তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৩৫
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁
দুমকা বাতাসের এলোথেলো ঝাপটায় পূর্বের গভীরতম স্পর্শের কাছে প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে উঠছে মন। পূর্বের ব্যান্ডেজ করা হাত আজ কঠিনভাবে গাল চেপে ঠোঁটের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে মগ্ন। চোখ খুললেই পূর্বের স্নিগ্ধ মুখের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য দেখলে আমি সত্যি মারা যাবো। আমার হার্টবিট থেমে যাবে আর এই থেমে যাওয়ার যদি স্থির হয়ে যায় সত্যি সত্যি আমার দম ফুরিয়ে মৃত্যু হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখলে হৃদকম্প অস্থির হয়ে উঠে। আমার হৃদস্থলে অবস্থিত ছোট মাংশল পিন্ডটা প্রচুর ধপধপ করছে। পূর্বের ওষ্ঠযুগলের স্পর্শ চক্রবৃদ্ধির মতো গভীর থেকে গভীরতমে ডুবে যাচ্ছে। পূর্বের বিশাল ভারী নিশ্বাস যতবার আমার মুখের উপর পরছে মাত্রাধিক পরিমাণে কেঁপে উঠে তন।
পূর্বের হাত গাল থেকে সরিয়ে পিঠের চুল ভেদ করে পূর্ণতার ঘাড়ে চাপ প্রয়োগ হচ্ছে। পূর্ণতাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরেছে পূর্ব। হঠাৎ ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতেই পূর্ণতা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে, পূর্বের উজ্জ্বল চেহারা কোনো এক কারনে বাচ্চাসুলভ লাগছে। পাপড়িময় চোখের বন্ধ পল্লব কাঁপাকাঁপি করছে, লালবর্ণের ঠোঁটদুটো দিয়ে হো হো করে শ্বাস ছাড়ছে, কালো চুলগুলোও ছুটাছুটি খেলছে এখন। ছোট্ট বাচ্চা যখন জিদ চাপিয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে আদর পেতে আসে পূর্বকে ঠিক তেমনি লাগছে। পূর্ণতা কলার টেনে পূর্বের মুখ নিজের দিকে নুইয়ে চোখের পাতায় ঘন আবেশে ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়। পূর্ব রেলিংয়ে দুহাত রেখে পূর্ণতাকে মাঝখানে বসিয়ে অনেকটা নিচু হয়ে ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। পূর্ণতা গলা জড়িয়ে পূর্বের কাধে থুতনি রেখে বলে উঠে,
– তোমার কিছু হয়েছে পূর্ব?
আমি খুব ভালো করেই জানি পূর্ব আমাকে কিছুই বলবেনা। ওর কার্যকলাপ বোঝার মতো ধূর্তবুদ্ধি অন্তত আমার পক্ষে নেই। পূর্ব শান্ত মস্তিষ্কে যখন আছে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে জটিল কিছু হয়েছে। আমি আর জোর করলাম না। পূর্বের সুন্দর ঝলমলে চুলগুলো আরো এলোমেলো করতে ব্যস্ত হলাম। পূর্ব এবার চোখ খুলে কয়েক মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ করলো নাকি? আমি ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলাম, ‘কি মিস্টার? কি সমস্যা?রাগ করলেন ?’। পূর্ব আমার ইশারায় ঠোঁটে মিস্টি হাসি দিয়ে মাথা স্লো মোশনের মতো ডানেবামে নাড়ালো। হঠাৎ নাকে নাক লাগিয়ে আমার উপর ভর ছেড়ে দিলে আমি উল্টে রেলিংয়ের ওপাশে পরতেই ভয়ে চোখমুখ বন্ধ করে এক চিৎকার দেই। কয়েক ফিট উচু এমন ভিউ পয়েন্ট থেকে পরে আমার মাথার ঘিলু থেতলে দেহ পুরো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সিউর! হঠাৎ মনেহলো আমার আত্মা আমার সাথেই আছে আমি কোথাও পরিনি এখনো মরিনি দিব্যি ঠিকঠাক মতো শ্বাস নিচ্ছি। কুঁচকানো এক চোখ খুলে দেখি আমার পিঠের নিচে পূর্বের শোয়া একমণের হাত! সেই হাত আমাকে রেলিংয়ের বাইরে আধশোয়া করে ধরেছে। আমি এতো ভয় আদৌ পাইনি যতোটা আকষ্মিক ধাক্কার দোটানায় আজ পেয়েছি। দুচোখ খুলে ডানে ঘুরিয়ে দেখি একটা কাক কা কা করে উড়ছে আর পূর্ব খিলখিল করে হাসছে। সর্বনাশ! আমার দম বুঝি আটকে এলো! চোখ খুলে রাখার সার্মথ্য পাচ্ছিনা! বুকে ঝড়ের তোলপাড় শুরু হয়েছে!অন্যদিকে চোখ বন্ধ করার শক্তি পাচ্ছিনা চুম্বকের মতো টানছে। এতো মারাত্মক কেন এই হাসি? বারবার, বারবার, বারবার…আমি হাসিটা দেখলেই বেকায়দায় ফাসি। পূর্বের এই হাসিটা যদি কোনো চিত্রশিল্পী দেখতো মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকতো। জলরঙে আঁকিবুকি করে সাদা ক্যানভাসে ছবি তোলার কথা তার মনে থাকতো না। হাসির মুখরেই পূর্ব দুইগালে খাঁজ করে বললো,
– এতো ভীতু হলে চলে? তুমি আমার কাছে থেকেও এমন খুকীর মতো চিৎকার দাও?
