তনুশ্রী পর্ব_১৫
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
অন্ধকার দূরীকরণে ভ্যানের সামনে টর্চ গোজা! মইনুল তির্থ বাড়িতে নেই! সাথে বাকি চারজন! চুমকি,টগর,চম্পা আর জুঁই! রিমি তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ ও চিন্তিত! বাড়ির সকল মেয়েরা রাতের বেলা গেলো কই? তনু খুব ছটফট করছে! ব্যথায় তার পুরো শরীর ঝিমিয়ে কাঁপছে! বারবার তলপেটে হাত রেখে গোঙাচ্ছে তনু! রিমি ওদের ভ্যানে উঠিয়ে বিদায় দেন। মোড়ল বাড়ির দার ছেরে পেরোতেই শোয়া তনুকে জিজ্ঞেস করে তূর,
– তোমার কি সত্যি সত্যিই ব্যাথা করছে তনু? ‘
একচোখে তাকিয়ে রয় তনু। সে নিশ্চুপ! গোঙানি নেই! ব্যাথার জন্য ছটফটানিও বন্ধ! তূর আবারো বলে,
– তুমি এইসব নাটক করছিলে?
– না তো!
– তাহলে এখন যে সুস্থ দেখাচ্ছে?
– অসুস্থ চান তাইনা? কাজে সুবিধা হইবো! চিন্তা নাই। আমি অসুস্হ! পরিক্ষা আপনার! ‘
– পরিক্ষা?
– কিছু না!
তনু আকাশ পানে তাকায়। মনে পড়ছে আজিদের বলা ডাহা মিথ্যা কথাগুলো। ‘রানির মতন থাকবো তনু’! হাহ্! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু৷ লতিফার লাশ এখনো পুলিশ দিয়ে যায়নি। আর না দিয়েছে ঘেঁটু,মুগির লাশ! তনুর চোখ বেয়ে গড়ে পরে শিশির বিন্দু! অন্ধকারে চক্ষুগোচর হয় তূরের!
‘ আজ যা হইতে চলেছে, তা যদি সম্পূর্ণ হয় তাইলে আমি ফারছি মা, অন্যায়ের শাস্তি দিতে ফারছি! আর যদি বিফল হই তাইলে সেচ্ছায় আন্তহত্যা করবো আমি। মা তুমি দেইখো তনু আর এই নরপ্রাসাধে ফিরতো না! আল্লাহ ভরসা! ‘
সবটা তনু মনে মনে বলে!
ভ্যান ঘাটে গিয়ে থামে!মাঠ দিয়ে ভ্যান যাওয়াই যেত কিন্তু বর্তমানে সেখানে সবে ধান রোপণ করা হয়েছে! তূর ভ্যানের ভারা মিটিয়ে তনুকে তুলতে যায়। হাত দেখিয়ে থামায় তনু! তূর ভ্রু নামি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো?
– লাগতো না!
তনু ভ্যান থেকে সুস্থ মানুষের ন্যায় ওঠে। তনু নামতেই আবারো হাত এগিয়ে দেয় তূর। তনু এবারও তা উপেক্ষা করে হাঁটতে থাকে। তূরের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়! হাটতে হাটতে বলে তূর,
– অভিনয় ভালোই পারো।
– আমি অসুস্থ!
তনু হেঁটে নৌকার কাছে যায়। তূর হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে। তনু ঠিক এমন করছে কেন তা বুঝতে পারছে না তূর! সেও যায়। তনু মাঝিকে ডাকে,
– মাঝি ভাই গোয়ালাদাপুর যাইবেন?
বিড়ি ফুকাতে ফুকাতে বলে মাঝি,
– হ যাইবো। বয়েন।
– টাহা কত লইবেন শুনি?
ঘাট অন্ধকার! শুধু মাঝিদের নৌকারই হারিকেনের আলোয় কিছুটা আলোকিত। মাঝি উঁকি মারে।
– কয়জন মানুষ?
– দুইজন!
– সাতটাকা দিয়েন!
– পাগল পাইছেন? পাঁচটাকার ভারারে সাত টাকা কন?
– আইচ্ছা উঠেন!
তূর দাড়িয়ে শুনে তাদের কির্তি। তনু নৌকায় বসে ডাক দেয়,
– আসেন না যে?
– আসি।
তূর উঠে পরে নৌকায়। নৌকার এক কোনে হারিকেন বাধা। তা দোলনিতে কেমন দুলছে! আকাশে চাঁদ নেই! হারিকেনের আলোয় নৌকা রোমাঞ্চকর জলজানে পরিনত। তনু বোরখা পরার ও সময় দেয়নি। পড়নে কালো রঙা শাড়ি! তূরের পরনে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। তনু শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় একবার। তূর পানির দিকে তাকিয়ে। নৌকার খেয়ায় সৃষ্টি শব্দ বেশ অদ্ভুত! কেমন শিহরণ জাগায় শরীর জুড়ে। তনু সে শিহরণ ঠাহর করে। অতপর বারবার তাকায় তূরের দিকে। তূর তাকায় না। তনুর মনে চলছে অজানা সব অনুভব! তার করা জিবনের হয়তো জঘন্য কাজ এটি হবে!
গোয়ালাদাপুরে এসে নৌকা থামে। তূর পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দেয়। তাদের এখন যেতে হবে আগে ইশয়াখের কাছে। সামনেই তাই হাঁটা ধরে তূর-তনু। কয়েকফুট এগোতেই সুবিশাল আম্বানি বাড়ি চোখে পড়ে। পুরো বাড়ি জুরে বৈদ্যুতিক লাইট লাগানো! দূর থেকে দেখলে যেন রাজপ্রাসাদ! তনু ও তূর আম্বানি বাড়িতে ডোকে। দরজা খোলেন ইশা,
– তনু, তূর তোমরা এখানে?
