তাসের ঘরে তুমি আমি পাঠ-৩

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০৩
#আয়াশ_রহমান

‘কি বললি?’
‘ক কই কি বললাম মা?’
‘দুধ পুড়ে যাচ্ছে তুই দেখলি কিভাবে?’
শান মুচকি হেসে উত্তর দিল। মা যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই তাদের কিন্তু অন্য পাচটি ইন্দ্রিয়ের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। দুধ পোড়ার সেন্টেই তো বুঝা যাচ্ছে।’

শানের কথায় সবাই স্বাভাবিক হল। পুতুল মনে হল অনেক বড় ভীতি তে রক্ষা পেলো।

পুতুল অফিসে গেলেই পিছনে শান লাঠি হাতে চশমা পড়ে রওয়ানা দিল।
পেছন থেকে বাবা ডাক দিল,’কই যাচ্ছিস বাবা?’
‘এইতো সামনেই একটু বাইরে গিয়ে কোথাও বসি।বাসায় ভালো লাগছে না।’
‘ওহ। আমিও সাথে আসব?’
‘ না বাবা একাই পারব, বেশিদূর যাব না।’

তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল শান। পুতুল অনেক দূরে চলে গিয়েছে হাটতে হাটতে। সামনে মোড় পাবে বলে। শান আরেকটু দূরে তাকিয়ে দেখলো একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, পুতুল গাড়ির সামনে গেলেই তার দরজা খুলে গেল। শান সেটা দেখে দৌড় দিল, লাঠি হাতে নিয়েই। কিন্তু কারো সাথে জোড়ে ধাক্কা খেলো। দুজনেই রাস্তায় পড়ে গেলো।

‘এই চোখে দেখেন না নাকি?’
শান তাকিয়ে দেখলো বোরকা পড়া একটা মেয়ে, হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। কিন্তু সাথে থাকা ডিমগুলো রাস্তায় পড়ে থেতলে গিয়েছে।
‘চোখে দেখতে পান না নাকি? আমার সব বাজার! আমার ডিমগুলো!! মামী আজ আমাকে কি করবে?’ বলতে বলতে উঠে শানকে দেখে চমকে গেলো মেয়েটি।
‘আপনি তো সত্যি মনে হয় দেখতে পান না, হাতে লাঠি, চোখে চশমা।’
শান মেয়েটিকে দেখছে, বয়স হয়ত খুব বেশি না ১৮ বা ১৯ হবে, টানা টানা চোখ দুইটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুখে মুখে কথা বলে।
‘তাহলে দৌড়েছেন কেনো?’ তারপর পিছনে কুকুর দেখে আবার একাই বলল,’কুকুর দেখে ভয় পেয়েছেন?’
শান শুনছে শুধু। পুতুলের গাড়ি চলে গেছে। কিন্তু শান দৌড়ের সময়ই নম্বরটা নিয়ে নিয়েছে।
‘আমি পাশের বাসায় আজ দুইমাস মামা মামীর সাথে ভাড়া এসেছি, আপনাকে তো দেখিনি এই এলাকায়! কে আপনি?’
মেয়েটির ডাকে দৃষ্টি ফিরল শানের।
‘আপনি কি বোবাও নাকি?’
শান অবাক হয়ে গেল। কি বলে মেয়েটা, ঠিক তখনই শানদের পাশের বাসার দুইতলা থেকে ডাক এলো।
‘মিথু এই মিথু জলদি আয়, ওখানে দাড়িয়ে কি করিস?’
‘হ্যা হ্যা মামী, আসছি। হায়রে আমার ডিম, এখন মামী আজ আবার আমাকে মারবে।’ কেদেই ফেললো বলতে বলতে বেচারি।
‘আজ আপনার জন্য আমার ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহই জানে।’ বলে হন হন করে চলে গেলো মেয়েটি।

পুতুলের চিন্তায় আবার রাস্তা ধরে সামনের দিকেই এগোচ্ছে শান। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কি সেটাই ভাবার পালা। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন বলল,’একি তুমি!!’

শান দেখলো তার পুরাতন অফিসের এক কলিগ রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করলো সে,
‘কে কে ভাই?’
‘শান তোমার চোখ ঠিক হয়নি?’
‘রিয়াদ ভাই নাকি? গলার আওয়াজে তো সেরকমই লাগে।’
‘হ্যা আমি রিয়াদ। কিন্তু তোমার,,,,,’
পাশের একটা চায়ের দোকানে বসল তারা।

