টিংটিংটুংটাং পাঠ-৪

টিংটিংটুংটাং

৪.
মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতের শুরু হয়েছে মাত্র। চট্টগ্রামে সাধারণত অত শীত পরে না। কিন্তু এবারকার শীতের কোনো বাঁধা ধরা নেই। দিনকে দিন তাপমাত্রা এত কমছে যে, শহুরে মানুষেরা বাধ্য হয়েছে সোয়েটার গায়ে দিতে। আমি রোজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেইসব মানুষের আনাগোনা দেখি। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবি, আমার মাঝে বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। ঠিক এ সময়টাতে মা-বাবা তুলাধুনা দিয়েও আমাকে ঘুম থেকে উঠাতে পারতো না। অথচ এখন আমি নিজে নিজে ভোর সকালে উঠছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শত শত ভাবনা-চিন্তার অবসান ঘটিয়ে কাজে লেগে পরছি। তারপর সারাদিন আর ঘুম নেই। আমার কেন যেন মনে হয়, একান্ত আমার দীর্ঘশ্বাসের সময় কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, “পালটে গেলে? আমি জানতাম পালটে যাবে।”
তারপর আবার সেই দীর্ঘশ্বাস! আমি সত্যি বিরক্ত। নিজেকে মানিয়ে নেয় কিভাবে? নিজের স্বপ্নগুলোর গলা টিপে এভাবে সবকিছু সহ্য করে?

—“তুলি? এত ঠান্ডায় বারান্দায় কি করছো?”
গাছে পানি দিচ্ছিলাম। ডাক শুনে রঞ্জনের দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকালাম। সে ঘুম থেকে উঠে রীতিমতো বিছানায় বসে আছেন। চোখেমুখে মা’রা’ত্ব’ক তন্দ্রা। চোখ মেলতে পারছেন না পর্যন্ত। দুএকবার হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে ভালো করে তাকাতে চাইলেন। অস্পষ্ট আমাকে স্পষ্ট করে দেখতেই ধমকে উঠলেন, “সোয়েটার পড়োনি কেন? আশ্চর্য! এদিকে আসো।”

দিরুক্তি করার অবকাশ নেই। আমি আস্তে আস্তে তার কাছে এসে দাঁড়ালাম। সে চট করে বাম হাতটা ধরলেন। পরপর আবার ধমক, “এই মেয়ে, হাত এত ঠান্ডা কেন?”
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। অনুভব করলাম, হঠাৎ করেই আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। অস’হ্য রকমের ঘুম। উষ্ণ বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে আমার ভেতরটায় তো’লপা’
ড় শুরু হয়ে গেছে। হাত ছাড়াতে গিয়ে বুঝলাম, রঞ্জন বাঘের থাবার মতো আমার হাত ধরেছেন। এত সহজে ছাড়াতে পারবো না। ধীরকণ্ঠে বললাম, “হাত ছাড়ুন। কাজ আছে।”
তৃতীয় বারের মতো রঞ্জন আবারো ধমকালেন, “গলাও ভেঙ্গে ফেলেছো দেখছি! কি সমস্যা তুলি? আমি কিন্তু ঠাটিয়ে এক চড় লাগাবো তোমাকে।”

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চেঁচিয়ে বললাম, “কি করেছি আমি? চড় কেন মারবেন? এনেছেন তো কাজ করার জন্যই।”
ভুল হয়েছে গেছে। বিরাট ভুল। আমি অনেকবার বলেছি, আমি চাপা স্বভাবের। হুট করে নিজের ভেতরকার কথা নিজেই প্রকাশ করে দেওয়ায় গুমরে গেলাম। চাপা স্বভাবের মানুষগুলো নিজের মনের কথা কাউকে বলতে চায় না। ভাবে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা বললে সামনের মানুষটা বিরক্ত হতে পারে। তাকে অপছন্দ করতে পারে। অন্যের পছন্দ অপছন্দ, লোকে কি ভাববে এসব চিন্তা করতে করতেই তারা পুরো জীবনটা পার করে দেয়। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমার শুধু মনে হচ্ছে, রঞ্জন এবার রেগে যাবেন। বোধহয় গায়ে হাতও তুলবেন। আমি মিইয়ে গেলাম ভয়ে। জড়তা নিয়ে বলতে চাইলাম, “আমি আসলে এভাবে বলতে…”
—“তোমার কাজ করতে ভালো না লাগলে করো না তুলি। শান্ত হও। এদিকে আসো।”

