“মেয়েটার সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক ছিল।”
বেশ সহজভাবেই কথাটা বললো মৃন্ময়। এরপর বেশকিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চললো। নিরবতা কাটিয়ে তুললো মৃন্ময়। বললো,
“চুপ করে আছেন যে?”
প্রিয়া এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ করে বসে ছিল। এবার মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি বলবো?”
“আপনার অদ্ভুত লাগছে না?”
“বুঝতে পারছি না।”
“দেখেন, আমি জানি আপনার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কয়েকদিন পরই আপনার আমার বিয়ে। সেখানে আপনি এখন শুনতেছেন হবু বরের অন্য কোনো মেয়েটার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল। আমি চাইলে হয়তো লুকাতে পারতাম। কিন্তু লুকাইনি কারণ আমি চাইনি আপনায় মিথ্যা বলে ঠকাতে।”
প্রিয়া বেশকিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলো,
“আসলেই তো! কিন্তু আমার খারাপ লাগছেনা কেন? আবার ভালোও লাগছেনা। অন্য কোনো সময় হলে হয়তো দেখা যেতো আমি মৃন্ময়কে ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আমার কোনো অনুভূতিই হচ্ছেনা। আমার কি বলা উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছিনা।”
মৃন্ময় বললো,
“অনেক ভালোবাসতাম মেয়েটাকে। ওর নাম ছিল রিমি। আমার এক ইয়ার জুনিয়র ছিল। কোনো এক বৃষ্টির সময়ে দেখে ভালো লেগে যায়। এরপর প্রণয়, তারপর ভালোবাসা। এরপর একসময় ফিজিক্যালি জড়িয়ে যাই দুজনে। আমি ওকে কোনো জোর করিনি। দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছিল।”
মৃন্ময়ের কথাগুলো শুনে বেশ অসস্তি হচ্ছিলো প্রিয়ার। তাই প্রসঙ্গটা পাল্টে বললো,
“আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনার আর কিছু বলার না থাকলে আমি বাড়িতে যেতাম।”
“খুব বেশি খারাপ লাগছে?”
“ঐ একটু আরকি!”
“চলুন, আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।”
“ধন্যবাদ। আমি একাই যেতে পারবো।”
“বেশ! তবে আমার বলা কথাগুলোর উত্তর আমি এখনই চাচ্ছি না। আপনি আগে সময় নিয়ে ভাবুন তারপর উত্তর দিন। যদি সবকিছু জেনেও মনে হয়, বিয়ে করার জন্য আমি আপনার জন্য পার্ফেক্ট তাহলে বিয়েটা হবে। আর যদি মেনে নিতে না পারেন তাহলে জোর করে বিয়ে করবো না।”
প্রিয়া কিছু বললো না। উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। বেশ অসস্তি লাগছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছেনা।
মৃন্ময় বড়লোক বাবার ছেলে। বাড়িতে বাবা-মা, আর মৃন্ময় থাকে। বড় ২ বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রিয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে মা,২ ভাই-ভাবী আর প্রিয়া থাকে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রিয়া সবার ছোট্ট। মৃন্ময়ের বাবার বড় বিজনেস আছে সেটারই দেখাশুনা করে মৃন্ময়। আর প্রিয়া অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে+একটা স্কুলে জব করে।
.
বাসায় যেতেই মায়ের সাথে দেখা হয় প্রিয়ার। তিনি প্রিয়ার গালে হাত রেখে চুমু দিয়ে বললো,
“কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“হুম ভালো।”
“পছন্দ হয়েছে তোর?”
“তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
প্রিয়া রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হাজার চেষ্টা করেও ঘুম আসছেনা। ঘুমও এখন স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। যে ঘুম আগে প্রিয়ার পিছুই ছাড়তো না সেই ঘুম এখন প্রিয়াকে ধরাই দেয়না। সবই সময়ের বিবর্তন। প্রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর উঠে টেবিল থেকে হুমায়ুন আহমেদের “আজ হিমুর বিয়ে” বইটা নিলো। বেশ কয়েকবার পড়ার পরও ইন্টারেস্ট কমেনা। হিমুর চরিত্রটা এখানে সত্যিই মুগ্ধকর। বই পড়তে পড়তে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে খেয়ালই করেনি। মাগরিবের আজান শেষ হতেই প্রিয়া ওযু করে নামাজ পড়ে নেয়। এরপর আবার বিছানায় গিয়ে পা গুটিয়ে বসে থাকে। মনটা আনচান করছে। কেন করছে এমন বোধগম্য হয়না প্রিয়ার। ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভাঙ্গে । নাম্বারটা সেভ করা নয় কিন্তু পরিচিত। মৃন্ময়ের নাম্বার। কলটা কেটে যায়। দ্বিতীয়বার রিং হতে প্রিয়া রিসিভড করে সালাম দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। কি করছেন?”
