“এখানে ভালো লাগছে বাবু। বসি কিছুক্ষণ।”
তুষার আর কিছু বলল না। সেলিনা বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নেন। তার হার্টে সমস্যা। বলা যায়, ওষুধের উপর জীবন চলছে। তাঁর জীবনে আর কোনো কিছু নিয়েই কোনো আশা ভরসা বা চিন্তা নেই একমাত্র তুষার ব্যতীত। তুষারের চিন্তায় তিনি দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার এই ছেলেটা ভীষণ চাপা স্বভাবের। যখন কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, নিজ থেকে বলে না। নিজের মতো করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ত্যাগ স্বীকার করে। তিনি তো মা, তাই তাঁকে আলাদা করে বোঝাতে হয় না। তিনি বুঝতে পারেন এবং ছেলের জন্য গোটা পৃথিবী এক করে ফেলেন। কিন্তু ইদানীং তিনি তুষার কে চিনতে পারছেন না। ছেলেটাকে অচেনা লাগে। বুকের ভেতর কি যেন চেপে রেখেছে। সেলিনার নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। এত আদরের ছেলের হৃদয়ের খবর সে জানেনই না!
“ওভাবে তাকিয়ে কি ভাবছো?”
তুষারের প্রশ্নে সেলিনার ধ্যান ভাঙে। তিনি মুচকি হেসে বললেন,
“কত বড় হলি, তাই দেখছি।”
“যত বড়ই হই, তোমার কাছে তো ছোট্ট বাচ্চাই।”
মায়ের কোলে গুটিশুটি মে*রে শুয়ে পড়ল ও। সেলিনার বেশ আদর লাগে। তিনি পরম মমতায় ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে চুলে ছোট ছোট টান দিতে লাগলেন।
“এরকম একটা পাটি আমার ঘরের বারান্দায় বিছাতে হবে। ভালো আরাম লাগে।”
“আমি কিনে নিয়ে আসবো?”
“আনিস।”
তুষার চুপ করে আকাশের দিকে তাকাতেই ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মায়ের শরীর ভালো না। তুষার জানে। ডাক্তার বলেছেন, তাকে যত কম উত্তেজিত করা যাবে ততই ভালো। যত কম দুশ্চিন্তা দেওয়া যাবে, ততই সে সবার মাঝে থাকবে। যত চিন্তা করবে তত দ্রুতই বিদায় নিতে হবে। এরপর থেকে মায়ের উপর দিয়ে কেউ কোনো কথাই বলে না। মা যা বলে, তাই। এই যে দোলা কে মা নিজে পছন্দ করলেন, তুষার কিচ্ছু বলেনি। আবার হ্যাঁও জানায়নি। সবসময় সময় চেয়ে এসেছে। দোলা বা মা-ও তাকে বিরক্ত করেনি। কিন্তু মনপুরায় গিয়ে…সব হিসেব এলোমেলো হয়ে গেল। সব ছক পাল্টে গেল। লোকে যদি প্রশ্ন করে, তুমি কি দেখে বকুলকে ভালোবেসেছো, তুষার নিশ্চিত সে কথার জবাব দিতে পারবে না।
সত্যিকারের ভালোবাসা উপর থেকে আসে। জাদুকরী এক বিষয়। কার সাথে কখন হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না। বাহ্যিক সৌন্দর্য, কথার মাধুর্যতা, অথবা অর্থ সম্পদ দেখে কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভব করাটাকে লোকে ভালোবাসা ভেবে গুলিয়ে ফেলে। কেউ বুঝতেই চায় না, ‘মোহ’ নামক একটি শব্দ রয়েছে। যা হুবুহু দেখতে ভালোবাসার মতোই কিন্তু ভালোবাসা নয়। ভালোবাসলে মানুষটার সব কিছুই ভালোবাসতে হয়। খারাপ গুণ, ভালো গুণ, সুন্দর কথা, তিতে কথা, ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর অথবা রাগী কণ্ঠ, ভেজা চেহারা অথবা ঘামে জবজবে চেহারা- সব মানে সব! সবকিছুতেই মানুষ মুগ্ধ হয়, ভালো লাগে, ভালোবাসে। একবার দেখে, দুইবার দেখতে ইচ্ছে করে, তারপর সেই দেখতে চাওয়ার চাহিদা বাড়ে। বাড়তেই থাকে। সত্যিকারের ভালোবাসায় অনুভূতির মৃ*ত্যু হয় না কখনোই। এই সহজ বিষয়টা অনেকে বোঝে না। তার মা-ও বুঝবে না। কোন উপায়ে মা’কে জানাবে সে…কাউকে হারানোর বিরহে সে জ্বলেপুড়ে দগ্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে হাত দিলেই র*ক্ত আসে। বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। সে ছাড়া চারপাশ শূন্য। শূন্যতা বুকে চেপে কতক্ষণ শ্বাস নেওয়া যায়?