শানের কাছে সব শোনার পর রিয়াদ বলল,’তাহলে তো খুব বিপদে আছো তোমরা।’
সবই ভাগ্য ভাই।’
‘আচ্ছা জব করবে?’
‘আমার মত অন্ধকে চাকুরী কে দেবে ভাই?’
‘আমার এক চাচা একটা প্রাইভেট মিডিয়া ফার্মে বড় পোস্টে আছে। সেখানে তুমি চাইলে রেডিও স্টেশনে কাজ করতে পার।’
‘মানে?’
‘অর্থাৎ তোমার দৃষ্টি লাগবে না, কথা দিয়েই কাজ চলে যাবে। আর এমনিতেও তোমার গলা তো খুব সুন্দর। মনে নেই অফিসে সবাই আমরা তোমার গলার গান শুনতে চাইতাম?’
‘তাহলে তো খুবই উপকার হয় ভাই।’ (শান ভাবলো ‘ভালই হবে এই জব করলে, নিজের লুকানো কথা আরো বিশ্বাসপ্রবণ হবে আর আমিও বাবা মার জন্য কিছু করতে পারব।’)

‘চল আজকেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি তোমাকে।’
‘আচ্ছা ভাই।’

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল শান। পুতুল তখনো আসেনি। তার মা বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল চাকুরী পেয়েছে সে রেডিও স্টেশনে। আর ডিউটি রাতে৷ ২ টায় শেষ অফিস৷
শানের বাবা মা চিন্তায় পড়ল। চোখে দেখতে পায় না তার উপর এই রাত বিরাতে কিভাবে যাবে ছেলেটি।
তবে শান তাদের আশ্বাস দিল সে পারবে৷ রিক্সায় যাবে আবার আসবে।

তখনই পুতুল আসল। কালকে ওই ব্যবহারের পর শানের মা পুতুলের সাথে কথা বলে না। তাই পুতুল বলল,’ আমি ঘরে গেলাম, আজ খাব না, ভাল লাগছে না শরীর।’
শানের মা সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। শান বলল,’আমিও যাব।’
রুমে এসে বোরকা খোলার পর শান খেয়াল করলো পুতুল সকালে যে শাড়ি পড়ে গেছিলো সেটা আর এইটা এক না। চোখ কুচকে গেল তার। তাও কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে আসল পুতুল।
বেলকনিতে ভেজা শাড়িটা নাড়তে দিতে গেল। শানও বেলকনিতে উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে।

শান তার দিকে ফিরে হঠাৎ সদ্য নাড়তে দেয়া শাড়িটায় দাত দিল। তারপর পুতুলকে বলল,’এই শাড়ি কোথায় পেলে?সকালে তো এই শাড়ি পড়েছিলে না?’

পুতুলের মুখে ভয়ের আভা দেখা গেলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। থতমত খেয়ে বলল,’তুমি কিভাবে জানলে?’
‘সকালে ইস্ত্রি করার সময় আমি শাড়িটা ধরেছিলাম, সুতি কাপড়ের ছিল। এটা তো শিফনের শাড়ি মনে হচ্ছে যেরকম আমি তোমাকে গিফট করেছিলাম, তোমার খুব পছন্দের ছিল।
পুতুল হঠাৎ কি মনে করে বলল,’আরেহ এটা তো তোমার দেয়া শাড়িই। আলাদা করে ব্যাগে নিয়েছিলাম।’
কি জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলে দিল পুতুল। শান পুরো অবাক। তার অন্ধত্ব এর সুযোগ নিয়ে কি কি বলছে সে।
‘কিন্তু এটা তুমি কেনো নিয়ছিলে?’
‘আজকে অফিস ছুটি নিয়েছি আগেই। বান্ধবীর ছোট মেয়ের জন্মদিন ছিল। দাওয়াতে আমরা কয়জন বান্ধবীই ছিলাম। আসলে আমাদের আজকে থাকার প্ল্যানিং ছিল তার বাসায়। তার স্বামী বিদেশে তো, একা থাকে তাই। বুঝোই তো বাচ্চার জন্মদিন। কেক গায়ে মেখে একাকার করে দিয়েছে পিচ্চি মেয়েটা। তাই আমাকে শাড়িটা চেঞ্জ করতে হল। থাকতেই চেয়েছিলাম ওখানে কিন্তু তোমার কথা ভেবে চলে আসলাম।’

বাহ কি সুন্দর বানোয়াট কথা বলে দিল পুতুল। শুনেই হাসি আসলো শানের। তবুও কিছু বলল না এখন।
‘আমিও বাইরে যাব। তুমি যেহেতু ঘাবে না ঘুমাও।’
‘কোথায় যাবে এই রাতে?’
‘সেটা নয় মায়ের কাছেই শুনে নিয়, যদি সময় হয়।’ বলে শান চলে গেলো।

রেডিও স্টেশনে আরজের কাজ দেয়া হল শানকে। শান টেনশনে ছিল পারবে নাকি। কিন্তু রিয়াদ ভাইয়ের চাচা তাকে সাহস জুগালো। এখন মোটামুটি ইজি হয়ে গেল কাজটা। প্রথম দিনেই শানের ভয়েস সবার হৃদয় কেড়ে নিল।

রাত ২.৩০, মাত্র বাসায় পৌছেছে শান। তার মা তার জন্য অপেক্ষা করছিলই। ছেলে চোখে দেখেনা, এত রাতে যদি কিছু হয়। কিন্তু তারা তো আর জানে না কিছু। তবে আসার সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্য খেয়াল করেছে শান। তাদের পাশের বাসার বেলকনি থেকে কারো ফুফানোর আওয়াজ আসছিল। ভাল করে খেয়াল করে দেখলো সকালের সেই মেয়েটা। বেলকনিতে দাড়িয়ে কেদে যাচ্ছে। শান কয়েক মুহুর্ত অবাক হয়ে তাকালেও বেশি কিছু ভাবেনি।

মাত্র রুমে ঢুকল সে। ঘুমাচ্ছে পুতুল, সেই মায়াবী মুখ যা দেখার জন্য অফিস থেকে প্রায় ছুটেই বাড়িতে ফিরত শান। মায়াবী গড়নের মুখটা দেখেই যেন সারাদিনের ক্লান্তি দূর করত সে। শরীরের পোশাক ঠিক নেই, ঘুমানোর সময় অবশ্য পুতুলের এটা আগেও হত। মুচকি হাসলো শান।
হঠাৎ ঘাড়ের দিকে নজর পরল শানের। মুহুর্তে চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। পুতুলের ঘাড়ের পাশে আরেকটু কাধের দিকে একটা তিল। যেটা শানকে বার বারই আকৃষ্ট করত। কত শত চুমু যে সেখানে দিয়েছে শান তার ঠিক নেই। আর আজ সে জায়গায়ই একটা দাগ। যেটাকে লাভ বাইট বলে। খুব তাজা দাগটা, মনে হয় আজকেই দেয়া হয়েছে।

চোখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ শানের। মনে ইচ্ছা হচ্ছে এখনই এক ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিক। সব কিছুর কৈফিয়ত চাইবে, কিন্তু আবার মন বলছে তাহলে তো যেকোনো কারণ দেখিয়ে পুতুল বাচতে পারে, নিজের চোখে সব সত্য দেখতে চায় শান। খুব কষ্টে মনকে মানিয়ে নিল সে।

পরের দিন সকাল হতেই শান পুতুলের পিছু নিল। এবার আর কোনো ভুল নয়। শান গাড়িটার নম্বর থেকে কালকেই গাড়ির মালিকের ডিটেইলস জেনেছে। আশ্চর্য হলেও এটা পুতুলের অফিসের কারো নয়। সাব্বির নামের একটা ছেলের। সে নাকি কয়েকটা গ্যারেজের মালিক।

পুতুলকে আজকেও সেই গাড়ি তুলে নিল। আজ শান পেছনে একটা সি এন জি নিয়েছে। কিন্তু গাড়ি তো পুতুলের অফিসের দিকে যাচ্ছে না। অবাক হলেও পেছনে যেতে লাগলো শান। গাড়িটা দ্রুত চলছে৷ শান সি এন জি চালককে আরো দ্রুত চালাতে বলছে। কিন্তু হঠাৎ গাড়িটা ভিড়ের আড়ালে মিশে গেলো। একটা সি এন জি তো আর প্রাইভেট কারের গতির সাথে পারবে না! বিরক্ত হল আজকেও সে। অগত্যা সি এন জি কে পুতুলের অফিসের ঠিকানা দিল। অফিসের সামনে নেমে আবার অন্ধের অভিনয় শুরু হল তার।

অফিসের সামনেই রিসেপশন। সেখানে গিয়ে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করলে রিসেপশনিস্ট এমন ভাব করলো যেন চিনতেই পারলো না। পাশ দিয়ে আরেকটা মেয়ে যাচ্ছিল। রিসেপশনিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ম্যাম ইনি পুতুল নামের কারো কথা জিজ্ঞেস করছে।’
‘কিহ, পুতুল!!’
শান মেয়েটিকে দেখে বুঝলো মেয়েটি এই অফিসেই কাজ করে।
‘মেয়েটি আবার বলল,’আপনি কে, আপনাকে তো চিনতে,,,’
‘আমি পুতুলের এক আত্মীয়। চোখের ডাক্তার দেখাতে এসেছি ঢাকা। উনি কোথায় বলা যাবে?’

‘কিন্তু পুতুল তো এ অফিসে থাকে না।’
‘মানে?’
‘মানে পুতুল তো ছয় সাত মাস হবে এই চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে!!!’

[কপি করা নিষিদ্ধ❌]

চলবে,

ভালো লাগলে সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করুন, আরো দ্রুত গল্প দেয়ার ট্রাই করবো। সবাইকে অগ্রিম ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here