তাসের ঘরে তুমি আমি পাঠ-৫

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০৫
#লেখক_আয়াশ

এতদিন সাব্বিরের প্রতিটা গ্যারেজে গ্যারেজে রাতের আধারে গিয়ে বিভিন্ন রকম নেশা দ্রব্য রেখে আসে যে, সে আর কেউ নয় শান নিজেই। তারপর নিজেই পুলিশের কাছে অচেনা নম্বর অথবা কোনো পি.সি.ও. থেকে ফোন দেয়। বিদেশ থেকে চিকিৎসাকালীন কিছু টাকা বেচে গেছিলো শানের। সেই টাকার প্রায় সবই শেষ এসব নেশা দ্রব্য ম্যানেজ করতে করতে।

আর একটাই কাজ বাকি আছে। সেটা সফল হলে
তারপরই সাব্বির রাস্তায় বসবে। কিন্তু শানের মাথায় অন্য বুদ্ধি।

এক ভয়ংকর পরিকল্পনা তার। সাব্বির দেশে আসলে সে গ্যারেজে থাকাকালীন পুলিশের রেইড হবে। হাতেনাতে ধরা পড়বে সাব্বির। আর শানের মোহরা হবে পুতুল। সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না।

অবশ্য এ পরিকল্পনা হয়েছে গতকাল রাতে। সে ঘরের বাইরে দাড়িয়ে ছিল। পুতুল ফোনে বলছিল আজ এতদিন পর সাব্বির আসবে। তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে পুতুল। সেকথা শুনে শানের কষ্টের চেয়ে মুখে ক্রুর হাসিই বেশি দেখা দিল।

সাব্বির আজ দেশে এসেছে ভোরে। সকাল সকাল উঠে বেলকনিতে বসে বসে প্ল্যানের সব ছক মাথায় কষছিলো শান।

তখনই তার মা এসে কাধে হাত রাখল,’বাবা উঠে পড়েছিস?’

‘হ্যা মা, মাত্র উঠলাম।’

‘আসিস এত রাত করে আরেকটু ঘুমালেও তো পারতি।’

শান কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘কিছু বলবে মা?’

‘হ্যা বাবা, কিভাবে যে বলি, আসলে তোর মামা নাকি অসুস্থ। আজ আমি আর তোর বাবা সেখানেই তাকে দেখতে যেতে চাচ্ছি।’

‘তো সমস্যা কি যাওনা। এক দুইদিন থেকে আসো।’
‘আসলে আমার কাছে তো টাকা যা ছিল সব পরিবারের খরচে শেষ হয়ে গেছে। আবার বৌমার কাছে বললেও কি বলবে তাই,,,,’

শান হেসে বলল, ‘যাবে কখন?’

‘বিকেলে আমি আর তোর বাবা রওয়ানা দিতে চাচ্ছি।’

‘অহ, আমি দুপুরে অফিসে গিয়ে বসের কাছে চেয়ে অগ্রিম কিছু এনে দেব মা। চিন্তা করো না।’

‘তোর এমনিতেই এ অবস্থা। তার উপর তোকে আরো কষ্ট দিচ্ছি আমরা। তাইনারে!’ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল শানের মা।

‘আমিই তো কুলাঙ্গার মা। তোমাদের দ্বায়িত্ব নিতে পারলাম না। এখনো তোমাদেরই পরিবার চালাতে হয়।’

‘আমার ছেলে নিজে চোখে না দেখেও তার বয়ষ্ক বাবা মাকে দেখে রাখতে রাত নেই দিন নেই খেটে যাচ্ছে। আর সে কুলাঙ্গার!! এ কথা ভুলেও বলবি না আর।’

শান মাথায় রাখা তার মার হাতের উপর হাত রেখে হাসলো।’কবে আসবে মা?’

‘এইত বাবা দুই একদিন মাত্র। কিন্তু এই এক দুইদিন থাকতে পারবি তো?’

‘হ্যা মা। একা নাকি আমি পুতুল তো আছে, সে কোথায়?’

শানের মা কেমন খাপছাড়া গলায় তাচ্ছিল্য সহকারে বলল
‘সে আজ সকালে উঠে বাজারে গেছে, অফিসের সবার জন্য নিজে রান্না করে নিয়ে যাবে। আর নিজের অসুস্থ স্বামীটার কোনো খোজ নেই। আগে থেকে জানলে তোর জীবনটা আমি এভাবে নষ্ট করতাম না বাবা।’

মুখ মলিন হয়ে উঠল মা ছেলের।
‘আহ মা বাদ দাও তো। আজ যাবে এক জায়গায়। চিন্তা মুক্ত হয়ে যাও।’ কথা কাটাতে শান বলল।

———–

পুতুল সকাল থেকে নানা পদের রান্না করতে ব্যস্ত। অবশেষে দুপুরে রান্না শেষ হল। সব গুছিয়ে রওয়ানা দিবে এমন সময় শান বলল,’পুতুল আজ আমাকেও একটু নিয়ে যাবে সাথে?’

