ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১২) #হালিমা রহমান

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১২)
#হালিমা রহমান

সকাল সকাল গোসলটা সেরে ফেললো সোনালী। কাল রাতে সুযোগ পেলে রাতেই করে ফেলতো।কত কিছুর ভিতর দিয়ে কাল পথ চলতে হয়েছে।মাটিতে শুতে হয়েছে,ঝোপঝাড়-কাটাগাছের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে হিয়েছে,হাঁটার সময় শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ যাতে না হয় সেজন্য খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছে।হাম্মামখানার এককোনে একটা বড় জানলার মতো আছে।আগে হয়তো জানলাটা আরো ছোট ছিল।কিন্তু এখন দেয়াল ভেঙে, কাঁচ ভেঙে তার আকার দ্বিগুণ হয়েছে।ইউসুফ ও মামুনের চোখ বাঁচিয়ে জানলা দিয়েই বাড়িতে ঢুকেছে সোনালী।হাম্মামখানার পাশেই এক বিশাল কাঠাল গাছ আছে।সেই কাঠাল গাছের ডাল থেকে জানলায় লাফ দিয়ে বিড়ালের মতো বাড়িতে ঢুকতে হয়েছে।কনুইয়ের দিকটায় ব্যাথা পেয়েছে খুব।জানলায় গ্রিল না থাকায় রক্ষা। গ্রিল থাকলে খবর ছিল কালকে।কাঠাল পাতার ফাঁক দিয়ে কি যেন একটা পোকা পড়েছিল ঘাড়ের উপর। পোকাটাকে সাথে সাথে মেরে ফেললেও ঘাড়ে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়েছে।সকাল থেকেই ঘাড়ের ব্যাথাটা বেড়েছে।ব্যাথার সাথে সাথে চুলকানিও আছে।মনে হচ্ছে এলার্জি হয়ে গেছে ঘাড়ের উপর।সোনালীর সারা শরীর ব্যাথা।এই প্রথম এতো কাজের চাপ একসাথে নিতে হচ্ছে।এটা সোনালীর জন্য গোল্ডেন চান্স।সঠিকভাবে কাজটা শেষ করতে পারলেই হলো।আর পিছু ফিরে তাকাতে হবে না। এরপর সোনালীর নাগাল আর কে পায়!

সোনালী ব্যাথা কমার মলম লাগিয়ে নিলো ঘাড়ে।কনুইয়েও একটুখানি দিলো।খাওয়ার পর ব্যাথার ঔষধ খেতে হবে।নাহয় আজ আর চলতে পারবে না সে।হাম্মামখানা থেকে বেরোলেই এক বিশাল বারান্দা সামনে পড়ে।দোতলার ঘরগুলো বারান্দার এককোনে।সোনালীর কাছে বাড়িটাকে অনেকটা হাসপাতালের মতো লাগে।তথার চোখে এটা যত সুন্দর,সোনালীর চোখে এটা ততোটাই সাদামাটা।একদম হা করে দেখার মতো কোনো বাড়ি এটা না।বারান্দার সর্বশেষের ঘরটা ইউসুফের। তাদের পাশের ঘরটা সোনালীদের।সোনালী গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দা দিয়ে হাঁটে।বিশাল বারান্দায় কয়েকটা ফুলের গাছ লাগালে মন্দ হতো না।বারান্দার রেলিং ধরে একবার নিচের দিকে তাকায়।যে যার মতো হাঁটছে,কথা বলছে,ছবি তুলছে।ডিরেক্টরও দেখা যাচ্ছে এককোনে।বসে বসে ইউসুফের সাথে কথা বলছে।উপর থেকেই ইউসুফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে সোনালী।সে নিজেও জানে না কিসের মধ্যে ফেসে গেছে ।রেলিঙের উপর দু-হাতে ভর দিয়ে নিচের দিকে ঝুকে দাঁড়ায় সোনালী।মনে মনে কিছু হিসাব কষে।কাঙ্ক্ষিত একজনকে চোখে পড়তেই মুখের হাসিটাকে আরেকটু চওড়া করে।একচোখ বন্ধ করে ইউসুফের দিকে কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে ইশারা করে।ঠোঁট গোল করে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” ওই যে,হারামীটা ওখানে।”

কয়েক সেকেন্ড পড়ে আবারো সোজা হয় সোনালী। তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।চুল থেকে তোয়ালে খুলে চুলগুলোকে একবার ঝেড়ে নেয় মেয়েটা।নরম তোয়ালেতে আলতোভাবে চুলগুলো মুছে পিঠের মাঝ বরাবর ছুঁড়ে মারে।গলায় তুলে গানের সুর।

_” আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়..”

