তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ৩৩.

0
347

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩৩.
গ্রাম থেকে অন্তির ফুপি সাবিনা এসেছেন। একা মানুষ এলেও বিশাল দুটো ব্যাগ বয়ে এনেছে। যেন এখানেই ঘাঁটি স্থাপনের আশায় আছে। তিন ভাইয়ের বাড়িতে এক মাস করে না থাকলে বেরানোর মজা হয় নাকি? এসে সরাসরি বড় ভাইয়ের ঘরে উঠছে সে। সিরিয়াল অনুযায়ী বড় ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন থাকার পর মেজভাই এর বাসায় তারপর ছোটভাই। সাবিনার আসার খবর পেতেই অন্তির ছোট চাচী দৌড়ে এসেছেন। তিনি প্রয়োজন ব্যাতীত খুব একটা অন্তিদের ঘরে আসেন না।

‘মেজভাবী শুনছেন আপা আসছে নাকি।’

নাহার খুব সাবলীল জবাব দিলো,

‘শুনলাম তো।’

‘এবার মনেহয় মাসছয়েক থাকার প্লান করে আসছে। ব্যাগ দুটো দেখছেন!’

‘থাকুক সমস্যা কোথায়? তুমি তো আপাকে ছাড়া কিছু বোঝো না। সারাদিন আপা আপা করে মাথা খেয়ে ফেল এখন সমস্যা কোথায়? করলা নাহয় আপার একটু সেবা যত্ন।’

রিপা চাচীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। চোর ধরা পড়ার মতো মুখ করে বেরিয়ে যেতে নিলেই সেখানে আগমন ঘটে সাবিনার। পান খেয়ে ঠোঁট জোড়া লাল টুকটুকে করে ফেলেছে। গায়ে টকটকে লাল রঙের একটা চাদর। হেলেদুলে এসে সোফায় বসে পান চিবুতে চিবুতে বলে,

‘আসলাম ঘন্টা পার হইছে একবার তো খোঁজ নিলা না। আমারই নামতে হইলো। এতদিন বাদে আসলাম তোমাদের আদর যত্ন কোই? আজকালকার মানুষেরা আদর যত্ন করার কথা ভুলছে। মানুষ আর মানুষ নাই।’

সাবিনার কন্ঠ হতাশা আর কষ্টে জর্জরিত। নাহার হাতের কাজ রেখে এগিয়ে আসে। ননদের কথা তার গায়ে লাগলেও আপাতত সে গায়ে লাগাতে চাচ্ছে না। ননদ জাতটাই এমন। যতদিন থাকবে উঠতে বসতে এমন কথা শুনতে হবে। উত্তর দিতে গেলে স্বামীর কাছে খারাপ হতে হবে। কি দরকার? ওসব গায়ে না নেওয়া ভালো। রিপা চাচী তার রূপ বদলে ফেলেছে। সাবিনার পাশে বসে একগাল হেসে বলে,

‘কি যে বলেন আপা! আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। মেজভাবীকে সাথে নিয়ে যেতে আসলাম। এর মাঝেই তো আপনি চলে এলেন। তা শরীর কেমন? শুকাইছেন মনে হচ্ছে!’

নাহার ভেবে পায়না এমন হাতির মতো শরীরের কোন অংশ শুকাইছে। এসব লো ক্লাস তেল তার ছোট জা-কে দিয়েই সম্ভব।

বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে অন্তি। এসে কারো সাথে কথা না বলেই নিজ রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। নাহার চিন্তিত চিত্তে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকায়। গলা উঁচিয়ে দু একবার প্রশ্ন করে,

‘কি হয়েছে? এত দ্রুত ফিরলি কেন?’

অন্তি জবাব দেয়নি। নাহারের মোন কেমন খচখচ করছে। এভাবে একটা ছেলের সাথে মেয়েকে পাঠানো কি ঠিক হলো? ঝোঁকের বশে বিবেগ হারিয়েছে একদম সে। নিজের বিবেগের উপর ভিষণ রাগ হলো সাথে মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা ও। এদিকে সাবিনাকে দেখেও এড়িয়ে যাওয়ায় দারুন ক্ষেপেছে সাবিনা। তার এতবড় বেইজ্জতি সে কিভাবে মেনে নিবে!

‘ভাইয়ের বাসায় আসলাম ভাইয়ের বউ মুখ ফিরায় নিলো এখন কিনা ভাইঝি ও! এই দিন দেখা লাগলো আমার।’

নাহার নরম গলায় বলে,

‘আপা আপনি ভুল বুঝছেন। ও হয়তো কোনো ব্যাপারে রেগে আছে। আপনি খেতে আসুনতো। ও ছোট মানুষ, ওর কাজ ধরার মতো কিছুনা। আপনার জন্য বড় রুইমাছ রান্না করেছি।’

______________

সাহেদ বাড়ি ফেরার পর বেশ বড়সড় আকারে বৈঠক বসেছে। বৈঠকটা মূলত অন্তি আর আরাভকে নিয়ে। আজ অন্তিকে নিয়ে আরাভ জমকালো কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো। সেখানে তার গোটাকয়েক বন্ধুরাও ছিল। কিন্তু আরাভ সহ তার বন্ধুরা যেমন পরিবেশ গড়ে তুলেছিল তেমন পরিবেশে কোনো সভ্য পরিবারের মেয়ের পক্ষে থাকা সম্ভব না। অন্তির বড় চাচা সবটা জানির পর ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। অন্য কোনো ছেলের ভরসায় কিভাবে সে বাড়ির মেয়েকে ছাড়তে পারে। সাবিনাও ভাইয়ের উপর হতাশা প্রকাশ করলেন। কড়া গলায় বললেন,

‘দরকার হলে মেয়ের বিয়ে দেব না তাও ঐ ছেলেকে জামাই হিসেবে চাইনা। কথাটা মাথায় ঢুকা সাহেদ। এই নিয়ে ফের যেন দুটো কথা আমার বলতে না হয়।’

সাহেদ মাথা নিচু করে বসে থাকেন। নিজের বিবেগের উপর ঘৃণা হচ্ছে তার। আজ যদি খারাপ কোনো কিছু ঘটে যেত? কি করতেন তিনি? কিভাবে মুখ দেখাতেন মেয়েকে? ভয়ে বুকটা মুচরে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে।
নাহারের চোখ ভরা পানি। মেয়েটা তার যেতে চায়নি। সে জোর করে পাঠিয়েছে। এর সবটা দ্বায় তার। মেয়ের ভালো চাইতে চাইতে যে খারাপ করে ফেলছিলো সেটাই বুঝতে পারেনি সে।

শাহিন সাহেব আলোচনার ইতি টানতে বলেন,

‘যা হয়েছে সেটাতো বদলানো যাবে না। কিন্তু তোমরা সচেতন হও। তাছারা আমাদের মেয়ে এখনো ছোট। বিয়ে দেওয়ার সময় যথেষ্ট রয়েছে। ওকে ওর মতো করে সময় দাও। নিজ পায়ে দাঁড়াক।’

শাহিন কথা শেষ করে উঠে যাওয়ার পরপর সবাই সবার জায়গা থেকে উঠে যায়। এই বৈঠকে অন্তি অনুপস্থিত ছিলো। সে রুমের দরজা আটকে বসে আছে। বাবা মায়ের উপর তার অনেক অভিমান জমেছে। আরাভের মতো খারাপ একটা ছেলেকেই কেন তাদের এতো পছন্দ হতে হবে। দিহানকে কেন তাদের চোখে পড়ে না? দিহান তো ওমন না। সে আলাদা। অন্যসব গুন্ডা মাস্তানদের মতো না। তবুও মায়ের ভিষণ অপছন্দ। এখানেই অন্তির অভিমান আটকে আছে।

