তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৫১.
#ফাবিয়াহ্_মমো
রাতটা প্রচণ্ড নিরব। কোনো শোরগোল নেই চারপাশে। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। বিছানায় সটান হয়ে কপালে কবজি তুলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে পূর্ব। মাথায় অদ্ভুত ঝিমঝিমানি ভাব। কানে ভোঁ ভোঁ করে শব্দ হচ্ছে। শরীর নিস্তেজ লাগছে। অসহ্য অনুভব হচ্ছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর। গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে ব্যাকুল মন প্রচণ্ড অবসাদগ্রস্তে নিংড়ে আসছিলো। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিলো পূর্ণতার কাছে! একটাবার ওর হাতদুটো ধরে বুকে মাথা রাখার জন্য আনচান করছিলো। সে কেনো পারলো না? আজ পূর্ণতার কাছে গেলে পূর্ণতা কখনোই ওকে ফিরিয়ে দিতো না। রাগ, অভিমান, ক্ষোভ নিয়ে পূর্ণতা বেশিক্ষন থাকতে পারেনা। এসব নিয়ে ভাবতেও বুকের ভেতরটা খানখান হয়ে ছিড়ে যাচ্ছিলো পূর্বের। মাঝেমাঝে ঠিক কি হয়ে যায় ও? কেনো সে রাগের কাছে বেকাবু হয়ে পরে? কি নিয়ে অদ্ভুত আচরণ করে সে? কেনো তার মাথার উপরে এতোসব দায়ভার এসে ঠেকলো? আজ বাবা সুস্থ হলে লাখ লাখ টাকার লোনের চিন্তায় সে এভাবে আদৌ মরিয়া হয়ে উঠতো? নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকেই সে গালাগাল করছিলো প্রচণ্ড। আজ পূর্বের মন ও মস্তিষ্ক প্রচণ্ড কুরুক্ষেত্রে লিপ্ত। কিছুইতেই সেটা শান্ত হতে চাইছেনা। আজ রাতটুকু সে কিভাবে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিবে? সোজা এমপি পদটা হাতছাড়া করে দিবে? দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাটা এভাবে ধূলিসাৎ হতে দেখবে পূর্ব কখনো সেটা ভাবতে পারেনি। মানুষকে সেবা করার জন্য যে মূলব্রত সে পণ করেছিলো সেটা সে ছাড়তে একেবারেই নারাজ। যোগ্য মানুষের জন্য পদটা ছেড়ে দিলে আজ মনটা শান্তি পেতো। কিন্তু একটা অসাধু, লম্পট, বদমাশ লোকের জন্যে পদটা ছেড়ে দিবে তা যে অসম্ভব!এমন লোক দেশের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মানুষের অন্নকষ্টে আরো দূর্ভিক্ষ বারিয়ে দিবে। সরকারের অগোচরে সর্বেসর্বা অধিকার নষ্ট করতেও এরা পিছপা হবেনা। পূর্ব কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। একদিকে পূর্ণতার সাথে ভুল বুঝাবুঝি। অন্যদিকে ইমতিয়াজ উদ্দিনের প্রস্তাব। ঠিক কোন সিদ্ধান্তটা আগে নিবে এ নিয়ে প্রচুর দ্বিধাদন্ডে ফেসে যাচ্ছিলো পূর্ব।
.
রাতেরবেলা মেয়ের হঠাৎ আগমনে বেশ আশ্চর্য হয়েছে খোদেজা। অর্নগল প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তরের পাট চুকায়নি পূর্ণতা। সে চুপচাপ লাগেজ টেনে নিজের বদ্ধ রুমের দিকে চলে যাচ্ছিলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ঘরের লক মোচড়ে নিজের রুমে ঢুকলো। খোদেজা দরজা আটকানোর সময় ঘড়িতে সময়টা একবার দেখে নিলেন। এই রাতেরবেলা নিশ্চয়ই পূর্বের সাথে ঝামেলা বাধিয়ে পূর্ণতা এখানে এসেছে। মনেমনে আরেকদফা চটে উঠলো খোদেজা। পূর্বের জ্বালায় অতিষ্ঠ বোধ করছেন তিনি। বিয়ের পর মেয়েটাকে আদৌ শান্তি দিয়েছে কিনা সন্দেহ উনার। পূর্ণতার বাবা ব্যবসার তাগিদ আজও শহর ছাড়া। খোদেজা নিঃশব্দে পূর্ণতার রুমে এসে দেখেন মেয়ে সদ্য হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছছে। চেহারায় কেমন অসুস্থ ভাব দেখা যাচ্ছে। খোদেজা রুমে ঢুকে বড় লাগেজের দিকে একপলক তাকিয়ে শেষে পূর্ণতার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন,
– তোর জামাই আর শান্তি দেয়নি, না?
আচমকা মুখ মোছা থেমে গেলো পূর্ণতার। ধীরগতিতে মুখের উপর থেকে তোয়ালে নামিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
– উনি আমাকে কবে অশান্তি দিয়েছেন মা? কেনো উনাকে কটাক্ষ করে কথা শোনাচ্ছো? আমি যে এখানে এসেছি তোমার কি খুব আপত্তি হচ্ছে? যদি হয়, তো বলো! আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।
– আমি তোকে কখন বলেছি আমার আপত্তি আছে? যতদিন ইচ্ছে থাক। কিন্তু তোর জামাই যেনো এখানে না আসে। ওর মুখদর্শন করতে আমি ইচ্ছুক নই।
– তোমাক মুখ দেখানোর টাইম উনার নেই। উনি যথেষ্ট ব্যস্ত মানুষ।
– তো আমার এখানে কি জন্যে এসেছিস? যা, স্বামীর কাছেই যা। এখানে পরে থেকে কি করবি?
– আমি আবার বলছি মা। যদি তোমার সমস্যা থাকে আমাকে বলো। আমি লাগেজ ঘুরিয়ে সোজা হোটেলে উঠছি।
– থাক। কোথাও যেতে হবেনা। বুঝেছি তো ওই বেয়াদব তোকে জাদুবশ করেছে। ওর নাম ছাড়া তুই কিচ্ছু বুঝিস না। রাতে খেয়েছিস? ভাত দেবো? আজ শুটকি রেধেছি। খাবি নাকি দু লোকমা?