সেলিনা ছেলের চোখে গভীর বিষাদ দেখতে পেলেন। তাঁর হৃদয় রাজ্যে হাহাকার ওঠে। তিনি অস্থির কণ্ঠে ডাকলেন,
“বাবু।”
তুষার চিন্তার ঘোড়ায় লাগাম টানে। শুয়ে থেকেই মুখটা মায়ের দিকে নিলো। জবাবে বলল,
“বলো মা।”
“তোর কি হয়েছে বাবু? তুই খাওয়া ছেড়েছিস কেন?”
“কই! সকালেও নাশতা করলাম।”
“এক কাপ চা খাওয়াকে কেউ নাশতা বলে না বাবু। তুই কি ভেবেছিস, আমি অসুস্থ তাই তোদের খোঁজ খবর রাখব না? সারা রাত ঘুমাসনি। আমি বারবার ঘুরে এসে দেখেছি, তোর ঘরে আলো জ্বলছে। যখনই দেখি, সবসময় অন্যমনস্ক থাকিস। যেন কিছু একটা চিন্তা তোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ছোট্টবেলা থেকে এ পর্যন্ত তোর সব কথার বন্ধু ছিলাম আমি। তাহলে আজ কেন লুকোচ্ছিস? বল বাবু, কি হয়েছে তোর? মায়ের থেকে লুকোতে নেই।”
তুষার মৃদু হেসে উঠে বসল। সেলিনার দু’গাল নিজের হাতে চেপে ধরে শীতল কণ্ঠে বলল,
“আমার কিচ্ছু হয়নি মা। তুমি অহেতুক চিন্তা করছো।”
“আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ব এই ভয়ে বলছিস না। আমি বুঝি বাবু। আমি তো তোর মা। তুই আমার নাড়ির টান! তবে এই যে লুকিয়ে রেখেছিস, কি লুকিয়ে রেখেছিস, কোন ব্যথায় নীল হচ্ছিস, তা জানার জন্য আমার আরও বেশি উত্তেজনা কাজ করবে। তখন অসুস্থ হলে সব দায়ভার কিন্তু তোর।”
“ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো মা!”
“করলে করছি। তবুও আমি জানতে চাই। আমার থেকে কিচ্ছু লুকোবি না। সব বল…”
“মা…”
তুষার থেমে গেল। সে কেন যেন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কোনো ভাবেই সাহস করতে পারছে না মা’কে বলার জন্য। আফজাল হোসেন বাড়ি ফিরে সেদিনই ছেলের কাছে এসেছিলেন। ছেলেকে বারবার বুঝিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন, মায়ের শরীরের কথা। যদি সব জানার পর সত্যিই কিছু হয়, এই দায়ভার আজীবন ঘাড়ে বয়ে বেড়াবে কেমন করে?
“কি হলো? কথা বলছিস না কেন?”
