#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat
৮.
এবার মনে মনে সেকেন্ড গোণা শুরু করল ইজান। চল্লিশ পর্যন্ত গুণতেই দেখে দরজা দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকছে মারজান। এখন দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর সময়, সাথে ঠোঁটের কোণায় থাকবে মুচকি একটা হাসি, অথচ…. ধুস শালার আইসক্রিম! মনে মনে গাল দিল ইজান।
ফোন ধরে থাকা হাত দিয়েই মারজানের দিকে হাত নাড়ল ইজান। চাঁদের দশদিন পেরিয়ে গেছে। আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে জোছনায় ভেসে যাচ্ছে গোটা ছাদ। আর ও দাঁড়িয়ে ছিল ছাদের দরজার ঠিক উল্টোদিকের রেলিঙের সামনে।
ইজানকে দেখতে পেয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠল মারজান, নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল ও।
এদিকে মারজানকে দেখে সব সময়ের মতই রাগ, বিরক্তি সব গলে পানি হয়ে গেল ইজানের। কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল মারজানের সামনে। ফোনটা পকেটে রেখে দুই হাতে দুইটা কোণ বাড়িয়ে ধরল মারজানের দিকে।
“গলে যাওয়া আইসক্রিম খান আপনি, লেখিকা ম্যাম?”
মারজানের মনে হচ্ছে ও স্বপ্ন দেখছে। কিছুক্ষণ আগে নিজে হাতে যে রোমান্টিক দৃশ্য রচনা করেছে, সেটা এখন ওর সাথে হচ্ছে? স্বপ্ন ছাড়া হয় নাকি এমন? নাহ! আজকাল ইজানকে নিয়ে উদ্ভট স্বপ্ন একটু বেশিই দেখছে ও।
কিন্তু স্বপ্ন যে দেখছে না সেটা বোঝাতেই যেন হাতে পায়ে বেশ কয়েকটা মশা একসাথে কামড় দিল।
উহ! করে উঠল মারজান, চটাশ করে হাতেরটা মারার চেষ্টা করল আর পা দুইটা ঝাড়া দিল জোরের সাথে।
প্রায় একইসাথে তাকাল ইজানের দিকে, “কী করছ তুমি এখানে?”
“কী আবার? অভিসারে এসে গলে যাওয়া আইসক্রিম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি”
ওর বলার স্টাইলে হেসে ফেলল মারজান। “কোনটা আমার?”
“ভ্যানিলা নাকি চকলেট?” জিজ্ঞাসা ইজানের।
এবার একটু জোরেই হাসল মারজান। এই সেইম লাইন ও গল্পে লিখেছে, দিনার মালিহার জন্য এই দুই ফ্লেভারের আইসক্রিম এনেছিল আর ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল।
“স্ট্রবেরি” উত্তর দিল মারজান।
“কীহ?”