সদ্য জাগ্রত রঞ্জন। এতটা মায়া লোকটার কণ্ঠে, চেহারায়! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে এগোলাম। তার পাশে বসলাম। রঞ্জন এক ঝটকায় আমাকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। বুকের সাথে এমন ভাবে ঝাপটে ধরলেন যে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার ভালো লাগছিল। আমি সেটা অস্বীকার করতে পারবো না।

—“কি হয়েছে তুলি? কেউ কিছু বলেছে?”
আমি জানি আমি বড্ড ইমোশনাল, আহ্লাদী। ইমোশনাল ফুল নামে বন্ধমহলে পরিচিত। কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে আমি শক্ত হয়ে শুয়ে রইলাম। যেখানে আমার কান্না করে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা। কাঠকাঠ গলায় বললাম, “কিছু হয়নি।”

রঞ্জন আমার মাথাটা আরেকটু শক্ত করে বুকের ভেতর ডেবে ধরলেন। চুলে অনবরত আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “আমি তোমার আপনজন হতে চাইছি। কিন্তু তুমি চাইছো না। আমি তোমার শরীর ছোঁয়ার আগে তোমার আত্মা ছুঁতে চাইছি। তুমি সেখানেও দূরে সরে যাচ্ছো। কেন তুলি? আমি আর কি করলে তুমি আমাকে বুঝবে? আমাকে চাইবে? বলো।”

ভেতর থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। শব্দ করে। রঞ্জনের শরীর থেকে একটা আলাদা ঘ্রাণ আসছে। এটা কি তার নিজস্ব ঘ্রাণ নাকি পারফিউমের, জানা নেই।
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললাম, “আমি পড়তে চাই।”
—“আমি তো মানা করিনি।”
—“কিন্তু মা দিচ্ছেন না। আমি উনাকে বলেছিলাম।”

আমি রঞ্জনের দিকে একটু তাকালাম। উনার অভিব্যক্তি দেখতে। বাংলার ঘরে ঘরে একটা প্রচলিত কথা আছে, “বউ গেলে বউ আসবে কিন্তু মা একটাই।” আমি দেখতে চাইছিলাম রঞ্জনও সেই ধারণার মানুষ কি-না! যারা বউকে শুধু অন্যের ঘর থেকে বয়ে আনা মেয়ে হিসেবেই গণ্য করে। নিজেদের পরিবারের মানুষ মনে করে না।
রঞ্জন বাস্তবিকই কিছু বললেন না। আমাকে হতাশ করে দিয়ে আমার গলায় মুখ গুঁজলেন। মৃদু স্বরে বললেন, “ঘুমাও তুলি। আমি পরে ডেকে দেবো।”

আমার অনুভূতিটা এমন ছিল যে, আকাশে ছোট্ট একটা মুক্ত পাখি উড়ছে। উড়তে উড়তেই কোথা থেকে একটা গুলি এসে তাকে নি হ ত করে তার স্বপ্নগুলো গ’লা টি’পে দিলো। কিন্তু আমার তখনো কান্না আসছিল না। আমি জড় বস্তুর মতো বুকে হাজার হাজার পাথর নিয়ে শুয়ে ছিলাম। শুয়ে থাকতে থাকতেই যেন ক্লান্ত হয়ে পরলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানা নেই। ঘুম ভেঙ্গেছে সাড়ে আট-টায়। রঞ্জনের ডাকে।

ফ্রেশ হতে হতে ন’টা বেজে গেল। এ ঘরে সকলে একসাথে সকালের খাবার খায়। নিচে নেমে দেখলাম সবাই আমাদের অপেক্ষাতেই টেবিলে বসে আছেন। কেউ কেউ ভীষণ বিরক্ত হয়ে ঝিমাচ্ছেন। আমার ক্ষীণ অস্বস্তি হলো। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, শ্বাশুড়ি মা আমাকেই দেখছেন। তার সব সময়কার তীক্ষ্ণ, অসন্তোষ চোখে। আমি চেয়ারে বসতেই গমগমে গলায় কাজের চাচিকে বললেন, “চা আর পরোটাগুলো আবার গরম করে নিয়ে আসুন ময়নার মা।”

নাস্তা বলতে আজকে আলু ভাজি, ডিম সিদ্ধ, চা আর পরোটা। আমি সকালে এত ভারি খাবার খেতে পারিনা। চা আর একটা পরোটাতেই হয়ে যায়। সেটা দশ-পনেরো মিনিট ধরে একটু একটু খাই। কিন্তু এখানে অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। তাড়াতাড়ি খেতে হয়।
শ্বাশুড়ি মা খাবারের মাঝপথে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “আজকে এত দেড়ি হয়েছে কেন ঘুম থেকে উঠতে?”

আমার আগে আগেই রঞ্জন দায়সারা ভাবে উত্তর দিলেন, “ও অসুস্থ।”

শুনে শ্বাশুড়ি মা একবার আমার দিকে তাকালেন। কিছু বললেন না। তবে টের পেলাম, তার মুখটা আগের চেয়ে গম্ভীর হয়ে গেছে।
রঞ্জন বিরতিহীন ভাবে আবার বললেন, “তুলিকে কি তুমি পড়তে মানা করেছো আম্মু?”

তিনি খাওয়া থামালেন। কাঠিন্যতা নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ।”
—“কেন মানা করেছ?”
—“বিয়ের পর কিসের পড়া? এখন সংসার সামলানোর সময়।”
—“তাহলে বলছো রুপাকে এখন বিয়ে দিলে রুপাও আর পড়তে পারবে না?”

শ্বাশুড়ি মা একটু থমকালেন। তারপর আচমকাই আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি সত্যি পড়তে চাও?”

দ্বিধায় পরে গেলাম। কি বলবো? হ্যাঁ, না কোনটা? পাশ থেকে রঞ্জনের তীব্র খোঁচানোতে সেদিকে তাকালাম। পেটে চিমটি দিয়ে ব্যথা করে ফেলেছে লোকটা। চোখ রাঙিয়ে ইশারা করছে হ্যাঁ বলতে। আমি আর সাত পাঁচ ভাবলাম না। অচিরেই মাথা দুলালাম। আমি পড়তে চাই।

শ্বাশুড়ি মা খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বললেন, “তাহলে আর কি, পড়ো যত ইচ্ছা। আমার কথার তো দাম নেই।”

আমার দুই চেয়ার সামনেই শ্বশুড় বাবা বসেছিলেন। উনাকে আমার মজার মানুষ বলে মনে হয়। জাদুকরী মানুষ। বাবা, বাবা একটা ভাব আছে উনার মাঝে। শ্বাশুড়ি মা উঠে যেতেই আমাকে ফিসফিসিয়ে বললেন, “ওই মহিলা এমনই। সময় পেলে আমাকেও সাইজ করতে বাদ রাখে না। তুমি ওসবে কান দিও না, ঠিকাছে?”

রঞ্জনকে দেখলাম হাসছেন। রুপা প্রতিবাদী গলায় বললো, “আমি কিন্তু আম্মুকে বলে দিবো আব্বু।”
বাবা চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, “তো যা না। এখনো বসে আছিস কেন? আমি কি ওই মহিলাকে ডরাই?”

রঞ্জন সাধারণত নাস্তা খেয়েই কলেজে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দেন। কিন্তু আজকে খুব রিলাক্স মুডে আছেন বলে মনে হচ্ছে। নাস্তা খেয়ে সোজা রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে মোবাইল চাপছেন। কোনো তাড়া নেই। আমি রুমে ঢোকা মাত্র কপাল কুঁচকে নজর উঠালেন। আমাকে আগা গোড়া দেখে বললেন, “রেডি হও।”
—“কেন?”
—“তোমাকে বিক্রি করে দেবো।”

চোখ বড় বড় করে তাকালাম, “মানে?”

মোবাইল রেখে রঞ্জন হাত-পা ছড়িয়ে শুলেন। চোখ বন্ধ করে হাসলেন অল্প। বললেন, “মার্কেটে নতুন গাড়ি এসেছে। তোমাকে বিক্রি করে ওটা কিনবো।”
এতক্ষণে স্বাভাবিক হলাম। আলমারি খুলে নতুন একটা জামা হাতে নিলাম। এটা কখনো পরা হয়নি। একদম নতুন।

—“কার কাছে বিক্রি করবেন? জায়গাটা কোথায়?”

রঞ্জনের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবুও পেছনে ফিরলাম না। বুঝতে পারলাম, রঞ্জন বিছানা ছেড়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন। আমার পেছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন, “আলফাজ রঞ্জন কিন্তু সত্যি তোমাকে বিক্রি করে দেবে, তুলি। সে মোটেও ভালো মানুষ না। অনতত তোমার বেলায় তো নয়ই।”

রঞ্জনের হৃদপিন্ড আমার খুব কাছে। ধুকপুক আওয়াজটা স্পষ্ট। সেই আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে আমার বুকের বা পাশটাও সজোড়ে ধুকপুক ধুকপুক করছে। বুঝলাম, আমার স’র্ব’না/শ আমি ঠেকাতে পারিনি। রঞ্জন নামক বি ষা ক্ত বি ষ অজান্তেই পান করে ফেলেছি। সেটা এখন আমার শরীর জুড়ে ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে। শিরা-উপশিরা, মন, মস্তিষ্ক কিচ্ছু বাদ নেই।

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বিঃদ্রঃ বানান ভুল থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here