তিথি ১ম ও ২য় পর্বঃ

#তিথিঃ
১ম ও ২য় পর্বঃ
লেখাঃ-মোর্শেদা হোসেন রুবি
♥♥♥❤❤❤❤❤❤
আতিক বদমেজাজী ধরনের মানুষ।চট করে রেগে ওঠা ওর স্বভাব।আর রেগে গেলে কাকে কি বলছে ওর হুঁশ থাকেনা।রাগ ঝাড়াটাই তখন ওর মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে যায়।
আজও সে খানিকটা রেগে আছে তবে রাগটা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেনা কারন আতিকের রাগটা আজ ওর মা’র ওপর।
বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আজ তিনি বললেন-“তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি”!আতিক মনে মনে রেগে গেলেও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে প্রশ্ন করলো-“বিয়ে মানে? কার সাথে”?
-“একটা মেয়ের সাথে আবার কার সাথে! তোকেতো এরআগে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছি! তোর কোন পছন্দ আছে কিনা, তুই বলেছিস, নেই! ছবি দেখিয়েছি বলেছিস,’আমার কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই,তোমার যেমন পছন্দ হবে তেমনই সই’! তাই তো এবার মনমতো মেয়ে পেয়ে যাওয়াতে আমি আর দেরী করিনি!”
-“দেরী করোনি মানে? কি করেছো!”
-“আরিশাকে নিয়ে মেয়েটাকে এক ঝলক দেখে এসেছি!’
-” তাতে কি হলো!দেখলেই তো আর বিয়ে যায়না! চেনা নেই জানানেই….!”
-“অতকথা আমি বুঝিনা,তোকে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়ে গেছে।আর চেনাজানার কথা বলছিস?ওকে আমি ভালো করে চিনি,আমার বান্ধবীর ভাতিজী,সাখাওয়াত ভায়ের মেয়ে। বেচারীর মা নেই!ওর বাবা মোয়াল্লেম, হাজীদের সাথে ঘুরে বেড়ায়।বছরের ছ মাস দেশের বাইরেই থাকে।মেয়েটা খুবই ভালো রে! একবার দেখবি?’
-“দেখে কি হবে! তুমি তো সব ঠিকই করে ফেলেছো’!
আমার জন্যে কি কিছু রেখেছো?
-“কি রাখবো?এক তুচ্ছ ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে বসেছিস!এবার আর তোর কোনো কথা আমি শুনছি না,আমি যা বলবো তাই হবে”!
আতিক জানে ওর মাও ভীষণ জেদী মেয়ে।তাছাড়া আতিক বারন করার মত যথেষ্ট কারন খুঁজে পায়নি।
গত দুবছর আগেও আতিকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।আকদের ঠিক আগের দিন মেয়েটা অন্য কারো সাথে চলে যায়।সেদিন আতিক খুব লজ্জিত ও অপমাণিত বোধ করেছিল।এদিকে সে গায়ে হলুদ মেখে বসে আছে ওদিকে পাত্রী উধাও।আতিক নিজেও মনে মনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল।জীবনের প্রথম প্রেম আবার প্রথম ছ্যাঁকাও! কষ্টটা সাংঘাতিক ছিল।
এরপর থেকে আতিক কোন মেয়ের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনা।ওর মনটাও যেন মরে গেছে।কিন্তু ওর মা হাল ছাড়ার পাত্রী নন, তিনি আতিকের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন।আতিক মায়ের সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে চায়না।ওর যদি কোন দুর্বল দিক থেকে থাকে তো সেটা হলো ওর ‘মা’!

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনাড়ম্বরে ঘরোয়াভাবে তিথির সাথে আতিকের বিয়ে হয়ে গেলো।
আতিক বিয়ের দিন থেকেই তিথির সাথে তেমন কোন কথাই বলেনি।কেবল একবার ঘরে ঢোকার পর তিথি সালাম দিলে সে উত্তর দিয়েছে।অতিথিরা চলে যাবার পর তিথি মেকআপ মুছে অযু করে এশার নামাজ পড়লো।নামাজ শেষে চিন্তিত মুখে বসে রইলো।এবাড়ীর অনেক কিছুই অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর কাছে।শ্বাশুড়ী ছাড়া কেউই তার সাথে তেমন কথা বলছেনা।শ্বশুড় এককোণে পত্রিকা নতুবা বই নিয়ে পড়ে থাকে।একটা ননদ আছে সারাক্ষণ মোবাইল হাতে,না নামাজ না পর্দা।এ কোথায় এসে পড়লো তিথি! এমন ঘর তো সে চায়নি।স্বামী সাহেব কথা বলা তো দুর ভালো করে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখেনি।তিথির চোখ ভিজে উঠতে চায় বারে বারে।এই এক স্বভাব ওর কথার আগে চোখে পানি আসে।

রাতে আতিক কখন ফিরেছে তিথি জানেনা।সে সোফাতেই ঘুমিয়ে গেছিলো।অভ্যেসমতো ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙলে দেখলো আতিক বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সংকোচ হলেও অযু করে এসে আতিককে বার কয়েক ডাকলো-“এই যে,আপনি নামাজ পড়বেননা?’
