#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:8
#Suraiya_Aayat
” শোনো তোমাকে আমি এটাই প্রথম আর এটাই শেষ বারের মতো বলছি তোমার ভাইয়ার মাথাটা বিগড়ানো বন্ধ করো ৷ তোমার জন্য তোমার ভাইয়া এখনো আমাকে বিয়ে করেনি ৷ বিয়ে করেও শান্তি দিলেনা তুমি আমাকে ৷ তাই এসব ছেলে ভোলামি কথাবাত্রা গুলো বন্ধ করো ৷”
ক্রমাগত মায়ার এমন উদ্ভট কথা শুনে নূরের চোখের জল আর আটকালো না, না জানি মায়া ওদের ভাই বোনের মতো পবিত্র সম্পর্কটাকে কতোটা নোংরা চোখে দেখে , ভাবলেই নূরের নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করে ৷ নূর ভাঙা গলায় বলল
” ভাবী দয়া করে তোমার এই মন মানসিকতার পরিবর্তন করো ৷ না জানি তোমার সাথে আমার কোন জন্মের শক্রুতা আছে যে তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না ৷”
নূরের কথা শুনে মায়া রেগে গিয়ে বলল
” শক্রুতা ! এর মাঝে আবার শক্রুতা এলো কোথা থেকে, আমি তোমাকে নিজের বোনের মতো ভাবি আর তুমি আমাদের মাঝে শক্রুতার কথা বলছো ৷”
হঠাৎ মায়া কেমন জানি উল্টোসুরে গাইতে লাগলো, নূর তার কারন বুঝলো না তবুও বলল
” আমি জানি তুমি মুখে সবার সামনে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও তোমার অন্তরে আমার জন্য ঘৃনা ভরা, তুমি কেন আমাকে সহ্য করতে পারো না তা আমি সত্যিই যদি জানতে পারতাম ৷” চোখের জল মুছে খানিকটা স্বাভাবিক গলায় বললো নূর ৷
হঠাৎ আচমকাই অপর পাশ থেকে হুঠ করে নূরের ভাইয়া বলে উঠলো
” কি সব বলছিস এগুলো ? তোর আর মায়ার মাঝে শক্রুতা হতে যাবে কেন? মায়া তোকে যথেষ্ট ভালোবাসে ৷”
নূর হঠাৎ করে ওর ভাইয়ার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো তবুও নিজেকে সামলে বলল
” ভাইয়া তুমি হয়তো পুরোটা শোনোনি ৷ এটা নতুন কিছু না, আমি জানি না সত্যিই আমার দোষটা ঠিক কোথায় ৷”
নূরের ভাইয়া নূরকে অনেক বিশ্বাস করে মায়ার তুলনায় ও বেশি আর এই সব ছোট ছোট বিষয়ের কারনে মায়া নূরকে সহ্য করতে পারে না ৷ নূরের প্রতি এই বিশ্বাস থেকে নূরের ভাইয়া মায়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো
” কি বলেছো তুমি নূরকে ৷”
মায়া একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তবুও ও হরার পাত্রী নয় নাই সাবলীল ভাবেই বলল
” তুমি তো শুনলে নূর কি বললো, ও বললো আমি নাকি ওকে সহ্য করতে পারি না, আমি নাকি ওকে হিংসা করি আরো কতো কিছু !”
নূর শুধু শুনছে, অবলীলায় মায়া ওকে মিথ্যাচার করছে ৷
নূরের ভাইয়া বলে উঠলো
” এগুলো কি শুনছি নূর তোর থেকে এগুলো আশা করিনি , মায়া তোর ভাবী হয় তুই তাকে এমনটা বলতে পারিস না ৷ যাই হোক তোর ব্যাবহারে এখন তো মনে হচ্ছে আমাদের বিয়ে হলে তুই এই বাসায় আসলে আমাদের কে বাসা ছাড়তে হবে ৷”
ওর ভাইয়ার বলা শেষের কথাটা যেন ওকে ভেঙে দুমড়ে মুছড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ৷ কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল
” ভাইয়া তুমি অন্তত এই কথাটা বলতে পারলে !”