“না মা, কিছু না। আমার কিচ্ছু হয়নি। ভারতের বিষয়টা নিয়েই অনেক চিন্তায় আছি। আমি কি পারব মা? আমার ইদানীং লিখতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেন আঁটকে যাই লিখতে গেলেই। মাথার ভেতর অনেক প্লট, অনেক থিম, অনেক রকমের চরিত্র। কিন্তু সেসব গোছানোর মতো যুতসই শব্দ পাই না, বাক্য সাজাতে পারি না। এসব নিয়েই একটু চিন্তিত রয়েছি। আর জানোই তো, মাথায় পেরেশানি থাকলে খাওয়া দাওয়ার প্রতি এমনিতেই আগ্রহ কমে যায়।”
যুক্তিসঙ্গত কথা, কিন্তু তারপরও সেলিনার বিশ্বাস হলো না। তাঁর মন বলছে, এখানে অন্য কিছু রয়েছে। বিগত দেড় বছর যাবত তুষার বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বাহিরে কিছু একটা করার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। সেই সুযোগ অবশেষে পেয়েছে। এখন তো দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ করার কথা। নাকি ওর কথাগুলোই ঠিক! আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে অথবা এই প্রথম অন্য প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে যাচ্ছে বলে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে? সেলিনা কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাঁর এক মন তুষারের কথাগুলো বিশ্বাস করতে চায়, অপর মন বাঁধা দেয়। সেলিনাকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুষার নিখুঁত অভিনয় করে ওঠে।
“আমার মা টা এত চিন্তা করতে পারে! মা, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। ডিম ভাজি দিয়ে গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। আর একটু টমেটোর সালাদ সাথে থাকলে মন্দ হয় না। পাওয়া যাবে?”
সেলিনা সকল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন।
“আমি দোলাকে বলছি…”
দোলা বাসায় রয়েছে! তুষারের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মা দোলাকে ছেলের বউ হিসেবেই ট্রিট করা শুরু করে দিয়েছেন। দোলাও নিজেকে এই বাড়ির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভাবে। দোলার পরিবারের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। শুধু বিয়েটাই হয়নি, কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা সংসার জীবনে আবদ্ধ। দোলা এবং দুই পরিবারের ভেতরকার সম্পর্ক ঠিক এরকমই! তুষারের আরও নিস্তেজ লাগে এইবার। কীভাবে সবকিছু ঠিক করবে সে? সে তো দোলাকে নয়…বকুলকে নিজের স্ত্রী রূপে চায়। কীভাবে এই কথা সবাইকে বোঝাবে আর কীভাবেই বা সবকিছু ঠিক হবে?
★
তুষারের ঠিক ভাবে খাওয়া হলো না। ভাত নিয়ে নেড়ে চেড়ে তারপর পাতেই পানি ঢেলে উঠে পড়ল।দোলা মাত্র সালাদ টা বানিয়ে নিয়ে আসছিল। এসে দেখল তুষার বেসিনে হাত ধুঁয়ে নিচ্ছে। দোলা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো,
“তোমার খাওয়া শেষ?”
তুষার ছোট করে জবাব দিলো,
“হুম।”
“কিছুই তো খেলে না। মা বলল, অনেক ক্ষিদে পেয়েছে নাকি।”
তুষারের বিরক্তি লাগল। ও প্রকাশ করল না।
“কেমন যেন লাগছে। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেমন লাগছে? শরীর খারাপ করছে? পেট ঘাটাচ্ছে? এক গ্লাস লেবুর শরবত…”
“প্রয়োজন নেই। শান্ত হও!”
তুষার চেয়ার টেনে বসল ফের। দোলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বসো। আমার কিছু কথা আছে।”
“কি কথা?”
দোলা অস্থিরতা লুকিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসল।
তুষার বলল,
“দোলা, তুমি আমাকে কেন পছন্দ করো?”
দোলা অবাক চোখে তাকাল।
“ওমা! এ আবার কেমন প্রশ্ন! কেউ কাউকে কেন পছন্দ করে?”
“অনেক কারণেই করতে পারে। তুমি কেন করো?”
“তুমি সুন্দর। তাই।”
দোলা ঠোঁট টিপে হাসছে। তুষারের মেজাজ অত্যধিক খারাপ হয়। সে সিরিয়াস কথা বলতে এসেছে আর মেয়েটা মজা নিচ্ছে!
তুষার কণ্ঠে গাম্ভীর্য ঢালে এইবার। বলল,
“দোলা আমি সবসময় সুন্দর থাকব না। এই চামড়া একদিন কুঁচকে যাবে।”
“সে অনেক দেড়ি…”
“দোলা তুমি কি আমার সাথে মজা করছ?আমি সুন্দর তাই আমাকে পছন্দ করো?”
“এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই আসলে। তাই কি বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।”
“দোলা..”
