#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা
বেশ লম্বা ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে নবদম্পতি তাদের আবাস্থলে এসে পোঁছালো। ভেতরে ঢুকে লাবণ্য আশেপাশে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা জরিপ করে নিল।
এরপর মহারানীর প্রথম কথা ছিল, “এমন বিশ্রী রঙের পর্দা কেন? এটা আপনার পছন্দ নাকি? ভয়াবহ ব্যাপার!”
হতচকিত অনিকেত বুঝে উঠতে পারল না এর উত্তর কীভাবে দেয়া যায়। তবে ওর পছন্দকে কেউ খোঁটা দেবে আর সে চুপচাপ হজম করবে এতটাও সহজ পাত্র সে নয়। সে ফুল ফর্মে ফিরে এসে দরাজ গলায় নিজের সাফাই গাইল, “পর্দায় সমস্যা কী? আমার পছন্দ যথেষ্ট ভালো!”
লাবণ্য সেটাকে থোড়াই কেয়ার করে যেন সপাটে ব্যাট চালিয়ে দিল, “সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। কী ক্যাটকেটে কালার পছন্দ করেন, সেটা আবার জোর গলায় ভালো বলে দাবী করছেন। যাই হোক, আজকেই নতুন পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে!”
“আজকেই ব্যবস্থা করতে হবে মানে কী?”
“আমি তো হিব্রু বা মান্দারিন ভাষায় কথা বলিনি। সহজ বাংলায় বলেছি, না বোঝার তো কিছু নেই।”
গা জ্বলে গেলেও নিজের মেজাজের পারদ নিয়ন্ত্রণ করে অনিকেত বলল, “দেখুন, জার্নি করে এসেছি, এখন যথেষ্ট ক্লান্ত৷ আপনার এসব অর্থহীন কথা শোনার কোনো মানে হয় না। কাল সকালে আমার অফিস আছে। এখন ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমাব।”
লাবণ্য দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল, “যে বাসার এমন ক্যাটকেটে রঙের পর্দা থাকবে সেই বাসায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে বের হবেন, দুজনে মিলে পছন্দ করে পর্দা নিয়ে আসব।”
অনিকেত দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টা হজম করে বলল, “সেটা বিকেল হোক তখন দেখা যাবে।”
লাবণ্য আর কথা বাড়াল না, বাসার ভেতরটা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে যখন রান্নাঘরে উঁকি দিল, অনিকেত মনে মনে প্রমাদ গুণল। ক্ষণেক পরেই লাবণ্যর চিৎকারে আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ হলো। হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুট লাগাল। রান্নাঘরের অবস্থা দেখে নিজেরই লজ্জা লাগছে অনিকেতের। এঁটো বাসন-কোসন, পাতিল সিঙ্কে স্তুপ করে রাখা, ভাত পড়ে শুকিয়ে গেছে। চুলার অবস্থা একেবারে নাজুক, চারপাশে ভাতের শুকনো মার লেগে আছে, ডাল, এছাড়া রান্না করার সময় যা-কিছু চুলার উপরে পড়েছিল কিছুই পরিষ্কার করা হয়নি। মেঝেতে হলুদ আর মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, চায়ের পাতির কৌটা উল্টে পড়ে আছে, চিনির বৈয়ামের মুখটা ঠিক করে লাগানো হয়নি বলে পিঁপড়ারা লাইন ধরে তাতে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে রীতিমতো নোংরা হয়ে আছে।
অনিকেত মিঁও মিঁও করে বলার চেষ্টা করল, “আসলে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তো। তাই গুছিয়ে যেতে পারিনি। তাছাড়া মিনু খালা যাবার দুইদিন আগে হুট করে এসে বলে গেছে সে আর কাজে আসবে না।”
“কতটা কী উদ্ধার করবেন সে আমার জানা হয়ে গেছে।”
অনিকেত অপমানিতবোধ করল, কিন্তু এবার নিজেকে ডিফেন্ড করার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। লাবণ্য এবার হেঁটে হেঁটে অনিকেতের শোবার ঘরে চলে এলো। অনিকেত নিজের মন্দ ভাগ্যকে দোষ দিল মনে মনে। আজ সে পুরো বোল্ড আউট। এই মেয়ে আজ মোক্ষম বাউন্সার ছুঁড়ে ওকে কোপোকাত করে দেবে নিশ্চিত। এমন ঝড়ো গতির বল ডিফেন্ড করার মতো দক্ষতা ওর নেই৷ আল্লাহর নাম নিয়ে বুকে একটা ফুঁ দিয়ে লাবণ্যর পিছু নিল।