_” ছোট্ট মেয়ে রাত আর নেই।এখন সকাল।সবার ঘুম ভেঙেই গেছে।”

চমকে পিছু ফিরে সোনালী।তার পিছনেই মামুন দাঁড়ানো।তার হাতে খাবারের ট্রে।মামুনের আগে খাবারের দিকে চোখ যায় সোনালীর।অমনিই পেটের ক্ষুধা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।খুব ক্ষুধা পেয়েছে তার।তাছাড়া মেয়েটা খুব ভোজনরসিক। সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার ক্ষুধা পায়।

_” ছোট্ট মেয়ে,আপনারও কি ক্ষুধা পেয়েছে?”

_” হ্যাঁ, খুব।আপনারা খাবার দিতে খুবই দেরি করেন।”

অকপট অভিযোগ। মনে মনে হাসে মামুন।মেয়েটা ভীষণ সহজ-সরল।হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” খুব ক্ষুধা পেলে এতোক্ষণ বলেননি কেন?”

_” কাকে বলতাম?আপনারা দুজন ছাড়া এখানে সবাই নতুন।একটাও কাজের লোক নেই এখানে।এতোবড় বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই কেন?”—মামুনের সাথে সোনালীও পা বাড়ায়।

_” কখনো প্রয়োজন হয়নি তাই।তবে আপনাদের আর সমস্যা হবে না।আজকেই একজন নতুন কাজের লোক আসবে।রান্নাবাড়ার সব দায়িত্ব তার।”

_” এগুলো কার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন?”

_” তথা ম্যামের জন্য।”

_” নিশ্চয়ই মি.ইউসুফ পাঠিয়েছেন।”

_” হ্যাঁ। ”

_” হায় আল্লাহ! সকাল সকাল কি একটা দৃশ্য দেখলাম।আমার ক্রাশ তার প্রেমিকার জন্য আমার চোখের সামনে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছে।ইশ! কি নিষ্ঠুর। আমাকে কি তার চোখে পড়ছে না?”

_” তথা ম্যামকে স্যার পছন্দ করেন,তা আপনি জানলেন কি করে?”

মামুনের কথায় মনে মনে হাসে সোনালী।তার মানে ও যা ভেবেছে তাই ঠিক।তথা সত্যিই আহমেদ ইউসুফের পছন্দের মানুষ।কথার প্যাঁচে কথা আদায় করতে খুব ভালো জানে মেয়েটা।

_” আপনার স্যারের চোখ-মুখই বলে দেয় যে সে তথা আপুর প্রতি দূর্বল।”

_” কিন্তু তথা ম্যাম তো বুঝতে পারেনি।”

_” আপনার ম্যামের চোখ নেই তাই বুঝতে পারেনি।আমার ক্রাশ সুন্দর হলে কি হবে,তার রুচি খুবই খারাপ।আপনার তথা ম্যামের চাইতে আমি বেশি সুন্দর,হুহ।”

_” আপনি তথা ম্যামকে হিংসা করছেন নাকি?”

_” মোটেও না।আমার রুচি অতোও খারাপ নয় যে পরের গোয়ালের গরুর দিকে নজর দেব।পরের গরু কখনো আমার গান গাইবে?”

_” স্যার শুনলে খবর আছে আপনার।”

_” আপনি না বললে কিভাবে শুনবে?আপনার আবার কথা লাগানোর স্বভাব আছে নাকি?”

মামুন অবাক হয়ে যায় সোনালীর কথা শুনে।মেয়েটার কি ভয়-ডর নেই?

_” আপনি খুব ইঁচড়েপাকা, ছোট্ট পেয়ে।অকালে পেকে গেছেন।আপনার বয়স আর কত হবে?বড়জোড় সতেরো-আঠারো।এই বয়সের মেয়েরা এতো বেশি বুঝে না।”

_” আপনি জানেন না, মেয়েদের বয়স নিয়ে কোনো কথা বলতে নেই?কিন্তু আপনি যেমন ভাবছেন আমি তেমনটা নই।”

_” আপনি তবে কেমন?”

_” আমি ভীষণ অন্যরকম।”—অকারণেই খিলখিল করে হেসে উঠে সোনালী।
মামুনের শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।অনেকটা কালবৈশাখির দমকা হাওয়ার মতো শীতল বাতাস আচমকাই তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।তার হৃদমাঝারের বন্ধ কপাটে অস্বচ্ছ এক প্রতিচ্ছবি কড়া নাড়ে।মামুন অপলক চেয়ে থাকে সোনালীর দিকে।মেয়েটা কেমন যেন।চেহারায় তীব্র কৈশোরের ছাপ।তার চলন-বলনে চঞ্চলতা যেন চুয়ে চুয়ে পড়ে।সোনালীর সবকিছু সুন্দর।পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে মাথার চুল–সবকিছু।একটুখানি সূর্যের আলো মেয়েটার কমলার কোয়ার মতো নরম ঠোঁট দুটোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।এই সাধারণ দৃশ্যটাও নজর কাড়ে মামুনের।সবুজ রঙের জামায় সোনালীকে একদম অপ্সরীর মতো লাগে মামুনের চোখে।সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।তার হাসফাস লাগছে খুব।মামুন সোনালীকে রেখেই হাঁটা ধরে।প্রেমে-ট্রেমে পড়ার ইচ্ছে নেই তার।নিজের অবাধ্য মনকে ধমক দিয়ে শান্ত করে মামুন।হতচ্ছাড়া মন কি ভুলে গেছে, মামুনের সন্যাস জীবন পালন করার ইচ্ছে আছে ?সোনালীকে পিছনে রেখেই আপনমনে বিড়বিড় করে মামুন।মেয়েটা ভীষণ ফাজিল।এতো ঢং করে কথা বলার দরকার আছে কোনো?বেয়াদব পাকনা মেয়ে।

মামুনের অবস্থা দেখে প্রাণ খুলে হাসে সোনালী।জাল বিছানো শুরু সবে।সেও দেখবে এই জাল কেটে মামুন আর ইউসুফ কিভাবে বের হয়।

***

_” আসব ম্যাম?”

তথা শুয়ে ছিল।পুরুষের কন্ঠ পেয়ে হকচকিয়ে উঠে বসে।বালিশের পাশ থেকে ওরনা টেনে গায়ে দেয়।মাথা বাড়িয়ে দরজার দিকে তাকায়।মামুন দাঁড়িয়ে আছে।

_” জ্বি,আসুন ভাইয়া।”

নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে মামুন।বিছানার পাশের টেবিলে খাবারের ট্রে রাখে।মাথা নিচু করেই বলেঃ” স্যার পাঠিয়েছেন। ”

_” আমার জন্য?”

_” জ্বি।”

একটু অবাক হয় তথা।সকালে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর ইউসুফের সাথে আর দেখা হয়নি।সকালে তথার কথাগুলো একটু কটুই ছিল।এতো কটু কথার পরেও যেচে খাবার পাঠালো! আশ্চর্য! এ নিছক অতিথিপরায়নতা নাকি অন্যকিছু?

_” আপনার কি আর কিছু লাগবে ম্যাম?”

_” জ্বি, না। এখন থেকে কি সবার খাবার ঘরেই পাঠানো হবে?”

_” জ্বি, না।আপনার ক্ষুধা পেয়েছে বলেই।স্যার পাঠিয়ে দিলেন।”

_” ওহ,আচ্ছা।আমার রুমমেটকে কোথাও দেখেছেন?”

_” হ্যাঁ। ঘরেই আসছে বোধহয়। আমি তাহলে আসছি।”

_” জ্বি,আচ্ছা।”

মাথা নিচু করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মামুন।খুব অদ্ভুত লাগে তথার।খাবারের ট্রের দিকে একনজর তাকায় সে।পাউরুটি,কলা,জেলী আর একগ্লাস জুস।সব বাইরের খাবার।নিজেকে খুব বিশেষ একজন মনে হচ্ছে।কলার খোসা ফেলে এক কামড় বসায় তথা।ইউসুফের এই আচরণটুকু ভাবাচ্ছে খুব।এতো যত্নের কারণ কি?সবার প্রতি কি একই আচরণ করে সে?নাকি এসব শুধু তথার জন্যই বরাদ্দ?

_” একা একা খাচ্ছ কেন?আমার মতো ক্ষুধার্ত মানবীকে চোখে পড়ছে না?”

_” জ্বি,না।যে সবসময় ক্ষুধার্ত থাকে,তাকে আমার চোখে পড়ে না।”

আবারো হাসে সোনালী।মেয়েটার হাসি সুন্দর বলে অকারণেই হাসে সে।ডানহাত দিয়ে একটা পাউরুটিতে একটুখানি জেলি মেখে নেয়।মুখে পুরতে পুরতে বলেঃ” তোমার সাথে থেকে সুবিধাই হচ্ছে আমার।তোমার বদৌলতে বেশ যত্ন-আত্তি পাওয়া যাবে।”

_” বুঝলাম না।”

_” কালকে বাস স্টেশনে তোমার একজন প্রণয় ভিক্ষুককে দেখেছিলাম।কি যেন নাম,ইরফান না?”

_” হ্যাঁ।”

_” আরেকজন পাগল ইরফানকে দেখার জন্য প্রস্তুত হও।তোমাকে দেখলে একজনের চোখের ভাষা বদলে যায়।খেয়াল করলেই দেখতে পাবে।”

ভাবলেশহীনভাবে কলা চিবোয় তথা।সোনালী কি ইঙ্গিত করেছে তা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে।সোনালীর কথা ফেলে দিতে পারে না সে।সত্যিই কি আরেকটা পাগল প্রেমিকের দেখা মিলবে এখানে?এখানেও একটু স্বস্তি পাবে না সে?আহ! যন্ত্রণা।ভালো লাগে না এসব আর।

***

রুবাইদা-মাহাদী স্কুলে চলে গেছে।তথা নেই।আকলিমা খাতুনের ঘর পুরো খালি।ঘরে থাকতে তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে একদিকে চলে যেতে।তথাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন তিনি।রান্নাঘরে বসে বসে একমনে রান্না করছেন আকলিমা খাতুন।একচুলায় ভাত আর অন্য চুলায় ডাল বসিয়ে দিয়েছেন।রান্নাঘরের ফ্লোরে লেপ্টে বসে লাউ কুটছেন। তার পাশেই ছোট বাটন ফোনটা।তথাকে দু’বার কল করেছেন।মোবাইল বন্ধ বলছে।ওখানে নেট নেই বোধহয়।

_” লিমা,একটু শুইনা যাও তো।”

ইকবাল মিয়া এখনো কাজে যাননি।পেশায় একজন আদমবেপারি তিনি।কম খরচে বিদেশে লোক পাঠান।আগে এই পেশায় আয় খুব বেশি ছিল।কিন্তু এখন কমছে।ইকবাল মিয়ার হাতে কাজ এখন খুব কম।তাই এদিক-ওদিক টইটই করেন বেশি।চুলার আঁচ কমিয়ে শোবার ঘরে ছুটে যান আকলিমা খাতুন।ইকবাল মিয়া খাটে বসে আছেন।তার সামনে একতাড়া নোট।হাতেও অনেকগুলো টাকা।সেগুলো গুণে গুণে সামনে রাখছেন।আকলিমা খাতুনের সামনেই সবগুলো টাকা গুণে শেষ করলেন ইকবাল মিয়া।কিছু টাকা পকেটে রেখে বাকি টাকা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দেন।

_” এই টাকাগুলো রাখো লিমা।যত্ন কইরা রাইখো।কয়েকদিন পরেই কাজে লাগব এগুলা।নব্বই হাজার আছে এখানে।আলাদা কইরা রাইখো টাকাগুলা।আজ বিকালে আরো নব্বই হাজার দিমু।”

এতো টাকা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যান আকলিমা।খাতুন।গলায় সন্দেহের সুর তুলে প্রশ্ন করেনঃ” এতো টাকা কই পাইছেন আপনে?এডি তো কাজের টাকা না।আপনে কহনো আমার কাছে কাজের টাকা রাখতে দেন না।তাইলে? কিসের টাকা এগুলা?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here