বললেন ইশা। তনু উত্তরে আনন্দ,
– ডাক্তার খানায় আইছি মামী। ভিতরে আসতে কইবা না? ‘
ইশার ইচ্ছে হচ্ছে লাঠিপেটা করে মোড়লবাড়িতে পাঠাতে। কিন্তু তিনি জানেন আজ তনুর কডিনি নেওয়া হবে। ইশয়াখ বলেছে তূর আসবে। ইশা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– আয়। তূর আসো। ‘
তনু এগিয়ে ভেতরে যায়। ইশা তূরকে থামিয়ে বলেন,
– পিচ্চি মেয়েটার সাথে এমন না করলেই নয়?
– ও নিজেই রাজি।
ইশা অবাক হয়ে বলে,
– সব জানে তনু?
– সবটা জানে। তবুও সে রাজি।
– মাইয়াডার মনে যে কখন কি চলে! দেখিও ওকে হ্যা? জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। সাবধাবে যাইয়ো কেমন? ‘
– যেতে তো মন চায়না! ‘
মিনমিনিয়ে বললো তূর। ইশা শুনেও না শোনার ভান করলেন। এখন এসব বলা মানেই কষ্ঠ বিলাশমাত্র! দুজনে তনুর পিছুপিছু হাঁটা ধরে। বড় বসার ঘরে পাতানো চেয়ারগুলোয় বসে সবাই। তনু আবারো একপলক চোখ ঘুরায় পুরো বাড়িতে!
– ইশয়াখ মামা নাই?
– না।
বললেন ইশা। তনু ফের বলে,
– কই গেছে?
– বাইরে। চলে আসবে।
__________
রাত প্রায় সারে আটটা! ইশয়াখ এখনো আসেনি। সকলে যথাস্হানে বসে। কেউ কোন কথা বলছে না। হঠাৎই আগমন ইশয়াখের। তনুকে দেখেই চোখ ঝিলিক মারে। তাড়াতাড়ির বেশি ঘরে ডোকে।
– তনু যে!
– অবশেষে আসলেন!
হা হুতাশের ন্যায় বলে তনু। ইশয়াখ তনুকে পরখ করে। অসুস্থের কোন ছাপ নেই! তাহলে কি বলে তূর তনুকে নিয়ে এসেছে?
– কি ভাবতাছেন? চলেন যাওয়া যাক!
– ক্ কই যাবা?
– ক্যান ডাক্তারখানায়। আমি জানি সব। এহন চলেন। বাড়ির বউরা আর কতক্ষণ বাইরে থাকবো? ‘
তনু উঠে দরজা পেরোয়। ইশয়াখ একবার তনুকে দেখে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। তূরও আসে। ইশা তির্থের কাকের মতন চেয়ে রয়। নৃশংস সব কুকুর দেখে চোখে।
বখরার মাঠ ধরে না ওরা৷ বেছে নেয় জঙ্গল! ঘন সবুজ আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন জঙ্গল। তূর তনুর একহাত শক্ত করে ধরে। ইশয়াখ টর্চ নিয়ে এগোচ্ছে।
জঙ্গলের মাঝ! নিশাচর প্রানিদের মতন চারজন লুকিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। মুখে কালো রঙা ওড়না বাধা। সাহসিনী তারা মেয়ে! টর্চের আলো নিয়ে যাওয়া ইশয়াখ আর তনু তূরের যাওয়া দেখে। তারা কিছুটা যেতেই বেড়িয়ে আসে যুবতী চার রমনী। পিছু নেয় তাদের। কিছুটা যেতেই ইশয়াখ পেছোনে কিছু হাটার আওয়াজ পায়। পাত্তা দেয়না! জঙ্গলে শুকনো পাতা আর কাঠখড়ি পড়ে আছে এলো মেলো ভাবে। হাটার শব্দকে তারা বাড়িয়ে তুলছে তিনগুন! বেশ সাবধানে হাটে সবাই। তনু একবার তাকায় পেছোনে। চারজন নারীর অবময় তার চোখে পড়ে। আসুক! সে কিছু বলে না। ফিরে তাকাতেই পেছন থেকে খচখচ আওয়াজ! চম্পার পা লেগে একটা ডালে, শুকনো ডাল মরমর করপ ভেঙে যায়। ইশয়াখের মস্তিষ্কে তা আসতেই ইশয়াখ লাইট পেছোনে ফেরায়। পাশে থাকা গাছের পেছনে চট করে লুকায় ওরা।
______
– এটা খাও তনু! ‘
হাতে ঔষধ নিয়ে কথাটা বললো ইশয়াখ। তনু ফিরে চায়। হাসপাতালে এসেই তনুকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তনু গ্লাস হাতে ঔষধ নেয়। তূর বাইরে। তার বুক ফেটে আসে কান্নায়। সে ছটফট করছে। চুলগুলো তার এলোমেলো! চোখে একবিন্দু শিশির দেখা দেয়। যদি এটা বন্ধ করা যেত? যদি পারতো তনুকে নিয়ে পালাতে?
তনু হাতে নেয়! ইশয়াখ অপেক্ষা করে। তনু ঔষধ মুখে নিয়ে পানি খায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তনু মাথা নুইয়ে দেয় স্ট্রেচারের বালিশে। ইশয়াখ তনুকে পরখ করেই বাইরে যায়। শুরু হয় অপারেশন! ডাক্তার ছুড়ি, কাচি নিয়ে এগোয় তনুর দিকে। তনু মৃতের ন্যায় শুয়ে থাকে।
#চলবে…