#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৪.
সময়ের কাটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটছে। ঢাকা শহরের বুকে দুপুর নেমেছে। ঘড়িতে সময় দুপুর একটা। অন্তি মাঠের এক কোনে জুবথুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বা হাতে ধরে রাখা তার শাড়ির কুচি। অন্যহাতে মাবাইল সহ পার্স। খোলা চুলগুলো অবাধ্যের ন্যায় উড়ে উড়ে চোখ মুখে পড়ছে। দু হাত ব্লক থাকায় বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে চুল সরানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে সে জায়গা ছেড়ে নড়তেও পারছে না। উঁচু হিলের তলায় শাড়ির কুচি বেঁধে শাড়ি কিছুটা এলোমেলো হয়েছে। এজন্যই মূলত সে এখানে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে গেলে যদি খুলে যায়? এক শাড়ি পরার জন্য এতসব ইতিহাস তৈরি হবে জানলে সে এই ভুল কিছুতেই করতো না। সবাই কেমন হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর সে?
ওদিকে তন্নির কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা ওয়াশরুমের নাম করে সেই গেলো এখনো এলো না। অন্তি যখন আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত তখন সেখানে আগমন ঘটলো দিহান মির্জার। তাকে খুব চিন্তাগ্রস্থ দেখালো। অন্তি চোখ পিটপিট করে চাইলো। এই লোকের মতলব কি? দিহান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
‘কোনো সমস্যা?’
অন্তি না বোঝার ভঙ্গিতে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। ছোট করে বললো,
‘কোনো সমস্যা না।’
দিহান আশপাশে তাকিয়ে পুনরায় বললো,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
অন্তি জবাবে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর যাই হোক সে তো এখন বলতে পারবে না তার শাড়ি খুলে যাওয়ার ব্যাপারটা। লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!
প্রশ্নের সাথে সাথে উত্তর না পেলে মেজাজ তিতো হয়ে আসে দিহানের। সেখানে এই মেয়েটা প্রতিটা জবাবের আগে মৌনতা পালন করে। দু একটা থাপ্পর লাগালে এতদিনে ঠিক ঠাক হয়ে যেত। কিন্তু সেটা পারছে না আপাতত। তেমন করলে এই মেয়ে তার জিনা হারাম করে দিবে।
দিহান দু আঙুল দিয়ে কপাল ঘঁষে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘যা পড়তে পারো না তা পরো কেন? দ্বিতীয়দিন যেন তোমায় শাড়িতে না দেখি!’
অন্তি ঠোঁট উল্টে তাকালো। শাড়ির কুচি শক্ত করে ধরে রাখলো। লোকটা বুঝলো কিভাবে? অন্তি আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে দিহানের পানে চাইলো। পরপর পাতলা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলতে নিলো,
‘আপনি বুঝলে কি…..’
তার কথাকে অসম্পূর্ণ রেখে দিহান উল্টো পথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে শাসিয়ে বললো,
‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। কাউকে পাঠাচ্ছি।’
অন্তি কথা শোনে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে দিহান দুকদম এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে অন্তির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
‘চুমু খেতে চাইতে লজ্জা লাগে না, আর সামান্য শাড়ি খুলে গেছে বলতে এতো লজ্জা? ইমপ্রেসিভ পারফরমেন্স! আ’ম ইমপ্রেসড্!’
কথা শেষ করে ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো দিহান। তবে অন্তি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। লোকটা কি বলে গেলো? পরক্ষণে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে। ইশশ! আবেগের বশে কোনো একদিন চুমু খাওয়ার কথা নাহয় সে বলেছিলো, সেটা এতদিন মনে রাখার কি দরকার ছিলো? লোকটা নিশ্চই তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য সেসব কথা নোট মার্ক করে রেখেছে! অন্তি চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ালো। এই মানুষটা তো চরম অসভ্যের সাথে নির্লজ্জ ও বের হলো। এতসব খারাপ গুণ কেন তার মাঝেই থাকতে হলো? অন্তি কিভাবে ওভারকাম করবে এসব গুণ?
প্রায় দশ মিনিটের মাথায় একটা আপু এলো। কোলে তার চার কি পাঁচ বছরের একটা মেয়ে। অন্তিকে দেখতেই হেসে বললো,
‘তুমিই রূপন্তি বুঝি?’
অন্তি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। আপুটা অন্তিকে বললো,
‘একটু কষ্ট করে ক্লাসরুমে চলো। এভাবে মাঠে বসে তো শাড়ি ঠিক করা যাবে না। হাঁটতে পারবে?’
অন্তি ছোট করে জবাব দিলো,
‘পারবো।’
‘গুড। আসো তাহলে।’
শাড়া ঠিক করতে করতে আপুটার সাথে অনেক কথা হলো অন্তির। তাদের কথার মেইন টপিক ছিল দিহান। আপুর ভাষ্যমতে দিহান এক কালে তার ও ক্রাশবয় ছিলো। দিহানকে পরপর চারবার প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার পর দিহান তার গাল বরাবর ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পর মেরেছিল। যদিও এর যথেষ্ট কারণ ছিলো। অতিরিক্ত আবেগের বশে সে হাত পা কেটে বসেছিলো। অনুভূতি স্লোগান ছিল, প্রাণ যায় যাক আমার তুমি হলেই চলবে। কিন্তু তার অনুভুতির দু আনা দাম দিহান দেয়নি। যাই হোক সেই থাপ্পর খেয়েই মূলত তার মাথা থেকে দিহানের ভূত নেমেছিল। তবে তার এই বারাবারি রকম পাগলামির দরুন তার পড়াশোনাটা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারে জানাজানি হওয়ার ফলে তার বাবা তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। এখন সে এক বাচ্চার মা।
এমন হৃদয় ভাঙার গল্প শুনে অন্তির দয়ার মনটা কেঁদে ওঠে। বুক ভার হয়ে আসে প্রেমে ব্যর্থ হৃদয়টার প্রতি। আক্রোশ নিয়ে বলে,
‘পাষাণ মানব একটা!’
অন্তির কথায় হাসে মেয়েটা। কোমরে কুচি গুজে দিতে দিতে বলে,
‘এক দিক থেকে কিন্তু এতে তোমার লাভ হয়েছে।’
অন্তি চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,
‘কিভাবে?’
‘দিহান পাষাণ না হলে সে এতোদিনে অন্যকারো হয়ে যেত। ও পাষাণ বলেই ওকে তুমি পাচ্ছ। লাভ হলো না তোমার?’
অন্তির মস্তিষ্ক চট করে ব্যাপারটা ধরতে পারতেই উচ্ছাসিত গলায় বললো,
‘একদম তাই!’
আপুটা শব্দ করে হেসে ফেলে। অন্তি লজ্জ পায়। সে সত্যিই লোকটার প্রেমে পড়ে নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে।
অন্তি শাড়ি ঠিক করে বের হতেই দেখলো দিহান ক্লাসরুমের সামনে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। পেছন থেকে সেই আপু এসে জোরে বলে ওঠে,
‘প্রেম বিদ্বেষী দিহান দেখছি এখন প্রেমে মাখো মাখো হয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দেওয়া হচ্ছিলো বুঝি?’
দিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অন্তিকে এক পলক দেখে নিয়ে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘অযথা কথা খরচ না করে তোর কাজে যা। এখানে তোর আর কোনো কাজ নেই।’
‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’
আপুটা চলে যায়। অন্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। এই যে দিহান তার দিকে তাকিয়ে আছে, এতে সে মাথা সোজা করতে পারছে না। যেন চোখে চোখ মিললেই তার মৃ ত্যু ঘটবে। দিহান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে শান্ত গলায় বলে,
‘এখন সব ঠিক আছে?’
অন্তি মাথা উপর নিক করে। দু দন্ড সময় পর দিহান পুনরায় বলে,
‘সোজা খাবারের ওখানে চলে যাও। আমি আশপাশেই থাকবো।’
দিহান ব্যস্ত পায়ে চলে যায়। দিহানের বলা কথাগুলো অন্তির ছোট মনে ঝড় তোলে। এলোমেলো করে দেয় অনুভূতিদের। কি ছিলো কথাগুলোতে? এত মাদকতা কেন? তার হৃদয় উষ্ণতায় ভরে ওঠে। এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মানুষটার ছোট ছোট যত্ন পাচ্ছে সে, তার লোভ বেড়ে যাচ্ছে। কড়া শাসনে আটকে রাখা হৃদয়টা অস্হির হয়ে ছটফট করছে। ভালোবাসা চাই তাদের। মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা প্রেমটা যেন নতুন রূপে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মানুষটার এতটুকু যত্ন পেতে সে মরতেও রাজি।
_____________
‘সোজা হয়ে দাঁড়াও! এভাবে কাচুমাচু করছো কেন? তুমি কি আসামি?’
নুহাশের ধমকে তন্নির চোখে জল আসে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চেয়েও কিছুতেই সে মাথা সোজা করে সরাসরি তাকাতে পারছে না। এদিকে নুহাশ ক্যামেরা হাতে অনর্গল নির্দেশনা দিয়ে চলছে। এভাবে না এভাবে দাঁড়াও, মাথা উঁচু করে তাকাও, অল্প হাসো, আকাশেল দিকে তাকাও ব্লা ব্লা ব্লা। ছবি তোলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে তন্নির ও। কিন্তু ক্যামেরা ম্যানটা নুহাশ না হলেই চলতো। এমন দানবীয় মানুষের সামনে সে কিভাবে পোজ নিবে?
তন্নির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে। ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুচ্ছো যত্ন নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তন্নি তখনো চোখ নামিয়ে রাখে। নুহাশ ধমক দিতে যেয়েও হেসে ফেলে। চঞ্চল কন্ঠে শুধায়,
‘তুমি বড্ড বোকা সুন্দরী! এত বোকা হলে চলে?’
এবার তন্নি তাকায়। সরাসরি নুহাশের চোখে চোখ রাখে। সে অন্তির মতো চটপটে নয়,শান্ত স্বভাবের, এটা সবাই বলে কিন্তু বোকা? এটা কখনো কেউ বলেনি। বোকা শব্দটা তন্নির কাছে নিতান্তই অপমান সূচক শব্দ বলে মনে হলো। তার আত্মমর্যদা সম্পন্নো মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। তন্নি প্রথম বারের মতো নুহাশের কথার বিরোধীতা করে প্রতিবাদী কণ্ঠে জানালো,
‘আমি বোকা না। আপনি ভুল বুঝছেন!’
নুহাশের হাসি সেকেন্ডের জন্য থামে। কপাল বরাবর সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। পরক্ষণে হাসি চওড়া হয়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কৌতুক করে বলে,
‘বোকা বলায় সুন্দরী বিড়াল বাঘ বনে গেলো যে! ইন্টারেস্টিং!’
তন্নি মাথা নিচু রেখেই দু পা পেছনে সরে দাঁড়ায়। চোখ তুলে সম্মুখে তাকানোর দ্বিতীয় চেষ্টা করে না। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলে,
‘যাচ্ছি।’
আর দাঁড়ায় না মেয়েটা। নুহাশ মুচকি হাসে। ভীতু বাঘিনীকে তার ভালো লেগেছে খুব। এই নতুন রূপটা আনএক্সপেক্টেড ছিলো। নারীর আর কতো রূপ আছে?
চলবে………..