#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat
৪.
বুড়িগঙ্গা সেতুর ঠিক মাঝখানে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইজান। ওর ফাঁকা দৃষ্টি নদীর কালো বুক চিরে ইতিউতি ভেসে চলা ডিঙি নৌকাগুলোর দিকে, না কি সামনের অসীম মহাশূন্যের দিকে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইজানের ভেতরে অস্থিরতা। পড়ার টেবিলে মনকে বসাতে ব্যর্থ হয়ে ছুটে এসেছে তাই নদীর বুকে খোলা হাওয়ায়।
কেটে গেছে দুটো সপ্তাহ। বিয়ের পরদিনই শশুড়বাড়ি থেকে চলে এসেছিল ইজান। কিন্তু মারজানের ক্রমাগত তাগিদে গল্প পড়া থেকে রেহাই পায়নি। সেদিন রাতে বাধ্য হয়ে সেই এগারোটা পর্ব পড়তে হয় ওকে। আর পড়তে গিয়ে ভীষণ অবাক হয় ইজান। বউয়ের অনুরোধ রক্ষা করতে হবে বলে কোনরকম চোখ বুলাচ্ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব থেকে এমনভাবে ডুবে গেল গল্পের মধ্যে যে ঘুম টুম কোথায় পালিয়ে গেল। অস্থির হয়ে খুঁজছিল বারো নম্বর পর্ব এখনও কেন দেয়া হয়নি। সাথে সাথে সে ফোন দেয় মারজানকে। লেখিকা তখন লেখালেখি সেরে সবে গভীর ঘুমে তলিয়েছেন, ফোনের রিংটোনের কী সাধ্য সে ঘুম ভাঙাবে?
পরদিন মারজান ওকে রিশাতের চিন্তাভাবনা নিয়ে যা যা জানতে চাইল, বেশ সুন্দর করে সেগুলোর উত্তর দিল ইজান। মারজানের খুশি তো আর ধরে না। বিয়ে করতে চেয়ে যে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপর দিনেরাতে কলেজ আর কোচিং এর সময়গুলো বাদে যখন তখন বেজে উঠতে লাগল ইজানের ফোন। বিয়ের পরপর বউয়ের অবিরাম ফোনকল পেতে কোন বরের না ভালো লাগে? কিন্তু সেই ফোনকলের শুরু যদি হয় গল্পের নায়কের ছ্যাঁকা খাওয়ার ব্যথা আর শেষ হয় প্রথমবার চাকরি পাওয়ার অনুভূতি দিয়ে তাহলে কোনো বরেরই মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক রোমান্টিক মনে হবে না। তবে হ্যাঁ, এরপর আর বলে বলে নতুন পর্বগুলো পড়াতে হয়নি মারজানকে। পোস্ট করার সাথে সাথেই বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ে ফেলে ইজান। ইজানের কেমন লেগেছে সেটা মারজান আবার খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে। প্রত্যেকটা পাঠকের মন্তব্যই নাকি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এই দু’সপ্তাহে আরও দুইবার শশুড়বাড়ি গেলেও রাতে সেখানে থাকা হয়নি ইজানের। কারণ তার নিজের এডমিশন কোচিং এ লাগাতার মডেল টেস্ট চলছে। তবে এর মাঝেও একটু সময় বের করে ঘুরতে বেরিয়েছিল মারজানকে নিয়ে, কিন্তু অভিজ্ঞতা সেখানেও সুখকর হয়নি ইজানের জন্য। সারা পথ মারজানের সমস্ত মনযোগ থাকে রাস্তায়। পাশে একটা মানুষ বসে আছে নাকি কলাগাছ, তার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। দ্বিতীয় দিন রেস্টুরেন্টে বসে জিজ্ঞেস না করে পারেনি ইজান, এত কী দেখে ও। উত্তর দিল, সবকিছু। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মানুষ দেখে, মানুষের ব্যস্ততা, তাদের জীবনযাত্রা দেখে। রাস্তার কুকুর-বিড়ালগুলোকেও দেখে। হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাইকেই দেখো, দেখোনা খালি এই ইজানকে, বিড়বিড় বলে উঠেছিল ইজান। এছাড়া কোন রাস্তা কোথায় গিয়ে পড়ছে, কোন বাঁকে কয়টা গাছ কিংবা দোকানপাট আছে, কোথায় ভিক্ষুক বসে, কোন ফুটপাতে কোন জিনিসের পসরা বসে, সেগুলোও খেয়াল করে সে। কখন কোন গল্পে লেগে যায়, বলা তো যায় না। কথাগুলো শুনে ইজানের ফিলিং হয়েছিলো ফেসবুকের ওই ইমোজিটার মতো, যেটার চোখ মুখের যায়গায় তিনটা লম্বা দাগ টানা থাকে।
