ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২২)

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২২)
#হালিমা রহমান

ঘরের জানলায় দুটো পাখি বসেছে।ছোট্ট দুটো চড়ুই পাখি।পুরোনো দেয়াল থেকে খুটে খুটে কি যেন খাচ্ছে পাখি দুটো।জানলার ওপাশেই একটা বিশাল আমগাছ।আমগাছের একটা বিশাল ডাল জানলা ছুঁয়েছে।সেখান থেকে তিনটে বড় পাতা ছিঁড়ে নেয় সোনালী।আমপাতা দিয়ে সে খুব সুন্দর করে তালা বানাতে পারে।ছোটবেলায় এই গুণ থাকায় অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না তার।শাফিন কতদিন পিছু পিছু ঘুরেছে।সকাল-বিকাল সোনালীর কাছে তালা বানানোর পদ্ধতি শিখতে চেয়েছে।কিন্তু শেখায়নি সোনালী।কেন শেখাবে?শাফিনও যদি শিখে যায়, তবে সোনালী আর পাত্তা পাবে? সোনালী -শাফিন মাত্র সাতাশ দিনের ছোট-বড়।শাফিন বড়,সোনালী ছোট।দুজনের শৈশব,কৈশোর কেটেছে একসাথেই।দুজনের মাঝে ভাই-বোনের সম্পর্কের চাইতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশি।শাফিন কোন মেয়ের সাথে হাঁটছে,কথা বলছে,কার সাথে কতদিনের জন্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে– এসব খবর যেমন সোনালী জানে, তেমনি সোনালীর কখন মার্কেটে যায়,বাড়ি থেকে পালিয়ে ট্যুরে যায়, ইভটিজিংয়ের অপরাধে কোন ছেলের হাত ভেঙেছে সোনালী,কোন ছেলের পা ভেঙেছে—এসব খবর শাফিনের নখদর্পনে। পেটে পেটে খাতির দুজনের।এ কারণে বাড়ির লোকে বহুবার দুটোকে ধরে-বেঁধে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।এক্ষেত্রে শাফিনের বিশেষ কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও সোনালীর তীব্র আপত্তি ছিল।শাফিন একইসাথে ভাই ও বন্ধু।সোনালীর সব সমস্যা সমাধান কে করে?শাফিনই তো।একটু এদিক-ওদিক হলে কার চুল টেনে ছিঁড়ে সোনালী? সেটাও শাফিনের।শাফিন ভাই। ভাই মানে ভাই।ভাইয়ের সাথে আবার বিয়ে কীসের?হোক সে চাচাতো ভাই।দু-জনের মাঝের সম্পর্কটা তো আর দশটা সাধারণ ভাই-বোনের মতো নয়।শাফিনকে স্বামীর আসনে কল্পনা করতেই গা ঘিনঘিন করে সোনালীর।শাফিন হয় ভাই নাহয় বন্ধু।স্বামী কখনোই নয়।তাছাটা,বিয়ের পর হয়তো শাফিন আধিপত্য বিস্তার কর‍তে চাইবে সোনালীর উপর।সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে না।সোনালীর ব্যবহার,দুষ্টুমি আর আগের আগের মতো সহ্য করতে পারবে না শাফিন।ঝগড়াঝাটি হবে দুজনের মাঝে।কথা বলবে না একে অন্যের সাথে। তখন কি হবে?সোনালী এসব সহ্য করতে পারবে?উঁহু, কখনোই না।

স্নিগ্ধ সকালের আকাশে তেজহীন সূর্য।জানলা গলে একফালি সরু সোনালী রঙা আলো সগর্বে ঘরে ঢুকেছে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোনালীর আধ-ভেজা চুল ছুঁয়ে দেয়।সোনা রঙা আলো লুটোপুটি খায় কমলার কোয়ার মতো নরম তুলতুলে ঠোঁট দুটোতে।মেয়েটা সুন্দর।স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সুন্দর হলে মানুষের চোখে পড়া যায়, ঠিক ততোটুকুই সুন্দর সোনালী। অবশ্য এখানে যারা এসেছে তাদের সবাইকে সুন্দরীদের দলেই ফেলা যায়।সুন্দর না হলে আহমেদ ইউসুফের এখানে আসতে পারতো ?
কিছু মানুষ আছে যাদের সঠিক বয়স আন্দাজ করা যায় না।বয়স হলেও চেহারায় শেষ কৈশোরের ছাপটা থেকেই যায়।সোনালীকে সেই দলে ফেলা যায়।ঊনত্রিশের ঘরে পা দিলেও মেয়েটাকে ঠিক অষ্টাদশী কিশোরীর মতো দেখায়।খুব সহজে বয়স বোঝা যায় না।এ কারণেই তথা,মামুনসহ এখানের সবাই ওকে খুব ছোট ভাবে।গুনে গুনে আটবছরের বড় হওয়ার পরেও হাঁটুর বয়সী মেয়ে তথাকে আপু ডাকতে হয়।হাহ! কি একটা অবস্থা।

সোনালী জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকায়।ঠান্ডা লেগে গেছে হঠাৎ করেই।গলা ভেঙে গেছে।নাক বন্ধ হয়ে আসে।জ্বিভ তেতো হয়ে আছে। মাঝরাতের দিকে জ্বরও এসেছিল।ভোররাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই গোসল করতে হয়েছে সোনালীকে।ঘর্মাক্ত শরীরে থাকতে পারে না সে।কেমন যেন ঘিনঘিন করে শরীর।ঢাকায় যেয়েই ভাল একটা ডাক্তার দেখাতে হবে।শরীরটার যে কি হলো! এই বিপদের মাঝেই অসুস্থ হতে হলো?ভালো লাগে না আর।

চোখে রোদ লাগায় ঘুম ভেঙে যায় তথার।কাল খুব রাত করে ঘুমিয়েছে। তাই সকাল সকাল উঠতে পারেনি আজ।হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতেই চোখ পড়ে সোনালীর উপর।জানলায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পিছন থেকেই ডাক দেয় তথা।

_” সোনালী”

_” হুম।”

_” কয়টা বাজে?”

_” সাড়ে দশটা বোধহয়। ”

_”আল্লাহ এতো বেলা হয়ে গেছে! মরার ঘুম ঘুমিয়েছিলাম।কিছুই বলতে পারি না।”—মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলে তথা।শরীরে ওড়না চাপিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।চুলগুলোকে হাত খোঁপা করতে করতে ঘর থেকে বেরোনোর উদ্যোগ নিতেই,পিছু ডাকে সোনালী।

_” তথা আপু,একটা কথা বলব?”

_” হুম, বলো।”

_” তুমি যা করছো তা কি ঠিক?”

সোনালীর কথা ঠিক বুঝতে পারে না তথা।কপাল কুঁচকে বলেঃ” কিসের কথা বলছো?”

_” কাল রাতে তুমি ঘরে ছিলে না।তুমি বোধহয় আহমেদ ইউসুফের সাথে ছিলে, তাই না?তুমি ঘরে ফিরেছো ঠিক মাঝরাতে।আমি কি ভুল?”

_” উঁহু। ঠিক ধরেছো।আমি কালকে ইউসুফের সাথেই ছিলাম।আমাদের মাঝে কালরাতে অনেক কথা হয়েছে। জানো,ইউসুফ আগে থেকেই আমাকে ভালোবাসতো।আমারও ওনাকে ভালো লাগে।তাই রাখ-ঢাক করে আর লাভ কী?কাল রাতে প্রেম নিবেদন করেই ফেললাম।বিষয়টা সুন্দর,তাই না?”— একটু লাজুক দেখায় তথার মুখ।

সোনালী কোনো উত্তর না দিয়ে বিরক্ত চোখে চেয়ে থাকে।একটা মানুষ কিভাবে এরকম হুট করেই প্রেমে পড়তে পারে? আশ্চর্য! প্রেম কি আম-জাম যে গাছ থেকে পাড়লাম আর খেয়ে ফেললাম? তারপরেই প্রেম হয়ে গেল। কি অদ্ভূত! তাছাড়া কি দেখে ইউসুফের প্রেমে পড়লো তথা? সৌন্দর্য?হ্যাঁ এটাই হবে।সৌন্দর্য ছাড়া আর কি আছে ওই হারামজাদার? মনের সৌন্দর্য তো একটুও নেই।এখানের সবচেয়ে খারাপ লোকটার প্রেমে পড়েছে তথা।সে কি বুঝতে পারছে কত বড় ভুল করেছে?মাশুল কি দিতে হবে না?অবশ্যই হবে।ভুলের মাশুল দিতে তার প্রাণটাই না বেরিয়ে যায়।

_” তথা আপু,এতোরাতে একটা পরপুরুষের ঘরে যাওয়া উচিত হয়নি।দিনকাল ভাল না এখন।তোমার সাথে কাল খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো।”

_” আরে না পাগল,বিশ্বাস না থাকলে কি যেতাম?ওনাকে আমি খুব বিশ্বাস করি।আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওনার কাছেই আমি পুরোপুরি নিরাপদ।”

মুহূর্তেই বিরক্তে তামা তামা হয়ে যায় সোনালীর মেজাজ।কত বলদ মেয়েটা! এতো কনফিডেন্স নিয়ে নিরাপত্তার কথা শোনাচ্ছে সোনালীর কাছে।ইউসুফের কাছে নাকি ও নিরাপদ! ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে। “নিম্ন জাতের গাধা”–মনে মনে গালি দেয় তথাকে।

_” শোনো তথা আপু,আজকাল মেয়েরা নিজের ঘরেই নিরাপদ না।আর তুমি অচেনা জায়গায় এসে অচেনা এক ছেলের কাছে নিজেকে নিরাপদ ভাবছো?কতটুকু চেনো ইউসুফকে? এই আট-নয় দিনের সাক্ষাতেই একদম জীবন -মরণ প্রেম হয়ে গেল তোমাদের?তা কিসের প্রেমে পড়লে?আহমেদ ইউসুফের রূপের নাকি টাকার?”

স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। তথার কানে খট করে বাজে সোনালীর বলা শেষ কথাটি।মুহূর্তেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। শক্ত গলায় বলেঃ” তোমার জ্বিভ সামলাও সোনালী।মুখ খুললেই যদি এতো নিম্নমানের কথা বেরোয় ,তবে মুখটা বন্ধই রাখো।তোমার এসব থার্ডক্লাস কথা শোনার পর আমার কি ইচ্ছে করছে জানো?ইচ্ছে করছে দু গালে ঠাস ঠাস করে চারটে চড় মারি।কিন্তুও মারব না।কারণ তোমার মতো এতোটা নিচে নামতে পারিনি এখনো।আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে হবে না তোমায়।আমি কোথায় নিরাপদ,আর কোথায় অনিরাপদ তা তোমার চাইতে ভালো বুঝি।”

ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যায় তথা।সোনালী তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে।নেহাৎ তথাকে তার ভালো লাগতো বলে সাবধান করতে গিয়েছিল। কিন্তু এমন হবে জানলে কখনোই পরোপকারের নাম মাথায় আনতো না।আবার জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সোনালী।তথা মরুক বা বাঁচুক তাতে কিছুই যায় আসে না সোনালীর।সোনালী তো সাবধান করার চেষ্টা করেছিল,তথা যে ভুল করছে তার একটুখানি ইঙ্গিত তো দিয়েছিল।এর বেশি আর কি করা যায়? ” তুই মরবি তথা”– জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আপনমনে বিরবির করে সোনালী।

***

_” ওই যে দেখ,আমার পাগল আশিক আসছে।”—- হাতের ইশারায় মামুনকে দেখায় সোনালী।

শাফিন ভ্রু কুঁচকায়।গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” পাগল আশিক মানে?তোকে পছন্দ করে?”

_” হুম।অনেক পছন্দ করে।”

_” তুই কি করে জানলি?”

_” মানুষের ভাব-ভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায়।আজকে সকালে আমি গোসল করে ঘরে যাচ্ছি,তখনই আমার সাথে দেখা।গলার স্বর শুনেই বুঝলো ঠান্ডা লেগেছে।এই ঠান্ডা নিয়ে এতো সকালে গোসল করা উচিৎ নয়,এ নিয়ে দশ মিনিট লেকচার দিলো।তারপর আবার আমার ঠান্ডা কমানোর জন্য নিজের জ্যাকেট এনে দিয়েছে ঘর থেকে।বলেছে, যতদিন ঠান্ডা না কমে ততোদিন ফেরত দেওয়ার দরকার নেই।দেখলি কি কেয়ারিং।”

_” আল্লাহ রে! কত প্রেম! দেখলে চোখ পুড়ে যায়।”

_” তোর সবকিছু পুড়ে যাক।এখন এখান থেকে যা তুই।”

_” কেন?”

_” আমি একটু মামুন সাহেবের সাথে কথা বলব।দু-কান ভরে তার মিষ্টি গলার স্বর শুনব।”

শাফিন দু-হাতে সোনালীর চুল টেনে দেয়।শাসনের সুরে বলেঃ” ওই হারামজাদার সাথে এতো মেলামেশার কি দরকার?তোর কথা -বার্তা ভালো লাগছে না।ওইদিন সৌরভও আমাকে বললো।”

সৌরভের নাম শুনে বিরক্ত হয় সোনালী।সৌরভ ওদের কলিগ।কিন্তু সবসময় সোনালীর পিছনে লেগে থাকে।অকারণেই খোঁচা মেরে কথা বলে।এসব একদম সহ্য হয় না সোনালীর।কপাল কুচকে বলে ঃ” আমার আচরণ ভালো না লাগলে তোরা নিজেরা কাজ কর।আমার আশায় বসে আছিস কেন?তোরা পাঁচটা পুরুষ একটা মেয়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছিস।আচ্ছা কাপুরুষ তো!”

_” ইশ! গলার জোর বেড়েছে।”

_” হুম বেড়েছে।শোন, আজ বিকালে একটু বাজারে যাবি।যেভাবেই হোক মনির স্যারের সাথে যোগাযোগ করবি।আর আসার পথে ফার্মেসী থেকে দুটো হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ আনবি।মনে থাকবে?”

_” ঘুমের ঔষধ দিয়ে কি হবে?আর আমি তো কোনো ঘুমের ঔষধের নাম জানি না। ”

_” তুই একটা বলদ।তুই।নাম জেনে কি করবি?ফার্মেসীতে বললেই তো দেবে।যা ভাগ এখন।আমি একটু আমার আশিকের সাথে খোশগল্প করে আসি।”

শাফিনকে পিছনে ফেলেই হাঁটা ধরে সোনালী।সকালবেলা মামুনের কাছে একগোছা চাবি দেখেছিল।ওখানেই হয়তো গোডাউনের চাবি আছে।সোনালী দেখেছে চাবিগুলো মামুন মানিব্যাগে রেখেছে।ওই চাবিগুলো দরকার সোনালীর।আজ রাতেই দরকার।যেভাবেই হোক আজ গোডাউনে ঢুকতেই হবে।দেখতেই হবে কি আছে সেখানে।

***

__” অ্যাকশন”___

ডিরেক্টরের উচ্চ আওয়াজ কানে আসতেই মৃদু হাসি হাসে তথা।আবার শুটিং শুরু হয়েছে তবে আজকে তথার কাজ নেই। তথা জমিদার বাড়ির বিশাল রান্নাঘরে বসে আদর্শ গৃহিনীর মতো রাঁধছে।চুলায় ভাত-ডাল বসিয়ে বটিতে ইলিশ মাছ কুটছে।সকালবেলা রোকসানা খালা এসে সবার জন্য রান্না করে বাড়ি চলে যায়।তারপর আবার শেষ বিকালে আসে।রান্নাঘর খালি পেয়ে আজ রাঁধতে বসেছে তথা।ইলিশমাছ খুব সুন্দর করে রাঁধতে পারে সে। তথা মন-প্রাণ দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধছে। ইউসুফকে কখনো দুপুরে খেতে দেখেনি।আজ নিজের হাতে রান্না করছে দু-জনে একসাথে খাবে বলে।নিচু চুলা।তাই পিঁড়ি পেতে বসেছে তথা।ডানপায়ের তালুতে বটি চেপে নিষ্প্রাণ মাছটাকে কুঁটছে।

খানিক বাদে কোথা থেকে উড়ে আসে ইউসুফ।তথাকে নিচে বসে কাজ করতে দেখে নিজেও আসাম করে বসে পড়ে তথার সামনে।দু আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে।আঁশটে গন্ধ সহ্য হয় না তার।তথার দিকে চেয়ে ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলেঃ” শুভ সকাল,কামিনী ফুল।”

_” দুপুর বারোটা বাজে শুভ সকাল হয় না।”

_” কি করব বলুন।কালকে ঘুমটা এতো ভালো হলো সকাল সকাল ভাঙলোই না।”

_” ভালো।”

_” আপনাকে কাজ করতে কে বলেছে?মাছের গন্ধ নাকে যাচ্ছে না?”

_” উঁহু, একটুও না।আমার এতো সাহেবিয়ানা নেই।মাছের গন্ধ,গোবরের গন্ধ সব সহ্য হয়।”

_” তাই বলে মাটিতে বসে মাছ কাঁটতে হবে?উঠুন।”

মাছের পেটি বের করতে করতে বিরক্ত চোখে তাকায় তথা।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” রান্নাঘরে আপনার কাজ কী?যান ঘরে যান।আমার কাজ শেষ হলেই আমি আসব।”

_” কত সাহস মেয়ে! আমাকে ধমক দেয়।”

_” আরেকটা কথা বললে খুন করব।এই যে বটিটা দেখছেন।অনেক ধার এতে।আপনার মাথাটা ফেলার জন্য এক কোপই যথেষ্ট।আমি কতো কষ্ট করে তার জন্য রান্না করছি,আর সে এসেছে খবরদারি করতে।সাহস কতো!”

প্রশ্রয়ের হাসি হাসে ইউসুফ।প্রসন্ন কন্ঠে বলেঃ” ওহ,আমার জন্য রান্না হচ্ছে।কি সৌভাগ্য আমার! তাহলে আমিও একটু সাহায্য করি।”

চুলার দিকে এগিয়ে যায় ইউসুফ।ভাত বোধহয় হয়ে গেছে।মাড় দেখা যায় না।

_” কামিনী ফুল,ভাত নামিয়ে ফেলব?”

_” উঁহু, মাড়ি ফেলতে হবে।”

_” আমি করে দেব?”

গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করে তথাঃ” আপনি পারবেন? করেছেন কখনো?”

_ ” করিনি কিন্তু ট্রাই করে দেখতে পারি।”

_” দরকার নেই।এ এতো সোজা কাজ নয়।পরে দেখা যাবে হাত-পায়ে মাড় ফেলে পুড়িয়ে ফেলবেন।”

_” আরে আপনার
সাহেব এতো বোকা না।কত কঠিন কাজ করি আর এটা তো একদমই সহজ।এই যে দেখ, পাতিল ধরলাম আর এই তো এখানে ফেলে…
আহ! উফ. ”

ইউসুফের হাত থেকে আগুন গরম ভাতের পাতিল ছিটকে পড়ে যায় দূরে।সবকিছু ঠিকই ছিল।কিন্তু ভারী পাতিলটা পিছলে যাওয়ায় অঘটনটা ঘটলো।সসপ্যানে মাড় না পড়ে পড়লো ইউসুফের বামহাত ও পায়ের উপর। হাঁটুতে মাথা ভর দিয়ে ডানহাতে পায়ের পাতা চেপে ধরে ইউসুফ।জ্বলে যাচ্ছে একদম।তথা দৌড়ে আসে ইউসুফের দিকে।রক্তমাখা হাতে পুড়ে যাওয়া পায়ের পাতায় ঘষে দেয়। ব্যতিব্যস্ত গলায় বলেঃ ” নিষেধ করেছিলাম আমি।কোনো কথা শুনতে চান না কেন, বলুন তো?ব্যাথা করছে খুব? চলুন পানি দেবেন।উঠুন।”

সজোরে আরো কয়েকবার ইউসুফের পায়ের পাতা দুটো ঘষে দেয় তথা।ইউসুফের জানটা মনে হয় বেড়িয়ে যাবে।পোড়া জায়গায় কেউ এতো জোরে ঘষাঘষি করে? বহু কষ্টে তথার হাত সরায় ইউসুফ।নির্জীব গলায় বলেঃ” পা ভেজানোর জন্য একটু পানি দিন, কামিনী ফুল। এভাবে ঘষলে আমার চামড়াগুলোই উঠে যাবে।”

তথা হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারে।দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলেঃ” আমি এক্ষুণি আসছি।আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”

তথাকে দরজা দিয়ে বেরোতে দেখে তড়িৎ গতিতে দেয়ালের ওপাশে চলে যায় শাফিন।পানি খেতে এসেছিল এখানে।কিন্তু এমন একটা সিনেমা দেখা হয়ে যাবে, তা ভাবেনি।তথার উপর খুব সন্তুষ্ট শাফিন।বুদ্ধির অভাবে পোড়া জায়গায় ঘষে দিয়ে ভালোই করেছে।আরেকটু ঘষামাজা করা উচিৎ ছিল।ঘষতে ঘষতে চামড়া তুলে নিলে ভালোই হতো।শালা রান্নাঘরে গেছে পোদ্দারি করতে।হতচ্ছাড়া বদমায়েশ একটা।

***

শনিবারে হাট বসে এইগ্রামে।বিকাল থেকে হাট শুরু হয় আবার এশারের আগেই শেষ হয়ে যায়।পঞ্চগড়ের এই অজপাড়া গাঁয়ের মিলনমেলাই হলো এই হাট।শাফিন বিকেলের শেষদিকে তিনি বেরিয়েছে।সিনিয়র অফিসার মনিরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।সবার ফোন গায়েব করে ফেলেছে ইউসুফ।ফলস্বরূপ সেই দুই তারিখের পর থেকে হেডকোয়ার্টারে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।আজ যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতেই হবে।এখানে ফ্লেক্সিলডের দোকান আছে নিশ্চয়ই।সেখান থেকেই একটা কল করবে শাফিন।এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে হাঁটছে শাফিন।কাঁচা রাস্তার দু’ধারে বিক্রেতারা সবজি নিয়ে বসেছে।গাছের টাটকা সবজি,পুকুরের জ্যান্ত মাছ।শাফিনের চোখ জুড়িয়ে যায়।ঢাকায় এরকম তাজা সবজি-মাছ পাওয়া আর বাঘের চোখ পাওয়া একই কথা।এখন তো সবকিছুতেই ভেজাল।নির্ভেজাল কিছু পাওয়া যায় আজকাল?

শাফিন মাস্ক পড়ে এসেছে।তবু তার বেশভূষা ভিন্ন বলে অনেকেই কৌতূহলী চোখে দেখছে তাকে।তবে সেদিকে পাত্তা দেয় না শাফিন।দেরি করলে চলবে না।তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে।কিছু দূরে পৌঁছাতেই কিছু মানুষের জটলা চোখে পড়ে।মানুষগুলো কি যেন দেখছে গোল হয়ে।বেশ কৌতূহল বোধ করে শাফিন।কোনো সমস্যা হলো নাকি ওখানে? দ্রুতপায়ে জটলার দিকে এগিয়ে যায় শাফিন।দু-হাতে ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দু-জন লোক ও একটি উল্টে যাওয়া রিকশা চোখে পড়ে।এক্সিডেন্ট হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে।রিকশাওয়ালা উঠে বসলেও আরোহী উঠতে পারেনি।উপুড় হয়ে মাটির উপর পড়ে আছে।শাফিন সেদিকেই এগিয়ে যায়।কালো শার্ট-প্যান্ট পরা একটা ছেলে।কাছে যেয়ে সোজা করে ছেলেটাকে।অজ্ঞান হয়েছে নিশ্চিত।সোজা করে মুখের মাস্ক খুলতেই চমকে যায় শাফিন।অত্যন্ত পরিচিত একটি মুখ,পরিচিত মানুষ।শাফিন আস্তে আস্তে চড় দেয় ছেলেটার গালে।হতভম্ব গলায় ডাকতে শুরু করেঃ ” ইরফান,ইরফান….”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here