তনুশ্রী♥পর্ব_১৩
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
– ঘৃনা? আমি আফনাকে তো সেদিন থেইকাই ঘৃনা করি। মামা হয়েও বিয়ের কথা কইছেন, আমারে বাজেভাবে…. ‘
তনু বলেই মাথা নিচু করে নেয়। ইশয়াখ তাকিয়ে রয় শুধু। কিছু বলে না। তনুর স্বরে ধিক্কার,
– শুনেন, জানিনা কেন আসছেন এখানে! শুধু এটাই বলবো পাপ বহু করে ফেলেছেন৷ খুব শিগগিরই দুনিয়ার শাস্তিডা পাইবেন! খুব শিগগিরই! ‘
তনু বাইরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ায়। মইনুল নিরব দর্ষকের মতন শুধু দেখছে। তূর দরজায় দাড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে। পিছু ডাকে ইশয়াখ,
– তুমি দেবে?
পিছু ফিরে হেঁসে চলে যায় তনু। আজকাল সে বেশ রহস্যময়ি! লতিফার মৃত্যুর পর থেকেই সে এমন!
_________
চোরের মতন মোড়লবাড়ির গেট পেরোয় জুঁই। কারো নজর পরার আগেই সে বাগানে ডুকে যায়। কিছু ফুল তুলে হাতে গুজে এগিয়ে যায় অন্দরমহলের দিকে। ভেতরে ডুকেই তনুর সাথে দেখা হয় জুঁইয়ের। তনু তখন মইনুলের ঘর থেকে বের হচ্ছে। জুঁই থামে। তনু জুঁইকে দেখেই এগিয়ে আসে।
– কই গেছিলেন? ওই উনি আইছে তবুও বাইরে ছিলেন?’
জুঁই মাথা উঁচু নিচু করে জিজ্ঞেস করে,
– কে আইছে?
– ইশয়াখ!
– কি কও? কহন? ঘরে চলো। ব্যাডা ভালা না তো।
– আপনি জানেন না? কই ছিলেন?
জুঁই আমতা আমতা করে বলে,
– চলো তুমি। পড়ে কইতাছি! ‘
তনু ও জুঁই ঘরে চলে যায়। ইশয়াক তূরকে আরেকদফা শাসিয়ে চলে যায়।
________________
তখন সময় ১৯৪৬! সবেমাত্র তূর মাধ্যমিক পাশ করেছে! পড়ালেখায় তূরের ন্যায় ভালো হয়তো মোড়লপাড়াতে কেউ নেই! গোয়ালাদাপূরে তখন পাঠশালা নেই! বিশ্বস্ত ‘আম্বানি’ পরিবার যা মোড়লবাড়ির থেকেও দ্বীগুন বড় ও বিত্তবান সে সময়। মোড়ল মইনুলের খুব করে ইচ্ছে জাগে ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন! সঙ্কট টাকার! ইশয়াখ তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বেড়িয়েছে। ঢাকার শিক্ষার্থী ইশয়াখ! মোড়লবাড়ির সাথে আম্বানি পরিবারের মিল ছিলো খুব! মইনুল ছুটে যান আম্বানি পরিবারে! তখন আম্বানি পরিবারে ইশয়াখের বড়ভাই ইখতিয়ার সবে নিখোজ হয়েছে! তা জানতেন না মইনুল। তিনি ছুটে যান। ইশার কান্নাস্বর তিনি বাড়িতে ডুকতেই শুনতে পান তিনি। ভেতরে ডুকতেই চমকান আরেকদফা। ইশয়াখ খুব বাজেভাবে ইশাকে মারছে আর চুপ হতে বলছে। তিনি দরজাতেই থেমে যান। ইশয়াখ লক্ষ করে এগিয়ে আসে। কন্ঠে ছাপ নেই ভয়ের,
– আপনি? মইনুল বাবু হঠাৎ? ‘
মইনুল ভয়ক্লিষ্ট কন্ঠে বললেন,
– ইশা..!
ইশয়াখ রিরক্তির ন্যায় বলে,
– উফফ! আর বলবেন না। ভ্যা ভ্যা করে শুধু কাঁদছে এই মহিলা। পাগলের মতন করছে! কিন্তু আপনি এখানে? ‘
– ইখতিয়ার আছে বাড়িতে?
ইশয়াখ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বলে,
– কেন? কিছু দরকার?
– একটু প্রয়োজন ছিলো..
– নাই সে! কেন শোনেন নি সে নিখোজ?
– না আসলে..
