তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৩৮

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৩৮
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

পূর্ব রুমের দরজা জানালা আটকাতে চাইলেও পূর্ণতার অনুরোধে জানালা আটকাতে পারলোনা। লাইটহীন বদ্ধ রুমের বীভৎস অন্ধকার পূর্ণতার সহ্য না। পূর্ব এখন অতিরিক্ত করছে বলে পূর্ণতার ধারনা। যে ব্যক্তি ছবি তুলতে চেষ্টা করেছিলো সেটা মিডিয়ার গুপ্তচর। পূর্ব ইতিমধ্যে লোকটার যতটুকু অবয়ব দেখেছিলো তা নিজের লোকদের কাছে বিস্তারিত জানিয়ে আর্জেন্ট রিপোর্ট চেয়েছে। তারাও পূর্বকে আশ্বাস দিয়েছে ওই ব্যক্তি যেকোনো মাধ্যমের স্টাফ হোক পূর্বের পায়ের কাছে এনে ধরা দিবে, সম্পূর্ণ বায়োডাটা পাঠিয়ে দিবে। পূর্ব ওদের সাফ সাফ জানিয়ে দেয় মিডিয়ার লোকদের কোনোভাবে হেনস্ত না করতে এতে ওরই ক্ষতি হবে। পূর্ণতা রুমে আসার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে পরনের শাড়ি পাল্টে সাদামাটা একটা শাড়ি পরে আয়নার সামনে চুল আচড়াচ্ছে। আয়নায় নিশ্চল চোখদুটো পূর্বের সাথে কথা বলার উশখুশ করছে। চোখাচোখি হওয়ারও সুযোগ নেই, পূর্ব এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত ভঙ্গিতে সোফায় আইপ্যাড নিয়ে বসেছে। কপাল কুঁচকানো, মুখে গাম্ভীর্য ভাব, স্ক্রিনের উপর ধুপাধুপ দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল তীরের গতিতে চলছে। পূর্ণতা ভেবে পায়না এই বান্দা এতো স্পিডে কিভাবে টাইপ করে? যেহারে টাইপ করছে তাতে বিশ্ব রেকর্ড করে অস্কার ছুড়লেও অস্কার বলবে, ওই আবুল ভ্যাবলা কোথাকার? আমাকে কোথায় পাঠাচ্ছিস? পূর্বের কাছে? না বাপ, পায়ে ধরি পাঠাস না। পূর্ণতা আর নিরবতা চাপতে পারলোনা চিড়ুনিটা শব্দ করে রেখে দ্রুতপায়ে পূর্বের সামনে এসে দাড়ালো। পূর্ব না শোনার ভান করে বাঁ ভ্রুটা উচুতে তুলে সিরিয়াস কিছু ভাবছে এমন ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। রাগে পূর্ণতার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, গায়ে ঠান্ডা পানি ঢাললে ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ হতো সিউর। অনেকক্ষন পর পূর্ব মুখ না তুলে ছোট্ট প্রশ্ন করলো।

– কিছু দরকার?
– হ্যাঁ দরকার!
– চিৎকার করছো কেন? আ’ম নট ডিফ।
– তুমি আমাকে চোখে দেখো না?
– তুমি নিশ্চয়ই পিপড়া নও যে দেখতে অসুবিধে হবে? জিলাপি না বানিয়ে কথা বলো।
– আমি ঘুমাতে পারছিনা!
– ব্যাপারটা পেচানোর মানে কি? আমি অন্য রুমে যাচ্ছি। ঘুমাও।

পূর্ণতার রাগ ছুই ছুই করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, পূর্ব কি জানেনা পূর্ণতা ওকে ছাড়া ঘুমাতে পারেনা? পূর্ণতা চেঁচিয়ে উঠলো!

– তুমি একটা স্বার্থপর!

পূর্ব হঠাৎ পা থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ব্যঙ্গতার সুরে বললো,
– তাই? কি অপরাধ আমার? সবাই যেখানে আমাকে নিঃস্বার্থ ডাকে তুমি তো দেখি স্বার্থপর ডাকছো! কেন?

