#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা
অনিকেতের মনে হচ্ছে বিয়ে করে জুজুৎসুর প্যাচে ফেঁসে গেছে। নিজের পরিচিত গণ্ডিতে নিজেই নাজেহাল। অনিকেত নামের শাব্দিক অর্থ ‘গৃহহীন’, এই নামটা যে ওর ভাগ্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে এটা সে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি। নিজের ইঁদুর কপালে ভাগ্য নিয়ে দুঃখ হলেও ‘নিজ গৃহে পরবাসী’ কথাটা যিনি লিখেছিলেন তার দুরদর্শিতায় সে মুগ্ধ।
কেন যে মায়ের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে গলে গিয়ে এই ভয়ংকর দজ্জাল মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলো! এরচাইতে এক শিশি বিষ পানিতে মিশিয়ে ঢকঢক করে গলধঃকরণ করলে ঢের ভালো হতো! এই মেয়ে হিটলারের চাইতে ডিক্টেটর!
অনিকেত অভ্যাসবশত গোসল করে এসে ভেজা তোয়ালে বিছানায় ভুল করে রাখলেই লাবণ্য এমনভাবে তাকায়, ভয়ে ওর হৃদপিণ্ড লাফ দিয়ে গলার কাছে চলে আসে। নিয়মিত সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই তবে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু চলতো, এখন সেই জো নেই! ভয়ে বন্ধুদের বাসায় আনতে পারে না, যদি ওদের সামনেই এই মেয়ে তার স্বভাবসুলভ আচরণ করে বসে, তবে মানসম্মান পেছনের জানালা দিয়ে বাপ বাপ করে পালাবে! এই মেয়েকে ওর বউ কম, ওঝা বেশি মনে হচ্ছে। অনিকেত যেন ভূতে পাওয়া মানুষ আর এই মেয়ে বউরূপী ভূত নামানোর ওঝা! ঝাড়ুপেটা খাওয়াটাই শুধু বাকি আছে বোধহয়!
এই যে অনিকেতের একটু চড়া ঝাল খাবার অভ্যাস, কিন্তু বউ রান্নায় ঝাল একেবারেই দেয় না৷ পানসে খাবার খাওয়া যায় নাকি! প্রথমদিন বলেছিল, “মরিচ বলে একটা বস্তু আছে, যেটা খাবারে দিতে হয়, সেটা বোধহয় আপনি ভুলে গেছেন।”
“মরিচ গুঁড়া দিয়েছি তো তরকারিতে, কাঁচা মরিচও দিয়েছি। ঠিকঠাকই তো লাগছে।”
“মোটেই না। একেবারে পানসে লাগছে।”
“আপনি তাহলে এক কাজ করুন, খাবার সময় এক্সট্রা মরিচ পাতে নিয়ে খান৷ রান্নায় বেশি মরিচ দিলে আমি তো সেটা খেতে পারব না৷ কারণ কমানোর প্রসেস জানা নেই৷ এটা ছাড়া সমাধানের রাস্তাও নেই।”
“আলগা মরিচ নিয়ে খেতে হলে রান্নার কী দরকার, দুইটা আলু, দুই টুকরা মাংস, একটা মাছের টুকরা সাথে যেই মশলা, টশলা লাগে সেগুলো প্লেটে একসাথে নিয়ে চিবিয়ে খেলেই তো হয়।”
“তাহলে এক কাজ করুন, আপনি এভাবেই খেয়েন নাহয় এরপর থেকে। আমি শুধু আমারটুকুই রান্না করবনি।”
নির্লিপ্ত গলায় লাবণ্য জবাব দিয়েছিল, পাছে সত্যি সত্যি ওই কাঁচা তরকারি খেতে হয় ভেবে অনিকেত দ্রুততার সাথে জবাব দিয়েছিল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি এডজাস্ট করে নেব।”
মেয়েটার কোনো বিশ্বাস নেই, ভয়ংকর বিপজ্জনক বিশেষণটাও ভীষণ মলিন এই মেয়ের কাছে! কাঁচা তরকারি চিবিয়ে খাওয়ার চাইতে এই সেদ্ধ তরকারি খাওয়া ঢের ভালো! ঝোল তো নয় ট্যালট্যালে পানি, এটা বলার সাহসই হলো না আর! তখন যদি ওর খাবারে সত্যি সত্যি পানি ঢেলে দেয়!