“আমি শুনছি!”
“দোলা আমাকে মুক্তি দাও।”
দোলা স্তব্ধ হয়ে গেল এইবার। এতক্ষণ ধরে যে হাসিটা ওর ঠোঁটে ঝুলে ছিল তা নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। তুষার আচানক ওর হাত দুটি জোর করে ধরে বলল,
“আমায় ক্ষমা করো। আমি এই মানসিক অশান্তি আর নিতে পারছি না। তুমি সুন্দর, নিঃসন্দেহে তুমি অনেক রূপবতী, গুণবতী। কিন্তু তুমি আমার জন্য তৈরি হওনি! আমি তোমাকে কোনো ভাবেই অন্য নজরে দেখতে পারিনি, পারবোও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না এবং ভালোবাসা বিহীন কোনো সংসার চাই না। আমি চাই না, আজীবন টা ত্যাগ করে দেই। মানিয়ে চলি। একটা সামাজিক নাটক করি। আমি চাই মন থেকে বিবাহিত জীবনে সুখী হতে আর সেইটা তোমার সাথে সম্ভব নয়। প্লিজ দোলা…আমাকে মুক্তি দাও। আমার জীবন থেকে, আমার পরিবারের সবার জীবন থেকে তুমি চলে যাও। জাস্ট চলে যাও। গায়েব হয়ে যাও। আমি আর পারছি না… বিশ্বাস করো, একেবারেই পারছি না।”
তুষার উঠে দাঁড়াল এবং গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। রেখে গেল আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে ডুবে যাওয়া একটি থমথমে মুখ। একটু বাদেই সে মুখে বৃষ্টি নামে।
_____________
ভারতে যাওয়ার দিন গুলো তর তর করে এগিয়ে এলো। আজ সন্ধ্যায় ভারতের উদ্দেশ্যে ওর যাত্রা শুরু হবে। তুষার নিজ ঘরে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ও তৈরি হয়ে গেছে। আগাগোড়া নিজেকে আরও একবার দেখে নিলো। সব ঠিকঠাক আছে। আফজাল হোসেন ছেলের ঘরে ঢুকলেন। তুষার দেখেও ফিরে তাকাল না। সত্যি বলতে, পরিবারের উপর বিশেষ করে বাবার উপর এক বুক অভিমান জমা হয়েছে ওর। এবং এই এক বুক অভিমান নিয়েই ও ভারতের দিকে যাচ্ছে। আফজাল হোসেন ছেলের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন। প্রশংসিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ভীষণ চমৎকার দেখাচ্ছে।”
তুষার গম্ভীর মুখে বলল,
“ধন্যবাদ।”
“এভাবে বিদায় জানাবে?”
তুষার জবাব না দিয়ে হাত ঘড়িটা দেখল।
“তোমার মা কিন্তু টের পেয়েছেন তোমার আর দোলার ভেতর কিছু একটা হয়েছে। মেয়েটা বাড়ি আসছে না সেদিনের পর থেকে। ডাকলেই এই ওই অযুহাতে নিষেধ করে দিচ্ছে।”
“ভালো।”
“তুষার! মায়ের শরীরটা..”
তুষার আফজাল হোসেনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক হাত উঁচু করে তাকে থেমে যেতে বলল।
“আমি জানি। তাকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছি। আর কি চাও?”
“তুষার…”
“বাবা…দোয়া রেখো, আমি যেন আর ফিরে না আসি অথবা আমার চোখ দুটো যেন অন্ধ হয়ে যায়। আমি যেন কিচ্ছু দেখত না পারি। রাত হলেই আমার যন্ত্রণা শুরু হয় বাবা। রাতের আকাশের চাঁদ দেখলেই আমার চাঁদ রাণীর কথা মনে পড়ে। ও যে ওই চাঁদের মতোই একা বাবা! আমার পথ চেয়ে বসে আছে। আমি জানি…আমার যন্ত্রণা হয় বাবা। তুমি কোনোদিন কাউকে মন থেকে ভালোবাসোনি তো, তাই এসব আবেগ তোমার কাছে মূল্যহীন হয়েই রইবে।”
তুষার স্যুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেল। আফজাল হোসেন স্পষ্ট দেখলেন, ছেলের চোখের কোণে পানি। তাঁর কেমন যেন লাগল। নিজেদের কথা ভাবতে গিয়ে ছেলেটার উপর বড় অন্যায় অবিচার করে ফেলছেন কি?