পূর্ণতা ওর সামনে এসে হাত থেকে আইপ্যাড নিয়ে সোফার দিকে ছুড়ে মারলো। পূর্ব অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকালে হঠাৎ পূর্ণতা জাপটে ধরে বলে উঠে,

– তোমার গায়ের গন্ধ না পেলে তো ঘুমাতে পারিনা।

পূর্ব মুচকি হেসে দেয়। পূর্ণতার মাথা বুকের মধ্যখানে দুহাতে ঢেকে বলে,
– গোসলের পর পারফিউমের স্মেল থাকার কথা না।
– আবার ফাজলামি?
– না সত্যি। আজ তাড়াহুড়ো করে দুপুরেও পারফিউম দেইনি।
– তুমি ইয়ার্কি শুরু করলে? আমি পারফিউমের কথা বলেছি? তোমার গায়ের গন্ধ বলছি।
– বাহ্! জানতাম না তো! ওটা কেমন হয়?
– তুমিই….!
রাগে কথা শেষ করতে পারলো না পূর্ণতা। ইদানিং পূর্বের রাগগুলো সংক্রামনের মতো ওকে আক্রান্ত করেছে। উল্টাপাল্টা কিছু শুনলেই মাথায় হুটহাট রাগ চড়ে যায়। পূর্ণতা কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব কোমর চেপে উঁচুতে তুলে নিজের হাইটের সমান করে। পূর্ণতা ঠোঁট শক্ত করে নামার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলে পূর্ব কোমরে আঙ্গুল ডাবিয়ে সর্তক কন্ঠে বলে,

– গলা জড়িয়ে ধরো।…আমি ধরতে বলছিনা?

শেষ বাক্যে কেঁপে উঠলো পূর্ণতা, নির্লিপ্তে হাতদুটো এগিয়ে পূর্বের গলা জড়িয়ে ধরলো সে। সুদূর থেকে আসা রাস্তার নিয়ন বাতির আলোতে অন্ধকার রুমটায় অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে পর্দাগুলো ভেতরে এসে উড়ছে, ভ্যাপসা গরম কাটিয়ে শীতলতার প্রহর শুরু হচ্ছে, গোটা শহরসহ চারপাশ ঘুমন্তাবস্থা লেপ্টে আছে কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, শুধু নিস্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। পূর্বের বড় বড় চোখের পাপড়িপূর্ণ চক্ষুতারায় এ কেমন চাহনি! শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল, নম্র অদ্ভুত শীতল চাহনি। এই দৃষ্টিতে একবার আটকে গেলে দুনিয়ার সব চিন্তা মাথা থেকে উড়ে যায়। পূর্ণতা ঘোরের মধ্যে টের পাচ্ছে পূর্ব ধীরস্থিরে হেঁটে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখবে? সেই ক্ষমতা ওর নেই। পূর্ণতা বুঝতে পারলো বাতাসে ওর চুলগুলো প্রচুর উড়ছে, পূর্ব ওকে রুমের জানালার কাছে নিয়ে এসেছে। রাতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে?নইলে জানালা গলে এক টুকরো জোৎস্না কিরন পূর্বের মুখটার উপর এতো সুন্দরভাবে পরতো না।। খানিকক্ষন পর পূর্ব হালকা গলায় বলে উঠলো,
– পার্টিকে ওয়াদা দিয়েছিলাম গ্রাম থেকে এলেই এতোদিনের জমা কাজগুলো সেরে ফেলবো। এখন কি করি বলো?

কন্ঠে কি ছিলো জানা নেই, পূর্ণতা আরেক ধাপ সেই কন্ঠের আবেশে ডুবে গেলো। পূর্ব অবশ্যই পূর্ণতার মনের অবস্থা খোলাবইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠার মতো আওড়াতে পারে এতে নিঃসন্দেহে বলা যায় পূর্ণতার ব্যাপারে সুক্ষাতিসুক্ষ জিনিসও বুঝতে পারে ও। বাসন্তী রঙের শাড়িতে লাল ব্লাউজে রূপবতী লাগছে পূর্ণতাকে। লম্বা জার্নিতে ক্লান্ত দুই চোখ, মিষ্টি হাসির কোমল দুই ঠোঁট, কানের পাশে ছিটকে আসা এলোথেলো চুল, থুতনিতে ছোট্ট মাদকপূর্ণ গর্ত! পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার গালে ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়। ফিসফিস নিচু গলায় নেশাময় কন্ঠে বলে উঠে,