বিয়ের আগে কী ভেবেছিল আর এখন কী হচ্ছে। মনের মধ্যে কত আশা আর স্বপ্নের জালই না বুনেছিল, বন্ধুদের মত সেও এখন থেকে রাত জেগে প্রেয়সীর সাথে ফোনালাপ করবে। সকাল বিকাল হাজারবার কারণে অকারণে মেসেজের টুংটাং এ মন নেচে উঠবে। তিনবেলা “বাবু, খাইসো?” টাইপ মেসেজও কত মধুর লাগবে। ও আচ্ছা, টুংটাং বাজছে তো ফোন, কিন্তু কেন? না, লেখিকার কিছু একটা জানার ইচ্ছে হয়েছে। ইজান যেন তার সার্চ বাটন। কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা থাকলেই তার জবাব ইজানের কাছে পাওয়া যাবে। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল, মারজান যে জিনিসগুলো জিজ্ঞেস করে, সেগুলো পরের পর্বে গরুখোঁজা খোঁজে ইজান। কিন্তু সরাসরি তো নয়ই, তার ধারেকাছের কিছুও থাকে না লেখায়। প্রশ্নগুলো নাকি তার হঠাৎ হঠাৎ মনে চলে আসে। তাই যখন জানতে ইচ্ছে করে তখন জেনে নেয়। কে জানে, কখন কোন লেখায় কাজে লেগে যায়?
সবথেকে দুঃখের কথা হচ্ছে, ব্যক্তি ইজানের কোন বিশেষত্ব বা গুরুত্ব যেন মারজানের কাছে নেই। ইজান কেমন আছে, কী করছে, ওর পড়ালেখা কেমন হচ্ছে, এসব কিছুর প্রতি ওর কোন আগ্রহই নেই। এমনকি ইজান এমন কিছু জিজ্ঞেস করলে সেটার উত্তরও কোনোরকম দিয়ে সে ফিরে যায় নিজের ইম্পর্ট্যান্ট টপিকে। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে, তবে কদাচিৎ। মোটকথা, নিজের লেখকসত্তার বাইরে ওর যেন আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।
ইজানের মনে হচ্ছে, মারজানের সাথে ওর সম্পর্কের কোন উন্নতিই হয়নি। যে সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল ভালোবাসার কিংবা নিদেনপক্ষে বন্ধুত্বের, সেটা ওই জিজ্ঞাসা আর জবাবেই আটকে আছে।
“আরে, ইজান না?” পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ শুনে ঘুরল ইজান। রাফায়েত ভাইকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা, আনন্দের আতিশয্যে তাকে জড়িয়ে ধরল ইজান। আল্লাহ সত্যিই বান্দার মনের গোপন ইচ্ছার খবর রাখেন। ইজানের অস্থির মন রাফায়েত ভাইয়ের মত কাউকেই খুঁজছিল।
রাফায়েত ভাই ওর মাদ্রাসা হোস্টেলে রুমমেট ছিল। সবদিক দিয়ে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে এমন আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে আজ ছয় বছর পরেও সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। যেকোনো সমস্যা, যেকোনো অসুবিধায় ওর সবার প্রথমে রাফায়েত ভাইয়ের কথাই মনে পড়ে।
কুশলাদি বিনিময়ের মাঝেই রাফায়েত ভাই ইজানের মনের অস্থিরতা বুঝে ফেললেন। জানতে চাইলে আর লুকালনা ইজান, নিজের মনের কথাগুলো খুলে বলল। মনে মনে ভয় পাচ্ছিল, রাফায়েত ভাই হয়ত হো হো করে হেসেই উড়িয়ে দিবেন পুরো বিষয়টা। কিন্তু ওর সন্দেহ ভুল প্রমাণ করে মনযোগ দিয়ে সবটা শুনলেন তিনি।
“হুমম, বুঝতে পেরেছি তোর বক্তব্য। এখন আমি যা যা জিজ্ঞেস করব, তার ঠিকঠাক উত্তর দিবি। ভালোবাসিস ওকে?”
