তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ৩৫.(শেষ-প্রথম খন্ড)

0
485

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩৫.(শেষ-প্রথম খন্ড)
শীতের চাদর চিড়ে এক খন্ড সূর্যের আলো এসে পড়েছে অন্তির রুমে। টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। মাত্রই পারু এসে রেখে গেছে। অন্তি কফির মগে লম্বা চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে। ফোন হাতে তুলে তন্নিকে কল করে। কল একবার বাজতেই ওপাশ থেকে তন্নি কল রিসিভ করে। কাঁদো গলায় বলে,

‘অভশেষে তোর আমায় মনে পড়লো! এমন কেমনে পাড়িশ? রাত থেকে না ঘুমিয়ে ফোন হাতে বসে আছি। চিন্তায় চুল পড়ে টাক হয়ে যাওয়ার জোগাড়। হয়তো জ্বর ও চলে এসেছে। আর তুই কিনা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস?’

‘ঘুমের সাথে নো কম্প্রোমাইজ বেব। চিন্তা চিন্তার জায়গায় আর ঘুম ঘুমের। একের জন্য অন্যকে ছাড়তে পারবো না আমি।’

অন্তির কথার পিঠে তন্নি জবাব দিলো না। তার দুচোখ ভরা ঘুম। যখন তখন ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া গাছের মতো ঢুলে পড়বে সে। তন্নি গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে। নিভু গলায় বলে,

‘আপডেট বল। শুনে ঘুম দিব। খারাপ সংবাদ হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবো আর ভালো হলে আগামীকাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।’

অন্তি দারুন করে হাসে। হাসির তালে সাদা দাঁত গুলো সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

‘আজকের সকালটার মতো সতেজ সংবাদ। সামান্য বিষাদ ও রয়েছে। মা খুব রেগে আছে আমার উপর। তাছাড়া সব ঠিকঠাক। শাশুড়ি আম্মু সব ঠিক করে রেখে গেছেন।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। কংগ্রাচুলেশন এবং টাটা।’

ফোন কাটলে অন্তি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার আবারো ঘুম পাচ্ছে খুব। মন ভালো থাকলে ঘুম ভালো‌হয়। অন্তি গলা উঁচু করে পারুকে ডাকে।

‘আমার ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত এ রুমে আসা মানা। আজকের জন্য আমার রুমের সকল কাজ থেকে তোকে ছুটি দেওয়া হলো।’

অন্তি ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে আরো একটা কাজ করলো। দিহানের নম্বরে ছোট করে একটা টেক্সট পাঠালো,

‘Congratulations! you’re gonna get me।’

________________

সময়টা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। হুট করেই ভিষণ শীত নেমেছে। অন্তির‌ রুমের বাতি অফ। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। আজ দিহানের সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। ঝগড়া বলতে মন কষাকষি। লোকটাকে দুটো কড়া কথা শোনাতে পারলে দারুন হতো। কিন্তু সে তা পারেনি। কিছু বলতে নিলেই তার বুকে ভালোবাসার ঢেউ উথলে ওঠে। আর কিছু বলা হয়না। তবে সে সহ্য ও করতে পারছে না। এমন পাথুরে মানবের সাথে কিভাবে সংসার করবে সে? দুটো মিষ্টি কথা যার মুখ থেকে বের হয়না তাকে নিয়ে কোন সাগরে ভেসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে সে? অন্তির মাথার মধ্যে রাগটা চড়া দিয়ে ওঠে। শোয়া থেকে উঠে বসে বড় করে শ্বাস ফেলে। বালিশের পাশ থেকে ফোন বের করে দিহানকে কল করতে। কিন্তু তার পূর্বেই দিহানের কল আসে। অন্তি কলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ এই ব্যস্ত মানবের তার কথা মনে পড়লো কেন?