পুতুল চমকে উঠল,’মানে!!!! তুমি এখন কোথায় যাবে? কেনো?’

‘আসলে আমার এখন একটু অফিসে যেতে হবে। নামিয়ে দিও না হয়। প্লিজ।’

শানের মা বাবা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। পুতুল বেড়োবে ঠিক তখনই পিছন থেকে কথাটি বলল শান।
অনিচ্ছা হলেও রাজি হল পুতুল।

বাসায় বাইরে গিয়ে একটা সি এন জি ঠিক করলো পুতুল। হাতে এক গাদা খাবার। শানের কাছেও অফিসের ব্যাগ। গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিল দুজন।

শান হঠাৎ বলল,’পুতুল একটা কাজ করে দেবে আমার?’

‘কি?’ কেমন বিরক্ত হয়ে বলল পুতুল।

‘রেগে যাচ্ছ কেনো? আশে পাশে ওষুধের দোকানের পাশে রেখে একটা মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনে দেবে? আমি যেটা খাই সেটা। চোখও জ্বালা করছে কেমন।’

সামনে ফার্মেসীর পাশে গাড়ি থামাতে বলে পুতুল ওষুধ আনতে নামলো। তখনই মুচকি হাসলো শান। নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা তড়িঘড়ি বের করে পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবারের ব্যাগটির দিকে হাত বাড়ালো।

————-

শানকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে পুতুল চলে গেল। অফিসে গিয়েই শান বসের কাছে কিছু টাকা চাইলো মায়ের কথা বলে। এমনিতেই অফিসের সবাই শানের কাজে আর ডেডিকেশনে মুগ্ধ। এক কথায় তাদের মিডিয়া চ্যানেল শানের গলার আওয়াজেই এখন এত পপুলার। শানের কথা শোনার আগেই বস তার হাতে টাকা গুজে দিল।
‘এখানে দশ হাজার টাকা আছে। তোমার মাকে দিও ঠিক আছে? বাকি টাকা মাস শেষে নিও।’

‘ধন্যবাদ স্যার। কি বলে যে আপনাকে,,,’

‘আরেহ তুমি আমার চ্যানেলের গৌরব। আমারই তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। এখন যাও রাতে এসো কেমন। গাড়িতে উঠিয়ে দিব?’

‘না স্যার আমি পারব। আসি স্যার।’
———

অফিস থেকে বেরিয়ে শান এক মুহুর্ত দেরি না করে পাশের কোনো পাবলিক ওয়াশরুমে গেলো। নিজের ব্যাগে আনা ফলস চুল দাড়ি পড়ে জামা পাল্টালো যেটা সে যা প্রতি রাতে করে। এবার লক্ষ্য সাব্বিরের গ্যারেজ। মুচকি হাসলো শান। যাওয়ার আগে পাশের একটা পি.সি.ও. থেকে পুলিশকে খবরটা জানাতে ভুললো না।
———-

গ্যারেজে মাত্র প্রবেশ করলো পুতুল। সাব্বির কথা বলছিল বাকিদের সাথে এসব নিয়েই। পুতুলকে আসা দেখে তাকে নিয়ে গ্যারেজের দুইতালায় গেলো।

শান একটু পরই পৌছাল। বৃদ্ধ লোকের বেশে এসেছে সে। নিচে গ্যারেজে অনেক লোক। গাড়ি রিপেয়ার করছে, তো কেউ পুরাতন গাড়ি কিনতে এসেছে। সবার চোখ ফাকি দিয়ে দুইতলায় গেল।

উপরের রুমের দরজা বন্ধ। কিন্তু পাশের জানালার ছিদ্র দিয়ে সবই প্রায় দেখা যাচ্ছে। শান সেখান দিয়েই খেয়াল করলো, পুতুলকে সাব্বির জড়িয়ে রেখেছে। পুতুলের গায়ে বোরকা নেই এখন আর। নিচে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সেজে এসেছে আজ। পাশে টেবিলের উপর পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবার। জড়িয়ে থাকা দৃশ্য দেখে শানের চোখ লাল হয়ে গেলো। এই বিশ্বাসঘাতককে সে কিনা ভালোবেসেছিলো!

‘কি করছো ছাড়ো।’ পুতুল ন্যাকামো করে বলল।

‘এতদিন পর কাছে পেয়েছি। ছাড়তে ইচ্ছেই করছে না।’ সাব্বিরের কেমন ঘোরের মধ্যে জবাব।

‘আহা, আগে খাবার এনেছি তোমার জন্য সেটা তো খেয়ে নাও।’

‘আমার খাবার তো আমি জড়িয়েই রেখেছি। সেটা আগে খেয়ে নেই। তারপর না হয় দেখা যাবে।’ কথাটা বলেই পুতুলকে আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে আরো গভীর হতে চাইলো।’

শান সেটা দেখেই জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখের সামনে তার একসময়ের ভালোবাসা অন্যের সাথে ভালোবাসার আদান প্রদানে ব্যস্ত।

ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো। না চাইতেও জানালা দিয়ে আবার চাইলো শান। পুতুলের ঘাড়ে মুখ গুজে আচলে টান দিতেই সাব্বিরের কানে আসল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ। সাথে সাথে ছিটকে গেলো দুজনই।

‘পুলিশ হঠাৎ এসময়!!’ সাব্বিরের ভয়ার্ত কন্ঠ।

‘আমাকে তোমার সাথে এখানে দেখে ফেললে কি হবে? কি বলবে সবাই?’ পুতুলও ভয়ে প্রায় কেদে দিয়েছে।

‘আরে পিছনে একটা সিড়ি আছে। তুমি সেখান দিয়ে নেমে যাও।’

‘তুমিও চলো।’

‘আরে না, আমাকে তো এসব ফেস করতেই হবে। আর তাছাড়া আমি এসেছি এখন। এই গ্যারেজে তো কিছু পাবে না।’

‘আচ্ছা আমি যাই।’ পুতুল সাব্বিরকে হালকা জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ালো ওইভাবেই।

বোরকা পড়তে ভুলে গেছে তাড়াহুড়োয়। বোরকাটা নিচেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল। দৌড়ের সময় পুতুলের পায়ের সাথে বেধে রুমের বাইরে পর্যন্ত চলে এসেছে। পুতুলের সেদিকে নজর নেই। সে দ্রুত এখান থেকে যেতে পারলেই বাচে।

শান সাথে সাথে আড়ালে এসেছে। যেন পুতুল দেখতে না পায়। পুতুল পিছনের গেট দিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই পুলিশ উপরের তলায় চলে আসল।সাথে গ্যারেজের অনেকেই এসেছে, কর্মচারী, ক্রেতাসহ সবাই। শোরগোলে সবার দেখার ইচ্ছা কি হচ্ছে এখানে। শান বৃদ্ধ বেশে তাদের মাঝে মিশে গেছে।

পুলিশ সবাইকে বাইরে রেখে সাব্বিরের রুমে গেলো। শান আবার জানালায় চোখ রাখল।

‘কি ব্যাপার আপনারা আমার গ্যারেজে?’ সাব্বির প্রশ্ন করলো।

‘আপনার গ্যারেজে নেশাদ্রব্য আছে আমরা খবর পেয়েছি।’

‘হাসালেন। এতদিন আমি দেশে ছিলাম না। আমার গ্যারেজে কে না কে রেখে গেছিলো ওইসব। তার ভিত্তিতে আমার উপর মামলা করেছেন, সিল করেছেন সব। আর এখন তো আমি দেশে। এখানে কে রাখবে? আপনারা খুজে দেখতে পারেন।’ সাব্বির বলে পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসল।

পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোজা শুরু করলো। কিছুই না পেয়ে চলে যাবে তখনই হঠাৎ একজন অফিসার বলল,’এই টিফিন বাটিগুলোতে কি?’

‘আমার লাঞ্চ।’ সাব্বিরের আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব।

পুলিশ কি মনে করে বাটিগুলো খুলতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাথে সাব্বিরের তো জান যায় যায় দশা।

সব গুলো বাটিতে মুখরোচক খাবার। কিন্তু তার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য-ইয়াবা ট্যাবলেট, ড্রাগস এর প্যাকেট!!!!!!।

‘পুতুল!!! তাহলে তুমি??? তুমি আমার সব গ্যারেজে এরকমটা করেছো? আমি তোমাকে ছাড়ব না পুতুল। ছাড়বো না।’ সাব্বির বসে পড়ে রাগে ক্ষোভে এসব বলছিল। তখনই হাতে হাতকড়া পড়ালো একজন। হাতে নাতে মাদকদ্রব্য ধরা পড়েছে। আজ আর রেহাই কোথায়!

বাইরে সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে এখনো দেখছে এসব শান। মুখে আজ তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না আরেকজন তো বাকি আছে। এবার তার পালা। সবাইকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পেতে হবে। সবাইকে!!!!

কিন্তু এক প্রলয়ংকারী ঝড় যে তার জীবনে আসন্ন সেটা কি শান জানে??

চলবে,,

সামনের প্রতিটা পর্বে থাকবে রহস্য আর রহস্য। আপনারা সবাই সাথে থাকবেন। সবার গঠনমূলক মন্তব্যের আশায়!!!!! অগ্রিম ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here