“আমার ফেভারিট ফ্লেভার। নেক্সট টাইম স্ট্রবেরি কিনবা। এখন চকলেটটাই দাও”
আইসক্রিম গলেছে বলে গলেছে? একেবারে গড়িয়ে পড়ছে, বিশ্রী অবস্থা। তারপরও খাবার অপচয় করার অভ্যেস নেই বলে পরবর্তী কয়েকটা মিনিট ওরা গলে যাওয়া আইসক্রিম আর নরম হয়ে যাওয়া কোণ খেল কোনরকম করে। শেষ করে দেখা গেল দুজনের হাত পুরো মাখামাখি। আর এর মাঝেও যে মশার অত্যাচার থেকে বাঁচতে দুজনে ক্রমাগত অদ্ভুতভাবে হাত পা নাড়াচ্ছিল সেটা বলাই বাহুল্য। বাই এনি চান্স দূর থেকে কেউ দেখতে পেলে মাইকিং করে পাড়া মাতাত, “অমুক বিল্ডিঙের ছাদে দুইটা মানুষকে জীনে ধরেছে”
পানির ট্যাংকির সাথে লাগানো কলের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিল দুজন। ওড়নার একটা অংশ হাত মোছার জন্য ইজানের দিকে বাড়িয়ে দিল মারজান। মারজানদের পুরো ছাদই ছোট-বড় অনেক রকম গাছপালায় ভরা। তবে পানি দেয়ার সুবিধার্থেই বোধহয় এই অংশটায় গাছের সংখ্যা একটু বেশি। বড় বড় ড্রামে বেশ কিছু ঝাঁকড়া গাছও আছে পাশেই। সেগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে একটা অপার্থিব আলো-আঁধারির সৃষ্টি করছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আছে হাসনাহেনার সুবাস। এক অন্যরকম ভালোলাগার দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা।
ইশ! এত রোমান্টিক দৃশ্য তো আমি নিজের গল্পেও লিখতে পারিনি, ভাবল মারজান।
কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে ইজানের বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করল মারজান।“থ্যাংকস ফর কামিং টু মাই লাইফ, মারজান। থ্যাংকস ফর বিয়িং এ ডেস্পারেট রাইটার। আই হ্যাভ নেভার বিন সো হ্যাপি ইন মাই লাইফ” মারজানের চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলল ইজান।
“মি টু” মনে মনে বলল মারজান।
***
আম্মুর আদেশ, সপ্তাহে অন্তত একবার শশুর শাশুড়ীর সাথে ফোনে কথা বলতে হবে। তাদের খোঁজ খবর নিতে হবে। ইজানের আম্মুকে তাই কল দিয়েছিল মারজান।
কিন্তু উনি ইনিয়েবিনিয়ে যা বলেছেন, তাতে ওর মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেছে। ইজান নাকি পড়াশোনায় একেবারেই মন দিচ্ছে না। কোচিংয়ের সব এক্সামে খারাপ মার্ক পাচ্ছে, আর এসবই নাকি হয়েছে হঠাৎ! এভাবে চললে বুয়েট তো দূর, কোনো ভালো ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পাবে না ইজান। একথা বলতে গিয়ে অলমোস্ট কেঁদে ফেলেছেন ওর শাশুড়ী।
মেসেজের টুং শব্দ শুনে দৃষ্টি ফেরাল মারজান। সায়মার মেসেজ।
“তোর নতুন উপন্যাসের ফিডব্যাক কিন্তু জোস হচ্ছে”
“হুঁ”
“কী করিস?”
“কিছু না”
সায়মাও কিছু লিখতে গিয়ে আর লিখল না। মারজানও আর কোনো মেসেজ দিল না। ওর কেন যেন খুবই অস্থির লাগছে। শাশুড়ী মার কথার মধ্যে কিছু একটা ছিল, কিন্তু সেটা কী, ও ধরতে পারছে না। ওর কি এসব সায়মার সাথে শেয়ার করা উচিত? নাহ, চিন্তাটা খারিজ করে দিয়ে ও বরং ফোন দিল ইজানকে।
কুশল বিনিময়ের পর আজকে প্রথমবারের মতো ইজানকে ওর পড়াশোনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল মারজান। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইল ও কয়টা কোচিং করে, কয়টা প্রাইভেট পড়ে, কোন কোন জায়গায় এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে, ওর ইচ্ছা কী, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফোন রাখার পর বিমূঢ় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল ইজান। কী হলো ব্যাপারটা? মারজানের গলার টোন এরকম লাগল কেন? প্রথমে ও ভেবেছিল কোনো গল্পের প্রয়োজনে এসব জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু পরবর্তীতে মনে হলো যে না, ওর বিষয়েই জানতে চাইছে। এটা তো ওর জন্য খুশির খবর। ফাইনালি মারজান ওর ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। কিন্তু ওর খুশি লাগছে না কেন? কেন মনে হচ্ছে ওর চেনা মারজানকে আজ ফোনের ওপারে পায়নি?