লাবণ্যর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিছানায় তাকিয়ে দেখল ভেজা তোয়ালে রাখায় সেটা শুকিয়ে গেলেও সেখান থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে, কতগুলো চিপসের প্যাকেট মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাগজপত্রের পাশে একটা মগ, তার ভেতরে চায়ের তলানি শুকিয়ে লেগে আছে। মেঝেতে সিগারেটের এসট্রে উল্ট ছাঁই পড়ে আছে।
“আপনার যে সিগারেট খাওয়ার গুণ আছে, আগে কিন্তু জানতাম না।”
“ছিঃ, ছিঃ! বন্ধুরা মাঝেমধ্যে হ্যাংআউট করতে আসে তখন ওই একটু আধটু… দেখুন আমি কিন্তু সিগারেট খাই না।”
লাবণ্যর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অনিকেত কেমন ভেজা বেড়াল হয়ে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা মা বা মামাকে বললে ওর খবর আছে! সেটা নিয়েই ভয় পাচ্ছে।
“আপনি সবসময় খান কিনা সেটা আমি কী করে জানব? তবে এখন থেকে বাসায় এসব সিগারেট চলবে না।”
অনিকেতের গা জ্বলে গেল, এভাবে অর্ডার করছে মনে হচ্ছে সে ওর বেতনভুক্ত কর্মচারী। মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো চেষ্টা না করেই বলল,
“আপনার কথায় সব হবে নাকি। বাসাটা আমার ভুলে যাবেন না।”
লাবণ্য হেসে বলল, “তাহলে তো ভালোই হলো। বাসাটা যেহেতু আপনার একার তাহলে এই জঙ্গল সরিয়ে বাসাটা বাসযোগ্য করে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করুন। যান, যান। সবকিছু পরিষ্কার করবেন।”
“আপনি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়।”
“সেটা আমি জানি। আপনি যদি স্বীকার করেন যে এটা আমাদের দুইজনেরই বাসা, তাহলে অবশ্য আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। তখন আধা-আধি কাজ ভাগ হবে। নইলে একাই করুন।”
“আমি পারব না, আমি এখন ঘুমাব।”
“আচ্ছা, ঘুমান। আমি নতুন জায়গাটার কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি তুলি। সিগারেট ছাইটাও তুলব। এরপর মা আর শফিক আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দেই। মা বলেছিলেন, ছেলে কীভাবে থাকে না থাকে তাই নিয়ে টেনশনে থাকেন। তাকে তার ছেলের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার একটা ব্যবস্থা করে দেই। আমি আবার কারোর কথা ফেলতে পারি না, সত্য বলতেই ভালো লাগে।”
অনিকেত দু’হাতে নিজের মাথার চুল চেপে ধরল, রাগে মনে হয় মাথাটা ফেটে যাবে এবার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ওকে, চলুন দুজন মিলে গুছিয়ে ফেলি।”
“কিন্তু আপনি তো বললেন বাসাটা আপনার, আমি কেউ নই। উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। তাহলে কেন কাজ করব?” লাবণ্যর কথায় অনিকেত বুঝতে পারল এখন হার মেনে নিতেই হবে, তবে তার সুযোগ অবশ্যই আসবে। এক মাঘে তো আর শীত যায় না।
“আচ্ছা, স্যরি। এই বাসা এখন থেকে আমাদের দুজনের। হ্যাপি? এখন প্লিজ কী করতে হবে বলে আমাকে কৃতার্থ করুন।”
“বাহ্! এই তো ভালো ছেলে হয়ে গেছেন। প্রথমদিন বাসে কী যেন বলেছিলেন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঠ্যালার নাম বাবাজী, আপনার সাথে দারুণ মানিয়ে গেছে কথাটা।”
“দেখুন, লম্বা জার্নি করে টায়ার্ড, আগেই বলেছি। আপনার নাটক দ্রুত শেষ করে কী করতে হবে তাই বলুন।”
“জার্নি তো আপনি একাই করেছেন, আর আমি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে টুপ করে এখানে পড়েছি।”
