#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৯
আজকে একসপ্তাহ বাদে অফিসে জয়েন করেছে নিলি। শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল। কাজে যোগ দিতে একদম মন চাইছিলো না। কিন্তু উপায় নেই। রেজোয়ান সাফ জানিয়ে দিয়েছে ছুটিতে থাকাকালীন সময় বেতন কাটা হবে। তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে জয়েন দিয়েছে। এদিকে নিজামউদ্দিন সাহেবের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। শ্বাসের টান বেড়েছে। নিলির ভাগ্য ভালো সে, জেলে থাকাকালীন পাশের কিছু প্রতিবেশী উনার দেখাশোনা করেছেন। নইলে জেল থেকে বেরিয়ে বাবার মুখ আর দেখা হতো না নিলির।
ইনফরমেশন লিকের আসল সত্যিটা বের হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নিলির প্রতি অফিসের কলিগদের আচরণের কোন পরিবর্তন হয় নি। একে তো নিম্ন পদমর্যাদার কর্মচারী তার ওপর কলিগদের অবস্থা এমন যেন জেল থেকে বেরিয়ে কোন ঘৃণিত কাজ করে ফিরে এসেছে সে।
★
দুপুরের দিকে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিলো নিলি। লাঞ্চের একটু আগে একজন সিনিয়র অফিসার, এসে নিজের তিনখানা ফাইল ধরিয়ে দিলেন ডেটা চেক করার জন্য। ফাইল টেবিলের ওপর রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন লাঞ্চ করতে। তিনি বেরিয়ে গেলে তাঁর পাশের দুজন মিলে নিলিকে পাঠালেন চা করে আনার জন্য।
নিলির আত্মসম্মানে লাগলো খানিকটা। এরা চাকর বাকরের মতন ট্রিট করছে নিলির সঙ্গে। অথচ এই কয়বছরে সে কষ্ট করেছে ঠিকই কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাতে নি। আত্মসম্মান নিয়েই চলেছে।
তথাপি প্রতিবাদ করলো না। চাকরীটা এখন তাঁর একমাত্র সম্বল। চুপচাপ চা এনে দিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। তাঁকে প্রতিবাদ না করতে দেখে পেছন থেকে একজন শিষ বাজালো। আরেকজন কমেন্ট ছুঁড়ে দিলো জেল খাটা আসামীর সঙ্গে ডেস্ক শেয়ার করতে পারবে না তাঁরা। প্রয়োজনে এই নিয়ে রেজোয়ানের সঙ্গে কথা বলবে।
নিলি শুনেও না শোনার ভান করে রইলো। কিন্তু থেমে রইলো রইলো কমেন্টকারী। নিলির জেলে যাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ রসাত্মক গল্প শুরু করে দিলো অফিসের সবার সঙ্গে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব শুনতে ভালো লাগছিলো না নিলির। ফ্রেশ হওয়ার বাহানায় ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
রেজোয়ানের সঙ্গে রেজা গ্রুপের একটা মিটিং শেষ করে সবে অফিসে ঢুকছিলো জাহিদ। ভেতরে ঢুকতেই কলিগদের কথোপকথন কানে এলো। নিলিকে হাসিঠাট্টা করছে সবাই। এগিয়ে এলো সে। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? তাঁকে দেখে গুঞ্জন থেমে গেলো। কেউ কেউ আবার মুখ টিপে হাসা শুরু করলো। বলা বাহুল্য, নিলির প্রতি সিমপ্যাথি থাকার কারণে অফিসের সবাই ইদানীং তাঁকে নিয়েও ঠাট্টামশকরা শুরু করে দিয়েছে।
তাঁকে উদ্দেশ্যে একজন নিচুস্বরে ফিসফিস করে বললো,’ঐ যে এসে গেছে। চোরের সাক্ষী কোতোয়াল!’
কথাটা কানে এলো জাহিদের। রেগে যাওয়ার পরিবর্তে উলটে মুচকি হাসলো সে। কমেন্ট কারীর উদ্দেশ্য করে বার তিনেক তুড়ি বাজিয়ে বললো,’মি.হাসান? কি মনে হয় আপনার? আমি বোকা? স্যারের পার্সনাল সেক্রেটারি হয়ে কেন একজন সামান্য ক্লার্কের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি? তাহলে শুনুন মি.হাসান। আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাদের বোকা নই। আমি ভাল করেই জানি কোথায় কি করতে হয়। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, একটা কথা আপনাদের সবাইকে জানিয়ে রাখি , বস কিন্তু কাউকে ছাড়বে না। যারা যারা উনার সঙ্গে মিস বিহেভ করছেন, ইচ অ্যান্ড এভ্রি পার্সনকে টার্গেট করে রেখেছেন বস। সময়মত ঠিক বুঝতে পারবেন।’
তাঁর কথা শুনে দপ করে নিভে গেলো প্রত্যেক হাস্যরত ব্যক্তির চেহারা। অবাক, বিস্মিত চাহনি নিয়ে চেয়ে রইলো জাহিদের দিকে। জাহিদ তাদেরকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এরপরেও যদি এরা সাবধান না হয় তাহলে আর কিছুই করার নেই তাঁর।
★
জাহিদ আসার ঘন্টাখানেক বাদে অফিসে এসে ঢুকলো রেজোয়ান। রেজা গ্রুপের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকাটা আদায় করে নিয়েছে সে। ভেতরে ঢুকেই জাহিদকে খবর পাঠালো নিলিকে ডেকে আনার জন্য।
রেজোয়ান ডাকছে নিলির পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আজকে আবার কি ঘটেছে! রেজোয়ান এসেই তাঁর খোঁজ করছে? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো অন্তত আজকের দিনে যেন কোন খারাপ খবর শুনতে না হয়। এমনিতেই শরীর ভালো নেই। তারওপর কোন দুঃসংবাদ সহ্য হবে না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো সে। রেজোয়ান লাঞ্চ করছে। হাত ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বললো।
ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো নিলি। রেজোয়ান তাঁকে বসতে বললো না। নিলিকে দাঁড় করিয়েই লাঞ্চ শেষ করলো। খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,’আজিজের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশনের জন্য পুলিশ আপনার বাসায় যেতে পারে কিংবা অফিসেও আসতে পারে। আমি আশা করবো আপনি তাদের কোন রং ইনফরমেশন দেবেন না।’
নিলি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। এরমানে কোনরকম রং ইনফরমেশন দেবে না সে।
-‘আজ অথবা কাল এই দুদিনের ভেতরই আসবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে বলতে না পারলে জাহিদকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন। উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই।’
-‘ঠিক আছে।’
-‘শুনুন?’
-‘জি?’
-‘যা-ই বলবেন না কেন কম্পানীর সম্মানের বিষয়টা অবশ্যই মাথায় রাখবেন।’
আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো নিলি। রেজোয়ানের একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হাত দুটো চেপে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিলি। সেদিনের পর থেকে রেজোয়ানকে অসম্ভব ভয় পায় সে। তাঁর বুঝতে বাকি নেই, যতই কান্নাকাটি,যতই ক্ষমাপ্রার্থনা করুক না কেন তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না রেজোয়ান। নিলিকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে সে।
কিন্তু সত্যি কি তাই? সত্যিই কি নিলিকে ঘৃণা করে রেজোয়ান? নাকি জোর করে ঘৃণা করতে চাইছে? ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
ভুলটা সেদিনই করে ফেলেছে রেজোয়ান। নিলিকে চাকরীটা দেওয়া মোটেও উচিত হয় নি। এখন না চাইতেও মন বারবার এই লোভী, স্বার্থপর মেয়েটার কথাই ভাবছে। নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।
★
ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক! নিলির বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাচ্ছে। রেজোয়ান তাঁর একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
তাঁর প্রতিটা নিশ্বাস গুনতে পারছে নিলি। পারফিউমের গন্ধ অনুভব করতে পারছে।
রেজোয়ান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। আচ্ছন্ন গলায় বললো,’আই হ্যাভ অ্যান অফার ফর ইউ?’
ভয়ে,অস্বস্তিতে কথা বলতে পারলো না নিলি। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রেজোয়ান তাঁর আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,’ইউ ক্যান সার্ভ মি। পার নাইট টুয়েন্টি থাউজেন্ড!’
অপমানে রক্ত সরে নিলির মুখ থেকে। বিস্ময়ে চক্ষু কোটরাগত! রেজোয়ান সেসব পাত্তা না দিয়ে নতুন করে যোগ করলো,’ডোন্ট ওরি। ইট’স আ ডিল। নো ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্ট!’
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো নিলি। এতবড় অপমান সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই। নিজেকে শান্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে বললো,’আর কত অপমান করবে? আর কত অপমান করলে শান্তি হবে তোমার?’
