#ডেস্পারেট_লেখিকা
-Farhina Jannat
১৩.
ইজান বিস্মিত হবার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছে। পলক না ফেলে শুধু তাকিয়ে রইল মারজানের দিকে। চেহারায় কোনো পরিবর্তন না এনে ধীর কন্ঠে উচ্চারণ করল তিনটা শব্দ, “কোনো লেখার জন্য?”
উপর নিচে মাথা দোলাল মারজান। ইজান কিছু না বলে পরাস্ত সৈনিকের ন্যায় দু’হাতে মুখ ঢাকল। এই মেয়েকে সে কী বলবে? আজ কেন যেন রাগও হচ্ছে না। শুধু এক অদ্ভুত হতবিহ্বলতা ওকে কাবু করে ফেলেছে।
ইজানের নীরব প্রতিক্রিয়া দেখে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল মারজান। “আমি… আমি… এখুনি সবাইকে গিয়ে বলছি যে সত্যিটা কী।“ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। তড়িৎ গতিতে ওর হাত ধরে ফেলল ইজান।
“দাঁড়াও!” শান্ত স্বরে বললেও এমন গম্ভীর হুকুমের মতো শোনাল শব্দটা যে মারজান থমকে গেল। “তাহলে দোষ তুমি করেছ, আর দোষ হয়েছে আমার। তাই তো?” বলল ইজান।
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল মারজান। “তাহলে এর শাস্তি আমি তোমাকে দিব। তোমার শাস্তি এটাই যে তুমি এটা কাউকে বলতে পারবে না। সবাই যা জানে, সেটাই জানুক। তোমার এই বোকামীর খবর আমি আর তুমি ছাড়া যেন আর কেউ না জানে।“
“কিন্তু ইজান, সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি তোমাকে আমার কাজের দায়ভার কীভাবে নিতে দিই? আমি শুনেছি, বাবা আর ভাইয়া তোমাকে কীভাবে একিউজ করছিল। আমি চুপ থাকতে পারব না।“ আবারও দুচোখে পানি টলমল করে উঠল মারজানের।
“হাজব্যান্ড ওয়াইফের সম্পর্কটা একটু কমপ্লিকেটেড, মারজান। মাঝে মাঝে অধিক ভালো কিছুর জন্য একজনের দায় আরেকজনকে নিতে হয়। আর আমারও দোষ আছে বই কী। তোমার ছোটো ছোটো পাগলামি এতদিন প্রশ্রয় দিয়েছি। বুঝিনি যে একদিন এই দিনও দেখতে হবে।“ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ইজান।
“কিন্তু….”
“কোনো কিন্তু না। আমার কথার যদি বিন্দুমাত্র দাম তোমার কাছে থাকে, তাহলে আমার কথা শুনবে তুমি। এটাই আমার শেষ কথা।“
এত সিরিয়াস ভাবে ইজানকে এর আগে কখনো কথা বলতে দেখেনি মারজান। তাই এখন আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেল। কিন্তু সবার সামনে এভাবে ইজানকে ছোটো করে রাখতে ও পারবে না। ওকে সত্যিটা বলতেই হবে।
***
দুপুরের খাবারের পরে ঘুমিয়ে পড়েছে মারজান। ইজানের চোখে ঘুম নেই। কপালে হাত দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ও। মারজানের লেখালেখি নিয়ে ওর কোনো আপত্তি নেই। এরকম প্রতিভা বরং লুকিয়ে রাখাই অন্যায়। কিন্তু ওর ডেস্পারেশনটা ক্ষতিকর। কীভাবে এই জিনিসটা বোঝাবে মারজানকে? এভাবে চলতে থাকলে, আজ নিজের হাত কেটেছে, কোনোদিন রাস্তায় গাড়ির নিচে হাত পা দিয়ে ফেলবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? কিছু একটা করতে হবে। কিন্ত কী? জানালার পর্দা টানা থাকা সত্ত্বেও কিছু একটার আলো বিরক্তির উদ্রেক করছে। টেবিলের দিকে তাকাতেই উৎসটা চোখে পড়ল। মারজানের ল্যাপটপ অন করা। কোনো এক অদ্ভুত কারণে মারজান ল্যাপটপের অটো স্লিপ অপশনটা পছন্দ করে না। তাই ও নিজে অফ না করা পর্যন্ত অন থাকে স্ক্রিন। ইজান উঠে দাঁড়াল ল্যাপটপটা অফ করার জন্য।