কথাগুলো শুনলো আরেকজন, সেলিনা। তিনি আসছিলেন ছেলের রুমের দিকেই, ছেলেকে বিদায় জানাতে। দূর থেকে বাবা-ছেলেকে অন্যরকম দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন বাইরে। ভাগ্যিস দাঁড়িয়েছিলেন, নইলে কোনোদিন বোধহয় জানতেই পারতেন না, তাঁর ছেলের জীবনে চাঁদ রাণী নামক কেউ রয়েছে! তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে তুষার চলে গেল….
★
প্রিয় নারী,
তোমার কাছে পাঠানো এটি আমার প্রথম এবং শেষ চিরকুট। চিঠি লিখবার সময় নেই। সংক্ষেপে দুটো কথা জানিয়ে রাখব। আমি বাংলাদেশ ছাড়ছি। আগামী দিন পনেরো আমি ভারত অবস্থান করব। পরিবারে তোমার কথা জানিয়েছি। তারা মানছে না। মানবে বলে মনেও হয় না। কিন্তু আমি তোমাকে যেহেতু কথা দিয়েছি এবং যেহেতু একবার বলেছি, ‘ভালোবাসি’, তাই আমি সেই কথা থেকে পিছপা হবো না। আমাদের বিয়ে হবে। আমি দেশে ফিরেই মনপুরায় ছুটে আসব। তোমাকে বিয়ে করব। শুধু আমাদের সংসার জীবন শুরু হবে দেড়িতে। অপেক্ষা করতে হবে তোমার। কঠিন অপেক্ষা। পারবে অপেক্ষা করতে? আমার জন্য যুদ্ধ করতে? যদি পারো তাহলে বকুলের মালা বানাও। আমি এসে খোঁপায় পরাবো। নিজের যত্ন রাখবে চাঁদ রাণী। মনে রেখো, যত দূরত্বেই থাকি না কেন, তোমার আমার আকাশটা এক। মনে পড়ছে তোমায় চাঁদ রাণী। খুব মনে পড়ছে।
আমাকে মনে পড়ে চাঁদ রাণী? বিড়াল ছানাটি কেমন আছে? তুমি কেমন আছো? সর্বশেষ, ভালোবাসি তোমায় চাঁদ রাণী, আকাশের বিশালতার চেয়েও বেশি, ভালোবাসি…
ইতি,
তোমার পুরুষ!
.
.
যাওয়ার আগে মনপুরার পাড়ায় মিষ্টির দোকানী ছেলেটার ঠিকানায় তুষার চিঠিখানা পোস্ট করে দিয়ে তারপর গেল। চিঠিটা পৌঁছালো দিন পাঁচেক পড়ে। মিষ্টির দোকানীর নাম গতর আলী। নাম শুনে বয়স্ক কারো চেহারা আন্দাজ হলেও নামের মালিক যুবক। তুষারের কাছের হয়ে গিয়েছিল। তুষার আসার দিন ভোরে গতরকে বলে এসেছিল তার এবং চাঁদ রাণীর সম্পর্কের কথা। তাই গতরের বুঝতে সময় লাগল না, কার নামে চিঠি এসেছে। সে ফজরের নামাজ পড়েই রওনা হলো বকুলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মেয়েটাকে এই চিঠি পড়িয়ে শোনাতে হবে। গতরের ভেবে অবাক লাগে,কোথাকার কোন অজপাড়াগাঁ-র মেয়ের জন্য শহুরে এক বাবুর এত ভালোবাসা! গতর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চকিত হলো। এত সকালে অত মানুষ কেন ঘিরে রেখেছে বকুলদের বাড়ি?
(চলবে)
[মোরশেদ এবং শাহজাদির ব্যাপারে খোলাসা হবে। ওদের নিয়ে লেখা বন্ধ হয় নাই। আমি আস্তে আস্তে সব শেষ করছি। পরবর্তী পর্ব পরশু পাবেন।]