পূর্ণতা মাথায় হাতখোপা বাধাতেই বললো,
– ঝাল দিয়েছো? না দিলে দুটো শুকনো মরিচ মচমচ করে ঘিয়ে ভেজে দাও।
– এই রাতে তুই ঝাল খাবি?
– হ্যাঁ খাবো।
খোদেজা খুব অবাক হলেন। কিন্তু সেটা চেপে গেলেন। মেয়ের মনমতো টেবিলে ভাত বেড়ে দুটো শুকনো মরিচ মচমচ করে ঘিয়ে ভেজে আনলেন। পূর্ণতা লাগেজ থেকে আলগা কাপড়গুলো বের করে আলমারিতে তুলছিলো। অন্তত সাতদিন আগে ওই বাড়িতে ফিরবেনা। পূর্বের একটা উচিত শিক্ষা না হওয়া অবধি পূর্ণতা এখানেই থাকবে। ভার্সিটির নোটগুলোও সে বুদ্ধি করে এনে ফেলেছে। এখন আর চিন্তা নেই। এবার একটা কঠিন হেস্তনেস্ত সে করবেই।ঞ
খাওয়ার টেবিলে বসে শুটকির গন্ধে দুইবার বমি করেছে পূর্ণতা। খোদেজা চোখ বড় বড় করে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া কিছুই হতে পারছিলো না। হাবভাব দেখে যা অনুমান করছে তা কি সঠিক? নাকি গ্যাষ্ট্রিকজনিত সমস্যা? শেষে কৌতুহল না চাপতে পেরে পূর্ণতাকে জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে খোদেজা। পূর্ণতা গর্ভধারণের সত্যটা খোদেজাকে জানিয়ে দেয় শেষমেশ। খোদেজা খুশিতে আটখানা হতেই আবার মিইয়ে যান গম্ভীর ভঙ্গিতে। পূর্ণতা শর্ত, কসম, ওয়াদা তিনটাই জুড়ে দেয় এখুনি কাউকে না জানাতে। তবে খোদেজার আনন্দ যেনো আকাশ ছুঁইছুঁই। মেয়ের মা হওয়ার খবর শুনে নিজের মাতৃত্ব দিনের স্মৃতি মনে পরলো উনার। আনমনে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত বোধ করছেন খোদেজা। এরপরই শক্ত হয়ে যান পূর্বের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভেবে। মেয়েটা ওই ছেলের কাছে আদৌ সুখ পাবে? যদি পূর্ব ওকে একফোঁটা কষ্ট দেয় খোদেজা নিজের মেয়েকে নিজের কাছে এনে ফেলবে। আর থাকতে দিবেনা পূর্ব নামক বেয়াদবের কাছে।
.
সকালের নাস্তা করতে পারেনি পূর্ব। খালিপেটে একগ্লাস পানি খেয়ে সাদা পান্জাবী গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পরেছে সে। নিজের দিকে খেয়াল রাখার ছিটেফোঁটা সময় নেই পূর্বের। আজ পার্টি অফিসে গিয়ে ইলেকশনের ব্যাপারে জরুরি আলোচনায় বসবে। ইমতিয়াজ উদ্দিনের প্রস্তাব নিয়ে পুরো রাত ভেবেছে পূর্ব। সেই সাথে ভেবেছে পূর্ণতার ব্যাপার নিয়েও। পূর্ণতা আপাতত ওর মায়ের কাছেই থাকুক। কিছুদিন বাবা-মায়ের সাথে থাকলে একাকিত্বের সময়গুলো ঘুচে গিয়ে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠবে। তাছাড়া এখান থেকে ভার্সিটি যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য।। তাই ওখানে থেকে কিছুদিন আরামে যেতে পারবে পূর্ণতা। গাড়ি বাইপাস রোডের কাছে পৌঁছতেই মোমিনকে কল করলো পূর্ব। মোমিন সাথসাথেই কল রিসিভ করে বললো,
– বস আপনে আইসেন?
– চোখ ডানে ঘুরাও।
মোমিন রাস্তার ধারে দাড়িয়ে ফোন কানে রেখে পূর্বের জন্য অপেক্ষায় ছিলো। পূর্বের নির্দেশমতো মাথা ডানে ফিরতেই পূর্বের গাড়িটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
– বস নামেন নামেন, আমি চালাই। আপনের মাস্ক কই?
পূর্বের তৎক্ষণাৎ খেয়াল হলো আজ এই প্রথম সে মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরিয়েছে। প্যান্টের পকেটে, পান্জাবীর পকেটে, গাড়ির ভেতরেও সে মাস্ক নিয়ে বের হয়নি। একে তো ব্যস্ত সড়ক, তার উপর মাস্ক ছাড়া বের হওয়াটা একদমই অনুচিত। পূর্ব পকেট থেকে একটা রুমাল নিয়ে মুখে চাপলো। এরপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের সিটে বসতেই মোমিন ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। পূর্ব সিটে পিঠ হেলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মোমিন সেটা মিররে পর্যবেক্ষণ করতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,
– বসের কি শরীর খারাপ?