– যান এখান থেকে!
– জ্বি। ‘
মইনুল দুয়ারে গিয়ে আশাহত দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ইখতিয়ারের ছিলো অনেক জানাশোনা! বিদেশে অনেকবার বানিজ্যেও গেছে। আর অর্থও কম নয় তার। গোয়ালাদাপূরের সবথেকে বিত্তবান শ্রেণির লোক ইখতিয়ার। ইখতিয়ারের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো মইনুলের! কিন্তু তিনি আশাহত! দুয়ারে পা রাখার আগেই ডাক পড়ে পেছন থেকে,
– কি চাই বলতে পারেন আমায়! ‘
তবুও তিনি আলোর ছটা দেখলেন না। এতটুকু ছেলে তাকে কিভাবে সাহায্য করবে? তিনি তবুও বললেন,
– তোমার ভাইয়ের থেকে কিছু টাকার প্রয়োজন ছিলো। আর..’
– আর কি?
– তূরকে চেনো? আমার বড় ছেলে। তাকে বিদেশে পাঠাতে চাইছিলাম। ইখতিয়ারের সাহায্য লাগতো আরকি। ‘
ইশয়াখ কিছুক্ষণ ভাবে তারপর বলে,
– আপনি মোড়লপাড়ার মইনুল মোড়ল না?
– হ্যা। ‘
বাধ্যের ন্যায় বলেন মইনুল। ইশয়াখ মাথা উঁচু নিচু করে ভাবনায় ডুব দেয়। অতঃপর বলেন,
– আমি সব ব্যাবস্হা করে দিতে পারি। ইভেন, আমিও বিদেশেই যাবো। তবে…’
আশার আলো দেখতে পান। মইনুলের মুখে হাসি ফোটে! তিনি উতলা কন্ঠে বলেন,
– ক..কি?
– একজায়গায় বসি আমরা?
– অবশ্যই!
ইশয়াখ নিজের রুমে চলে যায়। সমস্ত কিছুর সাক্ষী হিসেবে মেঝেতে বসা ইশা থেকে যায়। ইশয়াখ মইনুলকে পালঙ্কে বসিয়ে বলে,
– আমার একটা কালোব্যাবসা আছে! বেআইনি ব্যাবসা। তো এতে আপনাকে যোগদান করতে হবে। সম্ভবত বিদেশ ফেরত হয়ে তারপর একটু বাড়বে এই ব্যাবসা। আপনি কিছু বলবেন? ‘
উত্তরে মইনুল অবাক চোখে তাকান ইশয়াখের দিকে। এতটুকু ছেলে করে বেআইনি ব্যাবসা? উনি ভাবলেও ভিরমি খান। কিন্তু তার আগ্রহ জাগে। কৌতুহলী মইনুল বলে ওঠে,
– ক কি ব্যাবসা?
– সেটা একটু পড়ে বলি? আপনি আপনার ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চান তাইতো? বিদেশে গিয়ে কেমন থাকবে.. মানে বলছি সে ভালো থাকবে কি না তার নিশ্চয়তা কিন্তু নেই! ‘
মইনুল ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে,
– মানেহ্?
– মানে হলো আমার সাথে আপনি যুক্ত হলে অনেক লাভবান হবেন। মাসেই কয়েক হাজার টাকা পাবেন। সেখানে মোড়লগিড়ি করে দু হাজারের বেশি পাবেন না! আর এতে যদি আরেকজন কাউকে ডোকাতে পারেন, মানে বলছি আপনার ছেলে কিংবা আপনার…! ‘
– তূরকেও ডুকতে হবে?
– আপনার আরেক ছেলে তির্থ তাইনা? ধরুন আপনি ওকে ডোকালেন,তাহলে সেও হাজার টাকাই পাবে। আর যার জন্য এতকিছু,সেতো বিদেশে যাচ্ছে তাইনা? ওদেশের লোকের সাথে কথা বলার এক্সপেরিয়েন্স থাকবে তূরের। তাই সে আসার পর তাকে এতে যুক্ত হতেই হবে! ‘
– কিন্তু সেতো তখন খুব শিক্ষিত হবে। কেন এসবে সে যুক্ত হবে? ‘
– হতেই হবে! এটারও দলিল আমি তৈরি করবো। আর তখন সেতো বাধ্য! ‘
– বেআইনি ব্যাবসায় এগুলো খাটবে না!