আরও ঘন্টাখানেক হয়ত এই গবেষণাই করে চলত ওর মন, কিন্তু তাতে বাধ সাধল সুফিয়া বেগমের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। দ্রুত ঘরের দরজা খুলে বাইরে এল ইজান।
কণ্ঠ আসছে বাবা মায়ের রুম থেকে। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দুজনে ওকে দেখে থমকে গেলেন। মুহূর্ত খানেক মাত্র, সুফিয়া বেগম আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হাত তুলে তাকে থামালেন হক সাহেব। তার শীতল দৃষ্টি আর শক্ত চেহারা দেখে থেমে যেতে বাধ্য হলেন সুফিয়া বেগম।
“তুমি ঘরে যাও ইজান। আমাদের মধ্যে কিছু মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে, নাথিং এলস।” ইজানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন তিনি। উসখুস করে উঠলেন সুফিয়া বেগম, কিন্তু কিছু বলার সাহস করতে পারলেন না।
“ঠিক আছে” বলেই নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য ঘুরল ইজান।
“ইজান!” বাবার মুখে ডাক শুনে আবার পেছনে ঘুরল ও।
“মারজানের সাথে কথাবার্তা হয়, বাবা?” সুফিয়া বেগম বিশেষ ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালেন। তার সৌভাগ্য যে, ছেলে কিংবা ছেলের বাবা কেউই সেটা লক্ষ্য করল না।
“জি বাবা” সলাজ মুখে উত্তর দিল ইজান।
“আর প্রিপারেশন কেমন চলছে? তুমি যে ভেবেছিলে এ সময় বিয়ে করলে পড়ালেখায় হ্যাম্পার হবে, তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?”
“না বাবা।” মনে অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল ইজান।
“আমি মনে অনেক আশা নিয়ে কাজটা করেছি বাবা। দেখো, আমাকে যেন নিরাশ হতে না হয়, কেমন?”
“জি বাবা।”
“ঠিক আছে, যাও”
***
একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল ইজান। বাবাকে আশ্বস্ত করে এলেও সত্যটা ও নিজে ভালোভাবেই জানে। বিয়ের পর থেকে ও বাস্তবিক অর্থেই পড়ায় প্রচুর ঢিল দিয়ে ফেলেছে। কোনো রকমে কোচিং এর এক্সামগুলোতে এটেন্ড করছে ঠিকই, কিন্তু আগের মতো ভালো ফলাফল আসছে না। আসবে কী করে? এমন না যে মারজান ওকে সারাক্ষণ ফোন আর মেসেজ করে বিরক্ত করে। কিন্তু যে খোদ মনের ভেতর এসে বসে আছে, তার ফোন আর মেসেজেরই বা কী দরকার। ইদানীং পড়ার টেবিলে বসে হয় ও মারজানের লেখা পড়ে, আর নাহয় সামনে বই খুলে রেখে মারজানকে নিয়ে আকাশকুসুম কল্পনায় বিভোর হয়ে যায়। নিজেকে এতদিন বুঝ দিচ্ছিল যে, এর ফাঁকে ফাঁকে ও ঠিকই পড়ে নিচ্ছে, কিন্তু আস্তে আস্তে নিজের ফাঁকি নিজের কাছেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। কী করবে ও?
এসব ভাবতে ভাবতে আর বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঘড়ির কাঁটা কখন বারোটার ঘর ছুঁয়ে ফেলল, টেরও পেল না ইজান। মেসেজের শব্দে মনযোগ বিঘ্ন হলো ওর। মারজানের মেসেজ।
‘কালকে আমাকে নিতে আসতে পারবে?’
কোথায় গেল দুশ্চিন্তা আর কোথায় গেল দ্বিধা? মনের মধ্যে অফুরান আনন্দের বাতাস সব উড়িয়ে দিল। মারজান আজ প্রথমবারের মতো নিজে ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে?
“অফ কোর্স, মেরি জান” রিপ্লাই দিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর ইজান আজকের মতো টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল।
(চলবে)