– আমিতো আছি পাশে। চিন্তা কিসের?
– পা..পার্টির কাজ? তোতলানো সুরে বললো পূর্ণতা।

জড়তা ভেঙ্গে নিরবে হেঁটে বিছানায় শুইয়ে দিলো পূর্ণতাকে। পূর্ণতা উত্তরের জন্য এখনো সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, পূর্ব কিছু না বলে আইপ্যাডে কি যেনো করে বিছানায় ফিরে এলো।। ডানপাশে শুয়ে পরতেই হঠাৎ পূর্ণতার মাথার দুপাশে হাত রেখে ওর উপর ভর ছেড়ে দিয়ে ঝুঁকলো পূর্ব। পূর্ণতা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন ছুড়বে তার আগেই পূর্ব গালে, কপালে, থুতনিতে এবং সর্বশেষ ঠোঁটে চুমু খেয়ে বালিশে মাথা দিলো। পূর্ণতাকে কাছে টানতেই পূর্ণতা প্রশ্নের জন্য মুখ খুলছিলো ওমনেই পূর্ব হাতচাপা দিয়ে মাথা না সূচকে নাড়িয়ে বলল,

– ভালো মেয়ের মতো বুকে আসো। হার্টবিট শুনতে শুনতে নাকে গন্ধ টেনে ঘুমিয়ে পরো।

.

নাস্তাটা খেয়ে তাড়াহুড়ো করে পান্জাবী গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পরলো পূর্ব। পার্কিং লট ফাঁকা, নিজের গাড়িটা কোনাবাড়ির ঘটনায় নষ্ট অকেজো হয়ে গ্রামে পরে আছে। পূর্ব ট্যাক্সিতে বসে পান্জাবীর হাতা গুটাতেই কানে ইয়ারপড ঢুকিয়ে কল পিক করলো। বহুদিন পর ওপরওয়ালা থেকে কল এসেছে। নালিশ বা অভিযোগের বেলায় এসব কল আসাটা স্বাভাবিক যেখানে পূর্বের নামে মার্ডার কেসের চার্জ লেগেছে।

– আসসালামুয়ালাইকুম।
– সালামটা পরে নিচ্ছি। আমি তোমার ব্যাপারে এমন নিউজ পাবো আশা করিনি।
– স্যার, মূল ঘটনা কি সেটা আমি জানিনা। মার্ডার চার্জ যারা লাগিয়েছে তাদের ব্যাপারে ইনফরমেশন ঘোলাটে পেয়েছি। ওরা আমাকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করেছে। এখন থানায় যাচ্ছি।
– আমার সেক্রেটারি নিউজটা কিভাবে দিয়েছে তা আমার গলার স্বর দ্বারা ঠিকই অনুমান করতে পাচ্ছো।
– আমি যেখানে দোষ বা ভুল করিনি সেখানে আমার উপর উটকো মামলা কে করতে পারে এটুকু জ্ঞান আমার আছে। আপনার কাছে অনুরোধ, মিডিয়ার লোকদের শান্ত করুন। আমি দোষী সাব্যস্ত হলে আমাকে নিয়ে মুখরোচক কাহিনি লেখার জন্য আমি নিজে আহ্বান করবো। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হবার পর!

পূর্ব কথা শেষ করলে হঠাৎ গাড়ির লুকিং মিররে দেখে ড্রাইভার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা বৃদ্ধ, চোখেমুখে বয়সের ভারে অজস্র ভাঁজ। পূর্ব কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– এইযে চাচা? আপনি কি কিছু বলবেন?
লোকটা মিনমিন করে বলে উঠলো,
– না মানে, না পূর্ব ভাইসাব।

পূর্ব সাথেসাথে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো! ফোনালাপের কোথাও আজ নিজের নাম উল্লেখ্য করেনি, অথচ লোকটা ওর নাম জানে? পূর্ব জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি আমায় চিনেন?
– আপনেরে কেডায় না চিনে। আপনে হইলেন আমগোর ফিরেস্তা।
– জ্বি? পূর্ব কথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারলোনা।
– আপনে আমারে চিনবেন না ভাইসাব। কিন্তু হগলে আপনেরে চিনে। আপনে একবার শ্যামলী রোডের ওইখানে বস্তির মাইয়ারে কোলে তুইলা হাসপাতালে নিয়া গেছিলেন। মাইয়ার চিকিৎসার টাকা দিছিলেন। হেরপর-তে চিনি।