– খাটবে..খাটবে! ইশয়াখ কাঁচা খেলোয়ার নয় মইনুল মসাই! আপনি জানেন আমার ইমপুট আউটপুটের ব্যাবসা আছে? সেটার কথাতেই দলিল হবে। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না! এগুলো আমিই দেখবো! আপনি বলুন রাজি কিনা? ‘
– কত টাকা ধার নিতে হবে?
ইশয়াখ খিলখিল করে হাসে। মইনুলের কোন দিকে এখন হুস নেই। তার শুধু বড় ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চাই! ইশয়াকের হাসি দেখে মইনুল মুখ বাঁকান। ইশয়াখ বলে,
– ধার নিতে হবে না। আমি এমনিতেই দিবো। শুধু..’
মাত্রা বেড়ে চারগুন হয় লোভের! পাপে পা দিতে প্রস্তুত হন মইনুল। সাথে নেয় তার দুই সন্তানকে! তিনি সানন্দে বলে,
– আমি রাজি! ‘
মইনুলের সাথে আরও ঘন্টাখানেক আলাপ হয়। কিভাবে পথের শিশু মিসকিন ছেলেমেয়েকে ধরবে তার সবটা ইশয়াখ বুঝিয়ে দেন মইনুলকে। মইনল ঠিকঠাক সবকাজ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়!
পেরিয়ে যায় কিছুদিন..,
মইনুল জমির দলিল বলে সই করিয়ে নেয় ছেলে তূরের থেকে। তির্থ এসব দেখে মানতে পারেনি। টাকা সেও উপার্জন করবে! তাই বাবার সাথে এককথাতেই রাজি হয়ে যায় তির্থ! তূর আর ইশয়াখ একসাথে যায় বিদেশ! সেখানে কি আদেও ইশয়াখ তাকে পড়াশোনা করতে দিয়েছিলো? নাকি শিখিয়েছে ডিল কিভাবে করবে?
বিদেশে দুজনে মিলে গড়ে তুলে ইনপুট আউটপুটের ব্যাবসা। ইশয়াখ বাংলাদেশের বিভিন্ন সামগ্রী ওদেশে বিক্রি করে। অনুমোদন ও পায় খুব শিগ্রি! তূর তখনো এসবের কিছু জানে না!
বছরের পর বছর পেরোয়,ইশয়াখ প্রতি বছরেই আসে গ্রামে। আসেনা তূর। মইনুল শুনে শুনে আসে তূর ঠিক আছে কিনা! ইশয়াখ আনন্দের সহিত বলে ঠিক আছে।
আর দুটো বছর পর তূর গ্রামে ফেরে। তদ্দিনে এখানেও তাদের ব্যাআসার অনেকটা বিস্তার ঘটেছে। এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহুরে হাসপাতাল থেকে তাদের কাছে ফোন আসে। তারাও মাল চায়। টাকাকড়ির বনিবনা গলেই ইশয়াখ ডেলিভারি করে। দুজনে বিদেশ থেকে আসার পর তূর যখন সমস্তটা জানতে পারে সে চরম বিষাদে পড়ে যায়। দুদীন ঘর থেকেই বেরোয় না। ইশয়াখ পুলিশ ডাকে। মইনুল আশ্বাস দেয় ও কাজ করবে! বাবার কথা আর নিজের করা ভুলের জন্যই এত বড় নোংরামিতে পা দেয় তূর! নিজ হাতে তনুর ডিল করে ফোনে! আর সেসব নিয়েই তাকে আবারো আসতে হবে বিদেশে! হোক সেটা ব্যাবসাহিক নামে!
______
কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়তেই মইনুলের পিলে চমকে ওঠে। গলায় হাত রেখে বেশ কয়েকবার শ্বাস নেন মইনুল। তার ভেতর জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে!
সন্ধ্যা নেমেছে! বৃষ্টিস্নাত দুপুরের দিকে রিমি আখতার বিদ্যুতিক সক্ খেয়েছে, নয়তো তার থেকেও বড় কিছু! তূর আর মইনুলের সমস্ত কথা কানে এসেছে রিমির। তারমানে সেদিন রাতে তাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে বলা হয়েছে সে রোগি! এই নাম করে শুধু তাকে নয়,বরং পুরো বাড়ির বউদের নেয়া হয়েছে গোয়ালাপুরের ডাক্তারখানায়! তিনি মেঝের এক কোনে বসে। সেসব শোনার পর তার আর কিছুই ভালো লাগছে না! এমনকি এই সন্ধ্যায় তিনি ঘরের আলোও জ্বালাতে ভুলে গেছেন! নিজ স্বামী,ছেলেরা আজ তার কাছে অচেনা লাগছে।
– আম্মা আসবো?