পূর্ব জানালা থেকে চোখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– না।
মোমিন উত্তরটা শুনে মৃদ্যু হেসে আবার মনোযোগ দিলো গাড়ি চালানোর দিকে। আজও তার বসের মন ভালো নেই। তার বস মানুষটা সকলের অগোচরে গাড়ির মধ্যে যে রূপ নিয়ে থাকে সেটা দেখলে সকলের মায়া লাগতো। এমন রাশভারী, রাগী, গম্ভীর মানুষটা গাড়ির ভেতরে দুঃখী হয়ে থাকে। অসহায় জীবের মতো চুপচাপ শান্ত হয়ে যায়। দুনিয়ায় কেউ নেই – এমন একটা বোধ নিয়ে চোখ করে থাকে গাড়ির সিটে।
পার্টি অফিসে গিয়ে জানতে পারলো আলোচনার সময় একটু পিছিয়েছে। এখনো দলের কিছু উর্ধ্বতন নেতারা আসেনি। পূর্ব গোল টেবিলের বড় রুমে না গিয়ে অন্য একটা কক্ষে যেয়ে ইজিচেয়ারে বসে পরলো। অন্যান্য নেতারা যারা অফিসে উপস্থিত ছিলো তাদের বেশিরভাগই একসঙ্গে জড়ো হয়ে খোশমেজাজে গল্প করছে। পূর্ব নিরিবিলি স্পেস নিয়ে বসতেই হঠাৎ দরজায় ঠকঠক কড়া নাড়লো কেউ। পূর্ব চোখ খুলে সেদিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো বাদামী পান্জাবী, সাদা পায়জামা, হাতের দশটি আঙ্গুলেই আংটি ঝলমল করছে, দাড়ি মেহেদিতে লাল এবং ঠোঁটে রহস্যজনক হাসি ঝুলছে। পূর্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
– আসুন ইমতিয়াজ সাহেব। চেয়ারে বসুন।
ইমতিয়াজ উদ্দিন সেই রহস্য হাসি দিয়ে পূর্বের সামনে চেয়ার টেনে বসলেন। পূর্ব পান্জাবীর হাতা গুটাতে ভুলে গিয়েছিলো। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পান্জাবীর হাতা কনুইয়ে ভাঁজ করতে উদ্বুদ্ধ হলো। সৌজন্য গলায় বললো,
– ঠান্ডা না গরম? কি আনতে বলবো ইমতিয়াজ সাহেব?
ইমতিয়াজ উদ্দিন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছুক্ষণ মৌনব্রত পালন করে সরল গলায় বললেন,
– ব্যাংকের লোন পরিশোধ করতে চেকে কত এমাউন্ট বসাবো?
– আপনি বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন ইমতিয়াজ সাহেব।
– আমি এখানে কারোর কপচানো শুনতে আসিনি। যা দরকার তাড়াতাড়ি এখানে ঝেড়ে ফেলো। বলো চেকে কতো বসাবো? তিন কোটি চলবে?
পূর্ব পান্ঞ্জাবীর হাতা ভাঁজ করে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে আঙ্গুল আবদ্ধ করে বসেছিল। ইমতিয়াজ উদ্দিনের কথার ভঙ্গি দেখে সে চেয়ারে পিঠ ছেড়ে দিলো। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্ব? সে কি এমপি পদপ্রার্থী ছেড়ে দিবে? পার্টিকে সরাসরি ‘না’ করে দিবে? নানা প্রশ্ন যেনো ঘুরঘুর করে বিশাল ঢেউ তুলছিলো। ইমতিয়াজ উদ্দিন ফ্যানের নিচেও চুটিয়ে ঘামছেন। পূর্বের একটি সিদ্ধান্ত এখন এসপার-ওসপার কাহিনী সৃষ্টি করতে পারে। পূর্ব মাথাটা ডানকাত করে সরু দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
– আমার তরফ থেকে মিষ্টি খেয়ে যাবেন ইমতিয়াজ সাহেব। এবছর এমপি পদপ্রার্থী হওয়ার সৌভাগ্য পাচ্ছি। দুয়া করবো নেক্সট টিকিটটা যেনো আপনি পান। আর যদি কপালে সেটা নাও থাকে, তবে ভেবে নিবেন আপনার মতো অকর্মণ্য দুষ্ট লোককে পার্টি কখনো পছন্দ করেনি। যেতে পারেন।
পূর্বের চটান চটান উত্তর ও সিদ্ধান্তে অটল দেখে বেশ ক্ষেপে গিয়েছেন ইমতিয়াজ উদ্দিন। তিনি টেবিলে সজোরে একটা ঘুষি মেরে হুড়মুড় করে পূর্বের কলার টেনে ধরলেন। বাঁজখাই গলায় অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললেন,
– দুই দিনের সন্ন্যাসী, ভাতরে কয় অন্ন! তোর মতো বাইন্ঞ্চোদ আমাকে নক্শা শিখাবে? তোর জীবন যদি নষ্ট না করছি! তুই কি ভাবছোস? ইলেকশনে জিতলেই পাওয়ার পাবি? তোর মায়রে বাপ! দ্যাখ এই ইমতিয়াজ তোর কি দূর্দশা করে! তুই বিয়ে করছিস না? তোর বউকে আমি —- !
পূর্ব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেও শেষোক্ত গালি ও বাক্য শুনে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি। হাত উঠিয়ে ইমতিয়াজ উদ্দিনের চোয়াল বরাবর ঘুষি মারে সে। ইমতিয়াজ উদ্দিন ছিটকে দূরে গিয়ে পরলে পূর্ব পান্জাবীর কলার ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ায়। ইমতিয়াজ উদ্দিনের জিভে নোনাস্বাদ লাগছে। উনি চটজলদি জানালার কাছে গিয়ে একদলা থুথু ফেলে আশ্বস্ত হলেন রক্ত পরছে। পূর্ব সেখানে দাড়িয়ে থেকে ইমতিয়াজ উদ্দিনকে আর কিচ্ছু বলেনি। আজ কোনো ঝামেলা ডাকতে প্রস্তুত না পূর্ব। ঠিকঠাক মতো ইলেকশনের ফরমালিটি সব ফিউফিল করতেই দলের উর্ধ্বতন নেতা মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন পূর্বকে বললেন,
– দলের ব্যাপারে সকল নীতি আর্দশ তোমার জানা। আশা করবো এবারের নির্বাচনে তুমি বিপুল ভোটেই বিজয়ী হবে। কিন্তু সাবধান, নিজের ব্যাপারে যতটুকু স্বচ্ছ আছো, কাজের ব্যাপারেও সেটা দেখাবে। যাইহোক পুরোদমে প্রচারণার কাজে নেমে পরো। বাকিটা ভোটে দেখা যাবে।
– ধন্যবাদ স্যার। আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো বিজয়ী হওয়ার। দেশ ও দেশের মানুষকে সেবা করার জন্য যে সুযোগ আপনারা দিয়েছেন, আমি যথাযথ ভাবে পালনের জন্য অবশ্যই সচেষ্ট হবো। চেষ্টা করবো বিজয়ী হওয়ার এবং জনগণের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। ইনশাআল্লাহ।
পূর্ব সব ফর্মালিটির কাগজপত্র নিয়ে প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সেখানে সংবাদ মাধ্যমে ছোটখাটো ব্রিফ দেওয়ার জন্য আয়োছন করা হয়েছে দল থেকে। পূর্ব গাড়িতে উঠতেই মোমিন গর্বিত ভঙ্গির হাসি দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরাতেই বললো,
– বস, আপনারে দেইখা আজ খুশি লাগতিছে।
পূর্ব মৃদ্যু হেসে বললো,
– কেনো?