আতিক সাড়া দিলোনা।তিথি নামাজ পড়ে দেখলো আকাশ এখনো পরিস্কার হয়নি।সে গ্লাস থেকে অল্প পানি নিয়ে আতিকের মুখে পানির হালকা ছিটা দিলো।আতিক ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে দেখে একটা হাসিমাখা মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।আতিক তাকাতেই সালাম দিলো।আতিক সালামের জবাব না দিয়ে উঠে বসল।গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল-“পানি মারলে কেন?আমার সাথে ফাজলামো করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?’
তিথি থতমত খেয়ে বলল-“ফাজলামী করিনি,স্বামীকে নামাজের জন্য জাগানোর এটাই হাদীসের নিয়ম তাই…..!
আতিক নিজেকে সামলে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল-“শোনো, আমার সাথে আলগা খাতিরের চেষ্টা করবেনা।তোমাকে বিয়ে করেছি কেবল মা’র কথা রাখতে।আমার ব্যপারে তোমাকে ভাবতে হবেনা! স্বামীই….হুঁহ! (ব্যঙ্গ করে তিথির কথার পুনরাবৃত্তি করল আতিক)!
তিথির মুখটা কালো হয়ে গেলো।আতিক ফের শুতে গিয়ে বলল-“আমার রাগ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারনা নেই।তুমি নতুন তাই আজ কিছু বললাম না।আর আমি চাইনা এসব কথা মা’র কানে যাক,বোঝা গেছে?নাউ গেট লষ্ট ফ্রম হিয়ার!’
বলে সে উল্টো দিকে ঘুরে শুলো।তিথি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

মিনিট কয়েক পরে হুঁশ ফিরলো ওর।চোখের কোণ মুছে সোফাতে ফিরে গেল তিথি।পুরো বিছানা জুড়ে আতিক যেভাবে শুয়ে আছে তাতে ওর শোবার কোন জায়গা নেই।তাছাড়া যার মনে তিথির জন্য ঠাঁই নেই তার বিছানা দখল করে লাভ কি!!
.
বেলা বাড়লে শ্বাশুড়ীর ঘরে গেল তিথি।শ্বশুড় সাহেব আন্তরিক ব্যবহার করলেন।শ্বাশুড়ী আতিকের কথা জানতে চাইলে তিথি স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল।এই দুজন মানুষকে এসব বলে ভারাক্রান্ত করে লাভ কি! অশান্তি বাড়বে বই কমবে না
পায়ে পায়ে আরিশার ঘরে এলো।আরিশা মোবাইলে কথা বলছে।তিথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসবে কিনা ভাবছে তখনি শুনতে পেলো আরিশার কথাগুলো!
‘ভাইয়ার বিয়ে হলো মাত্র দুদিন হলো,এখনি আম্মু’কে কি করে বলি বলোতো! তাছাড়া আমার পরীক্ষা না শেষ হওয়া পর্যস্ত আম্মু ভাইয়া কেউই বিয়েতে রাজী হবেনা।আরে তুমি বুঝতে চাচ্ছোনা কেন? না,না..আমি পারবোনা! তোমার দাদী অসুস্থ বুঝলাম তাই বলে….তিথির দিকে চোখ পড়াতে থেমে গেল আরিশা।গম্ভীর স্বরে “পরে কথা বলছি”বলে কেটে দিলো লাইনটা।
-“ভাবী, তুমি এখানে?কোনো সাড়া না দিয়ে লুকিয়ে কথা শোনা কিন্তু ব্যাড ম্যানার্স!
-“আ..আমি চলেই যাচ্ছিলাম !তোমাকে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।নাস্তা করবেনা?চলো একসাথে নাস্তা করি?
-“ওও,থ্যাংকস।আমি পরে করবো। তুমি করোগে!”

তিথির বিয়ে হয়েছে আজ সাতদিন।সাতদিনে সাতটা কথাও আতিক তিথির সাথে ঠিকঠাক মতো বলেনি।তিথি জানেনা তার দোষটা কি!তার শ্বাশুড়ীর সাথে ছোটখালার খুব বন্ধুত্ব আর মায়ের অবর্তমানে মামাখালারাই ওর সব।তারা নিশ্চয়ই জেনে বুঝে এটা করেননি।এটা ওর ভাগ্য।তাই সে এটাকে নিজের তাক্বদীর মনে করে মেনে নিয়েছে।প্রত্যেক ঈমানদারকে তার তাক্বদীরের ভালোমন্দে বিশ্বাস রাখতে হবে এটা জানে তিথি।তাই কষ্ট হলেও এটা তার মেনে নিতে দেরী হয়নি।তবে সে খুব দ্রুতই বাড়ীর কাজকর্ম নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছে।তার আন্তরিক আচরণে শ্বাশুড়ী তো মহাখুশী।কিছু মানুষ আছে যাদের মাঝে অল্প সময়েই সবাইকে আপন করে নিতে পারার মত দুর্লভ গুণ থাকে, তিথি তেমনি একজন।আত্মীয় প্রতিবেশী বাসায় এসে তিথিকে দেখে যায় আর তার কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফিরে যায়।যেন মনে হয় তিথি অনেক বছর ধরে এবাড়ীতে আছে।এমনকি আরিশার মতো দাম্ভিক মেয়ে পর্যন্ত তিথির প্রতি অনুরক্ত আর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।আর উঠবেই না বা কেন!তিথিই তো আরিশা আর তারিকের বিষয়টি মা বাবার কাছে উপস্থাপন করে তাদের মৌণ সম্মতি আদায় করে নিয়েছে।বাকী রইল আতিক।যদিও তিথি এখানে দুর্বল কারন আতিক ওকে পাত্তাই দেয়না সেখানে আরিশার কথা তুলবে কিভাবে তিথি ভেবে পায়না।তবু একরাতে ঘুমাতে যাবার প্রাক্কালে তিথি বিনয়ের সাথে আরিশার বয়স,বিয়ের উত্তম সময়,ভালো ছেলে সম্ভ্রান্ত পরিবার,আরিশার ভালোলাগা নিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুললো।অবশ্য সে প্রথমেই আতিকের অনুমতি চেয়ে নিয়েছে বলে আতিক একধমকে তাকে থামিয়ে দেয়নি।কেবল থমথমে মুখে বলল-“তোমাকে ওকালতি করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে?’