তনুর কন্ঠস্বর পেতেই চোখ তুলে তাকান রিমি। শুধু তনুই নয় সাথে চম্পা,জুঁই,চুমকি আর টগর ও আছে। কিন্তু ডেকেছে তনু! রিমির আদেশ না নিয়েই ঘরে ডোকার কারো সাহস নেই। তিনি এগুলো মটেই পছন্দ করেননা। শুধুমাত্র সাহস দেখালো তনু! রিমিকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে তনু সবাইকে ডেকে আনে। আর এখন..
কটাক্ষ স্বরে বলেন রিমি,
– তোমরা? হঠাৎ না কইয়া এইহানে? ‘
সকলে এগিয়ে এসে রিমি আশেপাশে ধপাশ করে মেঝেতে বসে পড়ে। রিমি আবারো বলে,
– বইতাছো যে? এইহানে কিল্লাই সগলে? ‘
চুমকি বলে,
– আপনি বসে আছেন কেন?
– হেইডা কি এহন তোমারে বলবো?
– না চাইলে বলতে হবে না! আপনি চিন্তিত কি?
– না!
জুঁই বলে,
– তাইলে বইয়া আছেন ক্যান? উঠেন চা করতে হইবো না? ‘
– তোমরা করো গিয়া!
চম্পা বলে,
– আপনি ছাড়া কখনো আমরা রান্নাঘরে ডুকেছি? দেখেছেন কখনো? আর আজ বলছেন, নিজে নিজেই করতে? আপনি অসুস্হ হলেও তো এমন বলেননা! ‘
– তো কি?
– তো কি মানে? চলেন আম্মা! একসাথে..
– আমি একা থাকবার চাই! ‘
সবাই একে অপরের দিকে চাওয়া চাওই করতে লাগলো। রিমির উত্তর চুমকি দিলো,
– আজ এমন করছেন কেন? মন খারাপ? ‘
মুহুর্তেই ছোখ ছলছল করে ওঠে রিমির। সে সহ তার বাড়ির মেয়েরাও হয়তো কিছু এখনো জানে না। জানে না মইনুলের কুকির্তি! তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। চম্পা বলে,
– সত্যিই মন খারাপ।কি হয়েছে আম্মা?
– কিছু না!
– বলেন না কি হইছে? ‘
রিমি তনুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– আইয়া বেয়াদবের মতন ডাক দিয়া এহন চুপ আছো ক্যা? ‘
তনু বলে,
– আফনে ওনাগোর লগে কথা কইতেছিলেন!
– তো কিতা হয়? তুমি যাইতে কইবা না?
– হু, চলেন! ‘
রিমি হঠাৎই সকলের পায়ের কাছে বসে কেঁদে ওঠেন! হেঁচকি তুলে কাঁদছেন রিমি। মূহুর্তের মাঝেই তনুর শাড়ি ভিজে ওঠে। সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়! কখনোই রিমিকে কেউ কাঁদতে দেখে নাই! তাদেরও বুকে কেউ যেন সুচ ফোটাচ্ছে! প্রিয়ো কারো কান্না দেখা খুব কঠিন। জুঁইও কেঁদে ওঠে,
– আম্মা কান্দেন ক্যান? কি হইছে? ‘
রিমি মাথা তুলে তাকায়। চোখের পানি দু হাতের উল্টোদিক দিয়ে মুছেন। তারপর বলেন,
– তোমাগো একটা কতা কইতে চাই।
– কি কথা আম্মা?
রিমি কান্না মিশ্রিত স্বরেই মইনুল আর তূরের কুকির্তির সবটা বললেন। পাঁচজনে উত্তরে একসাথে বললো,
– আমরা সবটা জানি! এর জন্য কাঁদা লাগে?
অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রিমি। চোখ ছানাবড়া! চুমকি আর টগর তাকিয়ে তনুর দিকে। একপলক চম্পার দিকেও তাকাচ্ছে সবাই!
– তনু ক্যামনে জানলা?
উত্তরে তনু হাসে। বলে,
– আপনারা যেভাবে জানছেন! ঠিক সেভাবে।
– আর চম্পা তুমি?
চম্পা হাসে না! গলা ফাটা কান্না করে ওঠে। সকলে অবাক হয়! চম্পা কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছে না! আটকালো গলায় বলে,
……
#চলবে…
কিছু গঠনমূলক কমেন্টের আশায় রইলাম!!