পূর্ব অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না কবেকার ঘটনা। এরকম কেস অনেক হ্যান্ডেল করেছে ও, তাই ক্লিয়ার স্মৃতি মনে করতে পারছেনা। লোকটা পরমাহ্লাদে হাসি দিয়ে বলতে লাগলো,
– ভাইসাব আপনে মনেহয় ভুইলা গেছেন। খাড়ান মনে করায়া দেই, আপনে যেই মাইয়ারে হাসপাতালে ভর্তি করছিলেন ওইডা আমার বইনের মাইয়া আছিলো। আপনে দলবল লইয়া বস্তিতে সবার হালচাল দেখতে গেছিলেন, মাইডার শ্বাসকষ্ট দেইখা আপনে সব ভুইলা নিজেই কোলে কইরা হাসপাতালে নিয়া গেছেন। নাম হইলো গিয়া পারুল। আপনে ওরে আদর কইরা ডাকছিলেন পারু।

নামটা শুনতেই চট করে স্মরণ করলো মেয়েটার মুখ। পূর্ব মাথা নিচু করে হেসে দিলো। সেই নয়মাস আগের কথা, পূর্ব একদিন দলবল নিয়ে বস্তির মানুষের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলো। নিঃস্ব অসহায় অনাচার মানুষগুলো কতো কষ্ট করে ছোট্ট ঘরে থাকতো। সেদিন একটা ভ্যাপসা অন্ধকার ঝুপড়ি থেকে কারোর হাউমাউ কান্নার হাহাকার শুনেছিলো। পূর্ব অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকে দেখে নোংরা মেঝেতে ছোট্ট পিচ্চি মেয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বয়স বড়জোর আট বছর এমন একটা ফুলের মতো মেয়ে মুখ হা করে শ্বাস নেওয়ার যুদ্ধ করছে। পূর্বের বুকটা এমন নিংড়ে উঠলো ও কোনোকিছু না ভেবে কোলে তুলেই দৌড় লাগালো। হাপাতে হাপাতে গাড়িতে উঠে হাসপাতালে চলে যায়। মেয়েটা সুস্থ হলে মিটিমিটি হাসিতে বলে,

– আমার নাম পারুল। আপনের নাম কি?
পূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– আমার নাম পূর্ব। আচ্ছা পারুল সোনা, তোমার নামটাকে যদি ছোট করে ডাকি? যদি পারু বলে ডাকি সমস্যা হবে?
– আপনের যা দিল চায় তাই ডাকেন। আপনের সাথে আমার বহুত মিল।
– কিভাবে?
– পারু-পূর্ব, দুইজনের নাম ‘প’ দিয়া শুরু। আপনের বউ আছে?
– না, হেসে ফেলে পূর্ব।
– আপনেরে একটা কথা কই?
– হ্যাঁ বলো বলো, শুনবো।
– আমি বড় হইলে আপনেরে বিয়া করমু। আপনে করবেন?
পূর্ব অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালে ওর পেছন থেকে দলের সবাই হো হো করে হেসে দেয় সেদিন। কি লজ্জায় পরেছিলো ইশ! কোনো পিচ্চি মেয়ে এতো অকপটে বিয়ের কথা বলতে পারে? হঠাৎ ড্রাইভারের কথায় স্মৃতিভঙ্গ হলো ওর।

– ভাইসাব থানা আইসা পরছে।

পূর্ব গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দিতে নিলে সম্পূর্ণ নারাজ হয় ড্রাইভার। তবুও পূর্ব জোর করে ড্রাইভারের কোলে টাকা ছুড়ে দ্রুত চলে যায়। ড্রাইভার হা করে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব একমূহূর্তের জন্য মাথা ঘুরিয়ে বলে উঠে,

– চাচা পারুকে বলবেন পূর্ব এখন বিবাহিত। ওকে একদিন দেখতে যাবো। টাকাগুলো দিয়ে চকলেট কিনে দিবেন। আচ্ছা চাচা, আসি!!

.