-“ওকালতি বলছেন কেন,আমি আরিশার বোনের মত,ওর ভাবী।ওর সমস্যাগুলোতো আমাদেরই সমাধান উচিত!আমি সব জেনেশুনেও যদি নির্লিপ্ত থাকি তাহলে ওর প্রতি অবিচার করা হবে!,ও আপনার ছোট বোন।খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে করিয়ে দিন।এভাবে ছেলেমেয়ের অবাধ বন্ধুত্ব শরীয়ত পরিপন্থী।আজ যদি ও কাঁচাবুদ্ধিতে বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় নিজে নিজে বিয়ে করে ফেলে তখনতো এ পরিবারেরই সম্মান নষ্ট হবে। জেনেশুনে তো আমরা তা হতে দিতে পারিনা।পরে আপনারাই আমাকে বলবেন,’তুমি সব জানতে আমাদের জানাওনি কেন…!
-“হয়েছে,বুঝেছি’বেশী শরীয়ত বোঝাতে এসোনা।’।ফিতা কাটার মতো একপোচে তিথির কথাটা মাঝপথে কেটে দিলো আতিক।সে কিছুটা চিন্তিত মনে হলো,আপনমনেই বলতে লাগলো-“ছেলে কেমন কি!খোঁজ খবর নিতে হবেনা? বললেই হয়ে গেলো নাকি?”
তিথি মৃদু হেসে বলল-“জ্বী,ঠিকই বলেছেন,একদম বড় ভাইয়ের মতই কথা বলেছেন!আমার যদি এমন বড়ভাই থাকত তাহলে খোঁজ না নিয়ে আমাকে আপনাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতোনা।আপনিও ভালো থাকতেন,আর আমিও……!” এতটুকু বলে তিথি দ্রুত সরে গেলো সেখান থেকে।তার চোখ ভিজে উঠেছে। সে দেখলোনা আতিক ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। সে দৃষ্টিতে রাগ না অনুকম্পা ঠিক বোঝা গেলোনা।

অবশেষে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই আরিশার বিয়ের দিন ঠিক হলো!কারন তারিকের দাদী অসুস্থ।তিনি নাত বৌ’র মুখ দেখতে চান।তাই তড়িঘড়ি করতে হলো!আরিশাকে নিয়ে তিথির শ্বাশুড়ী কেনাকাটা করতে লাগলেন।তিথি একাই দক্ষ হাতে পুরো সংসার সামলাতে লাগল,সাথে আতিকের উগ্র মেজাজও।শ্বশুড়কে নিয়ে সমস্যা হয়না তিথির,যত সমস্যা আতিককে নিয়ে।এইতো সেদিন তিথি আতিককে খাবারের সময় পানি দিতে একটু দেরী করেছে।সেকি বিকট ধমক।আতিকের আবার খাবারের শুরুতেই দুএক ঢোক পানি না খেলে হেঁচকিমত উঠে যায়।সে তিথিকে সরাসরি না ডেকে খালি কাঁচের গ্লাসটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো মেঝেতে।তিথি বাবার ফোন পেয়ে ঘরে বসে নিভৃতে কথা বলছিলো।গ্লাস ভাঙার শব্দে বাবাকে কোনরকম বিদায় বলে দৌড়ে এসে দেখে আতিক রেগে টমেটোর মত লাল।হেঁচকির তোড়ে তিথিকে ধমকে সুবিধে করতে পারছেনা আতিক।তবু তিথি দৌড়ে পানি এনে দিল।আড়ালে তার চোখ ভিজে উঠল।সে ভেবে পায়না একটা মানুষ কারনে অকারনে এত রাগ করে কিভাবে! মাথা নিচু করে ভাঙা কাঁচের টুকরাগুলো তুলতে লাগলো।

একদিন আরিশার শাড়ী কিনতে যাবার দিন মা একপ্রকার জোর করেই তিথিকে নিয়ে গেলেন।তিনি জানতেন তিথি বোরকা পড়ে তাই ওকে একটা নতুন বোরকা উপহার দিয়ে বললেন-“কাল এটা তোমার জন্য কিনেছি,আজ এটা পড়ে চলো আমাদের সাথে।”
অগত্যা তিথিকে যেতে হলো।কাঁচঘেরা দোকানে বসে শাড়ী পছন্দ করছিলো ওরা।তিথি চুপ করে একপাশে বসেছিমা মাঝেমধ্যে ওর সাথে টুকটাক পরামর্শ করছিলেন।এমন সময় আতিক ঢুকলো সেখানে।ওকে তিথির পাশে টুল দেয়া হলে ও সরে গিয়ে বসলো।পরে দেখলো মা আরিশা দুজনই ঐ বোরকাবৃতাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন আর সেও মাথা নাড়াচ্ছে তখন বুঝার বাকি থাকলোনা যে ওটা তিথি।আতিক হাসি চাপল ওর বেশভূষা দেখে।এ দেখি পুরাই হুজুর।পথ চলতে গিয়ে অজান্তেই দুবার তাকালো তিথির দিকে।ওকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।কেমন যেন সম্ভ্রান্ত গোছের।মা আরিশাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লেন,আতিক বিপদে পড়ে গেল,সর্বনাশ!এই হুজুরকে নিয়ে রিক্সায় উঠতে হবে!!