মোমিন মেইন রোডে গাড়ি উঠাতেই মিররে তাকিয়ে জবাব দিলো,
– আপনের মতো মানুষ এমপি হইলে আমজনতার কতো সুবিধা হইবো সেইটা নিজের চোখে দেখতাছি।
পূর্ব এবার হেসে ফেললো। হাসি মুখেই বললো,
– আগেভাগেই দেখে ফেললে? মোমিন তুমি খুব মাখন চড়িয়ে কথা বলো বুঝলে? আমাকে এসব বললে লাভ হবেনা।
– না বস, আপনেরে কেন মাক্কন লাগামু? আপনে নেতা না হইয়াই এলাকার যে কাজগুলা করছেন ওই গুলাইবা কে করছে? আর এখন তো নির্বাচনেও দাড়ায়া গেছেন। আর টেনশন নাই। আল্লাহ্ দিলে এখন সব্বাই আপনের থেকে ভালো কিছু পাইবো।
– দোয়া রেখো সবার আশা যেনো পূরণ করতে পারি। সামনে কেমন ঝান্ডা খাবো তা তো জানিনা। কিন্তু এমপি হয়ে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। মানুষের জন্য রাস্তাঘাট ঠিক করা প্রয়োজন, ট্রাফিক সিস্টেম অন করা দরকার, পানির সমস্যা দেখতে হবে, আর্বজনার কথা তো বাদই দিলাম। কতশত কাজ…
বলতে বলতে পূর্ব বুকভরা নিশ্বাস ছাড়লো। শরীরে আবার ক্লান্তি অনুভব হচ্ছে। রাতটা একদম ঘুমাতে পারেনি পূর্ব। প্রথমত পূর্ণতা নেই। তার উপর নানা অপ্রীতিকর ঝামেলায় শান্তিটুকুও ছিলো না। হঠাৎ পূর্ণতার কথা মনে পরতেই পূর্ণতার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো ওর। পকেট থেকে ফোনটা বের করে অনেক অস্বস্তি অনুভব হচ্ছিলো। কি বলবে? কি বলা উচিত? একটু পর টিভির লাইভে আসলে পূর্ণতা কি ওকে দেখবে? হঠাৎ ওর মনেহলো পূর্ণতা যদি ভার্সিটিতে যায় তাহলে সে টিভি দেখতে পারবেনা। পূর্ব নানা উৎকট চিন্তার মধ্যে সবকিছু ভাবতেই পূর্ণতার নাম্বারে কল করলো। পূর্ণতা কল কেটে দিচ্ছে, রিসিভ করছেনা। কয়েকবার একই ভঙ্গিতে কল দিলো পূর্ব। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হিসেবে আবিষ্কার করলো পূর্ণতার ফোন বন্ধ। নিশ্চয়ই কালকের ব্যাপার নিয়ে এখনো মন উদাস করে আছে। পূর্ব একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলো। মোমিন গাড়িতে না থাকলে ফোন থেকে পূর্ণতার ছবি বের করে চুমু খেতো সে। কিন্তু সেটা সম্ভব না এখন। প্রেসক্লাবের সামনে গাড়ি থামতেই উপস্থিত সাংবাদিকের জটলা পূর্বকে ঘিরে ধরলো। সবার দৃষ্টি এখন তরুণ বয়সী ওয়াসিফ পূর্বের দিকে। পূর্ব গাড়ি থেকে না নামলেও সাংবাদিকের ভিড় দেখে কিছু একটা চিন্তা করতে লাগলো। এরপর ফোন নিয়ে কাউকে কল করে বললো বাইরের ভিড় থেকে কিভাবে সে ভেতরে ঢুকবে সে ব্যবস্থা করতে। কয়েকজন লোক কল করার দুমিনিটের মাথায় বেরিয়ে এসে পূর্বের সাথে প্রেসক্লাবে ঢুকে পরলো। টেবিলের উপর ফুল দিয়ে সাজানো উঁচু প্যান্ডেল মতোন জায়গায় এসে আসন গ্রহণ করলো পূর্ব। এই প্রথম ওর খুব নার্ভাস বোধ হচ্ছে। এতোগুলো ক্যামেরার সামনে এই প্রথম সে পরেছে। পুরো ক্লাবভর্তি শুধু সাংবাদিকের মানুষ ও তাদের দৃষ্টি চকচক করছিলো নানা প্রশ্নের মাধ্যমে গরমাগরম নিউজ বানাতে। ছবি তোলার ফ্ল্যাশও কিছুক্ষণ পরপর জ্বলে উঠে মুখের উপর। পূর্ব ভেতরে খুব উৎকন্ঠা বোধ করলেও বাইরে থেকে গম্ভীর চেহারা নিয়ে বসেছিলো।
খোদেজা আজ হাসপাতালে যায়নি। সকাল থেকেই পূর্ণতার বেগতিক বমিভাব দেখে সবগুলো ডেলিভারী কেস অন্য ডাক্তারের কাছে ছেড়ে এসেছে। পূর্ণতা নিজের রুমে শুয়ে আছে। খোদেজা রান্নার পর্ব সেরে টিভিতে রিপিট সিরিয়ালগুলো দেখার জন্য সোফায় বসলে হঠাৎ খবরের চ্যানেলে উনার চোখ আটকে যায়। হেডলাইনগুলো পড়ার পর বুঝতে পারে তার মেয়ের জামাই এমপি পদের জন্য নির্বাচনে দাড়িয়েছে। কতো বড় দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব জনতার সামনে এসেছে এটা ভেবেই খোদেজার ক্ষণিকের জন্য গর্ববোধ হচ্ছিলো। মানুষের জন্য সেবাধর্ম ব্যাপারটা খুব ছোট থেকেই পছন্দ করেন খোদেজা। পূর্বের ব্যাপারে যতোটুকু জরিপ চালিয়ে জেনেছে তার পুরোটাই মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ সেবা ছিলো। টিভির পর্দায় পূর্ব সকলের সামনে নিজের প্রথম বক্তব্য উপস্থাপন করছে। বলিষ্ঠ কন্ঠ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেতনা, নিজেকে আলাদা দেখানোর ব্যক্তিত্ব, সাবলীল ভাষায় গোছানো বার্তায় সবকিছু যেনো সুচিন্তিত ব্যক্তিধারার চিত্র ফুটে উঠছিলো। পূর্ণতার রুমের দিকে একবার তাকালো খোদেজা। মেয়েকে কি একবার ডাক দিবে? না, থাক। অনেক কষ্টে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে এসেছে। পরে নাহয় খবরগুলো রেকর্ড থেকে দেখে নিবে।
খোদেজার সাহচর্যে চারদিন কেটে গেলো পূর্ণতার। ভেতরের জিদ এখন আরো জমকালো রূপ ধারণ করেছে। পূর্ব নিজেকে এমন ভাবে গুটিয়ে নিয়েছে যেনো পূর্ণতার কোনো অস্তিত্ব তার জীবনে নেই। না কোনো ফোন, না কোনো যোগাযোগ, না কোনো দেখাসাক্ষাৎ, মোটকথা কিচ্ছু করেনি পূর্ব। চারটা দিন খুবই জঘন্যতম দিন হিসেবে কেটেছে পূর্ণতার। খোদেজার সামনে ভালো সেজে থাকলেও ভেতরে যে অভিমানের যন্ত্রণাগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো সেটা কাউকে দেখাতে পারছিলো না। পূর্ব একটা বার খোঁজ করেনি পূর্ণতার। সত্যিই পূর্ব ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো? নাকি অন্য কোনো কারন ছিলো? সেদিন কাটকাট জবাবে যেভাবে চলে যেতে বললো পূর্ণতার মনে দাগ কেটে গিয়েছিলো। হয়তো পূর্ব চুটিয়ে রাজনীতি করতে চাইছে। পূর্ণতার জন্য যে পিছুটান ছিলো সব ঢিলে করে দিয়েছে। আজ পূর্ণতা তার জীবনে নাহলেও চলবে। ডুকরে কেদেঁ উঠে পূর্ণতা। ঠিক কি নিয়ে সে পূর্বের জন্য আকুলিবিকুল করেছে? আজকের এই বীভৎস দিন দেখার জন্য? নাকি একটু সুখ, একটু শান্তি পাওয়ার জন্য সে ছটফট করেছে? গর্ভধারণের পর থেকে মন যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, এটুকু অনুমান করা যায় পূর্ব হয়তো ওকে আর জীবনে টানতে চাইছেনা। পূর্ণতা কান্না আর সামাল দিতে পারলো না। বিছানায় বসে মাথা নুয়ে হু হু করে কেদেঁ উঠলো পূর্ণতা। খোদেজা দরজায় ধাক্কা দিয়ে খোলার জন্য আকুতি করছেন। কিন্তু পূর্ণতার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যার জন্য সে বাঙলো বাড়িতেও দিব্যি একা একা থেকেছে সেই মানুষটা গত চারদিন ধরে বেশ শান্তিতে থাকছে। যার প্রতিটা কথা সে চুপচাপ মেনে নিয়েছে তার কঠোর আচরণ পূর্ণতার নরম মনে হিংস্র আঁচড় বসাচ্ছে। মা হওয়ার সুখটা সে পূর্বের কাছে জানাতে চেয়েছিলো সে সুযোগও পূর্ব দেয়নি। মানুষটা অগোচরেই পূর্ণতাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। চোখের বৃষ্টিধারায় গলা পযর্ন্ত আটকে আসছিলো। অসহ্য লাগছিলো, নিশ্বাসও যেনো বন্ধ হতে চাইছিলো। পূর্ণতা এভাবে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবেনা। আজই একটা ফয়সালা হওয়া উচিত। মনেমনে কঠিন কিছু কথা ভেবে পূর্ণতা দুহাতের তালুতে চোখ মুছলো। পরনের সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ বদলে একসেট ভালো সালোয়ার-কামিজ বের করলো। হালকা গোলাপীর কামিজ, সাদা সালোয়ার পরে মাথায় সাদা সুতির ওড়না টেনে নিলো। হাতে একটা কালো পার্স নিয়ে কিছু টাকা ও মোবাইল ঢুকিয়ে দরজা খুললো। খুলতেই খোদেজা হতভম্বের মতো তাকিয়ে আপাদমস্তক পূর্ণতাকে লক্ষ করে বললো,
– কোথায় যাচ্ছিস?
– বাইরে যাচ্ছি।
– এই বাইরেটা কোথায়? এই শরীরে বাইরে যাবি?
