তুমিই আমার প্রিয় নেশা পর্ব:৪২

0
1816

#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:42
#Suraiya_Aayat

” তুমি কি আজও আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি প্রিয়ন্তি?” খানিকটা অনিশ্চয়তা ভরা কন্ঠে বলে উঠলেন তেহেরাত সাহেব, পাশে খানিকটা দুরত্ব বজায় করে বসে রয়েছেন প্রিয়ন্তি মোস্তাফা ৷ মাথা নীচু করে রেখে চুপ করে রইলেন উনি, কি বলবেন বুঝতে পারছে না, বলার আছে অনেক কিছু কিন্তু বলতে পারছেন না তিনি ৷ প্রিয়ন্তির নিস্তব্ধতাকে অনুসরন করে তেহেরাত সাহেব পুনরায় বললেন
” তোমার ডায়েরিটা আমি পড়েছি, তোমাকে খোঁজার স্বার্থেই পড়েছি , যদিও কারোর একান্ত ব্যাক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়ার অধিকার আমার নেই সে আমার স্ত্রী হোক বা অন্য কেউ তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী ৷”
খানিকটা হাপিয়ে উঠে বললেন
” তোমার এই নিস্তব্ধতা আমার পুরোনো অক্ষয় পাপ গুলোকেই জানান দেই বড্ড দৃঢ় ভাবে তা আমি উপলব্ধি করি প্রতি মুহূর্তে , তবে শেষ বয়সে এসে সবটা হারানোর ভয় পায় বড্ড যদিও জানি যে কোন কিছুই আমি ধরে রাখতে পারিনি ৷”

ওনার কথাটা শুনে প্রিয়ন্তি ঈষৎ মুচকি হাসলেন,ওনার ঠোঁটে ফিচেল হাসির রেখা দেখে তেহেরাত সাহেব কিঞ্চিৎ হতচকিত হয়ে গেলেন ৷

” তা আমার সেই পুরোনো একান্ত ব্যাক্তিগত ডায়েরি পড়ে কি জানলে !”

তেহেরাত সাহেব ম্লান কন্ঠে বললেন
” তুমিও একটা সময় কাদম্বিনীর মতো অনুভব করতে !”

উনি এবার তেহেরাত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
” রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বিনী দেবীর ভুমিকা জানো?”

তেহেরাত সাহেব মাথা নীচু করে ফেললেন ৷ কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছে না ৷ মুখে ফুটে উঠেছে একরাশ অসহ্য ঘৃনা নিজের প্রতি ৷
‘ অতীত ত্যাগ করে বর্তমান কে আঁকড়ে বাঁচতে শেখো’- এই লাইন গুলো বোধ হয় শায়েরি বা কাব্যগ্রন্হেয় মানায়, আসলে বাস্তব জীবনে এগুলো বড্ড বেমানান তা আজ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন বেশ ৷
হঠাৎ হালকা শরীর কাঁপানো হাসি হাসলেন প্রিয়ন্তি মোস্তাফা,প্রেয়শীর সেই হাসির দিকে দৃষ্টি উচিয়ে দেখার ক্ষমতা তেহেরাত সাহেবের নেয় ৷
কম্পমান হাসির রেখাটা ক্রমশ সংকুচিত করে প্রিয়ন্তি বলে উঠলেন
” ক্ষমা তো আমি সেই দিন ই করে দিয়েছিলাম যেদিন তুমি তোমার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলে ৷ ক্ষমা চেয়েছিলে আমার কাছে কিন্তু সেদিন আমি তোমার ক্ষমা প্রার্থনার কোন জবাব দিইনি কারন আমি এক হতভাগা নারী যে ভেবেছিলো ,বলতে পারো এক প্রকার কল্পনা করেছিলো যে নাহ আর যাই হোক তুমি আমার ঈশারা বুজবে, কিন্তু নাহ,তুমি বোঝোনি, উল্টে আমার থেকে দূরে সরে ছিলে আর একরাশ অনুশুচনার মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলে ৷ হতাশ হতাম আমি জানো তো !”