তিথি চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।আতিক ভেবেচিন্তে একটা সিএনজি দাঁড় করালো।কর্কশ সুরে তিথিকে উঠতে বলল।সারাটা পথে তিথি কোনো কথা বললোনা।আতিক মনে মনে ভাবল-“ভারী দেমাক হয়েছে দেখছি’!
গ্লাস ভাঙ্গার পর থেকে তিথি ওর সাথে একটু দুরত্ব বজায় রেখেই চলছে।তবে আতিকের প্রতিটা প্রয়োজনের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি তার।ব্যপারটা কিছুটা হলেও আতিককে প্রভাবিত করে।নাহ্,সব মেয়ে বোধহয় একরকম না!তবু তিথিকে দেখলেই বিথীর কথা মনে পড়ে।বিথী আতিকের জীবনের দূর্ঘটনার নাম।হায় কপাল! নামেও দেখি মিল।
.
আজ আরিশার বিয়ে।বাড়ীঘর লোকে গমগম করছে।বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হলো।আতিক নিজেও বেশ ব্যস্ত তবু ওর চোখজোড়া তিথিকে খুঁজল।ব্যপারকি,এ গেল কোথায়?কোথাও বোরকা পড়ে বসে নেই তো!এরিমধ্যে আরিশার বিদায়ের সময় হয়ে এলো।অনেকেই মা কে বলল,আপনাদের বৌমাকে দেখছিনা।মা বলল-“আপা ও ভেতরে,ও তো সবার সামনে আসেনা,পর্দা করেতো!
-‘মাশাআল্লাহ,যাই ভেতরে গিয়েই দেখা করে আসি’!
আতিক মুখ ফসকে বলে ফেলল-“চলুন,আমি যাচ্ছি’!
মহিলা হাসিমুখে আতিককে বললেন-“কপাল ধুয়ে এমন বউ পেয়েছো বাবা! যেমন রূপ তেমন গুন’!
ভেতর ঘরে ঢুকতে গেলে আতিক বাধধার মুখে পড়লো-“এখানে ছেলেদের ঢোকা নিষেধ।সব মহিলারা ভেতরে!’
আতিক কিছুটা দমে গেল-“ও,আচ্ছা আন্টি আপনি যান।’
আন্টি ভেতরে ঢুকে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন।আতিকের বিরক্ত লাগছে।তিথিকে একঝলক দেখতে এতো হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে কেন? কি কৌশলে ওকে দেখা যায় ভাবতে লাগল।হঠাৎ কি মনে করে দরজা নক করল,এক কিশোরী উঁকি দিলে বলল-“ভেতরে বলো আতিক ভাই পাঞ্জাবী বদলাবে,তিথি ভাবিকে গিয়ে বলো”!
-‘আচ্ছা’ বলে ধুম করে গেট আটকে দিল মেয়েটি।
আতিক নিজের ঘরে ঢুকে অনর্থক আলমারী হাতড়াতে লাগল।আশ্চর্য তো,বুক এরকম ধুকপুক করছে কেন? তিথি কি নতুন কেউ?ধ্যুত শালা।অজান্তেই খিস্তি বেরিয়ে এলো।ঠিক তখনি দ্রুতপায়ে এক মহিলা ঘরে ঢুকল।সবুজের উপর নীল কারুকাজ করা কা্ঞ্জিভরম শাড়ী পড়া আধাহাত ঘোমটা দেয়া মেয়েটি ঘরে ঢুকেই দরজা চাপিয়ে দিল।’ঊফ্’ বলে ঘোমটাটা ফেলে দিলে তার চোখ ঝলসানো অবয়ব আতিকের সামনে আত্মপ্রকাশ করল যেন।সে মৃদু কন্ঠে ‘স্যরি’ বলে আলমারী খুলে বলল-“আর বলবেননা,বাড়ী ভর্তি এত মানুষ হাঁটাচলা করা দায়।আচ্ছা,কোন পাঞ্জাবীটা দেবো বলুন,তো!’
আতিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে আর ভাবছে,এটা কি তিথি!ও এত সুন্দর কবে হলো! চোখে যে কাজলটা দিয়েছে তার কোনো তুলনা হয়না! চেহারাটা আরো বাঙময় হয়ে উঠেছে।নিরব দৃষ্টিতে ওর গোটা অবয়ব জরিপ করতে থাকল।খোঁপাটা তো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তিথি আতিককে নিরব দেখে ভাবল রেগে আছে নাকি!ফিসফিসিয়ে বলল-“ব্যস্ততার কারনে আপনার দিকে লক্ষ্য করতে পারিনি,প্লিজ ধমকাবেননা।বাইরে সবাই শুনে ফেলবে।’
আতিক মনে মনে মর্মাহত হলো,মুখে বলল-‘বোতামটা ছেঁড়া।’
তিথি আঁতকে উঠল-“হায় আল্লাহ! বোতাম কিভাবে ছিঁড়লো”!
এটা পাল্টে অন্যটা পড়ুন।আমি সেলাই করে রাখবো!”
আতিক মেজাজী ভঙ্গিতে বলল-“পাল্টাবো না,এটাতেই সেলাই করে দাও!’
কাঁপা হাতে সুঁই সুতা চালালো তিথি।ওর এক নিঃশ্বাস ব্যবধানে থেকে আতিক বলল-‘খোঁচা লাগলে কিন্তু খবর আছে’!
♥♥♥
লেখাঃমোর্শেদা হাবিব।
(চলবে…)
.
#তিথিঃ
২য় পর্বঃ
‌মো‌র্শেদা হা‌বিব
♥♥♥♥
তিথি চটপটে হাতে বোতাম লাগানোর কাজ শেষ করল।এর মধ্যেই ডাক পড়লো আতিকের! সে ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে বলল,-“থ্যাংকস’!
তিথি মৃদু শব্দে বলল-“যাজাকাল্লাহ’!
আতিক চলে যাবার পর পর রবের দরবারে দু’আ করলো তিথি তার স্বামীকে এমনি করে তার অনুরক্ত করে দেবার জন্য।এটা তার প্রতিদিনের দু’আ।যার ফলশ্রুতিতে আতিককে আজ ওর সাথে সহজভাবে কথা বলতে দেখেছে।রবের শোকর আদায় করল ‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল’ বলে!
.
আরিশা চলে যাবার পর থেকে বাড়ীটা খালি খালি মনে হতে লাগল তিথির।আতিক সারাদিন ব্যবসার কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকে।তিথি ওর খাবার নিয়ে রাত বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বসে থাকে,ও ফিরলে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে। তিথি অদুরেই বসে বই বা ম্যগাজিন পড়ে।মাঝে মধ্যে প্রয়োজনীয় কথা থাকলে অল্প কথায় সারে।আতিক কখনো ফিরতে দেরী করলেও তিথি না খেয়ে খাবার নিয়ে বসে থাকে।সারাদিনের কাজের পরে ওর দুচোখ ভেঙে ঘুম আসতে চায়।তবু তিথি আতিকের সামনে নিজের ক্লান্তি প্রকাশ করেনা।বরং আতিক ফেরার আগে শাড়ীজামা বদলে হাতমুখ ধুয়ে হালকা সাজ গোছ করে ওর অপেক্ষায় বসে থাকে।এগুলো হাদীসেরই নির্দেশ।যে স্ত্রীর দিকে তাকালে স্বামীর মন খুশি হয়ে যায় সে স্ত্রী সম্পর্কে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।বেল বাজলে সে নিজে দৌড়ে যায়,হাসিমুখে সালাম দেয়।আতিক যদিও নিজের মত করে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তিথির দিকে তেমন মনোযোগ তার নেই তবু তিথি ক্লান্তিহীন ভাবে স্বামীর মন পাবার চেষ্টায় রত থাকে।আর দু’আ তো আছেই।
একদিন আতিক খেতে বসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে-‘সবার খাওয়া হয়েছে?’সে সাধারনত তেমন কোন কথা বলেনা।তাই তিথি কিছুটা অবাক হয় মনে মনে! বলে-“জ্বী,! আব্বা আম্মা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
-(কিছুক্ষণ পর বলে)তুমি খেয়েছ?
তিথি সামান্য হেসে বলে-“আপনার হোক, একটু পরে খাবো’!
আতিক চুপ মেরে গেল প্রথমে।পরে বলল-‘পরে খাবে কেন?যাও প্লেট নিয়ে আসো’!
তিথি কোনো দ্বিরুক্তি না করে একটা প্লেট তুলে নিয়ে তাতে অল্প খাবার নেয়।দুরে সরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আতিক ওর ওড়নার প্রান্ত ধরে টেনে বলে-‘এখানে বসলে কি সমস্যা?’
-‘না,সমস্যা কি!আপনার সমস্যা না হলে আমার কি সমস্যা?’
-‘হুজুররা দেখি কথা ভালই জানে’!
তিথি চুপ করে থাকল।আতিক ফের বলল-‘হুজুররা যে এত সাজগোছ জানে এটাও তো জানতাম না ‘!
-“হুজুরদের সম্পর্কে আর কি কি জানেন’! তিথির মজা লাগছে শুনতে তবু মুখ নামিয়েই আস্তে করে বলল কথাটা।
-‘জানিনা….,তবে জানতে চাই!’ ভারী স্বরে বলল আতিক।তিথি লজ্জা পেয়ে চুপ মেরে গেল।আর কিছু না বলে নিরবে খেয়ে চলল।আতিক খাওয়া ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।তিথিরর নার্ভাস লাগছে আতিকের চাহনী দেখে।হঠাৎ বিষম খেলো।কাশতে কাশতে নাকমুখ লাল হয়ে গেল তিথির।ওর অবস্থা দেখে আতিক দ্রুত পানি এগিয়ে দিলো, ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো! তিথির দুচোখে এবার বন্যা নামল।
আতিক বলল-‘ও কি,কাঁদছো নাকি?’
-‘না না,খাবার আটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল!এজন্যই চোখে পানি এসে গেছে! ‘দ্রুত ওড়না দিয়ে চোখ মুছে ফেলল।
আতিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল যেন কিছু বলতে চাচ্ছে!
তিথি এবার না পেরে বলে উঠল-‘এভাবে তাকিয়ে থেকেন না তো,দোষ হলে বলেন,মা্ফ চাই!এমন করলে খাবো কি করে?’
আতিক এবার হেসে ফেলল! তিথি মুগ্ধ হয়ে ভাবল-‘এ হাসতেও জানে?’
-‘ভাত খাবার পরে এককাপ চা খাওয়াতে পারবে?’
-‘জ্বী,পারবো।কিন্তু চা খেলে না আপনার ঘুম নষ্ট হয়?আজ খাবেন?’
-‘হমম,কাল তো শুক্রবার।সকালে কাজের চাপ নেই।তাই রাত জাগলেও সমস্যা নেই!’
তিথি আর প্রশ্ন করার সাহস পেলোনা।
-“ওও..’!তিথি আর কিছু না বলে প্লেট গোছাতে লাগল।আতিক ঘরে চলে গেল!কিছুক্ষণ পর তিথি চা নিয়ে ঢুকে দেখল আতিক ঘরটাকে রজনীগন্ধা দিয়ে একরকম সাজিয়েই ফেলেছে।দুটো ফুলদানীতে ফুলগুলো রেখে তাতে পানি ঢেলে দিচ্ছে।ঘরে মৃদু সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
তিথির পা দুটো জমে গেল।কোনোরকমে বলল-‘এই যে,আপনার চা!’
আতিক এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে চা টা নিল।তিথি ধীর পায়ে সোফায় গিয়ে বসল!আতিক ওর পাশে গিয়ে বসল।তিথি কি বলবে ভেবে পেলনা।অস্বস্তি কাটাতে হাত বাড়ালো-‘দিন,কাপটা রেখে আসি।’
-‘কোথাও যেতে হবেনা, চুপ করে বসো!”
-‘আমি জানি তুমি আমাকে ভয় পাও কারন আমার রাগটা অনেক বেশী।আসলে আমি তোমাকে আর দশটা মেয়ের মতই ভেবেছিলাম।আরিশাকেও দেখেছি,রাগ জেদ অলসতায় ভরা একটা মেয়ে।যখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখনকার সহপাঠীদেরও দেখেছি,তাদের মধ্যে মেয়েলি ব্যাপারটা কম পুরুষালি ব্যপারটা বেশী।তারপরেও জীবনের একটা পর্যায়ে এসে একটা মেয়েকে মনে মনে জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলাম।কিন্তু……!!
তিথি বাধা দিল-“থাক,বাদ দিন ওসব কথা”!
আতিক মৃদুস্বরে বলল-‘একটা কথা রাখবে?’
-‘জ্বী,বলুন’!
-‘সেদিন যে শাড়ীটা পরেছিলে! সেটা কষ্ট করে একবার পড়বে?”
তিথি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আতিক হাসল-‘”কি হলো! অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলে নাকি?আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি?’
-‘ন্ না,তা না! ‘
-‘আতিক ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল-‘আমি খুব স্যরি,তোমাকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনি।জীবনে প্রেম কি তা বোঝার আগেই প্রত্যাখ্যানের তীব্র আঘাতে জর্জরিত হয়ে গোটা দুনিয়াকে বিষ নজরে দেখতে শুরু করেছিলাম।তারপর তোমাকে দেখলাম।তুমি অদ্ভুত একটা মেয়ে!আমার প্রতি তোমার নিরেট দায়িত্ববোধ,আমাকে প্রতি মুহূর্তে সন্তষ্ট করতে চাওয়া, আমার ভালোলাগা মন্দলাগা গুলোকে এত গুরুত্ব দিয়ে তুমি আমাকে ভীষণভাবে দুর্বল করে ফেলেছো।এখন মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলবেনা আমার।
তিথি কি বলবে ভেবে পেলোনা।ওর দুআ যে এত রঙীন হয়ে বাস্স্তবায়ন হবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি কেবল ভেবেছে আতিক একদিন সহজ হবে।কিন্তু এ যে দেখি গলে মোম!
তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ এক ঝটকায় আতিক ওকে কোলে তুলে নিল।তিথি কোনরকমে উচ্চারন করল-“আরে পড়ে যাবো তো!”
-“পড়ে যেতে দিলে তো!”
–‘আচ্ছা,নামান,’শা..শাড়ীটা পড়ে আসি!”
-‘আরে ধুর! লাগবেনা!’
..♥…
দ্রুত হাতে রুটি সেঁকে প্লেটে সার্ভ করছে তিথি।আতিক খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছে।তিথি চা দিলে আনমনে খেতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলল।’আহ্’বলে চিৎকার করে উঠলে তিথি দৌড়ে এলো।-‘ইস্,একটু ধীরে খাবেননা!’
-‘আরে শেভ করতে হবে, দেরী হয়ে যাবেনা!’
-‘কিসের শেভ!আপনাকে দাঁড়িতেই চমৎকার দেখায়।।শেভ করেননা প্লিজ!’
-‘আমাকে হুজুর বানানোর মতলব, না?’
-‘হুজুর না হলে হুজুরনীর সাথে একদম মানাবে না যে!’
-‘এদিকে আসো’!গম্ভীর স্বরে বলল আতিক।
-‘আমার কাজ আছে!’ বলে তিথি হেসে এড়িয়ে যেতে চাইল।
-‘স্বামীর আদেশ অমান্য করছো কিন্তু! ‘
তিথি কিছু বলার আগেই সশব্দে কলিংবেল বেজে উঠল।তিথি ভেতরে সরে গেল,আতিক দরজা খুলল।আরিশা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল,হাতের ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে মারল।ওর চোখগুলো লাল আর ভেজা।আতিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।তিথি ছুটে এল।মাও শব্দ শুনে বেরিয়ে আসল।মা এসে ওর কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন-‘কি হয়েছে রে মা ?এই সাতসকালে এভাবে…?’
আরিশা কাঁদতে কাঁদতে উত্তেজিত সুরে বলল-‘আমি আর যাবোনা,একদম যাবোনা।আমাকে তোমরা যেতে বলবেনা! বলে দিলাম!’
-‘যাবিনা মানে? নিজে পছন্দ করেইতো বিয়ে করেছিস!এখনি এসব কথা কেন?’আতিক রেগে গেল!
তিথি ওর কাঁধে হাত দিয়ে থামতে বলল।
শ্বাশুড়ীমা কে বলল-‘আম্মা,আরিশা এইমাত্র এলো,ও আগে শান্ত হোক,এখন কিছু জিজ্ঞেস না করে ওকে আগে একটু স্থির হতে দিন”!
আতিকের দিকে তাকিয়ে বলল-‘আপনি কাজে যান,প্রয়োজনে আপনাকে ফোন দেবো!ওকে একটু সময় দিন।ফোন দিলে একটু সময় করে পারলে এসেন’!
আতিক কিছু না বলে চলে গেল।
তিথি এসে আরিশার হাত ধরল-‘সব শুনবো, আগে তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও,আমিও নাস্তা খাইনি,দুজনে একসাথে খাবো চলো!”
-‘না,আমি খাবোনা,তোমরা খাও”!
-“ছি,আপু,মাথা গরম করোনা তো'(আরিশাকে একহাতে জড়িয়ে ধরল তিথি)।”আমার মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে!এভাবে মাথা গরম করাটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ না”!
-“যে আমাকে মূল্যায়ন করতে জানেনা তার ঘরে আমি থাকবো কেন?'(আরিশা অভিমানাহত স্বরে বলল)!
-‘আচ্ছা,তুমি এসো তো প্লিজ!আগে ফ্রেশ হও সব শুনবো,ঐ দেখো মা কাঁদতে শুরু করেছে’!
অগত্যা আরিশাকে উঠতে হলো!
.
বাবা মা’র ঘরে খাটের উপর বসে আছে আরিশা।বাবা বোকার মত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।হয়ত কথা খুঁজে পাচ্ছেননা।কি বলবেন!মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন-“তুই কি কোথাও একটু মানিয়ে নিতে পারবিনা?এত অল্পে জেদ করলে কি চলবে? সংসার এখনো ভালোমত শুরু করলিনা এখনি এসব বলছিস?বাকী দিন কি করবি?”
মা তিথির দিকে তাকালেন-“তিথি,ওরে একটু বুঝা মা।’
-“আমি বাচ্চা মেয়ে না মা,লেখাপড়া শিখেছি মূর্খ না।আমাকে বোঝানোর কি আছে,আমি কি বুঝিনা? ওখানে আমাকে সবসময় ডমিনেট করা হবে,আমার চাওয়াপাওয়া গুলোকে পায়ের নিচে পিষে ফেলবে আর আমি মুখ বুজে তা সহ্য করবো?”