আবার মত্ত হাসিতে ফেটে পরলো পূর্ব। আচ্ছা পূর্ব? তুমি কি জানো তোমার এই হাসিটা দেখলে বহু মেয়ের হার্টবিট এ্যাবনরমাল হবে?তোমার প্রাণনাশী হাসিটা দেখে কেউ হয়তো পথ ভুলে যাবে কেউ নির্বিচারে তাকিয়ে থাকবে কেউ নিজের বোধশক্তি বিলুপ্ত করে হুঁশ ফুরাবে। হাসিটা ধরে রাখার জন্য যদি কোনো যন্ত্র পাওয়া যেতো আমি দেদারসে রেকর্ড করতাম। মন খারাপ হলে রেকর্ডিং থেকে শুনতাম। পূর্ব পিঠে চাপ দিয়ে একটান মেরে কাছে আনতেই ঠোঁটে চাপ অনুভূত হলো। পূর্ব চুমু দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললো,
– আমি তোমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। যেখানে আমার কিছু হয়ে গেলেও তোমার কিছু হতে দিবোনা।
স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর মতো জো খুজেঁ না পেতেই পূর্ব রেলিং থেকে নামিয়ে দিলো আমাকে। আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে নিচ থেকে ব্যাগটা কাধে তুলতেই বললো,
– পায়ে ব্যথা করেনা?
– না। কেন করবে?
– ওহ্ আচ্ছা, শরীরে এনার্জী বেশি?
– কি? বুঝলাম না? এখানে এনার্জীর…
হুট করে কথার মাঝে হামেশার মতো দাড়ি বসিয়ে কোলে তুলে নিলো পূর্ব। দুমদুমিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই ভিলেন মার্কা হাসি টেনে বলে উঠলো,
– খেলা হবে।।।
– আশ্চর্য!
– নো আশ্চর্য! কি ভেবেছো আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো? নো কুইন, আ’ম সরি। পায়ে প্রচুর ট্রাবেল নিয়েছো আর নিতে হবেনা, আমি আছি।
– আচ্ছা, তুমি যে রোমান্টিক সেটা তোমার চেহারা দেখলে বুঝা যায় না কেন?
– আমার চেহারা কি সাইনবোর্ড লাগে তোমার? এমনেই মেয়ে মানুষের জ্বালায় বাঁচি না। অসহ্য লাগে। তার উপর তুমি খালি দূর দূর করো ভালো লাগেনা।
– বেশি ইনোসেন্ট হয়ে যাচ্ছো না? দোষ তো তোমার। ঢাকনা খুলে রাখলে মাছি তো ভোঁ ভোঁ করবেই।
– তোমার মুন্ডু! আমি নিজের শার্টের বোতাম খুলি না ঢাকনা খোলার কেমন বিশ্রী উদাহরণ দিচ্ছো?