দিনটা তপ্তকর। সূর্য এখন মধ্য আকাশে দারুন দাপটে তাপদগ্ধ করছে। খালি বাড়িতে পূর্ণতার একগুঁয়েমি লাগছে। কেউ যদি থাকতো একটু কথা বলার জন্য? আসার সময় এতো তাড়াহুড়ো করেছে যে ফোনটা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছে। লাগেজটা কোনোরকমে গুছিয়ে আয়মানকে খবর দিতেই বাইক ছুটিয়ে নিয়ে যায় স্টেশনে। ইশ! আয়মান না থাকলে কি যে হতো!! এখন যদি আয়মান এখানে আসতো? বন্ধু,ভাই, ব্রাদার হিসেবে আয়মানের সঙ্গটা ছোট থেকে প্রিয়। পূর্ণতা এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুতেই হঠাৎ রুমের দরজায় কেউ নক করলো।

– কে?
– ম্যাডাম আমি।
– ভেতরে আসুন।
– ম্যাডাম, আপনার এক রিলেটিভ এসেছে তাঁকে আসতে বলবো?

আজব তো! রিলেটিভ তো সব গ্রামে এখনো। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আগামীকাল গাড়িতে আসবে, আর মা বাবা আসবে পরশু ট্রেনে। পূর্ণতা সর্তক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– দেখতে কেমন?
– লম্বা মানুষ। কাধে একটা ব্যাগ।
– আচ্ছা আসতে বলুন।

পূর্ণতা নিচে নেমে হতভম্ব হয়ে হঠাৎ দৌড়ে সামনে গিয়ে দাড়ায়।

– তুইইই!!!
– চিল্লাস ক্যান? রিটার্ন মারমু নাকি?
– একটা মারবো! আয় উপরে আয়। এখানে প্রচুর গরম।

আয়মান পূর্ণতার পিছু পিছু রুমে এসে সোফায় বসলো। পূর্ণতা গলা চড়িয়ে চাকর ডেকে আয়মানের জন্য খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বলে ওর পাশে বসলো।
– তুই হুট করে কি করে এলি? বাড়িতে জানে?
– ওয়াকিল ভাইরে জানায়া আসছি। বান্দার বাইক তো শেষ পূর্ণতা! টায়ার রিকোভার দিতে হইছে।
– তুই যেই স্পিড দিছিলি আমি তো সিউর ছিলাম সাংঘাতিক এক্সিডেন্ট করাবি!আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে!
– তোর মতো নিমোকহারামের জন্য কিচ্ছু করতে মন চায়না। আরে, ওইসময় যদি স্পিড না দিতাম তুই এইখানে আসতে পারতি? যাইহোক,ভাই তোরে বকেনাই?
– কেন বকবে?
– ওমা! আরেক জনের বউ আমি বাইকের পিছনে বসায়া আনলাম এইটা নিয়া তোরে বকেনাই?
– উনি তোকে বিশ্বাস করে আয়মান। এটাও জানে তোর আর আমার মধ্যে সম্পর্ক কেমন।
– তুই খবর দেখছোস?
– আসলামই কাল রাত্রে। টিভি চালু করার খেয়াল আছে?
– ভালো করছোস।
– ঘটনা কি খুলে বলবি?
– স্ট্রং আছোস তো?
– প্লিজ!
– পূর্ব ভাই নাকি কোন বেডারে খুন করছে এইটা নিয়া মিডিয়া মাতামাতি করতাছে। দেখ যাইয়া।
– ভুল বললি, মিডিয়া যদি মাতামাতিতে থাকতো তাহলে অলরেডি বাড়ির সামনে জটলা দেখতি। কাল রাতে উনি আমাকে সব কিছুই বলেছে।