তেহেরাত সাহেব ফুঃপিয়ে উঠলেন ,চোখ থেকে ঝরাতে লাগলেন অঝোর ধারার জল ৷ প্রিয়ন্তি মুচকি হেসে ওনার কাধে আলতো হাতের স্পর্শ রেখে বললেন
“ক্ষমা কেন করবো না বলতে পারো ! আমি কে ক্ষমা না করার ! যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা , পরম দয়ালু আল্লাহ ক্ষমাশীল, তিনি যদি সবার পাহাড় সমান গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন তাহলে আমি তার ক্ষুদ্র একটা বান্দা হয়ে তা কেন পারবোনা বলতে পারো ! বরং যারা ক্ষমা করে তারা সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে উচ্চ আসন লাভ করে ৷ সবচেয়ে বড়ো কথা যেটা তুমি কখনোই বোঝোনি তা হলো আমার ‘ ভালোবাসা ‘!”

তেহেরাত সাহেব কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললেন
” বুঝেছিলাম আর এখনো বুঝি , শুধু সেদিন তোমার মন পড়তে পারিনি আমি ৷”

প্রিয়ন্তি তেহেরাত সাহেবের দিকে ঝুকে প্রশ্ন করলো
” তুমি কাঁদছো ! কিসের জন্য ?”

তেহেরাত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার এক কাধ থেকে শাল ঝুলছে ৷ প্রিয়ন্তি ধীরপায়ে উঠে গিয়ে হেটে ওনার পাশে দাঁড়ালেন, কাঁধের শালটা কাধে টেনে দিয়ে ওনার কাধে মাথা রাখলেন
” আমরা মানুষ, মানুষ মাত্র ভুল হয় , কিন্তু ভুলটাকে শুধরে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানেই জীবনের আসল স্বার্থকতা লাভ করা ৷”

তেহেরাত সাহেব আর এক হাতে প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরলেন, সূর্য অস্ত যাবে যাবে,গোধূলির লগ্নে আকাশে রক্তির আভার মিষ্টি উজ্জলতা, কাটছে যত গ্লানি আর ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা ৷

___

” কোথায় যাচ্ছেন আপনি ?” অনেকটা আকাঙ্খিত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো নূর,হয়তো আয়াশের থেকে সঠিক উত্তরটার আশা রাখছে ভীষনভাবে ৷

আয়াশ পিছন ঘুরে নূরের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
” কোন দরকার ?”

নূর ওর প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেয়ে মাথা নীচু করে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে না সম্মতি জানালো ৷ মানুষটা কি ওর মন বোঝেনা নাকি বুঝতে চাইনা নাহলে এমন একটা প্রশ্নের এমন উত্তর ওর কাম্য নয় ৷

আয়াশ নূরের মুখের দিকে চেয়ে বলল
” আমি আসছি ৷”

নূর একটু কষ্ট পেলো তবুও বলল
” শুনুন !”

আয়াশ পুনরায় পিছন ঘুরে বলল
” কি ?”

নুর বেশ আলতো স্বরে বলল
” রাজকুমারীর সেই ছোট্ট বোনের কাহিনীটা তো এখনও বললেন না ৷”

আয়াশ নূরের প্রশ্নের উত্তরে বেশ রুক্ষ কন্ঠে জবাব দিলো
” সময় হলে নিশ্চয়ই বলবো ৷”

নুরের চোখের কোনে জল, আচ্ছা মানুষটা কি হৃদয় হীন ? প্রশ্নটা ভীশনভাবে কড়া নাড়ে নূরের মনে ৷ তার এই হঠাৎ বর্ষনের মতো রুক্ষ মেজাজের কিছু উত্তর নূরকে আহত করে মনে মনে ‌৷মন খারাপের রেশটা একেবারেই কমাতে নূর বললো
“যাওয়ার পথে খালামনিকে ডেকে দেবেন ৷”
আয়াশ সম্মতি জানিয়ে বলল
” কোন দরকার !”