তাঁর চোখের পানি রেজোয়ানের মুখের হাসি কেড়ে নিলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। বুক ভর্তি হাহাকার নিয়ে কৃত্রিম হেসে বললো,’তুমি আমাকে যেই আঘাত দিয়েছো তাঁর কাছে এইসব অপমান কিছুই না মিসেস মুবিন তালুকদার। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমার গলাটা টিপে ধরে কলিজটা ছিঁড়ে নিতো। আর না হলে প্রথমদিনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিতো।’
এত ঘৃণা আর সহ্য করতে পারছিলো না নিলি। বিনাদোষে এতগুলো দিন সাজা ভোগ করেছে। তবুও নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার কোন চেষ্টা করে নি। কারণ তাঁর মনে হয়েছে যার ভালোবাসা যত বেশি তাঁর ঘৃণার পরিমাণও ততো বেশি। কিন্তু আজকে আর পারলো না। রেজোয়ান ঘৃণার মাত্রাটা দিনদিন বাড়ছে।
চোখভর্তি পানি নিয়ে বললো,’তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমি টাকার জন্য মুবিনকে বিয়ে করেছিলাম?’.
-‘করো নি?’, অবাক হওয়ার ভান করলো রেজোয়ান। তাঁর চোখেমুখে তিরস্কার।
-‘ওরা তোমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো।’, বলতেই বলতেই নিলি কেঁদে ফেললো।
কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো রেজোয়ান! কি বলছে নিলি! তবে কি তাঁর ধারণা ভুল?
না মিথ্যে বলছে নিলি। টাকার জন্যই রেজোয়ানকে ছেড়ে গিয়েছিলো সে। নিজেকে সামলে নিয়ে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,’সেটা তুমি আমাকে এতদিন পরে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে? কেন?’
নিলি জবাব দিলো না। রেজোয়ান ফের ঠাট্টার সুরে বললো,’দয়া করে এসব কান্নাকাটির ড্রামা বন্ধ করো প্লিজ। বিপদে পড়ে এখন নিজের দোষ কাটাতে চাইছো তো? কোন লাভ নেই। তোমাকে আমি চিনে গেছি। এরবেশি চেনার রুচি আর নেই।’
নিলি আর টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। নির্বাক দৃষ্টিতে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে থেকে মলিন হাসলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করে,’তুমি প্রয়োজনের চাইতে সত্যিই অনেক বেশি চিনে গেছো আমাকে রেজোয়ান। এতটা না চিনলেই বোধহয় ভালো হতো।’
-‘রেজোয়ান? হোয়াই আর ইউ কলিং মি উইথ মাই নেইম? হোয়াট ডু ইউ থিংক? ইউ ক্যান কল ইউর বস উইথ হিজ নেইম?’
-‘সরি।’
অনুমতির অপেক্ষা করলো না নিলি। বেরিয়ে গেলো। সে যাওয়ার সময় রেজোয়ান পুনরায় চেঁচিয়ে উঠে জানালো তাঁর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে ভুল করেছে নিলি। রেজোয়ানের সঙ্গে রাগ দেখানোর কোন অধিকার তাঁর নেই। সে যেন নিজের বিহেভিয়ার কন্ট্রোলে রাখে।
কিন্তু নিলি বেরিয়ে যাওয়ার আধঘন্টা বাদেই দিনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটলো রেজোয়ানের সঙ্গে। জাহিদের হাতে করে রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে নিলি। সেটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জাহিদের দিকে চেয়ে রইলো রেজোয়ান। একেবারে ব্ল্যাংক রিয়েকশন দিয়ে গম্ভীরমুখে বললো,’তাঁকে ডাকো।’
-‘উনি বেরিয়ে গেছেন স্যার। যাওয়ার সময় আমার হাতে এটা দিয়ে গেছেন।’
চোখ বন্ধ করে বড় নিশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। ভালো হয়েছে নিলি চাকরী চেয়ে দিয়েছে। এখন আর তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না রেজোয়ানের।
কিন্তু মন থেকে খটকা দূর করতে পারলো না। এত দিনের এত অপমান, এত লাঞ্ছনা সব সহ্য করে অফিসে কাজ করে গেছে নিলি। কোনদিন কোন প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু আজকে হঠাৎ এমন কি হলো যে তাঁর দুটো কথাতে সে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো? তবে কি নিলির সত্যিই কোন দোষ ছিলো না? রেজিগনেশন লেটারটা টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলো সে। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
এতদিন ভালোবাসার মানুষের সমস্ত অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে নিলি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের অপমান সহ্য করা গেলেও ভালোবাসা নিয়ে অপমান সহ্য করা যায় না। রেজোয়ান আজকে তাঁর ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সব শুনেও তাঁর ভালোবাসাকে অপমান করেছে।
একমূহূর্তেই নিজের দৈন্যদশার কথা ভুলে গিয়ে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো নিলি। ভুলে গেলো এই চাকরীটা ছাড়া তাঁর অসুস্থ বাবার মুখে খাবার জুটবে না। রেজিগনেশন লেটারটা জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।