#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৭
ব্যবসায়িক একটা পার্টিতে এটেন্ড করার জন্য একসঙ্গে বেরিয়েছে রেজা এবং নিলি। রেজোয়ান যাওয়ার পর থেকেই নিলির মন ভালো ছিলো না। কিন্তু রেজার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে অবশেষে বেরলো।
নতুন করে মার্কেটে প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে রেজোয়ান।একই প্রডাক্ট রেজারও লঞ্চ করার কথা ছিলো। কিন্তু ভ্যালিডেশনে আটকে যায়। রেজাকে জ্বালানোর জন্য হঠাৎ করে সেলিব্রেশন পার্টি রাখার সিদ্ধান্ত নিলো রেজোয়ান। নিলি এবং রেজাকেও আমন্ত্রণ জানালো।
রেডি হয়ে বিশাল হলরুমের ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো রেজোয়ান। অত্যাধিক দুঃখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো সম্মুখপানে। একে অপরের হাত ধরে সবার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে জানাচ্ছে রেজা এবং নিলি। যেন সদ্য বিবাহিত নব দম্পতি। দুর্বিষহ যন্ত্রণায় রেজোয়ানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। অসহায় চোখে চেয়ে রইলো নিলির হাস্যজ্জ্বল মুখখানার দিকে। তাঁরসঙ্গে থাকাকালীন সময়েও ঠিক এমনি করেই হাসতো বুদ্ধিভ্রষ্ট, মূঢ়চিত্ত রমণীটি। আর্দ্র হয়ে এলো চোখজোড়া। পুরোনো স্মৃতিগুলো নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
-‘স্যার? আপনি ঠিক আছেন?’, চিন্তিত মুখে প্রশ্নটা করলো জাহিদ। তাঁর কন্ঠে সান্ত্বনার সুর।
জবাব দিলো না রেজোয়ান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে এগোলো। হাসিমুখে আমন্ত্রিতদের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো।
★
পার্টির একপর্যায়ে রেজোয়ানের দিকে চোখ পড়লো রেজার। দাম্ভিক হাসি ফুটে উঠলো মুখে। টেবিলের এক কোনায় বসে একের পর এক গ্লাস খালি করছে রেজোয়ান। কম্পানীর এতবড় সাফল্য অথচ তাঁর মুখে হাসি নেই। চোখের সামনে নিলির হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছে রেজা। তাঁকে দেখেই যেন আরো বেশি করে অন্তরঙ্গতা দেখাচ্ছে।
-‘হ্যালো মি.মুরসালীন?’ হাসিহাসি মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেজা। রেজোয়ান জবাব দিলো না।
-‘পার্টিতে এসেছি অথচ আপনি আমাকে একবারও বিয়ের জন্য কংগ্রাচুলেট করলেন না। এটা কিন্তু ঠিক না। আফটার অল আমরা একে অপরের বন্ধু! কংগ্রাচুলেশনস জানাতেই পারতেন।’
রেজোনের পাশেই চেয়ার টেনে বসলো রেজা। মদের গ্লাসটা টেনে নিয়ে ঠাট্টাসূচক গলায় বললো,’আর খাবেন না মি.মুরসালীন। অনেক হয়েছে! এবার আমার এবং নিলির কাপল ডান্স দেখবেন চলুন!’
-‘এসব বলে কোন লাভ নেই মি.রেজা। নিলি কক্ষনো আপনাকে বিয়ে করবে না। সি লাভস ইউ!’,কন্ঠে জেদ চেপে আছে রেজোয়ানের।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রেজা। রেজোয়ানের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো,’আপনি এই সান্ত্বনা নিয়েই থাকুন মি.মুরসালীন। সেই ফাঁকে আমি নিলিকে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেই!’
-‘ডোন্ট টক রাবিশ! সি ইউল নেভার মেরি ইউ!’
রেজা রেজোয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’সি অলরেডি কিসড মি!’
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল তাঁর দিকে চেয়ে রইলো রেজোয়ান। যেন মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে। নেশার ঘোরে সত্যি মিথ্যে যাচাই এর ক্ষমতা কাজ করছে না তাঁর। মাথার ভেতর ভনভন করছে। রেজা সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। মৃদু হেসে বললো,’আই স্যয়ার! হার লিপ্স ওয়াজ অ্যামেজিং!’
অতিরিক্ত রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেলো রেজোয়ানের। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে রেজার নাক বরার ঘুষি মারলো। কিন্তু মিস হয়ে গেলো। নেশাগ্রস্ত থাকার ফলে নিশানা ঠিক রাখতে পারলো না। তড়িৎ গতিতে পাশে সরে গেলো রেজা। সরে গিয়ে পালটা ঘুষি লাগালো রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করলো রেজোয়ানের নাক দিয়ে। এরপর শুরু হলো দুজনের মারামারি। মদের নেশায় রেজোয়ানের হুঁশ নেই। তথাপি শরীরের সব শক্তি দিয়ে রেজার পেটে লাথি মারলো। দূর থেকে সেটা দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে এলো নিলি। ধাক্কা দিয়ে রেজোয়াকে সরিয়ে দিলো। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো রেজোয়ান। উঠার শক্তি নেই তাঁর। একে তো মাতাল তার ওপর মারামারি। তথাপি টেবিলের কোনা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো।
রেজাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়েছে নিলি। উঠে দাঁড়িয়ে নানারকমভাবে রেজোয়ানকে দোষারোপ করলো রেজা। যেন তাঁর কোন দোষই নেই। এদিকে রেজোয়ান তখনো চিৎ হয়ে পড়ে ছিলো। তাঁর দৃষ্টি নিলির দিকে। নিষ্ঠুর মেয়েটা রেজাকে নিয়েই ব্যস্ত। অথচ মার খেলো সব রেজোয়ান। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, ঠোঁট কেটে গেছে। সেদিকে নিলির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে রেজার হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে গেলো রেজোয়ানের। এত নিষ্ঠুর! এত পাষাণ! কবে থেকে হলো নিলি।
মারামারির খবর শুনে দৌড়ে এলো জাহিদ। রেজোয়াকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হস্পিটালে নিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি।
★
পেটের ওপর আইস ব্যাগ ধরে আছে রেজোয়ান। জাহিদ তাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। খবর পেয়ে তিন্নিকে নিয়ে দেখা করতে এসেছে শায়লা মুরসালীন। জাহিদকে দেখে বহু কষ্টের মাঝেও হাসি চলে এলো তিন্নির। বউদের মতন রেজোয়ানের সেবা করে জাহিদ। ফিক করে হেসে দিলো সে। তাঁকে হাসতে দেখে জাহিদ বিব্রত হলো। শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘স্যার কিছুই খাচ্ছেন না ম্যাম। খালিপেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।’
শায়লা মুরসালীন গম্ভীরমুখে স্যুপের বাটিটা ওর হাত থেকে টেনে নিলেন। চামচে করে ছেলের মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,
-‘নে ধর, এসব দেখার জন্যই আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই জন্য তোকে আমি পড়াশোনা শিখিয়েছিলাম। লজ্জা করলো না তোর? তুই কি গুন্ডা না বদমাশ? কেন মারামারি করতে গেছিলি?
রেজোয়ান খপ করে মায়ের হাতটা টেনে ধরলো। তারপর মায়ের কোলে মাথা রেখে অশ্রুসিক্ত, বিষন্ন গলায় বললো,’আমাকে জাস্ট আরেকবার সুযোগ দাও মা। নইলে নিলির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ওকে আমি ভালোবাসি। ওর কোন ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারবো না। প্লিজ মা! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি এবার যদি ওকে ফেরাতে না পারি তবে তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। কিন্তু আরেক একবার সুযোগ দাও মা! প্লিজ!’
শায়লা মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর ছেলে ঐ সর্বনাশী মেয়েটার মাঝে কি পেয়েছে তিনি জানেন না। মায়ের দুঃখ, তিন্নির দুঃখ কারো দুঃখ রেজোয়ানের চোখে পড়ে না। সে কেবল আছে ঐ স্বার্থপর মেয়েটাকে নিয়ে। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন,’তুই ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেছিস রেজোয়ান। মায়ের দুঃখ এখন আর তোর চোখে পড়ে না। মা আর তোকে কিচ্ছু বলবে না। তোর যা ভালো মনে হয় কর।’
রেজোয়ান করুণ চোখে জাহিদের দিকে চাইলো। একমাত্র জাহিদ ছাড়া কেউ তাঁর দুঃখ টা বোঝার চেষ্টা করে না। নিলিও না। সবাই নিজের মত করে রেজোয়ানকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায়।
জাহিদ রেজোয়ানের অবস্থা দেখে মনে মনে দুঃখ বোধ করলো। একটা মানুষ সবার কাছে অপরাধী। সবাই তাঁর বাহিরের হাসিমুখটাই দেখে। ভেতরের কষ্ট কেউ বোঝে না।
শায়লা মুরসালীন তিন্নিকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। রেজোয়ান তখন তিন্নির সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাইলো। তিন্নি অবাক হলেও প্রতিবাদ করলো না।
-‘কেমন আছিস তিন্নি?’
-‘ভালো।’
-‘পড়াশুনা ঠিকমত করছিস?’
-‘করছি।’
রেজোয়ান স্থিরভাবে কিছুক্ষণ তিন্নির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’একটা প্রশ্ন করি তোকে?’
-‘কি প্রশ্ন?’
-‘তোর কি মনে হয়? আমি সত্যিই স্বার্থপর?’
-‘হ্যাঁ। আপনি খুব স্বার্থপর।’
রেজোয়ান হাসলো। মলিন হাসি। নিলির আজকের এমন নিষ্ঠুর আচরণ ভীষণভাবে আঘাত করেছে তাঁকে। নিলি তাঁর প্রতি এতটা কঠোর হবে ভাবতে পারে নি। বললো,’ সেজন্যই সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই না?’
-‘হয়ত বা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্যি যে মেয়েরা আপনার মতন স্বার্থপর প্রেমিকদেরই বেশি ভালোবাসে। তাঁরা চায় তাঁদের প্রেমিক পুরুষটি এমনি করে সারাজীবন ভালোবাসুক তাঁদের। ‘
-‘ঠাট্টা করছিস?’
-‘মোটেও না। আমার জন্য কেউ এমনভাবে স্বার্থপর হলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। আপনার ভালোবাসার রাজকন্যাটি বোকা। তাই সে আপনার ভালোবাসা বুঝতে পারছে না।’
রেজোয়ান অবাক হলো। তিন্নি আসলেই অনেক বড় বড় গেছে। অদ্ভুত সুন্দরভাবে ভালোবাসার কথা বলছে।
-‘তুই এত সুন্দর করে কথা বলা শিখলি কবে থেকে রে তিন্নি?’
তিন্নি হাসলো। নিষ্প্রাণ, নিস্তেজ হাসি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আপনি আমার প্রশংসা করবেন না রেজোয়ান ভাই। সহ্য হয় না। আপনার সাথে আমার ঝগড়ার সম্পর্ক!’
এরপর বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো তিন্নি। রেজোয়ান মলিন মুখে চেয়ে রইলো তিন্নি বেদনাতুর মুখখানার দিকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। অপরাধবোধ হচ্ছে। তিন্নিকে সে কোনদিন ভালোবাসে নি। এমন খেয়াল কখনো মস্তিষ্কে উদয়ই হয় নি। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা যে ভুল করে তাঁকে এতটা ভালোবেসে ফেলবে এটা সে বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো ইনফ্যাচুয়েশন। সময় দিলে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তিন্নিকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে রেজোয়ান। আরো আগেই বাসাটা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো তাঁর। তাহলে তিন্নির চিন্তাধারা এতদূর গড়াতো না। শায়েলা মুরসালীনও এতটা বাড়াবাড়ি করতে পারতেন না।