নূর এবার খানিকটা রেগে গেল,বেশ তীক্ষ্ণ মেজাজে উত্তর দিলো
” দরকারেই কি কোন মানুষকে প্রয়োজন হয়? আপনি বোধহয় দরকারেই সবাইকে চান, তা কখনো নিজের রসনাতৃপ্ত করার জন্য বা নিজের অন্তরের জ্বালা মেটাতে ৷”
কথাটা বলে নূর ছলছল চোখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্য দিকে ৷ মানুষকে এই সহজ মনে হয় তো এই কঠিন ৷
আয়াশ মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ৷ নুরের চোখ থেকে আপনা আপনিই জল গড়িয়ে পড়লো ৷ ঝটপট চোখের জল মুছে নূর ফোনটার দিকে তাকালো, ফোনের ওয়ালপেপারে একটা বাচ্চার ছবি দিয়েছে নুর সেটা দেখেই ওর মন ভালো হয়ে গেল ৷আর কয়েকমাস পর ওর ও একটা ফুটফুটে বেবি হবে, তাকে নিয়ে কতো কল্পনার জাল বুনছে নূর ৷কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খালমনি আসলেন, ওনার গলাভর্তি হাসি, বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললেন
” কি নূর , কেমন আছো এখন? বমি পাচ্ছে নাকি?”

নূর ও ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
” নাহ !”
উনি নূরের পাশে বসে বললেন
” শাশুড়িকে পেয়ে আমাকে ভুললে চলবে ? যতোই হোক আমি কিন্তু তোমার খালামনি সেটা ভুলো না ৷”

‘খালামনি ‘শব্দটা শুনে নূরের প্রশ্নটা যেন আরও সহজ হয়ে গেল , নির্দিধায় বলল
” একটা প্রশ্ন করি খালামনি ?”

উনি নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
” ধুর পাগলি, জিজ্ঞাসা করার কি আছে, বলো কি বলবেন ৷”

” আপনি সত্যিই কি আয়াশের নিজের খালামনি?”

কথাটা বলে নূর ওনার মুখের দিকে তাকালো,,উনি কথাটা ঠিক কতোটা গভীর ভাবে ভাবছেন তা ওনার মুখ দেখে বোঝা সম্ভব না ৷ কিছুখনের জন্য নূর ভাবলো যে উনি হয়তো কষ্ট পেয়েছেন নূরের এমন প্রশ্নে তাই নূর উত্তেজিত হয়ে বলল
” সরি সরি , আসলে আমি এভাবে বলতে চাইনি খালামনি , আমি কৌতুহল বশত একটা ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছি , কষ্ট পেও না ৷”

উনার চোখের কোনে জল দৃশ্যমান তা নূরের কাছে স্পষ্ট ,নূরের বুকের ভিতর মোঁচড় দিয়ে উঠলো, অজান্তেই ওনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও ,এখন নিজেও ভীষন কষ্ট পাচ্ছে ৷ নূরকে এবার উনি বলে উঠলেন
” রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আমি তোমাদের খালামনি নূর ৷ অনেক ভালোবাসি তোমাদের কে ৷ কতো বছর ধরে এই বাড়িতে আছি তার হিসাব নেই ৷আমি যখন এই বাসায় প্রথম এসেছিলাম তখন আহানের বয়স 10 আর আয়াশ ছিলো 7বছরের ৷ জানো তো ওদের দুইভাইয়ের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি অবাক হতাম, এতো অল্প বয়সেও ওদের মাঝে যা ভালোবাসা ৷”

নূর সস্তি পেলো, কৗতুহল বশত জিজ্ঞাসা করলো
” মানে?”

” মানে বলতে তেমন কিছুই না, আসলে দুটো ছোট বাচ্চা এক বাসাতে থাকলে তাদের মধ্যে তো খুটিনাটি বিষয়ে ঝগড়া হয় কিন্তু আয়াশ আর আহান কখনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতো না বরং ওদের একে অপরের বিরুদ্ধে বাইরের কেউ কথা বললে ওরা তখন খুব রেগে যেত, তখন অনেক ঝামেলা করতো তাদের সাথে ৷ আহান ছিলো বড্ড দুষ্টু প্রকৃতির কিন্তু আয়াশ বরাবরই অনেক শান্ত ৷ ”

নূর অবাক হয়ে বললেন
” সত্যি !”

উনি বললেন
” হমমম, আয়াশ কখনও রেগে আর উঁচু স্বরে কথা বলে না ৷ আর অনেক শান্ত এখনো, আর বড্ড মেধাবী,নাহলে কি আর সায়েন্টিস্ট হতে পারে ! তোমাকে একদিন বলেছিলাম না ওর ডিগ্রির কথা !”

নূর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ৷
উনি আবার বললেন
” আমি প্রথমে এই বাসাতে এসেছিলাম আহান আর আয়াশের হত ধরেই , তখন ইফার বয়স দেড় বছর ৷ আমার বিয়ের 2বছর পর আমার স্বামী 2য় বিয়ে করে, আমার ওপর অত্যাচার করলে আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি একরত্তির ইফাকে নিয়ে ‌৷কোথাও আশ্রয় না পেয়ে রাস্তায় মাথা গোজার ঠাই হয় ৷ একদিন ইফাকে নিয়ে এই এলাকার একটা দোকানের পাশে বসে ছিলাম ,আমার চোখটা লেগে এসেছিলো, বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো আর ঘুমিয়েও পড়ি, তখন আয়াশ আর আহান দুই ভাই ব্যাডমিন্ট খেলার জন্য সাইকেলে করে যচ্ছিলো,হঠাৎ কেউ ইফাকে নিয়ে পালাচ্ছিলো তা ওরা বুঝতে পারে, তার পিছু নিতে গিয়ে তাকে পিছন থেকে সাইকেলে ধাক্কা মারলে চোর মাটিতে পড়ে যায়, ইফা ব্যাথা পেয়েছিলো বেশ, জ্বর ও চলে এসেছিলো ৷তারপর ছোট্ট ইফাকে আহান কোলে করে আমার কাছে নিয়ে আসে তারপর ওরাই আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায় ৷ ভেবেছিলাম জমিদার বাড়ির বড়ো বড়ো মানুষরা আমাকে আর আমার মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে কিন্তু না তারা আপন করে নিয়েছিলো আমাদেরকে ৷ তারপর থেকে আয়াশ আর আহান আমার ও ছেলে হয়ে গেল ৷ কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়িতে ৷ ভাবী নিখোঁজ হলে আমিই ওদের খালামনির মতো সব কিছু পালন করতাম ৷ বড্ড ভালোবাসি ওদের ৷ তেহেরাত ভাইয়া আর প্রিয়ন্তি ভাবী আমাকে কখনো কাজের লোকের চোখে দেখেননি , নিজের বোনের মতোই ভাবেন তাই আমিই ওদের খালামনি ৷”

ওনার চোখের জল মুছিয়ে নূর ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন ৷ প্রতে্্যকটা মানুষের জীবনে একটা দীর্ঘ কাহিনী থাকে তা আমরা কখনও জানি আবার কখনও অজানাই থেকে যাই ৷ উনি চোখের জল মুছে বললেন
” যাই হোক, আমিই তোমাদের খালামনি বুঝলে ৷”
নূর মুচকি হাসলো ৷ উনি বললেন
” অনেক খন তুমি কিছু খাওনি, তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি ৷”

“নাহ আমার ক্ষিদে নেই খালামনি ৷”

” বললেই হলো ৷ এখন থেকে বূঝি বেশি খাবে , ইচ্ছা না থাকলেও খাবে ৷ আমি খাবার অনছি তারপর আবার গ‍ল্প করবো , আর আয়াশ ভীষন রকম বাচ্চা প্রেমী,আয়াশ বাচ্চাদেরকে খুব ভালোবাসে তাই নিজের বাচ্চার অযত্ন হলে তোমার আর রক্ষে নেই ৷”

নূর মুচকি হাসলো , কথাটা বলে উনি বেরিয়ে গেলেন ‌ ৷ এই বাড়ির মানুষরা কতো সহজে সবাইকে আপন করে নেই, কিন্তু আয়াশ !
” ওনার সব রাগ কি শুধু আমার জন্যই প্রজোয্য ? উনি তো সবার ওপর রাগ দেখান না তাহলে আমার ওপরই কেন খালি রাগ দেখান ? ওনার ডেভিল রুপটা কেন শুধু আমার জন্যই?”

নূরের মনে এই প্রশ্ন গুলো জেগে উঠলো ৷

#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here