তিথি চুপ করে আছে।উঠে এসে আরিশার হাত ধরে বলল-“আরি,চলো আমার ঘরে চলো।আব্বা আপনি বিশ্রাম নিন।চিন্তা কোরেন না,সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!”
.
আরিশা আগের তুলনায় কিছুটা শান্ত।সুবোধ বালিকার মত তিথির সাথে আতিকের রুমে এলো!
তিথি ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল-“আরাম করে বসো,আচ্ছা,তুমি যে হঠাৎ চলে এলে তারিক ভাই জানে?”
আরিশা চোখ মুছে বলল-“জানবেনা কেন!ওই তো বলল,”দরোজা খোলা আছে,যেতে পারো”!(বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল)!ও আমাকে মোটেও ভালোবাসেনা,আমারই ভুল ছিল,ওকে বিশ্বাস করেছি”!
তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“বিশ্বাস নষ্ট করার মত কি করেছে সে?”
-“ওর কাছে ওর ফ্যামিলি বড়! ওর দাদী বড়। আমি কে? আমি কেউ না।আমার জীবনের সুন্দর সময়গুলো ও অবহেলায় নষ্ট করেছে।বিয়ের আগে ও আমার জন্য পাগল ছিল,আর এই দুমাসের মধ্যেই ওর আমার প্রতি অবহেলা আমাকে শেষ করে দিয়েছে ভাবীইই…..বলে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল আরিশা।
এসময় ফোন বাজল।তিথি ধরল-“আসসালামুআলাইকুম”!
ওপাশ থেকে আতিক সালামের উত্তর দিয়ে বলল-“আরিশা কি বলে? কি করছে ও?”
-“এই তো ও এখানেই আছে।আমরা কথা বলছি।আপনি কাজ সেরেই আসুন।আমাদের আরিশা বুদ্ধিমতী মেয়ে ওকে নিয়ে ভাববেন না”!
-“তুমি একটু বোঝাও তো ওকে”!
-‘জ্বী”!
ফোন রেখে তিথি আরিশার সামনে বসে ধীরে ধীরে বলল-“শোনো আরিশা,তারিক ভাইকে বিয়ের আগে শুধু তোমার ঘনিষ্ট একজন বন্ধু হিসেবে পেয়েছো।কিন্তু এখন উনি তোমার বন্ধুর পাশাপাশি তোমার স্বামী তোমার অভিভাবকও।সে যেমন তোমার স্বামী তেমনি অন্য কারো ছেলে,কারো ভাই,কারো নাতি,কারো ভাতিজা ভাগিনা।একইভাবে তুমি এতদিন শুধুই কারো কন্যা ও বোন ছিলে,বিয়ের পর থেকেই তুমি হয়ে গেছো কারো বউমা,কারো চাচী -মামী,এমনকি দাদী নানীও।সম্পর্কের দাবী অনেক বড় আপু।এটাকে অগ্রাহ্য করা যায়না করা উচিতও না।তারিক ভাইকে তার সম্পর্কের দাবী মেটাতে তুমিইতো সাহায্য করবে।তোমার সাথথে তারিক ভাইয়ের সম্পর্কটাই এমন।তুমি তার অর্ধাঙ্গিনী মানে তুমি তার হাতপা চোখ কান।কখনো সম্পর্কের প্রয়োজনে তোমাকে নিজের কিছু স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে সেটাও নিজ স্বার্থেই কারন তাতে তোমার প্রতি তারিক ভাইয়ের আস্থা আরো বাড়বে।
-“সব বুঝলাম তাই বলে ও আমাদের হানিমুন ট্রিপ বাতিল করে দিবে? আমার সাথে কোনোরকম পরামর্শ না করেই??আমার কতদিনের শখ ছিলো গ্রান্ড সুলতানে…..(কান্নার দমকে আরিশার কথা আটকে গেল)এই সময়টা কি আর ফিরে পাবো?”
-“বোকা মেয়ে,দুজনের মাঝে ভাব থাকলে সবগুলো সময়ই রঙীন হয়ে ধরা দেয়,ভাব না থাকলে সারাজীবন একসাথে এক ঘরেও অশান্তির আগুন জ্বলে! শোনো,স্বামীকে যদি একেবারে নিজের করে পেতে চাও তাহলে তার সবকিছুকে আপন করে নাও।সে এমনিতেই ধরা দেবে।মাথা ঠান্ডা করে ভাবো,নিজের পায়ে কুড়াল মেরো না আরিশা।গ্র্যান্ড সুলতান তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা।পরে গেলে সমস্যা কি!বরং এখন ধরো ওনাকে চাপ দিয়ে নিয়ে গেলে কিন্তু ওনার মনের ভেতর ওনার দাদী বসে থাকবে !তোমাদের দুজনের মাঝখানে দাদী থাকলে কি সময়টা সুন্দর কাটবে যেমনটা তুমি আশা করো?? ”
বেল বাজার শব্দে দুজনেই সচকিত হলো।তিথি বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে আরিশার নাকটা তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে চেপে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলল-“আরে শোনো,কাউকে গোলাম বানাতে হলে আগে তার বাঁদী হওয়া লাগে”!
অমনি আতিক ঘরে ঢুকল।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here