– চোখে সানগ্লাস, মুখে মাস্ক, গায়ে হুডি জ্যাকেট, পায়ে স্নিকার ব্যস! এভাবে চললে গ্যারান্টি দিচ্ছি কেউ তোমাকে গিলে খাবেনা।
– প্লিজ পূর্ণ! থামো! আই এডমিট কিছু মেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সেটার জন্য সব মেয়েদের দোষারোপ করতে যেও না। সবাই শ্রেয়া, আনিশার মতো আত্মসম্মান ভুলে বসেনা। আমি সমাজে ঢুকেছি তাদের সাথে যথাসম্ভব মিশেছি এবং এটাও দেখেছি একজন আঠারো বছরের মেয়ের মধ্যেও ম্যাচুরিটি সেন্স কতটা সুন্দর! তাদের মতো মেয়ে দেখলে সুফিয়া কামালের মতো মহিলাদের কথা স্মরণে আসে। বাংলাদেশ এমনে এমনেই উন্নতির শীর্ষে একপা একপা করে এগুচ্ছে না। গোড়া থেকে বিবেচনা করলে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নারীদের ভূমিকাও আছে। ওরা মহীয়সী নারী বুঝলে? একজনের জন্য দশজনকে নোংরা বলতে যাবেনা। আগে চরিত্র দেখবে, পর্যবেক্ষণ করবে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।
পূর্ব খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো নারীদের ভূমিকা বোঝাতে। নারীকুলের সবাই যে শ্রেয়ার মতো মানসিকতা বদলায় না সেটাই হয়তো পরোক্ষভাবে বুঝালেন। পূর্ব সর্তকতার সাথে সিড়ি দিয়ে যখন নামছিলেন আমার ইচ্ছে জাগলো একবার জিজ্ঞেস করি ব্যাগ করে কি এনেছেন? কিন্তু প্রশ্নটা প্রশ্নরূপেই থেকে গেলো জিজ্ঞেস করা হলোনা। হঠাৎ দেখি আকাশের সাদা মেঘগুলো ঘনীভূত হয়ে কালো মেঘে পরিণত হচ্ছে। বাতাসের বেগও বাড়ছে। বৃষ্টি নামবে নাকি?
.
– আয়মান তুই ভাত খাবিনা বাবা? দেখ্ তোর জন্য শ্রেয়ার মা ডালের বড়া বানিয়েছে। আয় বাবা, গরম গরম ভাত দিয়ে ডালের বড়া খেয়ে যা।
আয়মান বিছানায় ট্রাউজার পরে খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আফিয়া ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দুপুরের খাবার খেতে তোষামোদ করছেন। আয়মান সকালে এক কাপ চা ছাড়া কিছুই মুখে দেয়নি, দুপুর পেরিয়ে বিকেল চলছে এখনো পেটে ভাত পরেনি। উদ্বিগ্ন আফিয়া আরো ক’বার তোষামোদ করলে পেছন থেকে দরজা দিয়ে শ্রেয়ার মা শায়লা ঢুকে। বিনীত হাসি ফুটিয়ে শায়লা আফিয়ার পাশে দাড়িয়ে বলে উঠে,
– আয়মান কি রাগ করলো নাকি আপা? আয়মান? এই আয়মান? দেখো কি এনেছি!!
আয়মান শায়লার কথায় না উঠে পারলো না। শায়লার বচনভঙ্গিতে এমন জাদু আছে কেউ কোনো কথা অস্বীকৃতি করতে পারেনা। আয়মান চোখ কচলে শায়লার দিকে ঢুলুঢুলু চাহনিতে তাকালে শায়লা ভ্রু কুচকে বলে,
– কি ব্যাপার? এই ছেলে তোমার চোখ লাল কেনো? অসুখ?
বলতে বলতেই শায়লা আয়মানের কপালে হাত ছোঁয়ালো। শরীর হালকা মতো গরম ওর। জ্বর পুরোপুরি আসেনি এখনো। শায়লা হাতে থাকা প্লেট নিয়ে আয়মানের কাছে বসলে ভদ্রমহিলা প্লেটের উপর আরেক প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে রাখে। গরম ধোয়া উঠা ভাতের এককোণায় ধনিয়া পাতা দিয়ে ডালের চারটা বড়া সাজানো। একসাইডে একটু লবণও রাখা। শায়লা আফিয়ার দিকে প্লেট এগিয়ে দিলে আফিয়া ভাত মেখে আয়মানের মুখে জোর করে লোকমা পুড়ে দেয়।
– আয়মান? কিছু নিয়ে মন খারাপ? সকাল থেকে দেখছি তুমি চুপচাপ হয়ে আছো। তোমার মতো ক্যাচক্যাচ করা মানুষটার কি হলো বলোতো?
