তোকে_ঘিরে❤ পর্ব_৩৭

তোকে_ঘিরে❤
পর্ব_৩৭
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

বুকের উপর ধাক্কা অনুভব করতেই সজোরে ছিটকে সিটের উপর উল্টে পরলো পূর্ব!ব্যালেন্স বিগড়ে ঘাড়ের বাঁদিকে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে চোখ কুঁচকে রইলো! হঠাৎ পকেটের ফোনটা বিকট রিংটোনে বাজতে শুরু করলে হাতড়িয়ে সে ফোনটা পিক করলো। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নাম দেখার সুযোগ পায়নি পূর্ব ওমনেই ওপাশ থেকে হাস্য কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

– কিও ভাই? কেমন আছেন?

পূর্ব ঘাড়ে হাত দিয়ে চোখ কুঁচকানো অবস্থায় সিট থেকে উঠতে চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না। ব্যথার ক্লিষ্টে সে আবার শুয়ে পরলো। অন্তত এটুকু আন্দাজ করতে পারলো ব্যথাটা খুবই তীব্ররূপে হচ্ছে। ঘাড়ের রগটা বুঝি ছিড়ে শেষ! অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে! এরই মধ্যে কানে দরজা লাগানোর শব্দ এলে কয়েক সেকেন্ড পর মনেহলো শার্টের কলার টেনে কেউ মাথাটা শূন্য তুলে ফেলেছে। ফোনের ওপাশে ‘হ্যালো হ্যালো’ কন্ঠ ক্রমাগত কানে আসলেও পূর্ব ব্যথার কাছে মাথানত করে পরিস্থিতির কাছে নিজেকে সপে দিতে বাধ্য হচ্ছিলো। ঘাড়ের অসাড়পূর্ণ ব্যথায় অন্য কেউ হলে কি থেকে কি করে ফেলতো আল্লাহ্ জানেন! মুখের উপর গরম নিশ্বাস এমনভাবে টের পাচ্ছিলো মধ্যবর্তী দূরত্ব তো নেই উল্টো নাকে নাক স্পর্শ করে লালচে ঠোঁটের উপর নিশ্বাসের তাপ অনুভূত হচ্ছে।

– নিজেকে ওয়েল স্ট্যান্ডার্ড পার্সোনালিটির ভাবতে ফ্যাবুলাস লাগে আপনার! আপনি খুব দামী লোক তাইনা ওয়াসিফ পূর্ব?

কানদুটো ভুল শুনলো নাকি? নাম ধরে ডেকেছে? কন্ঠে এতো রাগ? এতো তেজ? পূর্ব এবার বহুকষ্টে বীভৎস যন্ত্রণায় চোখ খুলে তাকালো, পূর্ণতা কলারটা এমনভাবে টেনে ধরেছে সিট থেকে মাথা কমপক্ষে একহাত উঁচুতে উঠে আছে। চোখেমুখে কি কঠিন রাগ! সামান্য সময়ের ব্যবধানে সবকিছু ওলোট পালোট করে কান্নায় চোখমুখ ফুলিয়ে নাকটা লাল করে এসেছে! গালদুটৌ লাল হয়ে আছে প্রচণ্ড কান্নার আবেশে। পূর্ব ঘাড়ের নিচ থেকে হাতটা এনে পূর্ণতার গাল স্পর্শ করলে পূর্ণতা রাগে কলার ধরে ঝাকি মারে! পূর্ব ব্যথার জায়গায় আরেকদফা ব্যথা পেয়ে চোখ পুনরায় কুঁচকে বলে,

– এই মেয়ে ব্যথা পাচ্ছি তো..

পূর্ণতা দাঁত কিড়মিড় করে কলার মুচড়ে ধরে সোজা বসিয়ে ছাড়ে পূর্বকে! পূর্ব সিট থেকে পা নামিয়ে ঘাড় ধরে দাড়িয়ে পরতেই পূর্ণতার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে দেখে ও সিটে পা উঠিয়ে আসন করে বসে আছে। পূর্ণতা না হয়ে যদি অন্য কোনো মেয়ে এমনকি পূর্বিকাও হতো পূর্ব ননস্টপ থাপ্পড় মারতে মারতে রাগ ঝাড়তো।। কিন্তু পূর্ণতার চোখের দৃষ্টি এমন ছিলো সামনে যদি একটা দিয়াশলাই রাখা হয় কাঠিতে ফট করে আগুন জ্বলে একটা উদ্ভট ব্যাপার ঘটতো! পূর্ব ঘাড়ে হাত ডলতে ডলতে কালো ডায়ালের হাতঘড়িটা সামনে এনে দেখলো সময় তিনটা পঁচিশ বাজে। ঘড়িতে একবার দৃষ্টি দিলো আরেকবার দৃষ্টি দিলো রাগীভূত পূর্ণতার দিকে। আশ্চর্য কন্ঠে বললো,

