ডেস্পারেট_লেখিকা –Farhina Jannat ৭.

0
132

#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat

৭.
বাসায় ঢুকে কাপড়গুলো খোলার পর নিজেকে মুক্ত মুক্ত লাগছিল ইজানের। মেসেজ আসার টুং শব্দে ফোনটা হাতে নিল ও। মারজানের মেসেজ।

‘I am so lucky to have u, Ijan। যে জিনিসটা আমি বুঝতেও পারছিলাম না, সেটা কত সহজেই না তুমি বুঝে ফেললে। আল্লাহ বোধহয় তোমাকে আমার সব সমস্যার সমাধান করতেই পাঠিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া। কিন্তু তোমাকে কী বলে থ্যাংকস দিব আমার জানা নেই। তুমিই বলো না, তোমার কী চাই?

NB: হাসার জন্য স্যরি। কিন্তু ইয়ে, বলছিলাম যে, আমি তো আমার গল্পের নায়কদের হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবি ছাড়াও আরও অনেক কিছুই পরিয়েছি। সব বাদ দিয়ে….???’

হেসে ফেলল ইজান। মনটা হালকা হয়ে গেল। ফোনটা বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল ও। আমার কী চাই? আমার চোখে তোমার জন্য যে অনুভূতি খেলা করে, তোমার চোখেও আমার জন্য সেই অনুভূতির প্রকাশ দেখতে চাই। আর কিচ্ছু না। বিড়বিড় করল ইজান।

***
‘সি-গ্রিন কালারের একটা শাড়ি পড়েছে সুহানা। হ্যান্ডপ্রিন্ট এর শাড়িটার নিচের জমীন আর আঁচলের অংশে নুড়িপাথর আর শামুক ঝিনুকের ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছে যেন বালুকাবেলা সমেত আস্ত একটা সমুদ্র সৈকত গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে সে। সাদা রঙের কীসের একটা জড়োয়া গহনা আর খোপায় পরা ধবধবে সাদা গাজরা ঢেউয়ের সাদা ফেনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।’

মোবাইলটা বুকের ওপর রেখে চোখ বুজল ইজান। অবশ্য চোখ না বুজলেও চলত। পড়তে পড়তেই ও সুহানার জায়গায় মারজানকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। এখনো পাচ্ছে। ইশ! কী অপূর্বই না লাগছে।

চোখ খুলেই মারজানের নাম্বারে ডায়াল করল ইজান।
হাই তুলতে তুলতে সালাম দিল মারজান। মনে পড়ল ইজানের, মারজান পর্ব পোস্ট করার পরেই শুয়ে পড়ে।

“স্যরি! ঘুমের সময় ডিস্টার্ব করতে কল দিয়েছি। কিন্তু কথাটা না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না” সালামের উত্তর দিয়ে বলল ইজান।

“বলো, প্রব্লেম নাই। আমি শুইনি এখনো, ক্লান্তিতে হাই উঠছে”

“ওকে। সুহানাকে যে শাড়ি পরিয়েছো, সেম ওই জিনিস হোক বা না হোক, আমি ওই কালারের শাড়ি পরে তোমাকে দেখতে চাই। তোমার কাছে থাকলে ভালো, না হলে আমি তোমাকে কিনে দিতে চাই”

“ইশ! আর এক ঘন্টা আগে বলতা!” আরও একটা হাই তুলে আফসোসের স্বরে বলল মারজান।

“এক ঘন্টা আগে কীভাবে বলব? তুমি তো পর্ব দিলাই দশ মিনিট আগে”
“ও হ্যাঁ, তাই তো”
“কিন্তু এক ঘন্টা আগে বললে কী হতো?”
“তোমার আশা পূরণ হতো”
“মানে?”