মায়া ওপাশ থেকে বলে উঠলো
” ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করো না নূর , তোমার ভাইয়া এখন সব জেনে গেছে তাই তুমি এসব বলছো তাইনা ৷”
নূরের ভাইয়া যখন মায়ার কথাটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ওকে দোষারোপ করতে পারে তখন বাইরের কোন মানুষের কথায় ওর কোন যাই আসে না ৷ নূর ভাঙা গলায় বলল
” জ্বি ভাবী তুমি ঠিক বলেছো , আমি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছি ,যাই হোক তোমাদের বিয়ে হলে আমি আর তোমাদের বাসায় যাবো না চিন্তা নেই ৷ আচ্ছা রাখছি গো আল্লাহ হাফেজ, আর ভাইয়াকে বলো সে যেন আমাকে নিয়ে আর চিন্তা না করে ৷”
কথাটা বলে নূর কলটা কেটে দিলো ৷ ফোনটাকে হাত দিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ৷ ফোনটা ভেঙে যাওয়াতে তার এক অদ্ভুত আওয়াজ হলো ৷
নূর ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় জোরে জোরে কেঁদে ফেলল ৷ প্রিয় মানুষদের থেকে পাওয়া আঘাতগুলোর কাছে অন্য আঘাত গুলো তো তুচ্ছা ৷
❤
” sir,আপনারা এভাবে আমাকে প্রেসারাইজ করতে পারেন না , তাছাড়া আমি জানি আমাকে কি করতে হবে ৷ বারবার আমকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই ৷” অনেকটা কর্কশ কন্ঠে বলল আয়াশ ৷
সামনে বসে থাকা মধ্যবয়সী লোকটা তার চোখের চশমাটা ঠিক করে বললেন
” এটা কোনভাবেই একটা সায়েন্টিস্ট সুলভ আচরন নয় আয়াশ ৷ তাছাড়া তুমি হয়তো ভুলে গেছো যে আমি তোমাদের হেড ৷আর তুমি আমাদের এই প্রজেক্টের বড়ো প্রজেক্টটার দায়িত্ব নিয়েছো ,আর এই হলো তোমার এগ্রিমেন্ট ৷” কথাটা বলে আয়াশের দিকে বেশ একশো পাতার একটা এগ্রিমেন্ট এগিয়ে দিলেন , যার প্রতিটা পাতায় আছে আয়াশের বাঁকা হাতের সিগনেচার ৷
আয়াশ পেপার গুলো নিয়ে দূরে ছুড়ে দিলো ৷ ও ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
” ভুলে যাবেন না sir আমি ছাড়া এই এক্সপেরিমেন্ট অসম্ভব , কজ আই হ্যাভ দা ডেড বডি যেটা আপনাদের দরকার ৷ তাই আপনারা আমার সাথে থাকলেন কি না থাকলেন বা আমাকে বরখাস্ত করলেন কি আই ডোন্ট কেয়ার বাট আই উইল সাকসিড ফর সিউর ৷”
আয়াশের কথা শুনে উনি একটু থেমে গেলেন, আর যাই হোক উনি যানেন যে আয়াশ ঠিক কতোটা দক্ষতাপূর্ন ৷ উনি খানিকটা ঠান্ডা গলায় বললেন
” ওয়েল , ফরগেট ইট ৷ আমরা এগ্রিমেন্ট নিয়ে কথা বলি ৷”
আয়াশ একটা বাঁকা হাসি হেসে টেবিলের ওপরে থাকা অ্যাসিডের বোতল টা মাটিতে ছুড়ে মারলো
” গো টু হেল উইথ ইউর এক্সপেরিমেন্ট ৷”
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল ৷ ওর মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেছে রাগে ,ওর ওপর কেউ অযাচিত ভাবে কোন রকম প্রেশার ক্রিয়েট করলে বা উঁচু গলায় কথা বললে আয়াশ তা সহ্য করতে পারে না ৷ গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললেই ড্রাইভার বলে উঠলো
” sir আপনি এখন আপনার ল্যাবে যাবেন নাকি বসায় যাবেন?”
আয়াশ রেগে গিয়ে উচ্চকন্ঠে বলল
” আমার বাসায় যে আমার ল্যাব সেটা কি তুমি জানো না ?”
উনি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললেন
” আসলে sir বাসায় যাওয়ার অন্য রাস্তা আর আপনার ল্যাবে যাওয়ার রাস্তা তো অন্য তাই আরকি ৷”
আয়াশ আর কিছু বললো না, রাগ হচ্ছে খুব , আর এখন রাগ কমানোর একটাই উপায় যা হলো ওর আফু সোনা ৷ আয়াশ নূরের নাম্বারে কল করলো ৷ ফোন সুইচ অফ ৷ বিরক্তি নিয়ে আর একবার ফোন করলো, এবার ও সুইচ অফ ৷ রাগের পরিমানটা বাড়তে লাগলো,না জানি আজ কি হবে !
❤
নুরের থেকে ঠিক এক হাত দূরত্বে ঝনঝন করে কাঁচের ছোট্ট একোরিয়াম টা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল ৷ নূর চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো,ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসছে, আয়াশ হঠাৎ এমন রেগে গেল কেন নূর তা জানে না , তবুও ওর আর কোন মন মানসিকতা নেই আয়াশকে কারন জিজ্ঞাসা করার, ও জানে মানুষটা ওকে পরোয়া করেনা ৷ নূরের ভীষন পরিমান কান্না পাচ্ছে, এটা কি ধরনের জীবনজাপন করছে ও যেখানে ওর নিজের পরিবার দূরে ঠেলে দেই অবিশ্বাস করে আর আরেকদিকে একটা সাইকো মানুষের সাথে জীবন কাটাতে হয় যে এই ভালো আর এই খারাপ ৷ নিজের জীবনের প্রতি তীব্র অনীহা জাগছে নূরের মাঝে ৷ নূর কোন সাড়াশব্দ করছে না, চুপ করে মেঝেতে বসে আছে ৷ নূরের এমন মূর্তির মতো ভাবাবেগ দেখে আয়াশ এবার আরো একটা কাঁচের জিনিস নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো , নূর চমকে কেঁপে উঠলো ৷ নূর তবুও আয়াশকে কিছু বলছে না ৷ আয়াশ নূরের হাত ধরে টেনে তুলে বলল
” এই মেয়ে মরে গেছো নাকি ? কিছু বলছোনা কেন? নাকি বোবা হয়ে বাকশক্তি হরিয়েছো কোনটা ?”
নূর আয়াশের হাতের বাধন ছাড়িয়ে বলল নরম কন্ঠে বলল
” আর কিছু ! আর কিছু ভাঙবেন ? নাকি আমাকে শেষ না করলে আপনার শান্তি নেই কোনটা ? বাঁচতে দিন না আমাকে , কেন আমাকে বেঁচে থেকেও মরে যেতে বাধ্য করছেন বলুন তো ? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করেছি বলে আমার মনে হয়না,না আপনাকে আমি আগে কখনো চিনতাম না আপনাকে আগে কখনো দেখেছি ৷ আপনি কখনো আমার মনের ওপর অধিকার জমাতে পারেননি দেখুন কিন্তু আমার শরীরের ওপর অধিকারটা কিন্তু ঠিক ই খাটিয়েছেন ৷ আমি কখনো কোন প্রতিবাদ করেছি ?করিনি তো ! কারন আমি যে অবলা, আমি প্রতিবাদ করলেও কেউ আমার কথা কখনো বিশ্বাস করবে কি?আমি জানি করবে না ৷ আমাকে জোর করে অপবাদ দিয়ে বিয়ে করেছেন, সেটাও মেনে নিয়েছি ৷ নিজেকে আমার সামনে অনেক রহস্যময় হিসাবে প্রমান করেন , আমার ওপর অযাচিত ভাবে সব সময় অধিকার খাটান, আমি তো কখনো কিছু বলিনি ৷ আসল কথাটা কি জানেন তো আপনার মতো অনেক পুরুষ আছে যারা নিজেদের ক্ষমতা দিয়ে নারীকে দমিয়ে রাখতে চাই যাই হোক দিন শেষে একটাই কথা বলবো
” আমাকে প্লিজ মুক্তি দিন ৷”
আয়াশ নূরের কথাটা শুনে নূরকে ছেড়ে দিয়ে নূরের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল
” তোমার মুক্তি আমাতেই ৷”
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল ৷ নূর মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো ৷ মানুষটাকে এতোকিছু বলার পরও কোন পরিবর্তন নেই ৷ নূর তো ভেবেছিলো আয়াশ হয়তো ওকে সপাটে একটা চড় মেরে দেবে কিন্তু তা না উল্টে নরম সুরে কথা বলে চলে গেল ৷ এটা তো এমন হয়ে গেল যে কনো মেঘ কখনো রোদ্দুর ! ও কি মানুষটা কে আদেও কখনো বুঝবে?
❤
নূরের গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে আছে আয়াশ, নূরকে নিজের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ৷ রুমে এসি চলা সত্বেও নুর ঘামছে , শরীরের মাঝে অসস্তিতে ভরপূর ৷ নূর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতেই আয়াশ বলে উঠলো
” আফু সোনা ঘুমাচ্ছনা কেন? তোমার ভাবীর জন্য চিন্তা হচ্ছে বুঝি ?”
ভাবী বলতে আয়াশ মায়ার কথা বুঝিয়েছে সেটা নূর বুঝলো কিন্তু মায়ার আবার কি হতে যাবে সেটা ভেবে নূর আর কিছু বলল না, চুপটি করে শুয়ে রইলো ৷
আয়াশ নূরের গলায় একটা চুমু দিয়ে বলল
” চিন্তা নেই তোমার ভাবীর বেশি কিছু হয়নি শুধু ডান হাতটা ভেঙেছে , সারতে টাইম লাগবে ৷”
নূর চমকে উঠলো, কই ও তো এমন কিছু শোনেনি ৷ নূর ধড়ফড় করে উঠে বসলো ৷ আয়াশ বিরক্ত হয়ে বলল
” বারবার দূরে চলে যাও কেন বলো তো, এই জন্যই তো পানিশমেন্ট দিই ৷ ”
নূর থমথমে গলায় বলল
” কি হয়েছে ভাবীর?”
আয়াশ একটা হাই তুলে বলল
” এক্সিডেন্ট করেছে হয়তো ওই আরকি ৷”
নূর অবাক হয়ে বলল
” আপনি কি অরে জানলেন যে ভাবীর এক্সিডেন্ট হয়েছে, আর কই ভাইয়া তো আমাকে কিছু বলেনি ৷”
আয়াশ এবার উঠে নূরকে কাছে টেনে নিয়ে বলল
” বলবে কিভাবে সে তো বউয়ের সেবায় মগ্ন যেমনটা আমি তোমার নেশাতে পাগল ৷”
আয়াশের কথা বলার ধরন শুনে নূর কাঁপাকাঁপা গলায় বলল
” সত্যি করে বলুন সব , আপনি কি করে জানলেন ৷”
আয়াশ নূরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নূরের দিকে ঝুকে নূরের মুখে ফু দিয়ে বলল
” আমিই তো হালকা করে একটা ধাক্কা দিলাম আর তোমার ভাবী রাস্তায় পড়ে গেল, এটা আমার দোষ বলো?”
ভয়ে নূরের চোখে জল চলে এলো ৷ নূর আমতা আমতা করে বলল ” সে তো আপনার কোন ক্ষতি করেনি, আপনি তাহলে তার পিছনে পড়েছেন কেন?”
আয়াশ নুরের চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলল
” আমার আফু সোনাকে কেউ কষ্ট দিলে বুঝি আমার কষ্ট হয়না বুঝি !”
কথাটা বলে নূরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো ৷
নূরের মাথায় ঘুরছে আয়াশের বাবার বলা কথাগুলো
” তোমার খুশিতেই আয়াশের খুশি ৷”
ওনার বলা কথাটা সত্যি নাকি মানুষটার ব্যাবহারই একটা গোলকধাঁধা ?
#চলবে,,,