– তুমি এতো তাড়াতাড়ি এলে কি কর পূর্ণ? হাও পসিবল? আই সয়ার! আমি বুঝতে পারছিনা কি করে এলে… !
– কেনো? ঢাকায় গিয়ে কি আরেকটা ধরার ধান্দা ছিলো আপনার? বদমাশ! বান্দাবাজ লোক! আমি এসেছি দেখে বুক পুড়ছে?
– তুমি কি বলছো তোমার হুশ আছে? এইসব বাজে ওয়ার্ড…! পূর্ণ প্লিজ! তুমি কি করে এখানে এলে ব্রিফ করো!
– আমি কি আদৌ আপনার জীবনের কেউ? আমাদের সম্পর্কটাকে কেন ড্রামাটিক বানাচ্ছেন? কি সুখ পাচ্ছেন বলুন তো?

পূর্ব মাথা নুইয়ে হালকা নিশ্বাস ছেড়ে আবার তাকিয়ে বললো,

– আমি অবশ্যই কোনো হিরো না পূর্ণ। না তুমি কোনো হিরোইন। আমাদের সম্পর্কের ভেতর এখনো কোনো থার্ড পার্সন আসেনি যে সম্পর্কটা ড্রামাটিক লাগবে। তুমি তুমিই আর আমি আমিই। মূল সমস্যাটা আমার। এতে আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমি জানি এটা ঠিক হচ্ছেনা। কিন্তু তোমার এটা এডজাস্ট করা লাগবে পূর্ণ। আফটার অল..
– আফটার অল এরপর? থামলেন কেন? আফটার অল আমি মেয়ে তাইনা? স্যাক্রিফাইস ব্যাপারটা মেয়েদের মূল আর্দশ!
– তুমি ভুল বুঝছো পূর্ণ। আমি অবশ্যই তোমাকে খাঁচায় বন্দি পাখি বানিয়ে রাখিনি। যথেষ্ট স্বাধীনতা এবং নিজের মত পেশ করার মতো অধিকার দিয়েছি।
– যদি বলি আমি তোমাকে চাই এটা কি আমার স্বাধীনতার মধ্যে পরেনা? স্বাধীনতা মানে কি নিজের করে পাওয়া না? কেন বারবার একই জিনিস রিপিট করছো? একটা কথা ক্লিয়ার করবে? আমি কি তোমার নিয়মতান্ত্রিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছি?

পূর্ব পূর্ণতার গা ঘেঁষে সিটে বসতেই পূর্ণতা অতিদ্রুত ট্রেনের গায়ে পিঠ সেটিয়ে দিলে পূর্ব আচঁলটা ধরে বললো,

– কথায় ‘আপনি তুমি’ গুলিয়ে ফেলছো পূর্ণ। শান্ত হও। আমার দোষ… আই এডমিট ইট। প্লিজ আর কিছু বলো না…
– কেন বলবো না? আমি তোমার কেউ..

পূর্ব আচমকা পূর্ণতার মুখে হাত চেপে চুপ করতে বললে পূর্ণতা ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভষ্ম রাগে ফের কলার টেনে ধরে। পূর্ব ঘাড় নুয়ে কলার মুচড়ে খামচে ধরা হাতজোড়া দেখতেই ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে মাথা উঠিয়ে বলে,
– এই কাজটা আগে করলে কি হতো? এভাবে নিজের করে নেওয়ার জেদটা দেখাতে এতো সময় লাগলো?

পূর্ণতা এক ঝটকায় মুখ বাকিয়ে মুখ হাত সরিয়ে রাগত স্বরে বলে,
– চুপ!
– ইশশ..মেরে ফেলছো তো! পূর্বের হাস্য কোমল ধ্বনি।
– আমি তোমাকে চুপ করতে বলেছি!
– তুমি আমাকে চুপ করতে বলে বুকে ছুড়ি ঘুরাচ্ছো কাজটা কি ঠিক? এমন অনুচিত কাজের জন্য সাবেক কমরেড হিসেবে তোমাকে কঠিন অপরাধে দন্ডিত করা উচিত! বাংলাদেশ দন্ডবিধি মতে ৩০২ ধারা মতে ওয়াসিফ পূর্বকে খুনের দায়ে পূর্ণতা ওয়াসিফকে সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দন্ডিত করা উচিত!
– আমার নাম পাল্টানোর চেষ্টা করবেনা! আমিতো তোমার কেউ না।
– থাপড়িয়ে চাপার দাঁত সব খুলে ফেলবো! আমার নাম মানে কি? তুমি কার স্ত্রী ভুলে গেছো? আমার নাম কেনো! তোমার সাথে আমার সবকিছু জড়িয়ে থাকবে! দরকার পরলে সেটা লেপ্টে থাকতেও দ্বিধা করবেনা!

পূর্ণতা কলারটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ হয়ে যায়। পূর্ণতার নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় পূর্ব কিছুটা বিস্মিত হলেও পূর্ণতার চিবুক ছুঁয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– তুমি অবশ্যই প্রাইভেট জেট দিয়ে আসোনি? তাড়াতাড়ি কি করে এলে এটুকু বললেই আমি তোমায় বিরক্ত করবো না। সত্যি বলছি।।

পূর্ণতা মাথা তুলে উত্তর দিবে তার আগেই পূর্বের ফোনটা ফালতু রিংটোন ছড়িয়ে বাজতে থাকে। একরাশ ভারী বিরক্তি নিয়ে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি রেখেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে পূর্ব।

– হ্যালো? পূর্ব ভাই? সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?

পূর্ব কোনো উত্তর দেয়না। কানে একহাতে মোবাইল চেপে অন্যহাতে পূর্ণতার হাত টেনে নিজের কাছে আনার জন্য বেগ পেতে হচ্ছে।

– ভাই? আপনে শুনতাছেন? হ্যালো? শালার নেটওয়ার্ক রে…

পূর্ণতা জেদ দেখিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিলেও পূর্ব খপ করে একগোছা চুল খাবলে পূর্ণতার মাথা টেনে নিজের কাধে রাখে। পূর্ণতা দুহাতে ঠেলে পূর্বকে সরিয়ে বসতে চাইলেও সম্ভব হয়না ততক্ষণে পূর্ব ওকে একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

– হ্যালো? ভাই? হ্যালো? কি রে মাদারবোর্ড মার্কা নেটওয়ার্ক! শালা…! হ্যালো..পূর্ব ভাই?
– বলো আয়মান শুনতে পাচ্ছি।
– ও আল্লাহ্ রে!! যাক শুনছেন তাহলে!! ভাই মনে কিছু নিয়েন না। আমার কাছে আমার বইন আগে। ওর কান্না আমি ভাই দেখতে পারিনা।

পূর্ব সিটে পিঠ হেলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বাঁ সাইড বরাবর পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরেছে। মাথাটা একপলক বায়ে ফিরে মাথায় ওষ্ঠউষ্ণের স্পর্শ করে বলে,

– চিতাবাঘের স্পিডে কি করে এলে সেটা ডিস্ক্রাইভ করো আয়মান।
– ভাই, বাইক দিয়ে আসছি।

পূর্ব খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠে আয়মানের কথা শুনে! গ্রামের রাস্তায় আশির উপরে স্পিড তোলা মানেই তুলকালাম ব্যাপার! পূর্ব কিশোর বয়সেই জেদের বশে বাইক চালানো শিখেছে তাই এ টু জেড বাইকে রিলেটেড সব তথ্যই পূর্বের জানা। এমতাবস্থায় পূর্ণতাকে পেছনে বসিয়ে হাই ডিফেন্ডার স্পিড মানে সাংঘাতিক কারবার!

– কি সর্বনাশ! স্পিড কত দিছো?
– না বললে হয়না?
– ইয়ার্কি করছো!স্পিড কত দিয়ে এসেছো?
– আটানব্বই-একশো স্পিড ভাই।
– ওহ্ গড! আয়মান তুমি কোন্ বাইক ইউজ করেছো? হাই স্পিড কিভাবে কন্ট্রোল করলে ?
– ভাই সুজুকি জিক্সার ছিলো। নতুন আপডেট তো বাইকের ফিচারগুলা আগুন!!

পূর্ব শব্দ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। পূর্ণতাকে জাপটে ধরে ওর ডানকাধে থুতনি রেখে চোখ বন্ধ করলো। কি সাংঘাতিক অবস্থা! যদি উনিশ থেকে বিশ হতো? একবার যদি তালগোল নষ্ট হতো? বাইক থেকে ছিটকে মাথা ফেটে শরীর কিভাবে ছিন্নভিন্ন হতো ভাবলেই গা শিউরে উঠে। পূর্ব আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয়। মুখ ডানে ঘুরিয়ে পূর্ণতার গলায় ঠোঁট বসিয়ে দুহাতে চেপে ধরে নিজের সাথে। ট্রেন ইসলামপুর স্টেশনে থামার জন্য নিজস্ব গতিবেগ কমিয়ে দিচ্ছে। এসি কামরার শীতাতপ বদ্ধ কেবিনে নিরবতার খামোশীভাব চলছে। পূর্ণতা উত্তপ্ত মস্তিষ্কে তেজঃপূর্ণ রাগে স্থির হয়ে পূর্বের বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ আছে। পূর্বকে আকড়ে ধরেনি সে। পূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে খানিকটা সময় পরপর গলায়, গালে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিচ্ছে। ট্রেন ঝাকুনি দিয়ে স্টেশনে থামলে নিরবতা ছিন্ন করে পূর্ব বলে,

– কি করলে তোমার রাগ কমবে বলো? আমি ওয়াদা করছি তোমার সব কথা রাখবো।

পূর্ণতা মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে পূর্বের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে কঠোর দৃষ্টিতে বললো,

– তুমি ঢাকায় নিশ্চয়ই বেহুদা কারনে যাচ্ছো না? কি কারনে যাচ্ছো সেটাই জানতে চাই।
– তুমি জেদ ছাড়বেনা তাইতো?
– হু,
– শোনো, আমি খবর পেয়েছি কেউ আমার নামে মামলা দাখিল করেছে। কে করেছে, কেনো করেছে এ বিষয়ে আমি পরিস্কার তথ্য খুজেঁ পাইনি। হতে পারে ডিরেক্ট জেলে যাবো আমি। এমনও হতে পারে আমি বিপদে ফাঁসবো। তুমি এ খবরটা জানলে উটকো টেনশন করবে তাই আমি বলতে চাইনি।
– এটা উটকো? তোমার কাছে উটকো কাহিনী লাগছে পূর্ব?
– মাথা ঠান্ডা করো পূর্ণতা। দেখো আমি কিন্তু এখনো কুল এন্ড কাম মাইন্ডে সব সামলাচ্ছি। এজন্যই তোমাকে এসব ম্যাটারে বলতে চাইনি। প্লিজ সিচুয়েশনটা বুঝো,

পূর্ণতা ফোঁস করে দুবার স্থিরভাবে শ্বাস ছাড়তেই হঠাৎ পূর্বের উপর ঝাঁপিয়ে ওকে জাপটে ধরলো! এহেন কান্ডে পূর্ব আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেললো! রাগ অভিমান জেদ যদি গলিয়ে ফেলো অদ্ভুত শান্তি লাগে? জ্বী হ্যাঁ লাগে! পূর্ব খুজেঁ খুজেঁ পূর্ণতার গলার নিচে নিজের মুখটা লুকিয়ে ফেললো। ফিসফিস করে বললো, একটু আদর করবা পূর্ণ? জাস্ট একটু? ট্রেন আবার সাইরেন বাজিয়ে চলতে শুরু করতে করেছে। এ যাত্রায় পূর্ব জয়ী!! পরের যাত্রায় কি অপেক্ষা করছে কে জানে?

.

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেসিযুক্ত তিন সিটের কেবিন। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো থাকলে ছোট্ট এই কেবিনটা নিজস্ব বলে ফিলিং কাজ করে। ট্রেনের ঝমঝম ঝাঁকুনি, সেই হালকা দ্রুত ঝাকুনি পেয়ে শরীর নিদ্রামগ্ন হতে চায়। ঘুম থেকে জাগলে আবার ঘুমাতে ইচ্ছে হয়। এসব নীতি মূলত ট্রেন জার্নিতে খাটে। দিনেরবেলার জার্নি বেশ আনন্দদায়ক। গ্রামীণ দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কখন যে আসল ঠিকানায় ট্রেন থামে টের পাওয়া যায়না…মনেহয় আরে, এইতো একটু আগে কমলাপুর স্টেশন ছাড়লাম! এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলাম? আবার রাতের জার্নিতে নিকষ কালোঅন্ধকারে গ্রাম পেরিয়ে নগর, নগর পেরিয়ে শহরে কখন যে ট্রেন ঢুকে পরে সে রাস্তা অবশ্য রাত্রি আধারে বোঝা যায়না। ব্যস্ত নগরীতে ঢুকলে বিকট কোলাহল ও হর্ণের কর্ণপাতে সড়ক, হাইওয়ে ও ব্রিজের রাস্তা তখন চলন্ত ট্রেনের আভাস পেয়ে সহসা থেমে থাকে…বাদশাহী মেজাজে ট্রেন চলতে থাকে হরদম গতিতে।। আরে বেটা তোরা আমাকে টপকে তোদের গন্তব্যে যেতে পারবিনা বুঝলি?… আচ্ছা?ট্রেন আদৌ এসব বলে? জীবন্ত হলে হয়তো ঠাট্টাস্বরে বলবে। একে একে সবগুলো বড় প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ট্রেন এখন ঢাকামুখী হয়েছে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন রাত ন’টা বাজছে।জামালপুর প্ল্যাটফর্মে পয়ত্রিশ মিনিট লেটের পরও ট্রেন যে এতো তাড়াতাড়ি ‘তেঁজগাও স্টেশন’ পেরুবে তা নিয়ে পূর্ব বেশ অবাক ছিলো। তাহলে ট্রেনের বিলম্বজনিত সমস্যা দিনদিন বাড়বে না কমবে? একটা দূষিত রাজনীতি থেকে কবে দেশটা মুক্ত হবে?

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মধ্যে যে আত্মগরিমা দেখেছিলো তা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে? যারা দেশটা স্বাধীনের উদ্দেশ্যে বুকের তাজা রক্ত দিলো তাদের অবদান কোথায় বিলিন হয়েছে? কেনো প্রশাসন ও সরকারজনিত সমস্যা জনগণ অনুভব করছে? কোথায় হারিয়ে গেছে ঐক্যবোধ? মানুষে মানুষে একাগ্র টান কেনো এখন দেখা মেলে না? বলা বাহুল্য শহরে যান্ত্রিক জীবনে যন্ত্রমানব হয়ে গেছে মানুষ। বাঙালিদের শিক্ষিত হতে বলা হয়েছিলো তারা উল্টো বুঝে মূর্খময় শিক্ষিত হয়েছে। যে শিক্ষায় মানবিকতার চর্চা নেই, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ-মান-মর্যাদা নেই সেটা অন্তত শিক্ষার নীতি হতে পারেনা। আজকাল ইয়াং এডুকেটেড যুবকরাই রাতের আলোতে মদের নেশায় ধর্ষণ করতে একচুল ভাবেনা। মেধাবী মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্রী তার প্রেমিক নামক পশুত্বের কাছে সম্মান তুলতে পরোয়া করেনা…এগুলো আদৌ শিক্ষা? পূর্ব মোবাইল স্ক্রিনে পিডিএফ পড়ার সময় অন্যমনষ্ক হয়ে এসব ভাবতে থাকে। ট্রেনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সিটের উপর পা উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে রেখেছে পূর্ণতাকে। ব্যান্ডেজ করা ক্ষত হাতটা পূর্ণতার মাথায়। পূর্ণতা ঘুমিয়ে পরলেও পূর্বের মস্তিষ্কে ঘুমের সাইরেন বাজেনি বলে ঘুম আসেনি। মোবাইল বের করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘Middle term’ বইটা পড়তে মগ্ন ছিলো সে। সেখানে একটা লাইন ছিলো যেটা পূর্ব বারবার পড়ছিলো,

‘What you need’ to ‘What you did’ is the path of success.

তুমি জীবনে ‘কি চাও’ যদি তা বুঝো, একদিন সময় পেরুলে বুঝবে তুমি জীবনে ‘কি পেয়েছো’ । পূর্ব বাক্যটা নিজের মতো সাজিয়ে বললো। মুচকি হেসে কি ভাবলো তারপর ঘুমন্ত পূর্ণতার গাল ধরে বুক থেকে তুলে ধরলো। অপলকে তাকিয়ে থেকে আচমকা অসহায় চাহনিতে মনেমনে বললো,

আমি নিজের জন্য সর্বনাশ ডেকেছি। সেই সর্বনাশে আমার হৃদগহ্বরের প্রাণনাশীকে দুঃখ দিচ্ছি।

.

রাস্তাঘাট সুনশান আশেপাশে কেউ নেই। পূর্ব অযথা রিস্ক এড়াতে বাসট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হলুদ হয়ে উঠছে পূর্বের মুখ। কালো শার্টের কিছু কিছু জায়গায় ইস্ত্রি ভেঙ্গেছে তবুও ফিটফাট সুদর্শন বলতে সবাই বাধ্য হবে। পূর্ণতার কমলাপুর থেকে বাসে উঠার পর আচমকা কথারোগ পেয়েছে। প্রচুর কথা বলছে পূর্ণতা আর সেসব কথা মনোযোগ দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে শুনছে পূর্ব। ঘুম থেকে উঠার পর পূর্ণতার মুখের দিকে তাকাতে বুক ধড়ফড় করছিলো পূর্বের। সদ্য ঘুম থেকে উঠা মেয়ের দিকে তাকানো মানে আগ্নেয়গিরির লাভা ফুটে বুকে। বাড়ির রুমের বেডরুম হলে পূর্ণতাকে ছাড় দিতোনা একফোঁটা। পূর্ব শুধু ওর কবজি চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলো,

– আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ পূর্ণ! কি করি বলো তো?

পূর্ণতা ওর কথা শুনে এমন বোকার মতো তাকালো আগামাথা না বুঝে বলেই ফেললো,
– পানি খাবে? মাথাব্যথা করছে?
পূর্ব এ্যাসেসোরিজ সিস্টেম থেকে লাগেজ নামাতেই বললো,

– তোমার ঠোঁটে একটা কামড় মারতে ইচ্ছে করছে, এবার বুঝছো?

লজ্জায় পূর্ণতা মাথা নিচু করে কেবিনের বাইরে চলে গেলো। কি অসভ্য লোক! ক্লান্তিকর জার্নিতে কেউ এসব কথা বলে?

.

রিকশা বাড়ির ফটকের কাছে থামে। বড় গেটের কাছে লাইটদুটো এখনো জ্বলছে দেখে পূর্ব রাগে পারেনা এক্ষুনি দারোয়ানকে সাইজ করে! ভাড়া চুকিয়ে পূর্ণতার আচঁলটা টেনে থুতনি অবধি ঘোমটা দিয়ে ওকে রিকশা থেকে নামায় পূর্ব। দারোয়ানের হাতে দুটো লাগেজ সপে দিয়ে ধমকে বলে উঠে,

– আমি যে ফোনে লাইটগুলো অফ করতে বলছিলাম কানে যায়নি! কেন এই লাইটগুলো জ্বলছে!

হঠাৎ মনেহলো পেছন থেকে একটা ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো! পূর্ব সাথেসাথে চমকিত দৃষ্টিতে পূর্ণতাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে ভেতরে যেতে বলে! দারোয়ান নিরুদ্দিষ্ট পথিকের মতো দাড়িয়ে থাকলে পূর্ব ওদের গলা ফাটিয়ে মেইন গেইটে তালা দিতে বলে! দুজন দারোয়ান যারা ছিলো তারা চেয়ার ছেড়ে তাড়াতাড়ি কাজে নিমগ্ন হয়। পূর্ব বাড়ির ভেতরে ঢুকে কেয়ারটেকারকে জলদি বাইরের লাইট নেভাতে আদেশ দেয়। পূর্ণতা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরে ঘোমটাহীনে দাড়িয়ে থাকলে পূর্ব হাত টেনে ওকে নিজের রুমে নিয়ে যায়। পূর্ণতা লাগাতার প্রশ্নবিদ্ধ করে, কি হয়েছে, কেনো এমন চেঁচাচ্ছে, আশ্চর্য..এরকম করার মানে কি।। পূর্ব রুমের দরজা লক করে হাপানো গলায় বলে,

– ছবি তুলছিলো পূর্ণ…ওরা তোমার ছবি তোলার চেষ্টায় ছিলো!

‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here