‘ছাদে আসো।’

‘এই মুহূর্তে……’

ছোট বাক্যটা শেষ হতেই টুট টুট করে কল কেটে গেলো। অন্তির জবাব শোনার অপেক্ষা করলো না সে। অন্তি চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নেয়। আজ এই লোককে সে নিজ হাতে খু*ন করবে।
বাহিরে বেশ ঠান্ডা বাতাস। অন্তির শরীরে পাতলা জামা কেবল। রাগের আগুনে তার ঠান্ডা লাগছে না বোধহয়। দিহান দাঁড়িয়ে আছে রেলিংয়ের পাশ ঘেঁষে। তার নজর ছাদের লোহার দরজা থেকে উঠে আসা অন্তির দিকে। ভ্রু গুলো সামান্য কুঁচকে তাকিয়ে আছে। অন্তি কাছে এসে দাঁড়ালে দিহান তার জ্যাকেট খুলে অন্তির গায়ে জড়িয়ে দেয়। গম্ভীর গলায় বলে,

‘আমার উপরের রাগ নিজের শরীরের উপর কেন দেখাচ্ছো? এতটুকু শরীরে এত রাগ কোথায় থাকে?’

অন্তি পুরো কথাকে এড়িয়ে যেয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,

‘কেন এসেছেন?’

‘তোমায় দেখতে।’

এই অতি সামান্য কথায় অন্তির জমে থাকা রাগ গলে পানির ন্যায় তরল রূপ ধারণ করে। চোখ ছলছল করে ওঠে। অভিমান গুলো জল আকাড়ে ঝড়ে পড়তে নিলে দিহান তা আঙুলের ছোঁয়ায় মুছে দেয়।

‘আপনি আমায় একটু বেশি বেশি ভালোবাসতে পারেন না?’

‘কাঁদে না। এখন থেকে বাসবো।’

‘আপনি আমায় ভালোবাসতে ভুলে যান। শুধু ব্যস্ত থাকেন। দেখা করেন না। এমন করলে আমি আপনায় আর ভালোবাসবো না।’

কথাটা বলে অন্তি নাক টানে। দিহান অন্তির ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বাঁধা দেয়। নরম গলায় শাসন ভঙ্গিতে বলে,

‘এমনটা যেন কখনো না হয়। কিছু কাজে ব্যস্ত থাকছি আজকাল। কাজটা শেষ হলেই তোমায় অনেক সময় দিবো। তখন বিরক্ত হলে চলবে না। তবে তোমার কাজ এই আমাকে ভালবাসা কেবল। আমাকে ভালোবাসতে ভোলার মতো ভুল কখনো করবে না জান। এই ভুলের মাফ নেই যে!’

অন্তি গোল চোখে তাকিয়ে থাকে। আকাশে একখন্দ চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। সেই মিষ্টি আলোয় দিহানের মুখটা জ্বলজ্বল করছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো দোল খাচ্ছে। অন্তিকে ছেড়ে দিহান বুকে দু হাত বেঁধে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশে অন্তি চুপটি করে দাঁড়িয়ে। কথা না হলেও পাশাপাশি নিরবে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব করে অনুভব করছে সে। দিহানের চোখ বন্ধ। অন্তি দূরত্ব ঘুচিয়ে কিছুটা কাছে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে,

‘শুনুন?’

‘শুনছি।’

‘আপনার বুক থেতে হাত নামান প্লিজ।’

‘কেন?’

অন্তি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। সে এখন কিভাবে বলবে যে সে একটু দিহানের বুকে মাথা রাখতে চায়? সে বোঝে না? এত অবুঝ কেন? অন্তির মন খারাপ হয়। মলিন হেসে বলে,

‘না কিছু না।’

অন্তি সরে দাঁড়াতে নিলে দিহান তার হাত টেনে ঘুড়িয়ে আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ এমন হওয়ায় খানিক চমকে যায় অন্তি। নড়েচড়ে ওঠে অল্প। খানিক বাদে শান্ত হয়ে লেপ্টে থাকে। দিহানের শরীরের কড়া গন্ধ নাকে ধাক্কা খায়। অন্তি চোখ বুঝে সেই গন্ধ নেয়। দিহান ফিসফিস করে বলে,

‘এর থেকে বেশি আর কিছু চেওনা রূপ। আর কিছুদিন মাত্র।‌ সব ভালোবাসা তোমার মুঠোয় এনে দিবো। আমি তোমায় হালাল ভাবে ছুঁতে চাই।‌ বুঝেছ মেয়ে?’