রাতে খেতে ডাকা হয়েছে অন্তিকে। কিন্তু সে দরজা খোলেনি। নাহার সাহেদের প্লেটে খাবার বেড়ে দিলে সাহেদ না খেয়েই উঠে যায়। নাহারের চোখ ভরে আসে। তার ও খাওয়া হয়না। খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখে। পারুকে ডেকে খেয়ে নিতে বলে। তার খাবার বেড়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির এমন অবস্থায় পারুর মনটাও খারাপ। সে ও ভিষণ মন খারাপ নিয়ে বলে,

‘খাইবার মন চায়না খালা। আপারে ভাত না খাওয়াইয়া আমি কোনোদিন খাইছি বলেন? আপা খায়নায় আমি কেমনে খাই?’

নাহার ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে,

‘ভাত খেয়ে প্লেট ধুয়ে রাখিস। তরকারিটা বাইরে আছে ফ্রিজে রেখে দিবি মনে করে।’

_______________

দুদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও রেজওয়ান মির্জা সময় বের করতে পারছেন না ছেলের জন্য অন্তির হাত চাইতে যাওয়ার। এদিকে রেহানা আতঙ্কিত হয়ে আছে। দিহান না ঝামেলা করে। ছেলের উপর তার বিশ্বাস নেই যেমনটা ছেলের বাপের উপর নেই তার। দুজনের কেউই সোজা কথার মানুষ না।
রেজওয়ান মির্জা পেপার পড়া শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক বসান। রেহানা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেন,

‘আপনার ভাবজ্ঞান কি? কি করতে চাচ্ছেন?’

রেজওয়ান মির্জা স্ত্রীর কথার মর্ম বুঝতে না পেরে বলেন,

‘কোন ব্যাপারে বলছো?’

রেহানা স্বামীর কথায় আশ্চর্য না হয়ে পারেন না। দুদিন যেতে না যেতে এত বড় একটা ব্যাপার ভুলে বসেছে মানুষটা। ছেলেকে সে চেনেনা? এ ব্যাপারে দিহান জানতে পারলে বাড়ি মাথায় তুলবে। নিজের রাগ চেপে রেহানা বলে,

‘আপনার আজ যত কাজ আছে ক্যান্সেল করুন। আমরা রূপন্তিদের ভাসায় যাচ্ছি আজ। এটাই ফাইনাল।’

রেজওয়ান চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বিতৃষ্ণ গলায় বলেন,

‘ছেলের সাথে সাথে তোমার মাথাও খারাপ হয়েছে রেহানা। ওর শরীরের অবস্থা কি? এই অবস্থায় বিয়ের ভূত চেপেছে মাথায়। তুমিও সেই ভুতকে দুধ কলা দিয়ে আপ্পায়ন করছো।’

রেহানা গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে জবাব দেন,

‘গেলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তাদের ও তো মতামত থাকবে। কথা বলতে সমস্যা কোথায়? কোনো কারণ ছাড়া তো ছেলে এত ব্যস্ত হয়নি। আপনি না চিনলেও আমার ছেলেকে আমি চিনি। সংসারের কোনো ব্যাপারে আপনি সিরিয়াস না। সব কিছুই আপনার কাছে ফালতু মনে হয়।’

‘এখানে সংসারের ব্যাপার কেন আসছে? আশ্চর্য!’

‘আশ্চর্যর কি দেখলে? আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই বলিনি আমি। যা বলেছি সবটা সত্যি।’

এ পর্যায়ে রেজওয়ান মির্জা হার মেনে নেন। ক্লান্ত গলায় বলেন,

‘আচ্ছা আজ যাচ্ছি আমরা। সময় মতো তৈরি হয়ে নিও।’

চলবে…………

(গল্পটা আর কয়েক পর্বের মধ্যেই সমাপ্ত করবো। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। ভালোবাসা নিবেন ❣️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here