– আমি অসুস্থ না মা। আমাকে দয়াকরে যেতে দাও। একটু পরেই আসছি।
খোদেজার পাশ কাটিয়ে পূর্ণতা বেরিয়ে গিয়ে সদর দরজায় হাত রাখলো। পায়ে জুতা গলিয়ে দরজার লক খুলতেই পেছন থেকে খোদেজা বললো,
– পূর্বের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস, এটা আমাকে বললেই পারতি। নিচে যেয়ে দাড়া, আমি আসছি। একা যেতে হবেনা।
পূর্ণতা দরজা খুলে বাইরে পা রেখে উত্তর দিলো,
– আমি এখানে রাতের বেলা যদি একা আসতে পারি, তাহলে দিনের আলোতে অবশ্যই একা বেরুতে পারবো।তোমার আসতে হবেনা।
পূর্ণতা চট করে দরজা টেনে লিফটে ঢুকে গেলো। রাস্তায় দাড়িয়ে উবার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গাড়ি চলে আসলো। পূর্ণতা গাড়িতে উঠে চিন্তা করছিলো এখন কোথায় গেলে ঠিক হয়। বাঙলো বাড়িতে এই টাইমে পূর্বকে পাওয়া অসম্ভব! পূর্ব কখনোই সকাল এগারোটার দিকে বাড়িতে থাকেনা।তাহলে পার্টির অফিসে যেয়ে দেখবে? না, অফিসে গিয়ে খোঁজ করাও যাবেনা। অযথা কৌতুহল উঠবে। পূর্ণতা যদিও উবারকে বাঙলোর ঠিকানায় যেতে বলেছে কিন্তু এখন মনেহচ্ছে এটা বোকামি হলো। পূর্ণতা অনেকক্ষন চিন্তার দেয়ালে আঁকিবুকি করতেই হঠাৎ মোমিনের কথা মনে পরলো। মোমিন অবশ্যই পূর্বের আপডেট সম্পর্কে জানবে। পূর্ণতা সাথেসাথে মোমিনকে কল দিয়ে ফেললো,
– হ্যালো, আমি কি মোমিনের সাথে কথা বলছি?
ওপাশ থেকে সরল গলায় উত্তর,
– জ্বী, আপনে কেডা? আপনেরে তো চিনলাম না।
– আমি তোমার বসের বউ বলছি, পূর্ণতা কবির। শোনো এখন, তোমার বস কোথায়? উনি কি পার্টি অফিসে নাকি তোমার সাথে?
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসছেনা। কোনো সাড়া দিচ্ছেনা মোমিন। পূর্ণতা মোমিনের নাম ধরে অনেকক্ষন জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু মোমিন কেমন চুপটি হয়ে আছে যা অনেকটা আশ্চর্যজনক। পূর্ণতার হঠাৎ সন্দেহ হলো, মোমিন পূর্ণতার কথা শুনেই যেভাবে চুপ মেরে আছে নিশ্চয়ই ভয়ানক কোনো কাহিনী আছে। এসব নিয়ে ভাবতেই হঠাৎ পূর্ণতার গলা শুকিয়ে বুক কামড়ে এলো। পূর্ব কি ঠিক আছে? চারটা দিন যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে পূর্ব এমন কাজ যখনই করেছে তখনই কোনো না কোনো জানের ঝুঁকিতে সে ফেসেছে। বুকের ভেতর ধপাস ধপাস লাফাতে শুরু করেছে পূর্ণতার। অনেক জোর দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মোমিনকে বললো,
– পূর্ব কোথায় আছে মোমিন? যদি কিছু জানো, দয়াকরে আমাকে বলো। আমি সত্যি জানতে চাই ও কোথায়। মোমিন আমার মন বলছে ওর ব্যাপারে তুমি জানো।
মোমিন হাঁশফাস করছে। কিছু বলার জন্য ওপাশ থেকে ‘মানে-মানে’ করছে। প্রচণ্ড জড়তা কাজ করছে পূর্ণতাকে জানানোর জন্য। মোমিনের এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার প্রচণ্ডরূপে অস্থির করে তুলছে পূর্ণতাকে। পূর্ণতা চোখ খিচুনি মেরে একমনে আল্লাহ্-আল্লাহ্ করছে শুধু। কোনো খারাপ সংবাদ যেনো না শোনায়। কোনো অমঙ্গল কথা যেনো না বলে। পূর্ব যেনো সুস্থ থাকুক। চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছিলো পূর্ণতার। এরই মাঝে মোমিন উচ্চারণ করলো,
– ম্যাডাম, বস বাড়িতেই আছে। আপনে ওইখানে গেলেই ওনারে পাইবেন। আজ বস অফিসে যায়নাই।
বুকের উপর থেকে পাথর নামার মতো অনুভূত হলো পূর্ণতার। ধপ করে সিটের গায়ে পিঠ হেলিয়ে মাথা পেছনে ঠেকিয়ে দিলো। জোরে নিশ্বাস ফেলে মোমিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে কল কাটলো। হঠাৎ খেয়াল হলো উবারের ড্রাইভারটা আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি হলেও পূর্ণতা সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে আকাশে তাকালো। সাদা আকাশটা ধূসরবর্ণে লেপ্টে আছে। মেঘের চেহারা ভয়াবহ। বাতাসটাও কেমন ভারী ভারী লাগছে। একটু আগে পরিস্কার আকাশ দেখে বেরিয়েছিলো পূর্ণতা। কিন্তু এখন মনেহচ্ছে ঝুম বৃষ্টি হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে রৌদ্রতপ্ত পথঘাট ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে উঠছে। মানুষও তাড়াহুড়ো করছে যার যার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। নির্দেশ মতো জায়গায় উবার থামালে গাড়ি থেকে নামলো পূর্ণতা। বুকটা দুরুদুরু করছে আজ। যতই পায়ে পা চালিয়ে এগুচ্ছে ততোই মনের উঠোনে ঝড়ের তান্ডব চলছে। বাঙলোর কাছে হামেশার মতো শান্তি, শব্দহীন, নিরব। আগেভাগে কেউ বলতে পারবেনা ভেতরে মানুষ থাকে কিনা। পূর্ণতা পার্স খুলে এক্সট্রা চাবি নিয়ে দরজা খুললো। এমন ভাবেই খুললো পূর্ব যেনো শব্দ না পায়। পূর্ণতা চুপচাপ দরজা লাগিয়ে পায়ের জুতা ছেড়ে রুমের দিকে চুপি দিলো। অশান্ত মনটা আবার ছটফট করছে পূর্বকে দেখে। দৌড়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে টলমল চোখে বিছানায় ঘুমন্ত মানুষটার দিকে এগিয়ে গেলো পূর্ণতা। বড় কাঁচের জানালাটা আজ আধখোলা। শো শো করে ঠান্ডা বাতাস এসে কপালের উপর এলোমেলো চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। পূর্ব কালো টিশার্ট গায়ে সাদা ব্লাঙ্কেট টেনে বুক পযর্ন্ত ঢেকে শুয়ে আছে। পূর্বকে সুস্থ দেখে অশান্ত মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছিলো। সেই সাথে অশ্রু নির্গমন হচ্ছিলো গাল ভিজিয়ে। পূর্ণতা বেডের কাছে এসে মাথার ঘোমটা নামিয়ে পূর্বের পায়ের কাছে বসলো। নিজের অকপটে ভুলের জন্য সত্যি অপরাধী পূর্ণতা। সেদিনের আচরণের জন্য প্রচণ্ড অনুশোচনায় পূর্বের পায়ের উপর দু’হাত রাখলো পূর্ণতা।
পায়ের উপর হঠাৎ কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায় পূর্ব। ভূত দেখার মতো মারাত্মক ভিমরি খেয়ে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
– তুমি এখানে কেন পূর্ণ? কখন এসেছো? কি আশ্চর্য!! পায়ে হাত রেখেছো কেন? ছিঃ, সরো। উঠে এসো ওখান থেকে। পূর্ণ প্লিজ! পায়ে হাত রেখে কেঁদো না। কাছে এসো প্লিজ। তুমি এভাবে কেঁদো না। থামো পূর্ণ..
পূর্ণতার পিঠ কান্নার হিড়িকে কেঁপে উঠছিলো। চোখের পানি টপটপ করে ব্লাঙ্কেটের উপর গোলাকার হয়ে পরছে। মাথা ঝুঁকিয়ে নিঃশব্দে হিচকি তুলছিলো পূর্ণতা। জড়িয়ে আসা কন্ঠে বললো,
– তুমি আমার উপর যতটুকু খেয়াল রাখো, আমি জানি আমি তার একফোঁটা শোধ করতে পারবোনা। কিন্তু তুমি আমার দিকে আর আগের মতো ধ্যান দাও না পূর্ব। তুমি নিজের ওয়াদা ভেঙেছো। তুমি আমার জায়গায় তোমার রাজনীতির পেশাটাকে মূল্যায়ন দিয়েছো। আমি আজ এসেছিলাম তোমার সাথে সবকিছু শেষ করে দিতে। আজীবনের জন্য সম্পর্ক চ্ছিন্ন করতেই এসেছিলাম। কিন্তু আসার পথে গাড়িতে যখন মোমিনের কন্ঠ শুনলাম সেই ভয়টা আমাকে তখনই শেষ করে দিচ্ছিলো। তোমার ক্ষতির খবর শুনলে যে আমার বুক পুড়ে সেটা তো তুমি কোনোকালেই বুঝবেনা পূর্ব। আমার যে একটা নরম মন আছে, হালকা আচড়ে খুব ব্যথায় কেদেঁ উঠে সেটা তুমি বুঝেও বুঝতে চাওনা। তুমি সবার জন্য নিঃস্বার্থ হয়ে যাও। অথচ আমার বেলায় তুমি প্রচণ্ড স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করো। আমি কি করবো বলো না? আমি কি করলে তোমার কাছে মূল্য পাবো? আমি যে আর অস্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারছিনা, আমার তো প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। কি নিয়ে আমি শান্তি পাবো? কি নিয়ে আমি বেঁচে আছি? আমার কাছে তো তুমি ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু তোমার কাছে পাষাণ মন আছে, রাগী ব্যবহার আছে, রাজনীতি আছে, সব আছে। আমার কাছে কি আছে? শূন্য ছাড়া কিছুই নেই। তোমার মতো পাষাণ হওয়ার জন্য ঠিক কি করা লাগবে পূর্ব? কি করলে আমি তোমার মতো স্বার্থপর হয়ে সব ভুলতে পারবো? আজ তুমি চারটা দিন…চারটা আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখোনি। তোমার কাছে বাহাত্তর ঘন্টা লাগলেও আমার কাছে অনন্তকাল লেগেছে। আর তুমি এখানে আরামে ঘুম দিচ্ছো…
পূর্ণতার আছড়ে পরা কান্নার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পূর্ব। বুকের খাঁজটা ভেদ করে দেখাতে ইচ্ছে করছে ঠিক কি পরিমাণ যন্ত্রণা সে চারদিন যাবৎ লুকিয়ে রেখেছে। আরামের ঘুম তো সেই চারদিন আগেই রাতের মধ্যে শেষ। পূর্ব নিজেকে যতটা নির্বিকার দেখাচ্ছে ঠিক ততটাই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে আছে ভেতরে। পূর্ব খুব কষ্টে ঢোক গিললো। বালিশ থেকে ধীরেসুস্থে উঠে বসতেই পূর্ণতার উদ্দেশ্যে বললো,
– আমার কাছে আসো। ওভাবে পা ছুঁয়ে আমার পাপ বাড়ানোর দরকার নেই। পূর্ণ আমার কথা শুনো, আমি ওখান থেকে তোমায় উঠে আসতে বলেছি। পা থেকে হাত সরাও।
পূর্ণতা শেষ বাক্য শুনে আচানক কেঁপে উঠে। অশ্রুসিক্ত চোখদুটো দিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই ধীরেধীরে পায়ের উপর থেকে হাত সরায় পূর্ণতা। কান্নার দমকে এখনো হিচকি তুলে ঠোঁট কাপিঁয়ে শিউরে উঠছে ও। পূর্ব ডানহাতটা পূর্ণতার দিকে বারিয়ে দিতেই সে চোখ শক্ত করে হাতটা ধরতে ইশারা করলো। পূর্ণতা শুষ্ক গলায় ঢোক গিলে ফোলা চোখে একবার হাতটার দিকে, আরেকবার পূর্বের দিকে তাকালো। পূর্ণতা হাতের উল্টোপিঠে চোখ ডলে পূর্বের দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ পূর্ণতার কোল থেকে ভারী পার্সটা পূর্বের পায়ের উপর পরলো। অদ্ভুত চাপাস্বরে পূর্ব আহ্ করতেই প্রচণ্ড ব্যথিত ভঙ্গিতে চোখ কুঁচকে ফেলে তৎক্ষণাৎ! পূর্ণতা একদম হতভম্ব হয়ে যায়! পূর্বের দিকে স্থির পানে তাকিয়ে থাকতেই বুকের ঢিপঢিপানি শব্দটা আবার শুরু হয়। পূর্ব ব্যথায় আর্তনাদ করলো কেন? সামান্য পার্স ব্যাগটা পায়ে পরলে এতো ব্যথা হবে? পূর্ব ততক্ষণে চোখ খুলে স্বাভাবিক হওয়ার ভঙ্গিতে পূর্ণতাকে অজুহাত দিতে থাকে তার কিচ্ছু হয়নি।। পূর্ণতা একসেকেন্ডও অপেক্ষা