দু’দিন থেকে শুরু হয়েছে নতুন উৎপাত, রাতের বেলা ঘুম যখনই একটু গাঢ় হয় লাবণ্য মাথা ধরে এমন ঝাঁকানো শুরু করে যে ঘুম পালিয়ে যায়। অনিকেতের ঘুম সহজে ভাঙে না, বন্ধুমহলে সে কুম্ভকর্ণ হিসেবে পরিচিত ছিল। ক্রেন দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেও সে বোধহয় বুঝতে পারত না। একবার হলে থাকার সময় মাঝরাতে ভূমিকম্প হলো, সবার হৈচৈ, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি কত ধুন্ধুমার অবস্থা, রুমমেটরা ওকে ডাকাডাকি করে হাল ছেড়ে দিল, কারণ সে তখনও দিব্যি সুখনিদ্রায় ব্যস্ত ছিল। সকালে ঘটনা শুনে সে নিজেই চমকে গিয়েছিল। কিন্তু এই মেয়ের অসাধ্য খুব কম জিনিস আছে! তাই ওর ঘুম ভাঙানোর কাজটা করতে সক্ষম হয়েছে।
“কী সমস্যা আপনার? সারাদিন আমার হাড় জ্বালিয়ে শান্তি হয়নি? মাঝরাতে ঢং শুরু করেছেন!” রেগেমেগে ঘুমকাতুরে গলায় কথাগুলো বলল অনিকেত।
“আপনি আপনার নাক ডাকাটা কন্ট্রোল করুন, তাহলে আমিও ঢং বন্ধ করব। মাঝরাতে ঢং করার কোনো শখ আমার নেই আর রোমান্টিক রোমান্টিক চন্দ্র বিলাস করারও ইচ্ছে নেই।” লাবণ্যর স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ জবাব।
“কীহ্! আমি নাক ডাকি? ফাজলামি করেন? এখন দেখছি ঝগড়ায় জেতার জন্য মিথ্যা বলাও শুরু করেছেন!” অনিকেত নিজের অল্প-বিস্তর নাক ডাকার অভ্যাস সম্পর্কে কিছুটা অবগত। কিন্তু এখন সেটা মেনে নেওয়া মানে হার স্বীকার করা। প্রতিপক্ষের বাড়ি বইয়ে নিজের দুর্বলতা কে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে যায়!
“আমি মিথ্যে বলছি? আমি নিজে ভুক্তভোগী বলেই বলেছি। আমার এত শখ নেই ঘুম ভেঙে আপনার সাথে ঝগড়া করার। আল্লাহর ওয়াস্তে নাক ডাকা বন্ধ করুন।”
“আপনার কোনোকিছুরই শখ নাই, অথচ ঠিকই এসব করে বেড়াচ্ছেন। মুখে মুখে সাধু সন্ন্যাসী অথচ আমার জীবনটা জ্বলন্ত চুলায় ঠিকই ভাজাভাজা করছেন।”
“ও, এখন সব আমার দোষ? আপনার সবচাইতে বড় সমস্যা কী জানেন, বুদ্ধি নামক জিনিসটা আপনার মগজে নেই। আমি আপনার জীবন ভাজাভাজা করছি না, আপনি বরং আমার জীবন কয়লা কয়লা করেছেন।”
“আপনার এত সমস্যা হলে আরেকটা রুম ফাঁকা আছে, সেখানে যান। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না খবরদার।”
“কাল থেকে তাই থাকব। আপনি এই রুমে আমার যেই জিনিসপত্রগুলা আছে, সব কালকে অফিস থেকে ফিরে সেখানে দিয়ে আসবেন।”
“এই যে শুনুন, সমস্যাটা আপনার, আমি কেন কষ্ট করব? আপনার মর্জি, আপনি যেখানে ইচ্ছে থাকেন, নিজের কাজ নিজে করেন।”
“তাইলে আপনি নিজেই ওইপাশে যান, আমার তো এই রুমটাই পছন্দ। আমি বরং এখানেই থাকি।”
অনিকেতের সব জরুরি জিনিস এই রুমে, ওর শিফট করা মানে বহুত ঝক্কি, তারচাইতে এর অল্প কিছু জিনিস একটু টেনেটুনে দিলে অন্তত কিছু সময়ের জন্য শান্তি তো পাওয়া যাবে, দেয়াল ঘেঁষেও ঘুমাতে হবে না! কিছু সময়ের জন্য তো স্বস্তি পাওয়া যাবে!
কিন্তু এত দ্রুত মেনে নিলে প্রতিপক্ষ মাথায় চড়ে বসবে ভেবে বলল, “আপনার ভাগ্য ভালো যে আমি মেয়েদের সম্মান করতে জানি। নইলে…”
“নইলে কী করতেন, মেরে লাশ গুম করে ফেলতেন?” ফিচেল হেসে লাবণ্য বলল।
এটা করতে পারলে কী যে ভালো হতো! কিন্তু সে তো খুবই ভদ্র ছেলে, মানুষ খুন করবে কেন সে! এই মেয়ের জন্য সে জেল খাটতে পারবে না!