“বসে আছি। আপনি?”
“এইতো ব্যালকোনিতে।”
“ওহহ।”
“হুম।”
এরপর আবারও নিরবতা। মৃন্ময় কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“আপনি কি এরকমই?”
“কিরকম?”
“কেমন যেন চুপচাপ।”
“কিজানি।”
“আপনি জানেন না?”
“না।”
“নিজে কেমন সেটা নিজেই জানেন না?”
“না।”
“অদ্ভুত তো।”
“হয়তো। নিজেকে এতদিন ভুল জানতাম আর ভুল চিনতাম। তাই এখন সঠিক কোনটা জানিনা।”
“ঠিক বুঝলাম না।”
“কিছুনা।”
“উমম ওকে! আচ্ছা কিছু ভাবলেন?”
“কোন বিষয়ে?”
“আজকে বিকালে বলা কথাগুলোর ব্যাপারে।”
“ভাবার কিছু নেই।”
“কেন?”
“সবকিছুরই কি প্রশ্ন হয়?”
“তা নয়। তবুও এত বড় একটা বিষয়ে আপনার ভাবা উচিত।”
“ভাবিনি।”
“তাহলে আমি উত্তরটা কি ধরে নিবো?”
“হ্যাঁ।”
“কি হ্যাঁ?”
“উত্তরটা হ্যাঁ।”
“তাহলে আমার অতীত নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা নেই?”
“না। মা বলে, প্রতিটা মানুষের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু অতীত আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা নেহাৎই বোকামি।”
“হুম আপনার মা ঠিকই বলে। ইভেন, আমি মনে করি সন্তানদের মঙ্গলের জন্য প্রতিটা বাবা-মায়ের উপদেশই সঠিক।”
“জ্বী।”
“তো বিয়েটা কি বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই করতেছেন?”
“জ্বী।”
“আমায় আপনার ভালো লেগেছে?”
“আপনাকে আমার পরিবারের পছন্দ হয়েছে।”
“সংসার তো আপনি করবেন। আপনার কোনো মতামত নেই?”
“আমার মনে হয়, আমি নিজে থেকে সবসময়ই ভুল সিদ্ধান্ত নিই।”
“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“আমার অতীত।”
“আপনারও অতীত আছে?”
“প্রতিটা মানুষেরই অতীত থাকে।”
“আপনারটা কি জানতে পারি?”
“পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছেনা।”
“ঠিক আছে।”
কথা বলা শেষ করে প্রিয়া মায়ের রুমে গেলো। মা তখন বিছানা ঝাড়ছিল। প্রিয়াকে দেখে বললো,
“কিছু বলবি?”
“আমার কষ্ট হচ্ছে মা।”
মা তাড়াডাড়ি প্রিয়াকে নিজের কাছে এনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। প্রিয়া কান্না করেই বললো,
“এভাবে জড়িয়ে ধরো না মা। আমার আরো কষ্ট হয়।”
“তোকে না কতবার বলেছি অতীত নিয়ে ভাববি না?”
“আমি কি করবো মা? অতীত যে আমার পিছু ছাড়ছে না।”
“অতীত ভুলে যা মা। সবাই অন্যায়ের শাস্তি পায়।”
প্রিয়া কিছু বলছেনা। কেঁদেই যাচ্ছে। প্রিয়াকে বিছানার ওপর বসিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মা চোখ মুছিয়ে দিলো। বললো,
“মৃন্ময় ছেলেটা অনেক ভালো। কত ভালো পরিবারের ছেলে দেখেছিস। অনেক সুখে থাকবি তুই। এমন পরিবার আর ছেলে সচারচর পাওয়া যায় না।”
“হুম।”
“আমি আমার আগের সেই হাসিখুশি প্রিয়াকে ফিরে পেতে চাই। যার হাসিতে এই বাড়ির প্রতিটা লোক হাসে। যার দুষ্টুমিতে এই বাড়ি মেতে থাকে।”
প্রিয়া আবারও চুপ। মা বললো,
“মৃন্ময়ের সাথে কথা হয়েছিল আর?”
“হ্যাঁ। একটু আগে ফোন দিয়েছিল।”
“কি বললো?”