___________

মার্চ মাসের প্রথম শুক্রবার। আকাশে একখন্ড আগুনের গোলার মতো জ্বলজ্বল করছে সূর্য। শীতের প্রোকোপ খানিক কমে এসেছে। হুটহাট করে গা কাঁপিয়ে ঠান্ডা নামে। কখনো বা সূর্যের তেজে গা গড়িয়ে ঘাম ঝড়ে। আর কিছুদিনের মাঝেই শীত বিদায় নিবে হয়তো। অন্তি বারান্দায় মেঝেতে গোল হয়ে বসে আছে। টুলে বসে সাবিনা অন্তির চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে।‌ অন্তি বারবার না করা সত্তেও সাবিনা চুপচুপে করে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। খসখসে কিন্তু মিহি গলায় বিলাপ করে বলছে,

‘তেল হচ্ছে চুলের পুষ্টি। তেল না দিতে দিতে চুলের কি সাংঘাতিক অবস্থা হইছে আল্লাহ! আমার ভাইয়ের বউটাও বলিহারি, মাইয়ার দিকে কোনো নজর নেই। একটা মাত্র মাইয়া তাই এই অবস্থা। আমাদের মতো চার পাঁচটা পোলাপান হইলে কেমনে মানুষ করতো?’

চুলের প্রসঙ্গ থেকে ভাইয়ের বউয়ের প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় অন্তি খুব একটা অবাক হলো না। এটা সে ছোট থেকে দেখে আসছে। তারা কোনো ভুল করলে দোষটা সর্বদা মা চাচিদের উপর থেকে চলে যায়।
সাবিনার কথা হয়তো নাহারের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। দরজার সামনে থেকে উত্তর দেয়,

‘আমার মেয়েকে আমার আদর যত্নে বড় করতে হয়নি আপা। একা একাই এতবড়ো হয়েছে। আরো পাঁচ ছয়টা ছেলে মেয়ে থাকলেও এভাবেই বড়ো হয়ে যেত।’

এ কথা সাবিনার ভিষণ রকম গায়ে লাগলে তিনি অন্তিকে বলেন,

‘তোর মায়ের কথা শুনেছিস? কেমন মুখে মুখে জবাব দেয় দেখ। আমি যে বড় তার কোনো সম্মান দেয় সে? ভাইয়ের বাড়িতে দুটো দিন মন ভালো করতে এসে কেমন বেজ্জতি হতে হচ্ছে! এই দিন দেখার জন্যই আল্লাহ আমাকে বাঁচায়ে রাখছে। আজ আসুক সাহেদ। ওর বউকে ও শিক্ষা না দিলে আমি এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।’

নাহার মুখ বাঁকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আজ বাসায় অনেক মেহমান আসবে। একমাত্র মেয়ের আকদ বলে কথা। এই দিনে ঝগড়ায় জড়ানোটা ভালো হবেনা। তাই সাবিনাকে ছেড়ে দিলেন তিনি। নয়তো প্রতিটা কথার ভলো জবাব দিয়ে আসতেন।

অন্তির পাশে তন্নি গালে হাত দিয়ে বসে আছে। অন্তির বাসায় সে খুব সকাল সকাল চলে এসেছে। ব্রাশটাও সে এবাড়িতে এসে করেছে। এত বড় একটা দিনে সে আসতে লেট করবে এমনটা কখনোই হবে না। গালে হাত রেখে তন্নি ভিষণ ভাবুক চিত্তে বললো,

‘দোস্ত তোর বিয়ে হয়ে গেলে তো তুই অন্যের বউ হয়ে যাবি তাই না?’