– আন্টি কিছু না। মাথাটা একটু ব্যথা।
– মাথাব্যথা? হায় খোদা!! আগে বলবেনা!! দাড়াও এক্ষুনি আদা কুচি দিয়ে চা করে দিচ্ছি।
– আন্টি নাপা খেয়ে নিবো, প্রবলেম নেই।
– কি উটকো বলছো আয়মান? টোটকা থাকতে নাপা খাবে কেনো? আমি শ্রেয়াকে বলে দিচ্ছি বাড়ির পেছন থেকে তুলসী পাতা আনতে। শ্রেয়া? শ্রেয়া কোথায় রে তুই?
শ্রেয়াকে এক হাক দিতেই বাধ্য মেয়ের মতো হাজির হলো শ্রেয়া। আয়মানের সাথে চোখাচোখি হতেই আয়মান ঘেন্নার দৃষ্টিতে মুখ ফেরালো শ্রেয়ার এতে ভাবাবেগ হলোনা। স্বাভাবিক গলায় বললো,
– হ্যাঁ মা বলো। ডেকেছো কেন?
– চারটে তুলসী পাতা ছিড়ে আনতো। কচি দেখে আনিস।
– কিসের জন্য?
– তোকে এখন কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে?
– মা, প্লিজ গলাবাজি করো না। কারনটা বলে দিলেই তো পারো।
– আয়মানের জ্বর এসেছে। তুলসী পাতা গরম করে বুকে মালিশ করে দিবো। শুনেছিস তো? এখন যা।
– আমি পারবো না। তানিয়াকে বলো।
আয়মান কঠিন চোখ করে শ্রেয়ার দিকে তাকালো। মুখে আরেক লোকমা ভাত নিয়ে চিবুতেই বলে উঠলো,
– আন্টি আমি কারোর দয়ার উপর হাবুডুবু খেতে চাইনা। আমি নিজেই ছিড়ে আনতে পারবো। এমন অকর্মণ্য মেয়েকে সময় মতো দু চারটা চড় মেরে সোজা করা দরকার। থ্যাংকিউ আন্টি বাট আমি ক্যাপসুলই খাবো।
আয়মান বিছানা থেকে নেমে পানি খেতেই আরেকহাত দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঔষুধের পাতা বের করলো। একটা ক্যাপসুল ছিড়ে সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা করে দিয়ে বলে উঠলো,
– অল ডান, ইনশাআল্লাহ্ জ্বর দুঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দিবে। গোসল করিনি, আসি।
আলমারি খুলে পোশাক নিয়ে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে শ্রেয়াকে ধাক্কা দিয়ে যেতেই হঠাৎ পিছু ফিরে বললো,
– ওহ্ সরি শ্রেয়া, আই এ্যাপলোজাইজ। নেক্সট থেকে ঠিকমতো চোখ কান খোলা রাখবো।
শ্রেয়া চোখ বিশাল বড় করে আয়মানের গমনের পথে হা করে তাকিয়ে রইলো। এটা কি গাধা, হাবলাকান্ত, ক্ষ্যাতমার্কা আয়মান? বন্দুকের নল দিয়ে ঢিসুম ঢিসুম বুলেট ছোঁড়ার মতো নিজের কেমন রূপ দেখিয়ে গেলো ও? কথার ধরন চেন্জ, এটিটিউট চেন্জ, চোখের শান্ত চাহনিও চেন্জ? শ্রেয়া কি নিজের ভুলের উপর পস্তাবে কখনো? আয়মান বহাল থাকবে নিজের কঠিন স্বীকার্যের উপর? কে জানে? উহু…সময় জানে। সময় সবকিছুর জন্য পরোপকার। কাউকে একফোঁটা কম দেয়না, কাউকে একফোঁটা বেশি। টাইম হেল্স এভ্রিথিং, উই শ্যুড ফরগেট সামথিং।
.