গতরাতে পূর্ব আমাকে প্রতিটা বিষয় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে। ও যেই পার্টিতে কাজ করছে সেখানে এমন তথ্য আছে যা পূর্বের সাথে খোলামেলা আলোচনা করেছে মূখ্য সাহেবরা। পার্টির অন্যান্য বড় নেতারা এ নিয়ে প্রচুর ক্ষুদ্ধ হয়েছে। দুদিনের নওজোয়ান ছেলের উপর উর্ধ্বতন সাহেব কি করে এতোটা ভরসা করে তা ভেবে পায়না। কাল চ্যাটার্জী নামের এক ভদ্রলোকের নাম শুনেছি। পূর্ব লোকটাকে রীতিমতো গালিগালাজ করে কথা বলে। পূর্বের মুখের ভাষা এতোটা বিশ্রী তা কল্পনাও করতে পারিনি। লোকটা নাকি খুবই খারাপ। এক নাম্বার লম্পট! তবে ওর নামের মামলাটা চ্যাটার্জী করেনি, করেছে অন্যকেউ। পূর্বের চেয়ে যারা বয়সে বড় ও প্রবীণ তারা বেশিরভাগ টাইম ওকে সহ্য করতে পারেনা। ওর ধারনা তাদের মধ্য থেকে কেউ বানোয়াট মামলা সাজিয়েছে।

আয়মান দুপুরের খাবার খেয়ে গেস্টরুমে ঘুমাচ্ছে। আমি সকাল থেকে কিছুই খেতে পারিনি, জানিনা পূর্ব আসলে কিরকম ধমক খাবো, না খাওয়া নিয়ে। ঘড়ির কাটা পিলপিল করে চলে যাচ্ছে আর এদিকে আমার ভেতরের অবস্থা অসাড় হয়ে আসছে। আধঘন্টা ধরে রুমের ভেতরে পায়চারি করছি। মনে শান্তি নেই। ওদিকে থানায় কি হচ্ছে তা জানার জন্য ব্যকুল হয়ে আছি। সময় আরো একঘন্টা পেরুলো। সূর্য এখন পশ্চিম আকাশে চলে এসেছে সময়টা মূলত বিকেল। জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম, দুমকা হাওয়া এসে গা ঠান্ডা করে দিলো। সকাল ন’টায় বেরিয়েছে পূর্ব এখন ঘড়িতে পনে পাচঁটা। প্রায় আটটা ঘন্টার ব্যবধানে ওর সাথে কি প্রলয় হচ্ছে এখনো অজানা। কাল জার্নি করে এসে রাতটা ঘুমায়নি। সকালেও তেমন খায়নি ক্লান্তিকর দেহটা নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছে। মনেমনে শুধু জপে যাচ্ছি ওর উপর কোনো কাল না আসুক, সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক। কেনো এই রাস্তায় ওর যেতে হলো? কি দরকার ওর মানুষের সেবা করে? মানুষ কি ওকে বিপদের সময় দেখতে আসবে? কেউ আসবেনা জেনেও নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকার করার মানে কি? হঠাৎ প্রশ্নের প্রহর ঘুচাতে বোধহয় গেট দিয়ে ঢুকলো পূর্ব। আমি জানালা দিয়ে ওকে দেখছি এটা ওর নজরে আসার কথা না। শুভ্র পান্জাবীতে দ্রুতবেগে হেঁটে আসছে পূর্ব। এরপর আর দেখা গেলো না ও ভেতরে ঢুকে গেলো। আমি জানালার ডানপাশে বাহু ঠেকিয়ে আকাশ দেখছি। যখন মন উদাস তখন আকাশও উদাসী লাগে, যখন মন ভালো তখন আকাশ দেখতে দারুণ লাগে। রুমের মধ্যে পায়ের শব্দ পেতেই কানে এসে গেলো ওর গলা,

– পিছনে ফিরো!

জানালা থেকে সোজা হয়ে পিছু ঘুরে দেখলাম। পান্জাবী ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। পূর্ব হাত ভাঁজ করে কঠোরভাবে তাকিয়ে আছে। আমাকে একদফা কঠিনভাবে ঝারি দেওয়ার জন্য সে সদা প্রস্তুত! আমি সামনে গিয়ে পান্জাবীর বোতাম ধরতে চাইলাম ও এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
– ঘেমে গেছি চোখে দেখো না? আর এসব কি পূর্ণতা? না খেয়ে দেবদাস হওয়ার মানেটা কি? আমি তোমাকে বলে গেছিনা আমি ফিরবো? তোহ্? না খেয়ে আমাকে দোটানায় ফেলার কারন কি?