বেশ কিছু ওয়ার্ড ডকুমেন্ট ওপেন করা। সেগুলো সেভ করে নিতে চাইল ইজান। এক এক করে ডকুমেন্টগুলো ক্লোজ করতে গিয়ে একটা বেনামি ডকুমেন্ট এ থমকে গেল।
চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল ও। এই জিনিস মনযোগ দিয়ে পড়তে হবে। জিনিসটা একটা চিঠি। শুরুতে সম্বোধন, ডিয়ার ইজান।
চিঠিটা খুব বেশি বড় না। যত পড়ছিল, ওর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। আর শেষ করার পর তো আনন্দের আতিশয্যে ইজানের চেহারা যেন চমকাচ্ছিল। চিঠিটা শেষও হয়নি৷ মাঝপথেই রেখে দিয়েছে। হয়তো আরও কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তাতে অসুবিধা নেই। যা জানার, তা জানা হয়ে গেছে। লেখিকা বউ নিজের মনের খবরও জানাতে চায় চিঠি লিখে। বেশ তো! কবে এই জিনিস পাঠায়, ইজানও অপেক্ষা করবে। কিন্তু আপাতত এই জিনিস হাতছাড়া করা যাচ্ছে না। সুন্দর করে চিঠিটা ওর মেইলে সেন্ড করে মারজানের সেন্টবক্স থেকে ডিলিট করে দিল। তারপর উঠে এসে ঘুমন্ত মারজানের কপালে নিবিড়ভাবে একটা চুম্বন এঁকে দিল। ওর একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে মনে মনে দৃঢ় প্রত্যয় নিল, মারজানকে সঠিক বুঝ ও-ই দিবে। ওকে দিতেই হবে।
***
তিনদিন পর। মারজানের শরীর এখন যথেষ্ট সুস্থ। বিকেলে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল ইজান। আজকেই এই দফা শশুরবাড়িতে থাকার শেষ দিন। কাল সকালে নাস্তা করে ইজান নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে।
রাত প্রায় বারোটা। কয়েল জ্বালিয়ে দুজনে দোলনায় বসেছে। মারজানের মাথা ইজানের কাঁধে, হাত ইজানের মুঠোয় বন্দী। দুজনেই অদ্ভুতভাবে চুপ করে আছে। আজকে ঘোরাঘুরির পুরো সময়টাও মারজান আশ্চর্যজনকভাবে চুপ ছিল। ওর উত্তেজনা, বাইরের দৃশ্য, মানুষ দেখার আগ্রহ, কিছুই পায়নি ইজান ওর মধ্যে। তাই এখন ইজান চুপ থেকে ওর ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করছে।
“মন খারাপ, মেরি জান?” মৃদুস্বরে জানতে চাইল ইজান।
“হুঁ” সোজাসাপ্টা উত্তর মারজানের।
“কেন?”
উত্তরে কিছু না বলে আরও একটু ঘন হয়ে বসল মারজান, হাতের মুঠো আরেকটু শক্ত হলো। বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইজান। ওর নিজের ভেতরেও কি একই অনুভূতি খেলা করছে না? বিয়ের পর এই প্রথম একটানা এতগুলো সময় ওরা একসাথে কাটিয়েছে। টানা তিনদিন, তিন রাত। এরপর বিচ্ছেদ যে কতটা কষ্টের, তা তো কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে।
“তাহলে একটা কাজ করি?” নিজের মন খারাপকে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে কন্ঠে স্ফূর্তি আনতে চাইল ইজান।
হঠাৎ করে ইজানের কন্ঠস্বর বদলে যাওয়ায় মুখ তুলে চাইল মারজান। চোখের দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা।
“আমার মিষ্টি বউটার যখন আমাকে ছেড়ে থাকতে এত কষ্ট হচ্ছে, তখন আংকেলকে বলি, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া হাম লেকে যায়েংগে’?”
