‘তুই’ #তৃধা_মোহিনী |পর্ব এক|

0
25

–‘দাদু প্লিজ দাদু।আমি এই বিয়ে করবোনা।কিছুতেই না। প্লিজ দাদু। প্রত্যয় আসবে দাদু। তুমি একটু অপেক্ষা করো প্লিজ দাদু। আমি প্রত্যয় কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। প্লিজ এমন করোনা।আমি মরে যাবো!’

এই টুকু বলেই মীরা কান্নায় ভেঙে পরে। কিন্তু মীরার দাদু এখনো সোফায় মাথা নিচু করে পাথরের মতো বসে আছে। মীরার কথায় উনার কোনো হেলদোল হলোনা।ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত। মীরার মা, বাবা, ছোট ভাই, মীরার দাদা,দিদুন, জেঠু, জেঠি এবং তার ছেলে আশরিক আলফাজ ধ্রুভ।

আজ মীরার বিয়ে ছিলো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে। কিন্তু বরযাত্রী আর আসেনি। কেনো তা সবারই জানা কিন্তু কেউ বলতে পারছেনা মীরা কষ্ট পাবে বলে। পুরো খান বাড়ী থমথমে কারণ,খান বাড়ীর একমাত্র মেয়ে মীরার বিয়ের দিন আজ। ৮ টা বাজতে চললো,কিন্তু বরযাত্রী এখনো আসেনি। আশেপাশে কানাঘুষা সেই কখন থেকে শুরু।সবাই এই সেই কথা বলছে।
.
আর মীরা নববধূ বেশে সেই দুপুরবেলা থেকে অপেক্ষা করছে তার ভালোবাসার মানুষটির কখন প্রত্যয় আসবে আর তার করে নিয়ে যাবে।
.
কিন্তু না আসেনি প্রত্যয়। না এসেছে কোনো বার্তা তার জন্য। যদিও এসেছে ঠিকি কিন্তু সেটা মীরা জানে না।
.
সত্যি না জানিয়েই তাকে কিছুক্ষণ আগে বলা হয়েছে প্রত্যয় নয় বরং ধ্রুভকে তার বিয়ে করতে হবে।প্রত্যয় বরযাত্রী নিয়ে আর আসবেনা। এই কথা শুনেই মীরা তার দাদুর পা জড়িয়ে কাদঁছে আর উপরের কথা গুলো বলছিলো।মীরা বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে।

মীরা আবারো বললো,

–‘দাদু, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না দাদু। আর একটু অপেক্ষা করো প্রত্যয় ঠিক আসবে আমায় নিতে প্লিজ দাদু।’
.
এসব বলে গুমরে কাঁদছে মীরা। মীরার দাদু এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার মীরার গালে সজোরে একচড় বসিয়ে দেয়।

মীরা চুপ হয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।তার দাদু তাকে মেরেছে তা বিশ্বাস হচ্ছেনা মীরার। সাথে সাথেই দাদুর পা ছেড়ে দেয় মীরা।মীরা বুঝে যায় ধ্রুভ কেই বিয়ে করতে হবে তার। ধ্রুভ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে ফ্লোরে।
.
মীরার দাদু চড় দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে থাকে। তিনি যে নিজের কলিজাতেই হাত উঠিয়েছেন আজ। এই সব দেখে জেঠু কেঁদে উঠে।

মীরার বাবা চুপ করে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। মীরার মা সে কখন থেকেই অজ্ঞান। মীরার জেঠি মীরার মার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।

মীরার দিদুন চোখ মুছছে বারবার নিঃশব্দে। আর ধ্রুভ একনজর এ মীরার দিকে তীক্ষ্ণ ও অগ্নিময় চোখে তাকিয়ে আছে।চোখ দিয়েই মীরা কে ঝালা ফালা করে দিচ্ছে ধ্রুভ। কিন্তু মুখ চোখ তার নরমাল কিন্তু চোয়াল শক্ত করে রেখেছে সে।
.
এক্টু পড় নিজেকে শক্ত করে মীরার দাদু ইব্রাহিম খান। তারপর চেঁচিয়ে উঠে,

–‘ এভাবে মরা কান্না না করে যা ভেতরে কাজী ডাক এখুনি বিয়ে হবে।মীরার সাথে ধ্রুভের।’
.
ব্যস আর কারো কথায় পাত্তা নেই। উনার দুই ছেলে চট জলদি উঠে দাঁড়ায়। মানে মীরার জেঠু আর বাবা।

উনারা কাজী ডেকে ভেতরে আনেন। যিনি প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে বিয়ে পড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। আর কাজীকে ভেতরে আসতে দেখে মীরা। তার দামী ও ভারী লেহেঙ্গা টা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে।কিন্তু আর কিছুই বলতে পারেনা মীরা। না কান্না করে সে কেনো করবে প্রত্যয় নিজেই তো আসেনি তাকে নিতে।তাহলে আর কেনো কান্না করবে আয়াত?অভিমানে মীরা গুম মেরে গেলেও মন মানছেনা কিছুই।
.
আর কোনো কথা হয়না ড্রইং রুমে। শুধু বিয়ে পড়ানো হয়। মীরা আর ঝামেলা করেনা কবুল বলে দেয়। কিছুই করার নেই যেখানে সেখানে কি ঝামেলা করবে সে?
.
বিয়ে পড়ানো শেষ হলে কাজী চলে যায়। আর মীরার দাদু ইব্রাহিম খান ধ্রুভ কে নিজের কাছে বসিয়ে বলে উঠে,