পূর্ব পকেট থেকে ওয়ালেট, রুমাল, ইয়ারপড বের করে রাখছিলো। রাগত সুরেই বলতে লাগলো,

– থানায় গিয়েও যতো ঝামেলা! যেই বদমাইশ আমার নামে মামলা করেছে, সে আমাকে ঠিক করে চিনেই না অথচ মামলা ঠুকে খালাস! বিডি’র পুলিশ যে দিনদিন টাকার জন্য চুম্বক হয়ে যাচ্ছে আজকে সাক্ষাৎ প্রুফ পেলাম। একটাকেও ছাড়বো না আমি। ….

সবগুলো কথা শুনলাম ঠিকই কিন্তু চুপচাপ এক পা এগিয়ে আবার পান্জাবীর বোতামে হাত দিলাম। পূর্ব খেকিয়ে উঠলো,

– একটা দিবো কিন্তু! বলছি না শরীর ঘামে ভেজা! সারাদিন গোসল ছাড়া আছি জানার পরও কাছে আসছো কেন? দূরে থাকো।

আমি একমূহূর্ত কঠিন চাহনিতে তাকালাম তারপর শুরু করলাম জেদ দেখিয়ে পান্জাবীর বোতাম খুলতে। পূর্ব আমার উপর মারাত্মক রেগে গিয়ে হাত চেপে ধরলো, আমি বেপরোয়া ভঙ্গিতে শেষ বোতামটা খুলতে না পেরে ছিড়েই ফেললাম। ও ভীষণ ক্রদ্ধ গলায় বললো,

– অতিরিক্ত পূর্ণতা! কেনো জোর করছো? এমনেই বিশ্রী অবস্থা, ঘামের উৎকট গন্ধ তবুও…! ধ্যাত! তোমার সামনে এসে খোঁজ করাটাই আমার বিরাট ভুল হয়েছে!

পূর্বের চেচামেচি যে নিচ পযর্ন্ত চলে যাচ্ছে সেটা আয়মানের হুড়মুড় আগমনে বুঝতে পারলাম। ও দরজায় দাড়িয়ে সদ্য তন্দ্রা ত্যাগ করে হাপিত্যেশ গলায় বলছে,

– কি হইছে! কি হইছে! ভাই আপনে চিল্লান কেন?

পূর্ব অবাক চক্ষুতে হা করে একবার আয়মানের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। আমি তখন আলমারি থেকে ওর পোশাক বের করছি, আয়মান ধুপধাপ এগিয়ে এসে বেকুবের মতো বললো,

– ভাই আপনে ওরে বকলেন? কেন বকলেন? খ্যাক খ্যাক না করলে আপনের চলেনা? সারাদিন ও কেমন টেনশনে ছিলো ওইটা জানেন? আসতে না আসতেই ওরে বকলেন! আজাইরা বাইন…

আয়মান খুবই ভয়াবহ একটা গালি দিতে নিয়েছিলো আমি তাড়াতাড়ি চিৎকার করে উঠলাম,
– আয়মান! তুই এখানে এসে ফাপড় দেখাচ্ছিস কেন? যা বাইরে যা! যা বলছি!

পূর্ব থতমত খেয়ে আয়মানকে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কখন এলে? এলে তো এলে, খবর দিবেনা?

আয়মান এখনো চোখ রাঙিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই হারামজাদার ছোট থেকেই স্বভাব, কেউ আমাদের তিন ফ্রেন্ডকে ধমক দিলে ও বীর সেনাপতি বাহুবলীর মতো রণবীর হয়ে যায়। আমি যে বিবাহিত বা এটা আমাদের স্বামী স্ত্রীর গোজামিল অবস্থা এটা ও ভুলেই বসেছে। পূর্ব প্রথমত অবাক ও এখানে কিভাবে, দ্বিতীয়ত আশ্চর্য আয়মানের মতো শান্ত বাসিন্দা রাগান্বিত হয়েছে। আমি পূর্বের হাতে পোশাক ধরিয়ে বললাম,

– দুপুরে এসেছে। ও ভেবেছিলো তুমি আমার উপর রাগ করে হয়তো কথাই বলছো না, তাই সিচুয়েশন দেখতে ছুটে এসেছে।

এবার আয়মানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– বন্ধু চেতিস না। ঠান্ডা পানির মতো ঠান্ডা হয়ে যা। পূর্ব আমাকে বকেনি। কিন্তু তোর ব্যবহার দেখে বকা খাই কিনা….