“এটা কেমন প্রশ্ন ভাই, ভালোবাসি বলেই তো এত আপসেট হচ্ছি।”
“উঁহু! আমার কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না।”
“মানে?”
“ও তোকে বিয়ে করেছে যেই কারণে, সেই উদ্দেশ্য তার পূরণ হচ্ছে, তাই সে হ্যাপি। কিন্তু তুই যে উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিস, সেটা তুই পাচ্ছিস না, তাই তুই আনহ্যাপি। এখানে ভালোবাসা তো দেখছি না আমি”
হকচকিয়ে গেল ইজান, কী বলছে রাফায়েত ভাই?
“তুই যদি ওকে ভালোবাসতি, তাহলে ওর এসব কাজগুলোকেও ভালোবাসতি। ভালোবাসায় এক্সপেকটেশন থাকে, কিন্তু এক্সপেকটেশন ফুলফিল না হলে মাত্র দুই সপ্তাহেই মানুষ এভাবে হতাশ হয় না, তোর মতো”
মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল ইজান, রাফায়েত ভাইও বুঝতে পারছে না ওকে।
“বুঝলিনা তো! আচ্ছা, একটা কথা বলতো, এই যে মারজানকে তুই ভালোবেসে ফেলেছিস, কেন মনে করছিস যে ওকেও তোকে ভালোবাসতে হবে? বিয়ে করেছিস বলে?”
মাথা নাড়ল ইজান।
“মিসটেক! গ্রেট মিসটেক! তিন অক্ষরের একটা শব্দ হয়ত ঘরের ভেতরে ঢোকাতে পারে, কিন্তু সবসময় মনের ভেতরে ঢোকাতে পারেনারে পাগলা! কারো অন্তরে প্রবেশের পথটা এতটাও সহজ নয়। হয়ত কারও কারও ক্ষেত্রে এই একটা শব্দই যথেষ্ট হয়, আবার কারও সারা জীবনের সাধনাতেও সিদ্ধিলাভ হয় না। আমরা হয়ত সেসব ভাগ্যবানদের দলে নই” রাফায়েত ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাস ইজানের নজর এড়াল না।
“আমরা মানে? ভাই! আপনার..”
“আরে না! আমি তো কথাটার গুরুত্ব বুঝাতে আমরা বললাম। এখন বল, কিছু বুঝলি, কী বললাম?”
“এখন কি আমাকে ওর মনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে হবে?”
“কেন? ঢুকতে চাস না?”
“না মানে…”
“না মানে তুই ভেবেছিলি তোকে কিছুই করতে হবে না। এনাদার মিসটেক! তুই বিয়েটা বড্ড টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়ে নিয়েছিস। তুই মারজানের কাছে যা যা আশা করছিস, সেগুলো তোর হক, অধিকার বলে মনে করছিস। কিন্তু সেগুলো যে তোকে কষ্ট করে অর্জন করে নিতে হতে পারে, সেটা ভাবিসনি। তোর বয়সী অন্য ছেলেদের কথা ভাবতো! কী করে তারা, যখন কারও প্রেমে পড়ে? প্রেয়সীর মন জয় করার জন্য কতকিছু করে দেখেছিস? মন জয় করা হয়ে গেলেও পুরোপুরি শান্তি নাই, আবার অপেক্ষা। বিয়ে হবে তো? নিজের করে পাবো তো? আশা নিরাশার শেষ নাই। আর তোকে দেখ, শেষ এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটাই ডান। তুই তোর ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেছিস। তাই বলে আগের স্টেপগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিস না ইজান। জয় করে নে নিজের প্রেয়সীর মন”
“কীভাবে?”
“ওর পছন্দ অপছন্দগুলো বোঝার চেষ্টা কর, দেখবি একটা সময় ওও সেটা করবে। একটা জিনিস মনে রাখবি, আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন চাই সেই মানুষটাও আমাদের এক্স্যাক্টলি তেমন করেই ভালোবাসুক। আমরা কেন যেন তাকে আমাদের মনমতো চাই। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তাদের ভালোবাসার ধরণও তাই আলাদা। অন্যকে নিজের মতো করতে সবাই চায়, কিন্তু নিজেকে অন্যের পছন্দমতো করে নিতে খুব কম মানুষই পারে”
হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল ইজান। ওর পিঠ চাপড়ে দিল রাফায়েত।
“আপাতত দুশ্চিন্তা বাদ দে। তোর বউ তোরই আছে, আর তোরই থাকবে। মাত্র দুইটা সপ্তাহ হয়েছে বিয়ের। সম্পর্কটা তৈরি হতে সময় দে, সারাজীবন পড়ে আছে ভাই আমার। তুই বল, ক্লাসমেট বেস্ট ফ্রেন্ড এ পরিণত হতে সময় লাগে না? তোর আর আমার আজকের সম্পর্ক কি একদিনে তৈরি হয়েছে? যত দিন যায়, বন্ধুত্ব তত গাঢ় হয়। সব সম্পর্কই তাই। পরিণত হতে সময় লাগে”
ভীষণ লজ্জা লাগছে ইজানের। নিজেকে এত বোকা এর আগে কখনো মনে হয়নি ওর। ওর মনের কথাটা যেন পড়ে ফেলল রাফায়েত।
“কীরে! মন খারাপ হয়ে গেল নাকি? হয়, হয়! এরকম সবারই হয়। আচ্ছা আচ্ছা মানুষ প্রেমে পড়ে আর বিয়ে করে বোকা হয়ে যায়, তুই তো সেখানে নেহাৎই শিশু। নিজেকে বোকা মনে করে লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই। তোর কথা শুনে মনে হলো মারজান মেয়েটা খুব সহজ-সরল। দ্য গ্রেট লেখিকার ভালোবাসা তুই পাবি ইজান, ডোন্ট ওরি। অভাগাদের দলে তোর নাম উঠবে না। আমি এবার যাই বুঝলি? দেরি হয়ে যাচ্ছে”
“ঠিক আছে ভাই, দোয়া কইরেন আমার জন্য”
“অবশ্যই!” আরেকদফা পিঠ চাপড়ে দিল রাফায়েত। “আল্লাহ হাফেজ”
“ভাই, শুনেন?” হাঁটার জন্য জিঞ্জিরার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল রাফায়েত, মুখ ফেরাল আবার, চোখে জিজ্ঞাসা। “আমি ছোট মানুষ, আপনার মতো হয়ত উপদেশ পরামর্শ দিতে পারব না। কিন্তু দুইটা কান তো আল্লাহ দিয়েছে, শুনতে পারব। নিজের মনের কথাগুলা এই ছোট ভাইরে বললে মনটা হালকা হবে। ভেবে দেইখেন কথাটা”
“ওরে বাবা! তুই তো বড় হয়ে গেছিস রে! অবশ্য বিয়ে করে ফেলসিস, বড়ই তো! যা, বাড়ি গিয়ে পড়তে বস। ঢাকায় চান্স না পাইলে বউকে ছেড়ে থাকতে হবে কিন্তু। সো, ভালো করে পড়”
“হুঁ!”
(চলবে)