“কীহ?” বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল মারজান।
“আরেকটা বছর ওয়েট করা খুব বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে মেরি জান!” মারজানের কপালে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছোয়াল ইজান।
একটা মিষ্টি বাসন্তী বাতাস যেন বয়ে গেল মারজানের হৃদয়ের কোল ঘেঁষে। পরমুহূর্তেই সেটা জমে গেল শীতলতায়। সুফিয়া আন্টি! ঢোক গিলল মারজান। উপরে মিষ্টি, ভেতরে তিতা এই মহিলার আচরণে সে আগে কনফিউজড ছিল। কিন্তু এবার হাসপাতালে থাকা অবস্থায় উনার যে শীতল চাহনি সে দেখেছে, তাতে আর কোনো আশা-ভরসা মারজান দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু, ইজানের সাথে থাকতে পারা! তার জন্য কি এটুকু সহ্য করা যায় না? মন যেন আবারও আকুল হতে চাইল।
ইজান মনযোগ দিয়ে মারজানের গভীর চিন্তায় ডুবে যাওয়া মুখখানি দেখছিল।“কী ব্যাপার ম্যাডাম, খুব ঝামেলায় ফেলে দিলাম দেখছি!”
লজ্জা পেল মারজান। বদটা গভীর দৃষ্টি দিয়ে ওর ভেতরের আকুলতা আবার পড়ে ফেলল না তো!
“কীসের ঝামেলা? কোনো ঝামেলা নাই। আর কোন কষ্টের কথা বলছ? হুহ! তোমার জন্য কষ্ট পেতে আমার বয়েই গেছে।“ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল মারজান।
“ইশ! আমার বউটা মিথ্যা কথা বলতে মোটেই শিখেনি। গলায় জোর আনলেই বুঝি সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যায়?”
“তোমার মাথা” মুখ বাঁকাল মারজান।
“আচ্ছা বেশ, যো মহারাণী কি মর্জি! এখন একটা কথা বলব, শুনবে?”
“হ্যাঁ, বলো” ইজানের কণ্ঠে সিরিয়াসনেস ফিরে এসেছে, খেয়াল করল মারজান।
“তোমার বুকশেলফে এত এত বই, যার প্রভাব তোমার লেখায় পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু একটা সারির কোনো প্রভাব আমি খুঁজে পাইনি। বলো তো, কোন সারির?”
“কোন সারির?” বিস্মিত কণ্ঠে বলল মারজান। ওর লেখায় যে ওর বুকশেলফের বইয়ের প্রভাব আছে, এই জিনিসটাই তো ও জানে না।
“এসো” হাত ধরে উঠিয়ে ওকে ঘরে নিয়ে এল ইজান।
বুকশেলফ থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে উপরের সারির দিকে ইশারা করল ও।
“পড়েছ, ওগুলো?”
লজ্জার একটা হালকা ছায়া যেন সরে গেল মারজানের চেহারার উপর দিয়ে। হালকাভাবে মাথা এদিক-ওদিক নাড়ল মারজান।
“কিন্তু নিচের সারিরগুলো? একটাও কি বাকি আছে পড়তে?”