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার জোগাড় অনিকেতের, কোনোমতে গলা চড়িয়ে বলল, “আল্লাহর ওয়াস্তে হেঁয়ালি রেখে কাজের কথা বলুন, প্লিজ।”
“আপনি এই ঘরটা পরিষ্কার করুন, আমি রান্নাঘর ভদ্রস্থ করা যায় কিনা দেখছি।”
যেতে যেতে থেমে ঘুরে তাকিয়ে একগাল হেসে লাবণ্য বলল, “এই জঙ্গলে থাকেন বলেই এরকম জংলী হয়েছেন দেখছি। সভ্যতা সব জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।” এরপর গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে গেল।
এই মেয়ে যে ওর জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে সেটা অনিকেত বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে। আজন্ম অলস অনিকেত আজ নিজের মন্দ কপালকে গালমন্দ করতে করতে কাজে লেগে গেল। একটা কথাই মাথায় ঘুরছে, “আমি কখনো ঋণ রাখি না লাবণ্য। সময় আমারও আসবে, তখন সুদ সমেত সব ফেরত পাবে, অপেক্ষা করো খালি।”
***
ঘর গুছিয়ে গোসল করে বাড়ি থেকে মায়ের পাঠানো একগাদা খাবার গরম করে যখন দুপুরের খাবার শেষ করল তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা সতেরো। অনিকেতের ভীষণ ক্লান্ত লাগছে বলে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই লাবণ্য পেছন থেকে বলল,
“রেডি হন তো। পর্দা না বদলালে শান্তি পাবো না। কোনো ধানাইপানাই একদম করবেন না।”
অনিকেত জানে আজ লাবণ্যর দিন, তাই সুবোধ ছেলেটি হয়ে ওকে সঙ্গ দিতে বের হলো। মেয়েটা যে কতটা খুঁতখুঁতে সেটা সাথে ঘুরতে ঘুরতে বুঝে গেল। একটা পর্দা পছন্দ করতে ঘণ্টা লাগিয়ে দিল। অবশেষে পছন্দ করে সবকিছু ঠিকঠাক করে এলো।
রাতেও মায়ের দেয়া খাবার দিয়ে চালিয়ে নিল। নতুন করে রান্না করার মতো অবস্থা কারোরই নেই। অনিকেত শোবার ঘরে লাগোয়া বারান্দায় মুহিতের সাথে ফোনে কথা বলছিল। লাবণ্য এসে শুয়ে পড়ল। অনিকেত কথা শেষ করে রুমে এসে দেখল ওর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে, সবসময়ের অপছন্দের দেয়াল ঘেঁষে জায়গাটা ওর জন্য বরাদ্দ হয়ে আছে৷
“লাবণ্য, আমি দেয়াল ঘেঁষে ঘুমাতে পারি না। ওদিকে সরুন।”
“সে তো আমিও পারি না।”
“দেখুন, সারাদিন আপনার বহুত নখরা সহ্য করেছি, আর একটুও সহ্য করব না।”
“নখরা কোথায় করলাম, বরং জায়গাটা বাসযোগ্য করেছি। তাছাড়া আমি আপনার জন্য বাসে জানালার পাশের আমার প্রিয় জায়গাটা স্যাক্রিফাইজ করেছি, এখন আপনি শোধবোধ হিসেবে আপনার প্রিয় জায়গাটা আমার জন্য স্যাক্রিফাইস করুন। কাহিনী শেষ। আপনি না আপনার বন্ধুকে ফোনে বললেন যে, ‘ঋণ রাখেন না’।” বেশ কড়া গলায় লাবণ্য কথাগুলো বলল।
“অসহ্য।” এটুকুই শুধু উচ্চারণ করতে পারল। এরপর কয়েল ধরালো।
লাবণ্য বলে উঠল, “আরে, কয়েল বন্ধ করুন। আমার ঠান্ডা লেগে যায়।”
“হুহ্! কয়েল নেভাই আর মশা উড়িয়ে নিয়ে যাক। আপনার শখ থাকলেও মশার খাদ্য হওয়ার শখ আমার নেই। মশারিও নেই, থাকলেও ওটা ব্যবহার করতে দিতাম না। কারণ মশারির মধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
লাবণ্য এবার আর কিছু বলল না, বিরস মুখে কাঁথার নিচে পুরো মাথা ঢুকিয়ে দিল, যাতে কয়েলের ঘ্রাণ নাকে না ঢুকে। অনিকেত বিছানায় উঠে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মাঝরাতে নাক ডাকার শব্দে লাবণ্যর ঘুম ভেঙে গেল। একে তো চোখ জ্বালা করছে কয়েলের ঝাঁঝে, এখন আবার এই উটকো যন্ত্রণা! গত দুইদিনের মতো আরেকটা নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে ভাবলেই অস্থির লাগছে!
এই ছেলেটার সাথে কীভাবে বাকি জীবনটা থাকবে বুঝে উঠতে পারে না! এভাবে থাকা যায় নাকি! মাথাটা কেমন বোঁ-বোঁ করতে লাগল!
…….
(ক্রমশ)