প্রিয়া সব কথাই মাকে বললো। শুধু ফিজিক্যাল রিলেশনের কথা স্কপি করে। মা বললো,
“কোনো মানুষই পার্ফেক্ট হয়না। তাকে মনের মত বানিয়ে নিতে হয়। আর আমি জানি, আমার মিষ্টি মেয়েটা সেটা পারবে।”
প্রিয়া মাকে জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর অর্ধেক শান্তি তো মায়ের বুকেই।
.
রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। একাই ছাদে হাঁটছে মৃন্ময়। আকাশে আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তবে অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় মৃন্ময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে প্রিয়ার কথা। আর আনমনেই বলে,
“মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? হাসেনা, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। কিন্তু তবুও এই মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে। যেটা আমাকে বারবার ওর প্রতি টানে। মাত্র অল্প কিছুদিনের পরিচয়েও কি কাউকে এত ভালো লাগতে পারে? আচ্ছা প্রিয়াকে কি শুধুই আমার ভালো লাগে? নাকি ভালোবাসাটাও সৃষ্টি হচ্ছে? তাহলে রিমি? রিমিকে কি আমি ভালোবাসিনা? না, না রিমিকে আমি সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। বরং রিমিই আমাকে ঠকিয়েছে।”
মৃন্ময় ছাদে পায়চারি করতে লাগলো। একসময় থমকে গিয়ে ভাবতে লাগলো,
“প্রিয়া তখন কি একটা অতীতের কথা বলেছিল। আচ্ছা ওর আবার কি অতীত আছে? ওরও কি আমার মত ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল? ছিঃ না কি ভাবছি। আচ্ছা যদি থেকে থাকে?”
হাজারটা প্রশ্ন মৃন্ময়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আবার পরক্ষণেই মনে হলো সামনাসামনি জিজ্ঞেস করবে। অবাধ্য মনটা তবুও কি যেন চাচ্ছে। মৃন্ময় নিজের গালে এক আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিয়ে ভাবতে লাগলো,
“উমম! প্রিয়ার ভয়েসটা শুনতে ইচ্ছে করছে।”
উনিশ-বিশ না ভেবে ফোন দিয়ে দিলো। প্রিয়া তখন ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরে এসে বিছানার ওপর থেকে ফোন নিয়ে দেখে মৃন্ময় ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে সালাম দেওয়ার আগেই মৃন্ময় তড়িঘড়ি করে বললো,
“স্যরি স্যরি এত রাতে কল করার জন্য। কিন্তু কি করবো বলুন? হাজার চেয়েও নিজের মনটাকে বোঝাতে পারছিলাম না। মনটা বারবার বলতেছিল, প্রিয়াকে ফোন দে তাড়াতাড়ি ফোন দে। এক্ষুণী ফোন দে। তাই আমিও আর মনের কথা না শুনে পারলাম না।”
মৃন্ময়ের কথা শুনে প্রিয়া একটু হাসলো। মৃন্ময় বললো,
“আপনি হেসেছেন?”
“হু।”
“সত্যিই হেসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা আপনি হাসতে পারেন।”
“কি জন্য এত রাতে কল করলেন?”
প্রশ্নটা ইগনোর করায় মৃন্ময় একটু কষ্ট পেলো। নিজেকে সংযত করে বললো,
“ঘুমাচ্ছিলেন?”
“না।”
“তাহলে কি বিরক্ত করলাম?”
“জ্বী না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আমি ভাবলাম, কিছু বলার জন্য হয়তো ফোন দিয়েছেন।”
“কতকিছুই তো বলতে চাই। শুধু অধিকারটা নেই।”
“কিছু বলার জন্য অধিকারও লাগে?”
“হুম লাগে তো। এত রাতে কল করেছি সেটাই তো অধিকারের বাহিরে হয়ে গিয়েছে। সব দোষ এই বেহায়া মনটার। আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য আকু্ল হয়ে গিয়েছিল।
তখন প্রিয়া দুম করে একটা প্রশ্ন করে বসলো,
“আমি আপনার কে?
মৃন্ময় ওপাশ থেকে কিছু বলতে যাবে তখনই প্রিয়ার ফোন সুইচড অফ হয়ে যায়। এটা অস্বাভাবিক নয়। প্রিয়ার ফোন খুব একটা প্রয়োজন হয়না এখন তাই চার্জও দেওয়া হয়না বেশ কয়দিন। ফোন চার্জে দিয়ে প্রিয়া শুয়ে পড়ে। ঐদিকে মৃন্ময় ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই অসহ্যকর একটা কথা মহিলা কন্ঠে শুনতে হচ্ছে, “আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।” হুট করেই মৃন্ময়ের প্রশ্নের কথা মনে পড়ে। আর রিপিট করে বলে,
“আমি আপনার কে!!”
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya