তুমি নামক প্রাপ্তি’ পর্ব-২৩

0
1853

#তুমি_নামক_প্রাপ্তি
#part:23
#Suraiya_Aayat

মিনহাজ সাহেবের কথা শুনে আরিশের মনে হাজারো কথা ঘুরপাক খেতে লাগল , আজকে ওর আম্মুর বলা কথাগুলো মনে পড়ছে , আর সেগুলোর সাথে মিনহাজ সাহেবের কথার মিল আছে , আর প্রতে্্যকটার সাথে এক একটা কথা মেলানোর চেষ্টা করছে ৷ আরিশ সমস্ত কিছু প্রথম থেকে ভাবতে লাগলো ৷

আরিশ ফিরে গেলসেই দিনের কথায় যেদিন শপিংমলে ও ওর আম্মুকে চিনতে অস্বীকার করেছিলো ৷ আরিশ বাসায় গিয়ে অনেক ভেবেছিল যে ওর আম্মুকে সব বলে দিবে না হলে পরে জানতে পারলে ওর আম্মু খুব কষ্ট পাবে,তাই সেদিন রাত একটার সময় আরিশ ওর নিজের বাসায় যায় গিয়ে ওর আম্মুর সাথে দেখা করে ৷
আরিসের এখনো মনে পড়ে সেদিন ওর আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে কান্না করেছিলেন অনবরত ৷ এত বছর ছেলের থেকে দূরে থাকার কষ্টটা খুব ভালো ভাবে প্রকাশ করেছিলেন তিনি ৷ আরিশ ও ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল অনেক ৷ প্রিয়জনদের কে ছেড়ে থাকার যে কষ্টটা সেটা কান্না করে হলেও খানিকটা কমে ছিল ৷ কান্না হলো কষ্ট প্রকাশের একটা অনন্য মাধ্যম ৷

আরিশ ওর আম্মুর চোখের জল মুছে দিয়ে বলল “আম্মু এখন কাঁদলে হবে না ,এখনো অনেক কিছু করা বাকি ৷ আমি একটা বড় কিছু করতে যাচ্ছি তবে তার আগে তোমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে তাই তোমার সাথে আজকে দেখা করতে এলাম ৷”

আরিসের ফিরে আসার খুশিতে উনার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো ৷ আরিশের গালে হাত রেখে বললেন
” কি বলবি আব্বু বল ৷ যা মন চাই বল ৷”

“আমি যেটা বলব সেটা তোমার শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে এমনকি তুমি আমাকে অবিশ্বাসও করতে পারো কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি ৷ তোমার ভাই আরমান সাহেব উনি একজন অপরাধী , নোংরা এবং নিকৃষ্ট একটা মানুষ ৷ উনি নারী পাচারের সাথে যুক্ত এমনকি নিজের মেয়ে আরূ কেও টাকার জন্য বিক্রি করে দিতে উনি একবারও দ্বিধাবোধ করেননি ৷ সৌভাগ্যবশত আরুর সাথে এখনও কোন খারাপ ঘটনা ঘটেনি তবে খুব শীঘ্রই ওর সাথে খারাপ ঘটনা ঘটবে ৷ আর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমার এই গোপনীয়তা ৷ তাই তুমি আমাকে বাধা দিলেও তোমার কথাটা হয়তো আমি রাখতে পারব না ৷”

আরিশের মা অনিকা খান আরিসের মুখ থেকে এমন কথা শুনেও যেন অবাক হলেন না, বরং চুপ হয়ে রইলেন তা দেখে আরিশ একবার ওর আম্মূর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো “আমি জানিনা তুমি আমার কথা কতটা বিশ্বাস করছো কি বিশ্বাস করছ নি তবে উনি যা করেছেন তাতে উনি শাস্তির যোগ্য ৷ উনি শুধু আরুর সাথে নয় , এমন আরও খারাপ কাজ করেছে আরও মেয়েদের সাথে ৷ উনার জন্য আজ কত মেয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন কে হারিয়েছে তার কোন হিসাব নেই ৷ এই অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত আর উনার সঙ্গে এই কাজের সাথে যারা যুক্ত আছে তাদেরকে শাস্তি দেয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন কাজ করার সাহস না পায় ৷”

অনিকা খান এখনো চুপ ৷ ওনাকে এখনো চুপ থাকতে দেখে আরিশ ওনার হাতের উপর হাত রেখে বললেন “আম্মু তুমি কিছু বলছেন না যে ,আমার কথা তোমার বিশ্বাস হলো না তাই না !”

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন
” আরু কখনোই আরমান ভাইয়ের মেয়ে ছিল না , এমনকি আহান ও ভাইয়া সন্তান নয় ৷’

উনার কথা শুনে আরিশের কপালের ভাঁজ গুলো গভীর হলো ৷উনি যা বলছেন তা অনেকটা আজগুবি গল্পের মতো শোনাচ্ছে আরিশের কাছে ৷ বারবার শুনছে আর অবাক হচ্ছে ৷
আরিশকে আরো অবাক করে দিয়ে অনিকা খান আরও বললেন
“ভাইয়া যখন ভাবিকে বিয়ে করে তখন ভাবি হয়তো তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা হবেন আর আহনের বয়স তখন চার কি পাঁচ বছর ৷ ভাইয়া ভাবি কে পছন্দ করত, তাই ভাবির বাবাকে টাকার লোভ দেখিয়ে ভাবির সাথে ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেয় ৷”

ওনাকে থামিয়ে দিয়ে আরিশ প্রশ্ন করে উঠলো
” তাহলে আরুর মা মানে আফসানা আন্টির স্বামী উনি আফসানা অ্যান্টিক এত সহজে ছেড়ে দিলেন ?উনি নিজের বউকে কেন নিজের কাছে রাখলেন না ?আবার কেন বিয়ে করতে দিলেন !”

“আমি যতদূর জানি ভাবির প্রাক্তন স্বামী একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন , উনি দীর্ঘ কয়েক মাস বাসার বাইরে থাকায় সেই সুযোগ নিয়ে ভাইয়া ভাবিকে বিয়ে করে তারপর দীর্ঘ সাত বছরের জন্য ভাবিকে গৃহবন্দী করে রাখে , যদিও এর মাঝে ঘটে যাওয়া হাজারো ঘটনাগুলো ভয়ংকর ,যার কোনটাই আমার জানতে বাকি নেই ৷”

এত কিছু শোনার পর আরিশ এর মধ্যে সব কিছু জানার কৌতূহল আরো বেড়ে গেল, ও আরো কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
” আর কি হয়েছিল আম্মু ?’

তারপর অনিকা খান আরিশকে সবটা বললেন, সমস্ত টা শুনে আরিসের সারা শরীর শিউরে উঠলো ৷ আজ ওর আম্মু ওকে এগুলো না বলেও হয়তো কখনো জানতেই পারতো না ৷

নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে বলে উঠল
” আফসানা আন্টিকে তার হাজবেন্ড আর কখনো খুঁজে পাইনি?”

“পেয়েছিল তবে ভাবি আর তখন ফিরে যেতে চাইনি ৷ বুঝতেই তো পারছিস যে পরিবেশে চলে গেছিল ভাবি সেই পরিবেশ থেকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে ফেরার হয়তো আর কোননো ইচ্ছেই ছিলো না আর ৷”

“তুমি এগুলো আর এত কিছু কি করে জানলে ?”

“আমি জানি সব কিছুই , আর তুই যা করছিস তাতে আমি মোটেও রাগ করিনি বরং তাকে সমর্থন করছি ৷ আমার ভাই যদি সত্যিই এত নিকৃষ্ট মানের কাজ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তার শাস্তি পাওয়া উচিত, এতে তোকে যতটা সাহায্য করার হয় আমি করবো, সবসময় তুই আমাকে পাশে পাবি ৷”

আরিশ ওর আম্মুর কোলে মাথা রেখে বলল
” আমি আমার আরুপাখিকে আর আর্শিয়ানকে খুব ভালোবাসি আম্মু , আমি আর ওদেরকে হারাতে চাই না , ওকে আর আর্শিয়ানকে হারালে আমি আর বাঁচবো না ৷”

আরিশ এর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
” সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ তবে একটা জিনিস ভেবেই ঘিন্না লাগছে যে আমার ভাই নিজের কার্যসিদ্ধি করার জন্য তার বোনের ছেলেকে মেরে ফেলতেও পিছুপা হয়নি ৷”
কথটা বলে উনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন ৷

আরিশ ওর আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, এসব পুরোনো কথা ভাবলেই ওর শরীর শিউরে উঠে ৷

আরিসের ভাবনা ভাঙিয়ে মিনহাজ সাহেব বলে উঠলেন
“তুমি কি আমার কথা শুনছো আরিশ?”

আরিশ নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে উঠলো
“হ্যাঁ আঙ্কেল শুনছি তো ৷”

আরিশ নিজের কৌতুহল টাকে ভাঙার জন্য প্রশ্ন করে উঠলো
” আপনাকে একটা কোশ্চেন করতে পারি ?”

” ইয়াহ, সিওর বলো ৷”

“আপনার ওয়াইফের নাম কি ?আইমিন বলতে চাইছি আপনার মুখ থেকে তো ওনার কথা সেইভাবে শোনা হয়নি আর আজকে আপনি যখন বলছেন তাই জানতে ইচ্ছা করলো আরকি, তাছাড়া আপনার ওয়াইফ আপনাকে হঠাৎ ছেড়ে চলে গেল কেন? আর আপনাদের কোন সন্তান ছিল না ?”

ওনার চোখের কোনে জল, উনি চোখের জলটা মুছে আরিশকে বললেন
“সে অনেক বড় কাহিনী,আজ নয়, এটা অন্য একদিন বলব তোমাকে ৷”

“আচ্ছা তা না হয় বুঝলাম , তা আপনার ওয়াইফের নামটা বললেন না তো ! আর আপনার ছেলে মেয়ের ব্যাপারে কিছু !”

” ওর নাম আফসানা ৷ আমার তখন চিটাগংগে ডিউটির জন্য আমি 5 মাস বাসার বাইরে ছিলাম, আমার একটা ছেলে ছিল তার নাম আহান তখন তার পাঁচ বছর বয়স ছিলো, আর আমার স্ত্রী সেইসময় প্রেগনেন্ট ছিল ৷ কোন এক সময় জতে পেরেছিলাম যে আমার একটা মেয়ে হয়েছে তবে তাকে এখনো দেখঊ উঠতে পারিনি,এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ রয়ে গেল ৷”

এটুকু বলতে না বলতেই আরিশ ওনাকে থামিয়ে দিলো,এরপর যা ঘটেছে তার সব ই আরিশের জানা ৷ এই নোংরা ইতিহাস শোনার মত আর ধৈর্য্য আরিশের মাঝে নেই ৷ তাই মিনাহাজ সাহেব কে থামিয়ে দিয়ে বলল
” আঙ্কেল আপনি পুরনো সবকিছু ভুলে যান ,তবে একটা জিনিস জানতে ইচ্ছা করছে আপনার সাথে আজকে আন্টির দেখা হয়েছে তাই না ! আপনি আজকে ওনার থেকে কিছু জানতে চাননি ?”

” আমি তার কাছ থেকে কেবল মাত্র একটাই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে আমার মেয়ের নাম টা কি ?সবকিছু জানলেও আমি তার নামটা জানি না, জানলে হয়তো বেঁচে থাকতে একটু হলেও শান্তি পেতাম না হয় তাকে একবার খুঁজে বার করার চেষ্টা করতাম আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতাম যে
” আমি তোমার খুব কাছের কেউ না হতে পারলেও কখনো তোমার কাছের একজন ছিলাম ৷”

উনার কথার মধ্যে দিয়ে একরাশ বুকচেরা কষ্ট বেরিয়ে আসছে ৷ সুন্দর মুহূর্তটা যেন নিমিষের মধ্যে কষ্টে ভরে গেল ৷

লাঞ্চ টাইমে আজকে আরু, আর্শিয়ান আর লারা বেরিয়েছিল লাঞ্চ করার জন্য ৷ ওদের অফিসের কাছেই রেস্টুরেন্টটা ৷ ওদের লাঞ্চ কমপ্লিট ৷ লারা আর আর্শিয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর আরু টাকা পে করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে গেলেই হঠাৎ আরিসের মত কাউকে দেখে থেমে গেল ৷ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখতেই বুঝলো যে সেটা নিহান আর তার সামনে বসে আছে মিনহাজ সাহেব ৷ মিনহাজ সাহেবের সাথে আরিশের যোগসুত্রটা ঠিক কোথায় তা আরু বুঝতে পারল না ৷
তবে এটা ও পরে মিনহাজ সাহেবের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে জানবে ৷ এটা ভেবে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল ৷

💖

আফসানা বেগম বাসায় ঢুকতেই আরমান সাহেব গলা খাকিয়ে বলে উঠলেন
” কোথায় গিয়েছিলে?”

আফসানা বেগম আরমান সাহেবের দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে বলল
” আরিশের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, কেন তোমার কোন সমস্যা?”

আফসানা বেগমের এমন কথা শুনে আরমান সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল , আরিশ ! আরিশ কোথা থেকে আসবে আবার ! নিজের চোখের সামনে আরিশকে যে কে মরতে দেখেছিলেন ৷ উনি এবার ভয় পেয়ে গেল ৷
ওনার কথাগুলো জড়িয়ে আসছে,আর সেভাবেই বলল
” তুই কি মজা করার আর জায়গা পাস না! বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে? কোথা থেকে আসবে আবার আরিশ , সে তো নিখোঁজ ৷”

“হারিয়ে যাওয়া মানুষের ফিরে আসতে সময় লাগে না সেটা হয়তো তোমার জানা নেই ৷”
কথাটা বলে ওয়াস রুমে ঢুকে যেতে গেলেই আরমান সাহেব বলে উঠলো
” তার সাথে কি কথা হলো ! সেকি আবার ফিরে আসবে নাকি আসবে না, আর কোথাই বা থাকে এখ সে ?”

“সে দাবি করেছে যে সে আরিস নয় তার নাম নিহান ৷ তবুও আমি জানি সে আরিশ ৷ বনানী 1 নাম্বার রোডে থাকে ৷ তুমি চাইলে তা সঙ্গে দেখা করে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারো, যদি এটুকু একটা ভাল কাজ করো তাহলে হয়তো তোমার দ্বারা আমার মেয়ের জীবনটা বেঁচে যায় ৷”

আরমান সাহেব ভাবতে বসে গেলেন , কোন উত্তর দিলেন না ৷ এখন কি করা যায় ! আবার আরিস কে মারতে হবে ৷ অথবা কালকের মধ্যেই আরুকে পাচার করতে হবে ৷ তারপর না হয় আরিশকে মারবে ৷

আফসানা বেগম ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলেন ৷
নিজের মনেই বিড়বিড় করতে আরম্ভ করলেন
” তোমার কুকর্মের জালেই তোমায় ফাসাবো ,তারপর,,,,,”

#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here