পূর্ণতা ওয়াশরুমে পা ধুয়ে রুমে ঢুকতেই দেখে পূর্ব রুমের সব জানালা আটকে রুমের নানা জায়গায় মোমবাতি জ্বালিয়েছে। সোনালি আভায় আনাচে কানাচে মোমের স্বর্ণালি শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। পূর্ণতা কানের পিছনে চুল গুঁজে আশ্চর্য দৃষ্টিতে রুমের মাঝখানে দাড়ালে হঠাৎ পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে কোমর জড়িয়ে পিঠের চুল সরিয়ে দেয়। ঘাড়ে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিতেই পূর্ণতা পেটের উপর রাখা পূর্বের হাতজোড়া চেপে ধরে।
– পূর্ণ?
পূর্বের কন্ঠ শুনে পূর্ণতা আরেকবার কেঁপে উঠলো। কন্ঠের সর্বত্র যেন নেশা জাতীয় কিছু মেশানো। পূর্ণতা কোনো জবাব দিলোনা। পূর্বের দিকে ঘুরে দাড়ালো। পূর্বের চোখের দিকে তাকাতেই তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। ভয়ংকর ধারালো দৃষ্টি! এই দৃষ্টি তীক্ষ্ম ছুড়ির মতো বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন করে দেয়। পূর্ণতার কাঁচুমাচু মুখ দেখে পূর্ব আনমনে হেসে দিলো হুট করে পূর্ণতাকে উঁচু করে তুলে মাথা ওরদিকে উঁচিয়ে বলে উঠলো,
– আজ আমায় একটু ভালোবাসবে? প্রমিস করেছিলে প্রতিটা দিন শেষবারের মতো কাটাবে। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, তোমায় কষ্ট দিয়ে থাকি, তোমাকে দুঃখ দিয়ে কাঁদিয়ে দেই আমাকে মাফ করে দিও। আমিতো তোমাকে ভালো…
পূর্ব কথা আটকে পূর্ণতার দিকে ভাবশূন্য হয়ে মাথা নিচু করে নেয়। পূর্ণতা অস্থির হয়ে আছে পূর্বের মুখে প্রতীক্ষার শব্দ শুনতে! আজ কি পূর্ব বলবেনা? আমি তোমায় ভালোবাসি পূর্ণতা বলবেনা? পূর্ব পূর্ণতাকে নামিয়ে দিলো। অদ্ভুত অজানা বিষন্নতায় মুখ মলিন করে মাথার কাছে জানালা খুলে দিলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে একহাতে শার্টের বোতাম খুলতেই অন্যহাতে নাম্বার ডায়াল করে কল দিলো। পূর্ণতা এখনো ঝিম মেরে দাড়িয়ে আছে দেখে পূর্ব কানে ফোন এটেই বলে উঠলো,
– ঘুমিয়ে পরো পূর্ণ। কাল সকালে বাড়ি ফিরতে হবে। আমি জরুরী কলটা করে আসছি।
.
ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে পয়ত্রিশ। পূর্ব কল করার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে রুমের বাইরে বসে এ্যালকোহল(ড্রিঙ্ক) খাচ্ছে। বিদেশী একবোতল আইটেম সে রেসোর্টের ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবস্থা করেছে। টানা চার ঘন্টা ধরে এক পেগ গ্লাসে যতবার চুমুক দিয়েছে ততবারই নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার মতো বমি করেছে। আচ্ছা বস্তুটা পেটে পরলে বমি হচ্ছে কেন? একটু দুঃখ মেটাতে খাচ্ছে অথচ নেশা হয়েও হওয়ার মতো হচ্ছেনা, শরীর অসুস্থ করছে। পূর্ব সিড়িতে বসে পা ঘাসে উপর ফেলে মাথা নুয়ে আছে। হঠাৎ কে যেনো ওর নাম ধরে চিল্লিয়ে উঠলো। পূর্ব চোখ সরু করে ঝিমঝিম মাথায় কপাল কুঁচকে তাকালো।
– কে…
– তুই নিজেকে চিনতে পারছিস না?
– পারছি। তুমি আমার প্রতিচ্ছবি।
– হ্যাঁ, আমি তোর ভেতরকার পূর্ব। ইনার সাইড অফ পূর্ব। আচ্ছা তুই এখানে বসে বসে মদ গিলছিস তোর লজ্জা করছেনা?
– করছে।
– তাহলে কেন এখনো পেগ হাতে নিয়ে বসে আছিস? ফেলে দে ওটা!
– নেশা করতে চাচ্ছি। কিন্তু নেশা যে হচ্ছেনা!! আমার পূর্ণতার কাছে যেতে ভয় করছে।
– কেন? কিসের ভয়? ও তোর বউ না? ও কি তোর প্রেমিকা?
– আজ আমাল পূর্ণকে একটা গোলাপের মতো লাগছে। এমন একটা গোলাপ যাকে ছুঁয়ে দেখার আগে আমার সহস্রবার ভাবা লাগে।
– তোর স্ত্রীকে স্পর্শ করতে ভাবা লাগে? তুই কি দিনদিন মরে যাচ্ছিস? তোকে তো সবাই বুদ্ধিমান ভাবে! এই তোর বুদ্ধির নমুনা?
– আমি ওর সামনে গেলে কন্ট্রোল করতে পারবো না। ওর সামনে গেলেই আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।
– তুই কি জেলে ঢুকা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস?
– আমি নিজের জন্য ভয় পাচ্ছিনা। ওর জন্য পাচ্ছি। আমার পূর্ণকে একা কার কাছে ফেলে যাবো? ও একমাত্র আমার দায়িত্ব। আমি ওকে নিজের কাছে রাখার জন্য ওয়াদা করেছি। কি করে একা ফেলে যাই?
– তোর পরিবার কি টপকে গেছে হারামজাদা? তুই এমন অবুঝের মতো প্রলাপ বকছিস কেন?
– পরিবার ওকে চব্বিশ ঘন্টা আগলে রাখলেও আমার থাকাটা জরুরী। রাতে যখন ঘুমাতে যাবে আমার বালিশটা শূন্য দেখবে তখন ও শান্ত থাকতে পারবেনা। প্রচুর কাঁদবে। শ্রেয়ার ঘটনা শেষ না হতেই আমার ঘটনা শুরু। আর কতো? ও আর কতো সহ্য করবে?
– তুই কোন্ সুখে রাজনীতি করছিস বেটা? ছেড়ে দে এসব! এসব ত্যাগ করে বাবার বিজনেসে বস! পারলে বিদেশ যা। তোর কি টাকা কম?
– মানুষের সেবা করার একমাত্র যোগ্য এবং উচিত পন্থাই হলো রাজনীতি। আমি সৎ হয়ে সৎ পথে রাজনীতি করছি। হ্যাঁ মানছি দু একটা মানুষ মেরেছি কিন্তু তারা আমার জন্য ছিলো ভয়ংকর। এছাড়া একটা নিরীহ মানুষের ক্ষতি আমি করিনি।
– দুনিয়ায় যে সত্যের মূল্য নেই ভুলে গেছিস?
– সত্যের মৃত্যু নেই — এটা বিশ্বাস করি।
– প্রবলেম সল্ভ হয়েই গেলো। যদি ভাবিস তুই কিছু করিসনি তাহলে পূর্ণতার সামনে যেতেও ভয় নেই। জেলে গেলেও ফেলত আসবি। এখন ওকে আগলে ধর। মেয়েটাকে নিজের কাছে নে। তোর জন্য মেয়েটা আজও কেন কষ্ট পাবে? এক্ষুনি যাবি তুই! এক্ষুনি যা!
পূর্ব ঈষৎ মাতালের ঘোরে দৌড় দিলো! হাত থেকে কাঁচের ছোট্ট গ্লাসটা ফ্লোরে পরে চুরমার হয়ে গেলো। শরীরে যতটুকু বল আছে সবটুকু খরচ করে সে কাঠের দরজা দিয়ে খুললো। যা ভেবেছে তাই! পূর্ণতা বালিশে মুখ উঠছে কেঁপে কেঁপে উঠছে দরজা খুলার দিকেও দৃষ্টি নেই।। পূর্ব পায়ে দরজা ঠেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেডের কাছে এসে সম্পূর্ণ শার্ট ছুড়ে মারলো। পূর্ণতা বালিশ থেকে চোখ ফুলিয়ে নাক লাল করে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ব উত্থাপিত তীব্র জলোচ্ছাসের মতো ঝাঁপিয়ে পরলো।। বিড়বিড় করে মাতালের মতো শুধু একবার বললো,
– আই এম সরি পূর্ণ। আই শ্যুড লাভ ইউ এভ্রি ডে, এভ্রি নাইট, এভ্রি মিনিট, এভ্রি সেকেন্ড, এভ্রিটাইম, মোর টাইম….আই এম সরি।
‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO