তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী(৩)
#লাবিবা_ওয়াহিদ
০৩.
আধঘন্টা ধরে দুই হাত মুঠিবদ্ধ করে রোবটের মতো বসে আছে সানাম। তার সামনে পায়ের উপর পা তুলে, পান চিবুতে চিবুতে সানামের পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে ফারিশের নানী। ইকরাম ফরিদ দূরে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করলেও শ্বাশুড়ির ভয়ে সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। এমনও হতে পারে বাইরের মেয়েটার সামনে তার ইজ্জতহরণ করে দিবে। নানী পান ফেলে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই ফারিশ এসে হাজির হলো গায়ে জ্যাকেট জড়াতে জড়াতে।
-“সানাম, রেডি হয়ে নাও। মা নাকি তোমায় এডমিশনের কথা বলেছিলো! কাল আমি যেতে পারবো না, আমার অফিস আছে। তাই আজ চলো।”
-“এডমিশান! কিয়ের এডমিশান? এই মাইয়া ঘাড়ের উপ্রে বইয়া খাইবো আবার পড়ালেহার ট্যাকাও উষুল করবো! ফারিশ তোরে আমি সাবধান কইরা দিতাসি এইসব মাইয়ার থেইকা দূরে থাক!”
-“তোমারে কে বললো নানী যে আমরা তার খরচ বহন করবো? সব তো আঙ্কেলের টাকাতেই, আমরা শুধু ব্যবস্থা করছি, এ-ই তো! তুমি না বুঝে বেশি বলো কিন্তু নানী! মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখো, স্বার্থপর আর ঈর্ষান্বিত হয়ে দুনিয়া চলে না। আর সানাম, তোমাকে কী বলেছি শুনতে পাওনি? যাও গিয়ে রেডি হও।” কিছুটা ধমকের সুরে বললো ফারিশ। ফারিশের ধমক খেয়ে সানাম চলে গেলো নিজের ঘরে।
নানী ফারিশের কথায় রেগে গেলেও শেষে ফারিশ ধমক দেয়ায় নানী দমে গেলো। সে চায় এতিম মেয়েটাকে এভাবে ধমকের উপর রাখতে। নানী নিজের পানের ডাব্বা নিয়ে আস্তেধীরে নিজের ঘরে চলে গেলো। নানী চলে যেতেই ফারিশ জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। ফারিশের পানি খাওয়া শেষ হতেই ইকরাম ফরিদ এগিয়ে আসলো ফারিশের দিকে।
-“একেবারে ঠিক সময়ে এসেছিস ফারিশ। নয়তো প্রথমদিনেই তোর নানী মেয়েটাকে বদহজম করে দিতো।”
-“তুমি চিন্তা করিও না বাবা। ইনশাল্লাহ সবটা সামলে নিতে পারবো। সকালের মেডিসিন নিয়েছো?”
-“মেডিসিন না নিলে বুঝি তোর মা আমাকে ফেলে তার অফিসে যেতো? না খেলেও জোর করে খাইয়ে তারপর অফিস যায়!” মায়ের কান্ড শুনে ফারিশ মুচকি হাসলো। অতঃপর সানাম আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।
সানাম নিজের ব্যাগ খুলে একটা জামা নিতে গিয়েই দেখলো তার বাটন ফোনটা। ১০ মাস টাকা জমিয়ে ১২০০ টাকা দামের এই মোবাইলটি কিনেছিলো সানাম। ফোনটা আপাতত তার প্রয়োজন না তাই সে আবার ব্যাগেই রেখে দিলো। ভোরেই অন্তরা তার কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলো। সানাম সুন্দরভাবে রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। ফারিশ সানামের কাগজপত্রের ফাইলটা সানামকে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-“তো যাওয়া যাক। বাবা আসছি!”
-“হু। বাইক সাবধানে চালাবি!”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে সানামকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সানাম ফারিশের সাথে ভয়ে ভয়ে লিফটে উঠলো। ফারিশ ১ চাপতেই ডোর অফ হয়ে গেলো। এদিকে সানাম চোখ বুজে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। লিফট নামতেই সানাম গিয়ে ফারিশের উপর পরলো। ফারিশ সানামের বাহু অপ্রস্তুতভাবে ধরে ফেললো।
-“এতোটুকুতেই মাথা ঘুরায় তোমার?”
-“তো কি করবো! আমি কখনো এই লিফতে উঠেছি নাকি। আল্লাহ কী ভয়ংকর লাগছে!”
ফারিশ উত্তরে কিছুই বললো না। সানাম যেন আবার না পরে তার জন্য ফারিশ সানামের একহাত ধরে আছে। আর সানাম আরেক হাত দিয়ে ফারিশের জ্যাকেট খামচে ধরেছে। সানাম এবার ফারিশের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। ভীষণ সুদর্শন ফারিশ। ফারিশকে দেখে সানামের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো। এমন সুদর্শন আগে কখনো দেখেছে বলে তার মনে হয় না। হ্যাঁ দেখেছিলো এক স্টুডেন্টের বাসায়। তবে সেই ছেলের সাথে ফারিশের আকাশ পাতাল তফাৎ। কই ফারিশ আর কই ওই ছেলে। লিফট খোলার শব্দ কানে আসতেই সানামের ধ্যান ভাঙলো এবং সে সাথে সাথেই সানাম চোখ নামিয়ে ফেললো। ভাগ্যিস ফারিশ লক্ষ্য করেনি নয়তো ভীষণ লজ্জায় পরতে হতো তাকে। ফারিশ অনেক আগেই সানামকে ছেড়ে দিয়েছে। সানামকে ছেড়ে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে গ্যারেজের দিকে যেতে লাগলো। সানাম তো একপ্রকার ছুটছে ফারিশের সাথে। এতো জলদি কেউ হাঁটে নাকি? বাইকের কাছে আসতেই ফারিশ তার হ্যালমেট হাতে নিতে নিতে বলে,
-“বাইকে উঠো। বসতে পারবা নাকি উল্টে পড়বা? তোমার তো আবার সবকিছুতেই সমস্যা!”
ফারিশের খোঁচা মারা কথায় সানাম কিছুটা চটে গেলো। অতঃপর রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার কী ত্যাড়া কথা ছাড়া আর কিছু মুখে আসে না!”
-“যাক বাবা। আমি কখন ত্যাড়া কথা বললাম?”
-“তাহলে এভাবে ত্যাড়া করে খোঁচালেন কেন?”
-“তাহলে কী সোজাসুজি খোঁচাবো? আমি মেয়েদের গায়ে হাত দেই না!”
-“হুহ ঢং! কাল থেকে তো টানাটানির উপরেই আছেন আপনি! যত্তোসব!”
-“কিছু বললে?”
-“না বললাম, বাইকে কতো উঠেছি!” দাঁতে দাঁত চেপে বললো সানাম। সানামের কথায় ফারিশ সানামের দিকে ফিরে ভ্রু কুচকে বললো,
-“কার সাথে বাইকে উঠেছো?”
-“আপনাকে কেন বলবো?”
বলেই সানাম ফারিশের পিছের সিটে বসে পরলো। ফারিশ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চাবি দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। জোরে টান দিতেই সানাম অপ্রস্তুত হয়ে পরতে পরতে বেঁচে যায়। তাও সে এখন অবধি ফারিশকে ধরে বসেনি। ফারিশ লুকিং গ্লাসে সানামের অবস্থা দেখে বাইক থামিয়ে পিছে ফিরলো।
-“এতো ঢং করো কেন তুমি? এই না বাইকে কতো উঠসো এখন তো আরেকটু হলেই মুখ থুবড়ে পরতে। ধরে বসতে পারো না?”
-“আপনাকে ধরে বসবো আমি? আপনাকে ধরলে তো আপনার ছ্যাঁকা লাগে, তিলকে তাল বানাতে সময় নেন না!”
-“মেয়ে তুমি আসলেই একটা বাচাল! তোমার সাথে কথা বলে ফালতু সময় ওয়েস্ট করার মতো সময় আমার নেই! ধরে বসতে হলে বসো নয়তো ধাক্কা দিয়ে বাইক থেকে ফেলে দিবো, স্টুপিড!” অত্যন্ত রেগে কথাগুলো বললো ফারিশ। অতঃপর আবার বাইক টান দিতেই সানাম নিজের অজান্তেই ফারিশের জ্যাকেট হালকাভাবে খামচে ধরলো। পুরো রাস্তায় কারো কথা হলো না। তবে ভার্সিটির রাস্তায় ঢুকতেই সানাম বলে উঠলো,
-“আমার মনে হচ্ছে আপনার বাসায় থাকা ঠিক হবে না!” সানামের কথা শুনে ফারিশ সাথে সাথে বাইক থামিয়ে সানামের দিকে ফিরলো!
-“কেন? আমার বাসায় কী এমন সমস্যা তোমার?”
-“আপনার নানু মনে হয় আমাকে পছন্দ করে না।” সানামের কথায় ফারিশ একটা লম্বা শ্বাস ফেললো।
-“তোমাকে আমি কীভাবে বুঝাবো জানি না। তবে আমার নানী খিটখিটে মেজাজের। আমার মায়ের নানার বিগড়ে যাওয়া মেয়েও বলতে পারো, তাই তার ব্যবহারও তেমন। তাই নানীকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মা আছেন, বাবা আছেন। তারা আমার অনুপস্থিতিতে তোমায় প্রটেক্ট করবে। তাই আপাতত নানীর চ্যাপ্টার বাদ দাও। এখন শুধু আগামী দিন গুলো সম্পর্কে ভাবো!”
বলেই ফারিশ বাইক চালানোয় মনোযোগ দিলো। ভার্সিটি পৌঁছাতেই ফারিশ সানামকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ক্যাম্পাসে যেতেই প্রায় মেয়েরাই তাদের আড়চোখে দেখছে। তাদের বললে ভুল হবে, ফারিশকে দেখছে। সেসব ফারিশ লক্ষ্য না করলেও সানাম ঠিকই লক্ষ্য করছে।
-“আজব। ওনাকে এভাবে দেখার কী আছে? ওনার রূপ কী বেয়ে বেয়ে পরছে নাকি উনি কোনো ফিল্মের হিরো? এই মেয়েদের দিকে তো এই বদরাগীটার নজরই নাই। যাক, মেয়েদের দিকে নজর দেয় না এমন ছেলেও তাহলে দুনিয়ায় আছে।” আপনমনে বিড়বিড় করে বললো সানাম। ফারিশ সানামকে নিয়ে একেবারে প্রিন্সিপালের কেবিনে চলে গেলো।
~চলবে।