“মানে হ্যান্ডপ্রিন্ট এর না, কিন্তু এই কালারের মধ্যে হাফ সিল্কের একটা শাড়ি আছে আম্মুর। হোয়াইট জুয়েলারি এটার সাথে মানায় কি না বোঝার জন্য পরেছিলাম”

“মানে মানে তুমি শাড়ি পরতে পারো?”
“আগে পারতাম না, কয়মাস হলো শিখেছি। একটা গল্পের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল।”

“হ্যাঁ, তোমার সমস্ত প্রয়োজনের শুরু তো গল্প দিয়েই হয়। বাট হাউ কাম আমি তোমাকে এখন পর্যন্ত শাড়ি পরে দেখলাম না?” মুখ গোঁজ করে বলল ইজান।

“তুমি তো এর আগে বলোওনি যে আমাকে শাড়ি পরে দেখতে চাও। বললেই তো পরতাম।”

“কোন হাজবেন্ড না তার বউকে শাড়ি পরে দেখতে চায়? তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়ত শাড়ি পরতে পারো না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে, নেক্সট যেদিন আসবা আমাকে বইল, আমি শাড়ি পরব, ওকে?”

“নট ওকে। তুমি আজকে এত সুন্দর শাড়িটা পরলা, আমাকে একটা ভিডিও কল দিতে পারতা! নাইলে এটলিস্ট একটা ছবি তো দিবা! তোমার সকল সাজসজ্জা না আমার জন্য হওয়ার কথা।”

“ইয়ে, আসলে মাথায় লেখার চিন্তা ঘুরছিল তো, তাই এসব মাথায় আসেনি। স্যরি?”
“একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”

“নেক্সট টাইম যা পরে যেভাবেই সাজোনা কেন, আমাকে দেখাইতে হবে”
“ওকে ডান। ইন শা আল্লাহ আর ভুল করব না। এবার ঠিক আছে?”
“হুমম ঠিক আছে”

ইজানের শখ পূরণ হয়ে গেল ঠিক দুইদিন পরেই। রাত তখন বাজে দুটো। ইজান মাথা চুলকাতে-চুলকাতে পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের ম্যাথ সলভ করছে। পরেরদিন কোচিং এ এক্সাম আছে আর ও একটা পর্যন্ত মারজানের একটা উপন্যাস পড়েছে পড়ার টেবিলে বসে বসে। এদিকে এ বিদঘুটে চ্যাপ্টার দুইটার প্রিপারেশন ওর সবথেকে খারাপ। এই সময় হোয়াটসঅ্যাপের রিংটোনের শব্দে ওর অখণ্ড মনযোগ এর ব্যাঘাত ঘটল। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অবশ্য বিরক্তি হাওয়া হয়ে গেল, মারজানের নাম ভাসছে সেখানে।

হাত দিয়ে যথাসম্ভব নিজের চুলগুলো সাইজ করে ভিডিও কল রিসিভ করল ইজান। পরমুহূর্তেই বিকট একটা চিৎকার দিয়ে চেয়ারসমেত পেছনে হটল ও, আর মোবাইল ছিটকে পড়ল টেবিলের ওপর। আরেকটুর জন্য চেয়ার থেকে নিচে পড়েনি ও। মারজানের ঘরের ভেতর এই ভয়ালদর্শন মূর্তি কোথেকে এলো? কথাটা মনে হতেই ছুটে এসে ফোনটা হাতে নিল ইজান। দেখল ভিডিওটা অফ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওপাশ থেকে মারজানের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, “এই, কী হলো তোমার। এভাবে চিৎকার দিলে কেন? ভয় পেয়েছো নাকি? এত বিকট লাগছে নাকি আমাকে?”

আমাকে! ওই ভয়ালদর্শন মূর্তিটা মারজান! মাই গড!

“হেলো, ইজান! শুনতে পাচ্ছো তুমি? ইজান?”
“হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। এসব কী মারজান?”

“স্যরি! কিন্তু তুমিই না ওইদিন বললা, যা-ই সাজিনা কেন তোমাকে যেন দেখাই। ময়দা আর টমেটো সস দিয়ে ভুত সাজা যায় কিনা সেটা দেখছিলাম আসলে” আমতা আমতা করে বলল মারজান।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলল ইজান। ওর নিরবতাকে অসন্তুষ্টি বলে মনে করল মারজান।

“আই এম এক্সট্রেমলি স্যরি, ইজান। তুমি আমার সুন্দর কোন সাজ দেখতে চেয়েছিলে আসলে, আমিই বুঝতে ভুল করেছি। খুব বেশি ভয় পেয়েছো?”

“আরে না না, হঠাৎ রাতের বেলা তো, তাই চমকে গেছি আসলে” মারজানের কণ্ঠের মন খারাপের সুর সম্বিত ফিরিয়েছে ইজানের। “তুমি একদম ঠিক করেছো। খালি সুন্দর সুন্দর সাজ দেখলে চলবে কেন? এসব কিছুও দেখতে হবে। নইলে কীসের অর্ধাঙ্গ হলাম? ভিডিওটা অন করো তো, ভালো করে দেখি। ভুত সাজাটা কত ঝাক্কাস হয়েছে।”

“ওকে” গলার স্বরে স্বস্তি ফিরে এসেছে মারজানের।

“খাইসে রে! সত্যি সত্যি ময়দা আর সস মেখে এই সাজ দিসো? এ তো ভুতেরা দেখলেও ভয় পেয়ে যাবে।”

“হি হি। তার মানে সাজটা এক্কেরে পার্ফেক্ট হইসে। থ্যাঙ্কিউ। এবার তাইলে মুখ ধুয়ে এসে লিখে ফেলি।”

“এক মিনিট! তুমি কি সুহানাকে এই সাজে সাজাতে চাচ্ছো নাকি? মামুন যে ভীতুর ডিম, ও তো হার্ট এটাক করবে।”

“আরে না, অন্য কাহিনি। বলব না, বললে পড়ে মজা পাবা না”
“ওকে, য্যায়সি মেরি বিবি কি মার্জি”
“ওকে, আল্লাহ হাফেজ”
“আল্লাহ হাফেজ”

***
আইসক্রিম হাতে নিয়ে মারজানদের বাসার ছাদে পায়চারি করছে ইজান। পায়চারি বললে আসলে কথাটা যত স্বাভাবিক শোনাচ্ছে, ব্যাপারটা তত স্বাভাবিক না। বেশি নায়কোচিত ভাব দেখাতে গিয়ে দুহাতে দুইটা কোণ আইসক্রিম নিয়ে চলে এসেছে, একটা পলিও নেয়নি। এখন বামহাতে আইসক্রিম দুইটা কোনোমতে ধরে ডান হাত দিয়ে অনবরত ফোন করে যাচ্ছে মারজানকে। প্রায় দশ মিনিট হতে চলল, এই মেয়ের ফোন ধরার নামই নেই। এদিকে আইসক্রিম গলে ইজানের হাত বেয়ে নামছে। তার উপর ডাইনোসর সাইজের মশা মারজানের ভাষায় ওকে পুরো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চটচটে হাত নিয়ে মারতেও পারছে না। তাই পায়চারি করে একটু বাঁচার প্রচেষ্টা।

কিন্তু মারজান ফোনটা কেন ধরছে না? ওর তো ঘুমানোর কথা নয়। মন খারাপ, বিরক্তি আস্তে আস্তে রাগে পরিণত হচ্ছে। আর রাগটা মারজানের উপর না হয়ে ধাবিত হচ্ছে মাসুমের দিকে। শালার রোমান্টিকতার গুষ্ঠি কিলাই!

মিনিট বিশেক আগের কথা। বলবিদ্যার চ্যাপ্টারটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য মাসুম রিকোয়েস্ট করছিল বেশ কিছুদিন থেকে। সেই সুবাদেই আজকে রাতে ওর মেসে থাকতে এসেছে ইজান। রাত জেগে ওকে ভালমতো বুঝিয়ে দিবে। দুটো ম্যাথ করার পরেই নোটিফিকেশন এর টুং শব্দে ইজান বুঝে যায় মারজান পর্ব পোস্ট করেছে। মাসুমকে ম্যাথ সলভ করতে দিয়ে ও নিজে বসে যায় গল্প পড়তে। এক মিনিটের মাথায় মাসুমকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার বউটার লেখা কী রোমান্টিক দেখেছিস! মাঝরাতে প্রেমিকার কোণ আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করেছে বলে প্রেমিক আইসক্রিম হাতে পৌঁছে গেছে নায়িকার বাসার ছাদে”

“জোস মাম্মা, জোস! কিন্তু একটা কথা বল, তোর বউ তো অনেক বুদ্ধিমতী, তাইনা?” দুই আঙ্গুলে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বলে মাসুম। ভ্রু দুটো কোঁচকানো, যেন ভীষণ ইম্পরট্যান্ট কিছু ভাবছে।

“হুমম, কেন?” ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বলে ইজান।
“তুই যে পর্ব দেয়ার সাথে সাথেই পড়িস সেটা ও জানে?”
“হুঁ”

“তাহলে ব্যাপারটা এমন না তো যে, তোর বউয়েরই আসলে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করেছে আর চালাকি করে গল্পের মাধ্যমে তোকেই সংকেত দিয়েছে। দেখতে চাইছে তুই ধরতে পেরে ওর মনের ইচ্ছা পূরণ করিস কী না”

“যাঃ ওর ইচ্ছা করলে ও এমনেই মেসেজ বা কল দিয়ে বলতে পারত। ওর ভেতরে এত প্যাচ নাই”

“মাম্মা, মেয়েদের তুমি কদ্দুর চিনো? বিয়া করসো আজ কয়দিন? হে হে, এদের পেটে আর মাথায় যে কী পরিমাণ প্যাচ থাকে, বুঝতে বুঝতে লাইফ শেষ করে ফেলবা, তাও বুঝতে পারবা না” ইজানের দিকে চেয়ে বার কয়েক ভুরু নাচায় মাসুম।

মাসুমের যথেষ্ট পরিমাণ প্রেম ট্রেমের অভিজ্ঞতা আছে। ওর কথাটা একেবারে ফেলে দেয়ার মত না। তার উপর তিনদিন হয়ে গেছে মারজানকে দেখেনি, মনটা এমনিতেই আনচান করছিল। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ইজান। গল্প পরে পড়া যাবে, আগে অভিসারে যাওয়া যাক।

মারজানদের বাসার দারোয়ান কাম মালী চাচার সাথে শুরু থেকেই বেশ ভালো সম্পর্ক ইজানের। জামাইবাবা বলে সম্বোধন করে ওকে। তাই এই মাঝরাতে সোজা ছাদে চলে আসাটা কোন ব্যাপারই ছিল না। মারজানের চমকে উঠা মুখটা কল্পনা করে পুলকিত হচ্ছিল ইজান। কিন্তু সব পুলক তো মশা খেয়ে দিচ্ছে একেবারে।

রাতের নীরবতা খানখান করে বেজে ওঠা রিংটোনের শব্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল ইজান। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে শব্দটা থামাল ও। মারজানই কলব্যাক করেছে।
“স্যরি স্যরি স্যরি। আমি না ভুল করে ফোনটা বারান্দায় রেখে চলে এসেছিলাম, আর সাইলেন্ট করা ছিল তাই বুঝতে পারিনি” সালাম দেয়ার পর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে হড়বড় করে কথাগুলো বলে গেল মারজান।

“ছাদে যাও” বলেই ফোনটা কেটে দিল ইজান।
মাঝরাতে হঠাৎ এই কথার অর্থ বুঝতে না পেরে কলব্যাক করল মারজান। কিন্তু রিসিভ করলনা ইজান। দুইবার এভাবে কল কেটে দেয়ার পর মারজান মেসেজ পাঠাল,
‘আমার এত রাদে একা একা ছাদে যেতে ভয় লাগে’

সেটা দেখে রাগের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ইজানের। কে বলবে, এই মেয়ে খানিক আগে নিজে হাতে এই জিনিস লিখেছে? নিজের বেলায় এত বোকা হয় কেউ?
ও ফিরতি মেসেজ দিল, “১ মিনিটের ভেতরে ছাদে না গেলে তোমার সাথে গল্প বিষয়ক সমস্ত আলাপ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। ইয়োর টাইম স্টার্টস নাউ!”

(চলবে)

আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম যে এটা হালকা কমেডি টাইপ গল্প হবে। যদিও কতটুকু কী লেখছি, আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটাতে ‘যে গল্পের নাম ছিলনা’র মতো রহস্য বা টুইস্ট কোনোটাই আশা না করলে ভালো করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here