‘হুহ।’

তন্নি গাল থেকে হাত নামিয়ে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ায়। যেন সে বিশাল কোনো ধাঁধার সমাধান করে ফেলেছে। অতঃপর নিজের মনের লুকায়িত কথাখানা প্রকাশ করে।

‘বলছিলাম দিহান ভাইকে বলনা নুহাশকে যেন একটু বিয়ের ব্যাপারে বুঝায়। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা কুমারী হয়ে বসে থেকে কি করবো? তার থেকে দুজনই বউ হয়ে গেলে কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ হয়। হয় না?’

অন্তি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

‘তোর হিটলার বাপকে ম্যানেজ করলেই তো পারিস।’

‘আমার বাপকে হিটলার বলবি না একদম। আমার বাপ হিটলারের থেকেও ভয়ানক।’

_____________

ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হলেও লোক সংখ্যা মোটেও কম নয়। বাড়ি ভরতি লোক গমগম করছে। সাহেদ বাড়ির পেছনে বাবুর্চি আনিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেছে। বিয়েতে বাড়িতে কোনোরকম সাজসজ্জা হবেনা এমনটাই বলেছিল শাহিন। কিন্তু সকাল হতেই দেখা গেছে তিনি ডেকরেটের লোক আনিয়ে পুরো বাড়িতে মরিচবাতি সেট করেছেন। তাজা ফুল দিয়ে গেট সাজিয়েছেন। তা দেখে বাড়ির সকলে মিটি মিটি হাসছেন।
বাড়ির আনাচে কানাচে হাসির শব্দে ভরে উঠেছে। ছোট ছেলেমেয়েদের কান্না আর চিৎকারের শব্দ বাতাসে ধাক্কা খেয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। এত কিছুর মাঝে অন্তির মনে শান্তি নেই। চুলে দুইবার শ্যাম্পু করার পরও তার মনে হচ্ছে চুল থেকে তেল কাটেনি। রাগে দুঃখে তার কান্না পাচ্ছে। এই ফুপিটা তার সবসময় দু চার লাইন বেশি বুঝে।তার বিয়ের দিনে কিনা সে চুপচুপে তেল মাথায় ঘুরবে! এটা কোনো কথা? তার দুঃখের সঙ্গি হয়েছে তন্নি। অন্তির কষ্ট মানেই তার কষ্ট। তার প্রাণটার আজ বিয়ে আর এই বিয়েতে কিনা তার প্রাণটা মন খারাপ করে থাকবে। কিছুটা দুঃখ নিয়ে তন্নি বলে,

‘তোর ফুপি বোধহয় প্রতিশোধ নিয়েছে দোস্ত।’

‘কিসের?’

‘আন্টির উপরের প্রতিশোধটা তোর উপর থেকে নিয়েছে। সিরিয়ালে দেখিস না মায়ের উপরের প্রতিশোধ মেয়ের উপর নেয়? ওমন ঘটনা ঘটেছে।’

অন্তি কিছু বলার আগেই অন্তির কাজিনরা তার রুমে চলে আসে। এখন মেহেদী দেওয়া হবে। বিয়ের কনের হাত ফাঁকা মানায় না। যদিও এ ব্যাপারে অন্তির তেমন আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু নাহার গরম গলায় বলেছেন,

‘বিয়ের দিন হাত ফাঁকা থাকবে এ কেমন কথা? অল্প করে হলেও মেহেদী লাগাও।’

অন্তি মায়ের কথা মেনে নিয়েছে। নাহার এই দু তিন মাস তার সাথে মেপে মেপে কথা বলে। বয়টা বিষণ কষ্টের। অন্তি অনেক চেষ্টা করেছে মায়ের রাগ ভাঙাতে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার। অন্তি হাল ছেড়ে দিয়েছে। মায়ের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ব্যতীত কিছুই বলেনা সে আজকাল।

চলবে…………

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here