— ‘মীরা খান বাড়ীর সবার কলিজা।তুমি তা জানো,কিন্তু তুমি ওকে কতোটুকু ভালোবাসো জানিনা। কিন্তু আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব তোমার। আশা করি তুমি সব ভুলিয়ে দেবে তাকে। নতুন করে গড়বে সব!’
.
ধ্রুভ মন দিয়ে দাদুর কথা গুলো শুনে তারপর বলে উঠে,

–‘জ্বী দাদু আমি চেষ্টা করবো।’
.
ইব্রাহিম খান নাতির কাধে হাত রেখে বলে উঠে,

–‘ চেষ্টা না আমি জানি তুমি পারবে।এখন যাও তাহলে তুমি তোমার বৌ নিয়ে যাও ভেতরে। সামলাও ওকে। সবার অবস্থা বুঝতেই পারছো?’
.
ধ্রুভ মাথা দুলিয়ে বলে উঠে,

–‘দাদু তুমি বললে আমি ওকে আমাদের বাগান বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাই। দু একদিন এখানে না থাকাই ভালো ও স্পেস পাবে। তুমি বললে নিয়ে যাবো।’
.
ইব্রাহিম খান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

–‘ তুমি একদম ঠিক বলেছো। যাও ড্রাইভার পৌঁছে দিবে তোমাদের। সাবধানে থেকো।’
.
ধ্রুভ আস্তে করে বললো,

–‘ জ্বী দাদু!’
.
বলেই ধ্রুভ উঠে মীরার কাছে যায়। মীরাএখনো ফ্লোরেই বসে। ইভেন এই ফ্লোরে বসেই মীরা কবুল বলেছে। নিজেকে ধ্রুভের সম্পত্তি বানিয়ে দিয়েছে। ধ্রুভ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে তারপর হাত ধরতে গেলে,মীরা উঠে দৌড়ে চলে যেতে নেয় কিন্তু ধ্রুভ মীরার হাতের কব্জি টেনে ধরে ফেলে। মীরা এবার চুপ থাকতে পারেনা। এতোক্ষণ সবই শুনেছে মীরা কিন্তু সে যেতে চায় না কোথাও তাই কাঁদতে কাঁদতে বলে,

–‘প্লিজ দাদু, আমি যাবো না। আমার প্রত্যয় কে খুঁজতে হবে। প্লিজ আমি কোথাও যাবো না দাদু। আমায় পাঠিয়ো না।কেনো এসব করছো আমার সাথে তোমরা।’
.
মীরা এসব বিলাপ বকছে। ধ্রুভ তার চোয়াল আরো শক্ত করে। রাগে গাঁ ফেটে যাচ্ছে তার কিন্তু কিছু বলে না। সে অপেক্ষা করছে অন্য কিছুর। মীরা নিজের হাত ধ্রুভের থেকে ছাড়াতে ছোটাছুটি করছে।কিন্তু ধ্রুভ হাত না ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
.
কিন্তু এসব দেখে ইব্রাহিম চৌধুরী প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,

–‘ধ্রুভ নিয়ে যাও ওকে।ভালোভাবে না গেলে অন্য ভাবে নিয়ে যাও।’
.
মীরা আবারো দাদুর চিৎকার এ আঁৎকে উঠে আর ভয়ে মীরার হাত গিয়ে চেপে ধরে। আর ধ্রুভ বাঁকা হাসে। সে তো এই চিৎকার টা শুনার অপেক্ষা করছিলো। এই চিৎকার কানে যাওয়ার ১০ সেকেন্ড পরই মীরাকে কে পাজা কোলে তুলে নিয়ে হাটা দেয় ধ্রুভ। আর মীরার কিছু করার নেই তাই ধ্রুভের বুকে পরেই কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে। মীরার বিদায় এভাবেই হয়ে যায়। তার বাবার বাড়ী থেকে।
.
আর ধ্রুভ হাটছে আর মনে মনে বলছে

–‘ তুমি ভাবতেও পারবেনা দাদু আজ আমি তোমার কলিজার টুকরার সাথে ঠিক কি কি করবো। গেট রেডী মীরা বেবি।তোকে আজকে আমাদের বিয়ের দিনে তোর লাইফের সব চেয়ে বড় গুড নিউজ টা দেবো’

বলেই বাঁকা হেসে মীরার দিকে তাকায় ধ্রুভ।
.
ওরা খান বাড়ীটা থেকে বেরিয়ে যেতে। ইব্রাহিম খান কেঁদে দেয়। আজ ফুলের মতো বাচ্চাটার গায়ে তুলেছেন তিনি। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে তার। অধিক রাগের অধিকার ইব্রাহিম খানকে পুরো শহর এখনো ভয় পায়। সাথে তার পুরো পরিবার। তিনি যেমন রাগি তেমনি বদমেজাজি তেমন নরম মনের। উনার এক কথায় শেষ কথা। উনার উপর কেউ কথা বলেনা। বয়স বাড়লেও এখনো ফিট তিনি। ছেলেরা বড় হয়েছে বাবা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো বাবার কথাই উঠতে বসতে হয় তাদের। আর উনি নিজের কলিজা ভাবে মীরাকে। আর আজ মীরার উপর হাত উঠিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মীরারা বেরিয়ে গেলেই, তিনি কেঁদে সোফায় শুয়ে পড়ে। উপস্থিত সবাই এসে উনাকে ধরে। আর ডক্টর ডাকে কারণ অবস্থা খারাপ উনার।
.
.
এদিকে ধ্রুভকে ড্রাইভার পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও,ধ্রুভ নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশেই মীরা এখনো কাঁদছে। কিন্তু তাতে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ দেখাচ্ছেনা ধ্রুভ। সে সিগারেট খাচ্ছে আর আপন মনে।আর ড্রাইভ করছে।আর বারবার মীরাকে তাচ্ছল্য ভাবে দেখছে। যেমন মীরার কান্নায় ধ্রুভের মনে পৈশাচীক আনন্দ পাচ্ছে। ধ্রুভ মনে মনে আবারো বলে,

–‘আজ সারারাত তোর এভাবেই কাঁদতে হবে মীরা। আজকের রাত যে তুই ভুলতে পারবিনা কোনো দিন। আমি ভুলতে দেবোনা কিছুতেই না।’
.
.
ঘণ্টা খানেক বাদে ধ্রুভদের দামী কার টা তাদের নিজস্ব বাগান বাড়ীতে থামে। মীরা কেদেই যাচ্ছে।এখনো থামেনি।

ধ্রুভ বিরক্তিকর স্বরে বলল,

–‘ প্লিজ এই ড্রামা স্টপ কর!আর নাম এসে পরেছি।’
.
মীরা ভাবছে কার সাথে বিয়ে হলো তার? যে কিনা টানা ৫ বছর পড় লন্ডন থেকে এসেও মীরার সাথে একবারো কথা বলেনি।

মীরা বুঝতে পারে ধ্রুভ তাকে সহ্য করতে পারেনা, কিছুতেই না। তাই তো দূরে দূরে থাকে দেশে আসার পর থেকে।আর তার সাথেই দাদু তার বিয়ে দিয়ে দিলো। ভেবেই মীরা আরো কান্না বাড়িয়ে দেয়।
.
ধ্রুভ রেগে কার থেকে নেমে। মীরাকে এক প্রকার টেনে কার থেকে নামায়। তারপর টেনে হিঁচড়ে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যায়।
.
মীরার অবস্থা খারাপ। লেহেঙ্গা এতো ভারী যে তার হাটতেও কষ্ট হচ্ছে, তার উপর ধ্রুভ তাকে টেনে হিঁচড়ে এক প্রকার দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মীরা বারবার লেহেঙ্গায় পা বেধে পড়ে যাওয়ার অবস্থা।

পায়ে ইতিমধ্যে ব্যাথা অনুভব করছে মীরা। চিৎকার করে কাঁদছে সে।
.
অবশেষে ধ্রুভ তাকে একটা রুমে এনে ধাক্কা দিয়ে বেডে ছুড়ে ফেলে। বেচারি পরে রয় আর উঠতে পারেনা। অনেক ক্লান্ত মীরা
আর কত?প্রায় ১ সাপ্তাহ ধরে বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত সে। তার উপর আজ বিয়ের দিন বিদায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ প্রায় টাইম কই এতো খাওয়ার?? তাও সারাদিন একটার পর একটা ঝটকা আর কত নিবে মীরা। আর না আছে শরীরে শক্তি না আছে মনে! তাই চুপচাপ এমনি পড়ে থাকে নরম তুলতুলে বেডে।
.
ধ্রুভ আবারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। তারপর বেরিয়ে যায় রুম থেকে সে। ছাদে চলে যায় ধ্রুভ।
.
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিগারেট ধরায় সে। তারপর দু তিনটা টান দিয়ে,নিজে নিজেই বলে উঠে সে

–‘কেনো বদলে গেলি তুই মীরা। সব ভুলে গেলি তুই স্বার্থপর মেয়ে। আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে প্রত্যয় কে বেছে নিলি?? তাহলে আমায় পাগল করলি কেনো??”
.
ধুভ অতীতে ডুব দেয়। সেই দিনে যেদিন থেকে মীরার পাগলামি দেখেছিলো ধ্রুভ।
.
.

চলবে

‘তুই’

#তৃধা_মোহিনী

|পর্ব এক|

কেমন লাগছে জানাবেন।ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।গল্প যেহেতু বড় করে চাচ্ছেন দুইদিন পর পর দেয়া হবে।ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here