একইভাবে মাথা নাড়ল মারজান, নেই। যেকোনো বই কেনার কয়েকদিনের মাথাতেই সেটা পড়ে ফেলে ও। তারপর মাঝে মাঝে পুরনো বই টেনে পড়ে।
“কেন, মারজান?” কন্ঠে ঈষৎ আক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইল ইজান।
“আমি যখন এমন বুকশেলফ বানিয়ে চেয়েছিলাম, তখন উপরের সারিটা আব্বু ভরে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে ঠিক পড়ে নিব। কিন্তু ওই, আর পড়া হয়নি।“
কথাটা বলতে গিয়ে নিজের কাছেই যেন নিজে ছোটো হয়ে গেল মারজান। একজন মুসলিমাহ হিসেবে সে জানে, এ জীবনের পরের যে জীবন, সে জীবনে কাজে লাগলে কেবল ওই বইগুলোই লাগবে। নিচেরগুলোর কোনো ভ্যালু নেই। ওগুলো কেবলই মনের খোরাক। কিন্তু উপরের তাফসীর, হাদীস, সীরাহ আর সাহাবীদের জীবনীগ্রন্থগুলো, শুধু এ দুনিয়ার পথনির্দেশিকাই নয়, বরং আখিরাতের পাথেয়ও। তাই ওগুলোই পড়া উচিত ছিল সর্বাগ্রে। সেজন্যই কি আব্বু সর্বপ্রথম ওগুলো কিনে দেননি? কিন্তু কী করেছে ও? মাঝে মাঝে শুধু কুরআন শরীফটা নামিয়ে তেলাওয়াত আর রমজান মাসে খতম দেয়া ছাড়া বাকি একটা কিতাবও কোনোদিন খুলে দেখেনি। ওগুলো কেউ পড়লে শুধু আব্বু আর আম্মুই পড়েছে। ওকে পড়তে বললে আলগোছে এড়িয়ে গেছে।
“আমিও তাই ভেবেছিলাম!” নিজের সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়েছে ইজানের। এই কিতাবগুলো শুধু মারজানের লেখায় নয়, ওর জীবনেও প্রভাব ফেলত। ওর ডেস্পারেশনও এমন পর্যায়ে যেত না বলেই ইজানের বিশ্বাস।
“আরে, এভাবে মুখ কালো করার কী হলো? সময় কি ফুরিয়ে গেছে? এতদিন পড়োনি তো কী হয়েছে? এখন থেকে পড়বে। আমরা দু’জনে মিলে প্রতিযোগিতা করে পড়ব, ইন শা আল্লাহ।”
দোলনায় ফিরে এলে মুখ খুলল মারজান। “কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে, আমি ওগুলো পড়িনি?”
“একজন মানুষ যখন কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করে, তখন সেই কাজে তার সারাজীবনের অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা আর অভিজ্ঞতার ছাপ দেখা যায়। তোমার লেখায় আমি সামাজিকতা, জীবনবোধ, বন্ধুত্ব, মা-বাবার মমতা-ভালোবাসা, রোমান্টিকতা, সবই পেয়েছি, কিন্তু কোথাও দ্বীনের ছোঁয়া পাইনি। অথচ তুমি একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিমাহ। সেখান থেকেই আমার ধারণা হয়েছে, তুমি শুধু এক্ষেত্রে আংকেল আন্টিকে ফলো করেছ, নিজে কোনো জ্ঞানার্জন করোনি। যার ফলে এর কোনো প্রভাব তোমার লেখায় নেই।“
বিস্ময়ে যেন বিমূঢ় হয়ে গেল মারজান। ইজান এত খুঁটিয়ে ওর লেখা পড়েছে! এরকম কাউকেই তো ও চেয়েছিল নিজের পাশে। পরমানন্দে চোখে পানি আসতে চাইল। অনেক কষ্টে সেটা আটকাল মারজান।
এসব অবশ্য খেয়াল করল না ইজান। সে তখনও বলে যাচ্ছে, “শুধুমাত্র দুনিয়াবি জ্ঞান দ্বারাই যদি তোমার লেখা এত সুন্দর হয়, ভেবে দেখো, দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের পর সেই লেখার মান কোথায় পৌঁছাতে পারে? তাই আমার সাজেশন হলো, লেখালেখির সাথে সাথে আমরা ওদিকেও জ্ঞানার্জন করব। আর ভালো কাজ শয়তানের খুবই অপছন্দ। সে তো আমাদের করতে দিবে না। তাই আমরা দুজনে একসাথে করব। যাতে একজনকে শয়তানে ধরে পিছিয়ে দিলে আরেকজন পেছন থেকে ঠেলা দিতে পারে। কী, বুদ্ধি কেমন?”
এখনও মারজানের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। সে শুধুই কয়েকবার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, বুদ্ধিটা আসলেই দারুণ।
(চলবে)