আমার কথায় দাড়ি ঝুলিয়ে আয়মান ফট করে বললো,
– ও পূর্ব ভাই? আমি সরি ভাই। আমি আসলে বুঝতে পারিনাই। ঘুমের মধ্যে আপনার চড়ানো গলা শুনে রাগ উঠছিলো। আমার বইন তো! ওরে এমনে কেউ বকতে দেখলে আমার জিদ উঠে।

– রুমের বাইরে যাও আয়মান!

– ভাই আপনে ওরে বকবেন? না ভাই প্লিজ! দোহাই! দেখেন আমার জন্য বকাটকা দিয়েন না।
– আমি বকবো না মারবো সেটা আমার ব্যাপার। তোমাক যেতে বলছি।
– আল্লাহ্! দেখেন ভাই, আপনে চাইলে হাত জোর করে মাফও চাইতাছি ওরে বকবেন না।

আমি দুজনের এলাহি কীর্তি দেখছি। আয়মান প্রথম খ্যাঁকশেয়ালের মতো খেকিয়ে উঠলো এখন ভেজা বিড়ালের মতো মিউমিউ করছে। অপরদিকে পূর্ব সাহেব আহত হরিণের মতো আশ্চর্য হয়েছিলো শেষে সিংহের মতো গজগজ করছে। হাউসফুল ড্রামা! চলুক…

– পূর্ব ভাই…
– যেতে বলছি!
– বিশ্বাস করেন,
– তোমার জন্য আমি ওকে থাপ্পড় মারবো আয়মান!

পূর্বের ঝাঁঝালো কন্ঠে কেঁপে উঠলাম দুজন। আমি সিউর! পূর্ব আমাকে ওর গাফিলতির জন্য পাক্কা দুঘন্টা কোমরের বেল্ট খুলে পেটাবে! আয়মান অনেকটা ঠেলে ঠেলে বাইরে চলে গেলো, ইচ্ছাহীন যাওয়া যাকে বলে। যাওয়ার আগে আরেকবার আকুতিভরা কন্ঠে বললো,

– ও ভাই? আপনে না ভালো মানুষ? ওর মতো মাসুম শিশুরে মারবেন? ওরে দেখলে সাতখুনের গুন্ডাও বলবো বাবু কোলে নেই? নাউযুবিল্লাহ…কি বলতাছি এগ্লা। থুক্কু থুক্কু! পূর্ব ভাই? ওরে…

– গেট আউট!

পূর্ব ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো! এমন ভয়াবহ শব্দে আমি আরো একবার শিউরে উঠলাম। সমস্ত সাহস নিংড়ে পানি পানি হয়ে গেলো আমার। ‘বজ্রপাত আঘাতের পর শব্দ করে, আঘাতের আগে না’ — পূর্ব খামোশ থাকলে রাগ সহ্য করে, রাগ অসহন হলে কাউকে ছাড়েনা। আমার হাত টেনে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘার্মাক্ত পান্জাবী একটানে খুলে সাংঘাতিক রাগ দেখিয়ে থুতনি উঁচু করতেই ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণতায় আকড়ে ধরলো। ঘাড়ের কাছে চুলের ফাঁক গলে আঙ্গুলের স্পর্শ জাকিয়ে ধরেছিলো। হিংস্রতার ক্ষোভ ক্ষণপরে ছেড়ে দিলো ঠিকই কিন্তু কিছুক্ষণ আমার উপর পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হনহন করে পা চালিয়ে কাধে গ্রে টিশার্ট ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দরজাটা ঠাস করে লাগালো। চমকে উঠতেই আমি ঠোঁটে হাত দিতে নিবো আবারও দরজা খুলে মাথা উকি মেরে কপাল কুঁচকে বললো,

– ওকে বলে দিও আমি এমন শিশুকে দেখলে কন্ট্রোল করতে পারিনা। আগেও পারিনি এখনো পারবো না! ঘাম শরীরে বাধ্য করলে চুমু দিতে! ব্যথা পেলে আই হেভ নো গাট্স!

মানে? এই কথার সারমর্ম কি? প্রশ্ন করার পূর্বেই পূর্ব দরজা লাগিয়ে দিলো আরকি!!

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

#মমোর গ্রুপ লিংক —

https://facebook.com/groups/556329845262224/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here