#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat
১২.
গোটা দুনিয়া চোখের সামনে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে ইজানের। ভেতরটা শক্ত আর ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাবা অবশ্য বলেছেন বেশি টেনশন না করতে। হাতের কাটাটা গভীর ছিল, প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ হওয়ায় খুব সহজেই ব্লাড ম্যানেজ করা গেছে। এখন মারজানের জ্ঞান ফিরলেই আর চিন্তার কিছু থাকবে না। আর জ্ঞান না ফিরলে? না, এরপর ইজান আর ভাবতে পারছে না, কিংবা বলা ভালো ভাবতে চাইছে না।
ও বসে আছে গ্রিন লাইনের বাসে শেষের সারির আগের সারিতে। ট্রেন আর প্লেইন, দু’টোর জন্যই অপেক্ষা করতে হতো কমপক্ষে চার ঘন্টা। এই চার ঘন্টা বসে থেকে অপেক্ষা করার ধৈর্য ওর হয়নি।
বাস চলতে শুরু করলে একটু যেন অস্থিরতা কমল। চুপচাপ বসে না থেকে মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শুরু করল ইজান। একটা সময় ভেতরের পাথর গলল। দুচোখ বেয়ে নেমে এলো জলধারা। দুহাতের কোলে মুখ গুঁজল ইজান।
আমি তোমাকে ছোটো একটা শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম বলে তুমি আমার সারাজীবনের শাস্তির ব্যবস্থা করছিলে! তুমি এত নিষ্ঠুর, মারজান? আর আমাকে কিছুই না বলে তুমি এভাবে চলে যেতে পারছিলে? ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমিও তো ওকে না বলে চলে আসতে পেরেছ! কিন্তু সেটা তো অল্প সময়ের জন্য, চিরদিনের জন্য না! নিজেই আবার উত্তর দিল ইজান।
কিন্তু সত্যিই কি মারজান কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিল? হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই চোখ মুছে দ্রুত হাতে ফোন বের করল ইজান। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই দুচোখ আবারও ভরে উঠল জলে। উপরের দিকে তাকিয়ে সেগুলো সামাল দিল ও।
প্রথমে অনেকগুলো মিসড কল, তারপর অনেকগুলো মেসেজ মারজানের নম্বর থেকে। প্রথম মেসেজগুলোতে স্যরি লেখা। তারপর বড় বড় দুইটা মেসেজ।
‘ইজান, আমি সত্যিই স্যরি। আমি বুঝিনি যে কাজটা এতটা খারাপ হবে। এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই তো একজন মানুষের কাহিনী লেখার আগে তার অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। তুমি আমাকে বলেছিলা যে, রাফায়েত ভাইয়া আমার লেখা পড়েন। তাই তাকে আমার লেখার মাধ্যমে আমি এনকারেজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আরেকটা বড় ভুল এখানেও হয়েছে। গল্পটা পুরোটা পোস্ট হয়নি। আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছিল। সারারাত জাগার পর ওই সময়ে রিভিশন দিয়ে ঠিকঠাক করতে ইচ্ছে হয়নি। তাই সায়মাকে পাঠিয়ে বলেছিলাম যে ওকে রিভিশন দিয়ে পোস্ট করতে। ওর কপি পেস্ট করতে গিয়ে কিছু একটা ঝামেলা পেকে গল্পের অর্ধেক পোস্ট হয়েছে। আর ও সেটা নিজেও খেয়াল করেনি। তুমি পরের অর্ধেক পড়লেই বুঝবা যে আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। কিন্তু এটা তো সত্যি যে আমি বিনা অনুমতিতে একজনের জীবন নিয়ে গল্প লিখে ফেলেছি। আমি অলরেডি পেজ থেকে গল্পটা সরিয়ে ফেলেছি। নিচে গল্পের পুরো অংশ দিলাম। পড়ে যদি তোমার ঠিক মনে হয়, রাফায়েত ভাইকে ফরওয়ার্ড করে দিও। আর আমার পক্ষ থেকে উনাকে প্লিজ স্যরি বইল। আমার আসলেই কাজটা করা ঠিক হয়নি।’
পরের মেসেজে পুরো গল্প লেখা। শেষের অংশে ছেলেটা নিজেকে সামলে নেয়, সব ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। নতুন একজন মানুষ আসে তার জীবনে, যাকে সে পূর্ববর্তী ভালোবাসার কারণে এক্সেপ্ট করতে পারে না। এরপর একদিন সেই মেয়ে ফিরে আসে নিজের ভুল বুঝতে পেরে। গল্পটা শেষ হয়েছে এইভাবে যে ছেলেটার এখন সম্পূর্ণ নিজের চয়েস, সে তাকে ফিরিয়ে নিবে কী না। মারজান নিজে কোনো এন্ডিং দেয়নি।
এবার আর অসন্তুষ্ট হতে পারল না ইজান। সত্যি বলতে, রাফায়েত ভাইকে ওই অবস্থায় দেখার পর থেকে একটা চিন্তাই ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেটা হলো ওর কি কিছুই করার নেই এক্ষেত্রে? কোনোভাবে কি ও ভাইয়ের কষ্ট একটু কমাতে পারে না? নিশ্চয়ই মারজানও এরকমই ফিল করছিল। আর ওর কাছে যেহেতু ওর কলমের অপশন রয়েছে, ও সেটাকেই ব্যবহার করতে চেয়েছে। ভেবেছে, মানুষটা যেন একটু শক্তি পায়। এটাই জীবনের শেষ নয়, এই ভরসা পায়। আল্লাহ চাইলে ভালোবাসা জীবনে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তার আগে নিজেকে শক্ত করতে হবে। সম্ভবত এই মেসেজটাই মারজান দিতে চেয়েছিল।
ও সাথে সাথে গল্পটা আর আগের মেসেজটা রাফায়েত ভাইকে ফরওয়ার্ড করে দিল। ফোনও করল। মারজানের খবর জানাল, ওকে ছোটো আর ইম্ম্যাচিউর ভেবে মাফ করে দিতে বলল আর ওর জন্য দোয়া চাইল।
আশ্চর্য শান্তভাবে ওর কথা শুনল রাফায়েত। বলল যে ছোটো বোন হিসেবে অলরেডি মারজানকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। এমনকি উল্টো ইজানকে সান্ত্বনা দিল, চিন্তা করতে নিষেধ করল। বলল যে, ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফোন রেখে হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল ইজান। বাসের মতোই ঝড়ো গতিতে উল্টোদিকে ছুটে চলেছে রাস্তার ধারের গাছগুলো। রাফায়েত ভাই মানুষটা কী দিয়ে গড়া? এত কিছুর পরও এত শান্তভাবে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়া যায়?
***
চোর চোর একটা অনুভূতি নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করল ইজান। মনে হচ্ছিল দাগী আসামী ও, এগিয়ে যাচ্ছে নিজের কাঠগড়ার দিকে। কারণ ইতোমধ্যেই মিরাজ ভাই ফোন দিয়ে ওকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়েছেন। তার বোনের এই অবস্থার জন্য ইজানকে দায়ী করেছেন। আরও বলেছেন যে, মারজানের যদি কিছু হয়, তিনি কাউকে ছেড়ে দিবেন না। এখন মারজানের আব্বু-আম্মু ঠিক কী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবেন, কেমন আচরণ করবেন, ভাবতেই ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছে ইজান।
তবে ইজানকে অবাক করে দিয়ে তেমন কিছুই ঘটল না। জ্ঞান ফিরেছে মারজানের। ডাক্তার বলেছেন, বিপদ কেটে গেছে। সবাই তাই খুব খুশি। রক্তশূন্যতার পাশাপাশি ওর কিছু নিউট্রিয়েন্টস ডেফিসিয়েন্সিও আছে। সেজন্যই অনেক দুর্বল। ভালোভাবে রেস্ট নিলে, খাওয়াদাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে। আগামীকালই ওকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে ওরা। শুধু মিরাজ ওর দিকে একটা কড়া দৃষ্টি হেনে বুঝিয়ে দিল, সে কোনো ফাঁকা আওয়াজ দেয়নি।
মারজান ইজানকে দেখে দুর্বল একটা হাসি দিল, তবে ওর মুখ জুড়ে ফুটে উঠল অদ্ভুত এক প্রসন্নতার ছাপ। বেচারি জ্ঞান ফেরার পর সবাইকে দেখেছে, ইজানকে ছাড়া। তাই ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল। ওর ইচ্ছে করল বলে, “আই অ্যাম স্যরি” কিন্তু চোখ বুজে আসছে। তাই ভাবল ঠিক আছে, পরেই বলা যাবে না হয়।
মারজানের ফ্যাকাশে মুখের প্রসন্নতা খুব একটা নিশ্চিন্ত করতে পারল না ইজানকে। কারণ আজ যে মারজান এইভাবে এখানে শুয়ে আছে, তার জন্য যে ও-ই দায়ী, এতে তো সত্যিই কোনো সন্দেহ নেই। ও যদি একটা বার মারজানের কথা শোনার চেষ্টা করত!
কেউ কিছু না বললেও নিজের দায়িত্ববোধ থেকে শশুর-শাশুড়ীর সামনে মাথা হেট করে নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইল ইজান। অদ্ভুতভাবে তারাও তাকে সান্ত্বনা দিলেন। তালুকদার বললেন, এই কাজ তাদের মেয়ের ইম্ম্যাচিউরিটিরই ফল। এখানে ইজানের খুব বেশি দোষ নেই। সামান্য ঝগড়াঝাটিতেই স্যুইসাইড করতে গেলে তো মুশকিল। মারজান সুস্থ হলে তিনি এই বিষয়ে ওর সাথে কথা বলবেন। শুধু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদলেন মনোয়ারা। বললেন, মেয়েটা কবে বড় হবে? এই নির্বুদ্ধিতার পরিণাম যদি সত্যিই ভয়াবহ হতো, তিনি কীভাবে বাঁচতেন? তার কান্না দেখে ইজানও বহু কষ্টে নিজের চোখের জল সামলাল। শশুর শাশুড়ীর সামনে কেঁদে ফেলা কোনো কাজের কথা নয়।
তবে ছেড়ে কথা বললেন না হক সাহেব। “তুমি বন্ধুর সামনে আমার মান-ইজ্জত বলে কিছু রাখোনি। আমি অনেক আশা নিয়ে তোমাদের দুই হাত এক করেছিলাম। তুমি এরকম একটা নাবালকের মতো কাজ করবে জানলে আমি কখনোই তোমাকে অন্তত বিয়ে দেবার কথা ভাবতাম না।“ এমন আরও অনেক কিছু বললেন তিনি। ইজানের কাছে কোনো প্রতিউত্তর ছিল না। ও চুপচাপ বাবার বকা হজম করে নিল।
রাতে মারজানের কাছে থাকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুখ ফুটে সেটা বলতে পারল না ইজান। নিজের অপরাধবোধ যেন ওকে বাঁধা দিচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ও কিছু চাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। কেন যেন ওদের দুজনকে আলাদা কথা বলতে দেয়ার কথাও কারও মাথায় এল না। ভগ্ন হৃদয়ে বাসায় ফিরে কোনোরকম রাতটা ছটফট করে কাটাল ইজান।
***
সকাল দশটায় মারজানকে রিলিজ দেয়া হলো। মারজানের ফ্যামিলির সাথ ধরল ইজানও। মারজানের সাথে একলা দুটো কথা বলার জন্য, ওকে একটুখানি বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরার জন্য ইজানের মনপ্রাণ আকুলিবিকুলি করছে। মারজানকে ওর ঘরে নিয়ে এলেন মনোয়ারা। পিছে পিছে এলো ইজান। শুতে ইচ্ছে করছে না বলে বিছানার কিনারে, নিচে পা নামিয়ে বসল মারজান। সেও যে ছটফট করছে ইজানের সাথে কথা বলার জন্য! মনোয়ারা বেরিয়ে যেতেই মারজানের কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল ইজান।
কতকিছু বলার ছিল, সব যেন দলা পেকে আটকে গেল গলার কাছে। ফিসফিস করে শুধু বলল, “আই অ্যাম স্যরি” তবু বলার সময় গলাটা কেঁপে গেল। আলতো ভাবে ওর পিঠে হাত রাখল মারজানও।
খানিক বাদে নিজেকে সামলে মারজানের হাঁটুর ওপর রাখা হাতদুটো নিজের হাতে নিল ইজান। মারজানের দৃষ্টি নিচু, সেখানে টলমল করছে জল।
“মারজান, আমি….” আর কিছু বলার আগেই ওর ঠোঁটে হাত চাপা দিল মারজান। চোখ তুলে ইজানের চোখে রাখল। চোখের কিনারায় আর আটকাল না জলবিন্দু। টুপটাপ দুফোঁটা গড়িয়ে এলো নিচে। ত্রস্ত হাতে সেগুলো মুছে দিল ইজান। “তুমি কাঁদছ কেন?”
“সবাই আমার জন্য তোমাকে দোষ দিচ্ছে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।“ গড়গড় করে আরও কয়েকটা ফোঁটা নেমে এল গাল বেয়ে।
“কী বলছ তুমি? আমারই তো দোষ। আমি যদি এভাবে রাগ করে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে না দিতাম, তুমি কি এই ভয়ংকর কাণ্ডটা করতে? এই দেখো, আবার কাঁদছে। প্লিজ কেঁদো না। আমার কত কষ্ট হচ্ছে কালকে থেকে ভাবো একবার।” কণ্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলল ইজান।
“সেটাই তো। সবাই যেটা ভাবছে, সেটাই তো না। সবাই তো তোমরা ভুল ভাবছ। আমি কালকে থেকে তোমাকে বলতে চাইছি, কিন্তু কেউ সুযোগই দিল না।“
“মানে কী?”
“মানে….. আমি তো স্যুইসাইড করতে যাইনি। শুধু একটু হাত কেটে দেখতে চেয়েছিলাম কেমন কষ্ট হয়।“ আমতাআমতা করে বলল মারজান।
(চলবে)