অনিকেত মুখে বলল, “পরশুদিন তো শুক্রবার, আপনাকে ওই রুম ঠিকঠাক করে দেব। এখন ঘুমাই প্লিজ, কাল অফিস আছে।”
***
লাবণ্য খেয়াল করেছে সে যখনই পড়তে বসে অনিকেত টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। জবের জন্য প্রিপারেশন চলছে। হল থেকে জিনিসপত্র আনতে হবে একদিন। আগে হলে বাবা, মা এসে হয়তো সব নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতেন, কিন্তু এখন তাদেরকে বলা যাবে না। সে একা এত টানাটানি করার মতো এক্সপার্ট নয়, সুন্দর গাধাটার সাহায্য লাগবে। কিন্তু বলতে গেলেই তার নানা ইনানি-বিনানি শুরু হয়ে যাবে। কিছু বললেই সে কথাটাকে প্যাঁচিয়ে জিলাপি বানিয়ে ফেলে। মাকাল ফলের সাথে সাথে অনিকেতকে জিলাপির কারিগর বলা যায়। আজ থেকে এটাই ডাকবে। পড়তে পড়তে বেখেয়ালে এই নতুন নামটা পেয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠল লাবণ্যর মুখে।
দুদিন হলো রুম বদলেছে, এখন ঘুমটা ভালো হচ্ছে এটাই শান্তি। কিন্তু বাড়তি শব্দের যন্ত্রণা বিরক্ত লাগছে। ওর শাশুড়ি চমৎকার একজন মহিলা, শফিক আঙ্কেল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, প্রাণবন্ত, মজার মানুষ। তাদের সাথে থেকে এই ছেলে সেসবের ছিঁটেফোঁটাও ধারণ করতে পারেনি এটা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। লাবণ্যর মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে, জিলাপির কারিগর ওকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করেই এসব করে কিনা! একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসার ঘরে এলো, অনিকেত সোফায় গা এলিয়ে, পা ছড়িয়ে আয়েশ করে ফোন ঘাটাঘাটি করছে, টিভিতে টকশো চলছে। যা ভেবেছিল তাই, টিভির দিকে তাকিয়েও দেখছে না। রাগে গা জ্বলে উঠল লাবণ্যর। টিভি বন্ধ করতেই অনিকেত ভালো মতো বসে বলে উঠল,
“আমি গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনছিলাম, আপনি টিভি বন্ধ করলেন কেন?”
“কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা তো দেখতেই পেলাম। অকারণে আমাকে ডিস্টার্ব করছেন কেন? আপনি কি বাচ্চা? কেবল স্কুলে যাওয়া বাচ্চারা যেমন একজন আরেকজনের পিছে লাগে তেমন আচরণ কেন করছেন? গ্রো আপ অনিকেত!” লাবণ্য চোখ দিয়ে আগুন ঝরিয়ে কথাগুলো বলল।
“নিজেকে এত ইইম্পর্ট্যান্ট মনে করেন নাকি? শুনুন, আপনাকে ডিস্টার্ব করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই৷ বরং আপনি সবসময় তক্কে তক্কে থাকেন, আমাকে কী করে খাটো করা যায়। আমি যদি প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা হই, তাহলে আপনি সিরিয়ালের কুটনি বুড়ি।”
“আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আমি যা করি সেটার যোগ্য আপনি। এমন নোংরা ঘরে যে থাকতে পারে, তার সাথে কথা বলতেও কেমন লাগে! আপনাকে ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করছি তাই শুকরিয়া করুন।”
“আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। আপনাকে আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।”
“ঠিক আছে করলাম না, আপনিও আমার কোনোকিছুতে নাক গলাতে আসবেন না।”
কথা শেষ করে রুমে যাবার আগে লাবণ্য রিমোটটা সশব্দে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল, ইচ্ছে করছিল অনিকেতের মাথায় মারতে। কিন্তু আজকের মতো মাফ করে দিল!
***
সেদিন ঝগড়ার পর থেকে তিনদিন দুজনের কথা বলা বন্ধ রইল। কেউ কারোর সাতে-পাঁচে নেই যেন। আজ যখন খেতে বসেছে তখনই অনিকেতের ফোনটা বেজে উঠল। লাবণ্য আঁড়চোখে দেখল, শফিক আঙ্কেল কল দিয়েছেন।
অনিকেত কথা শেষ করে অত্যন্ত বিমর্ষচিত্তে জানালো, “পরশুদিন মামা আসবেন৷ কীসের যেন কাজ আছে।”
“শফিক আঙ্কেল আসবেন? এটা তো দারুণ খবর। কিন্তু আপনি এমন হুতোম প্যাঁচার মতো এক্সপ্রেশন দিচ্ছেন কেন?” উচ্ছ্বসিত গলায় লাবণ্য বলল, কারণ সে শফিক আঙ্কেলকে খুব পছন্দ করে।
“আমিও খুশি, কিন্তু মামা এলে আবার আপনি আমার ঘরে ফেরত আসবেন, আবার আপনার ডিক্টেটরশিপ সহ্য করতে হবে সেটা ভাবলেই তো…” নাটুকে ভঙ্গিতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল অনিকেত।
এবার লাবণ্যও পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারল। তারমানে আবার সেই নাক ডাকা, আবার সেই নির্ঘুম রাত! ও আল্লাহ! আবারও এই যন্ত্রণা!
জীবনে প্রথমবার কোনো একটা বিষয়ে দুজিনের অনুভূতি একবিন্দুতে মিশে গেল!
…….
(ক্রমশ)
(এখন থেকে একদিন বিরতিতে আসবে ইনশাআল্লাহ। খুব বেশি বড় হবে না গল্পটা।)