না করে পূর্বের পায়ের উপর থেকে একটানে ব্লাঙ্কেট সরায়। পায়ের দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে। কখন যে হাত থেকে ব্লাঙ্কেটটা একটু একটু পরে যাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল নেই পূর্ণতার। শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। চোখের কোটর থেকে দুইকোণা বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। পূর্ব ওদিকে অস্থির হয়ে কাছে আসতে বলছে, নানা বাহানা দেখাচ্ছে, বিভিন্ন কথায় ভুলাতে চাচ্ছে, কোনো লাভ হচ্ছেনা। পূর্ণতার অবস্থা তখন চিন্তাশূন্য ব্যক্তির মতো। পায়ের টাখনু থেকে গোড়ালিসুদ্ধ পুরো সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা। কয়েকটা জায়গায় রক্ত শুকিয়ে খয়েরী হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ব্লাঙ্কেট এবার ছেড়েই দেয় পূর্ণতা। পূর্ব তাড়াতাড়ি করে ঠোঁট টিপে ব্যথা চেপে পূর্ণতার হাত ধরে ফেলে। একটানে নিজের পাশে বসিয়ে পূর্ণতার গাল মুছে দিতেই বলে,
– কিচ্ছু হয়নি। সামান্য ইন্জুরি। আমি আর দু’তিনদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবো পূর্ণ। আমার দিকে একটু তাকাও না প্লিজ…
পূর্ণতা চোখ খুলে মাথা নিচু করে আছে। একটু পরপর চোখের পাতা বুজে আবার ক্ষনিকের জন্য খুলছে। পূর্ণতা হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি পূর্ব। অত্যধিক মাত্রায় শক খেলে মানুষের যেমন চিন্তাচেতনা নষ্ট হয়ে যায় পূর্ণতার অবস্থাও তেমনই হয়েছে। পূর্ব ওর চুপটি ভাব মানতে নারাজ। একটা গালে হাত রেখে অপর গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয় পূর্ব। চোখের পাতায় কিছুক্ষন ওষ্ঠযুগল বসিয়ে পূর্ণতার গালদুটো নিজের হাতের দখলে নেয় সে। শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– আমার মতো পাষাণ তো আসলেই কেউ নেই। আমি তো জানি, আমি পাষাণ। তুমি তো পাষাণ নও পূর্ণ। তুমি কেনো আমার মতো পাষাণের পেছনে পরে আছো? আমাকে ছুড়ি দিয়ে মেরে ফেলো না প্লিজ। তুমি একেবারেই মুক্তি পেয়ে যাবা আমার কাছ থেকে। আমার মতো বদমাইশের তো বেঁচে থাকার দরকার নেই। তুমি এভাবে চুপ করে থেকো না। আমার রাগটা খুব বেশি বলেই তো আমার জীবনে তোমার মতো আর কেউ নেই। তুমি একটু তাকাও না পূর্ণ? বিশ্বাস করো আমি আরামে ঘুমাতে পারিনা। আমাকে ছুঁয়ে দেখো, আমি সত্যি খুব অসুস্থ। আজ সকাল থেকে একটু সুস্থ বোধ করছি। তোমার ওখানে এই ল্যাংড়া পা নিয়ে কিভাবে যাই বলো? শ্বাশুড়ি আম্মা কাল রাতেও কল দিয়ে তোমার কাছে যেতে নিষেধ করেছেন।। তোমার পূর্ব তো ল্যাংড়া হয়ে আছে, কিভাবে কোলে তুলে আনতাম?
পূর্ণতা ভাবশূন্য ভঙ্গিতে চুপ করে আছে। চোখের দৃষ্টি পূর্বের শান্ত চাহনির মাঝে। পূর্ব গাল থেকে হাত শিথিল করে লাগোয়া দেয়ালের কাছে বালিশ রেখে সেখানে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। পা একদম নাড়াচাড়া করতে নিষেধ করেছে ডাক্তার। তবুও পূর্ণতার আগমনে শরীর নাড়াতে কায়দা করে পা-টাও নাড়াতে হচ্ছে। পূর্ব ব্লাঙ্কেটটা টেনে পেটের উপর রাখতেই দুই বাহু মেলে পূর্ণতাকে কাছে আসতে ইশারা করে। পূর্ণতা শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই পা-টা দেখার পর থেকে। পূর্ব এবার ব্যকুল কন্ঠে মিনতির মুখ ভঙ্গিমায় বলে উঠে,
– এই পাষাণের উপর রহম করো? একটু বুকে আসো? আমি তোমায় একটু চেপে ধরতে চাই। আমিতো ল্যাম হয়ে আছি পূর্ণ। পা-ও নাড়াতে পারছিনা।
পূর্ব কথা শেষ করার পরও বাহুদ্বয় আগের মতোই মেলে রেখেছে। আকুল চাহনিতে কাছে আসার জন্য সেই দৃষ্টি যেনো তোষামোদ করছে। পূর্ণতা সেই দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতেই ধীরেধীরে পূর্বের দিকে এগিয়ে যায়। পূর্ব ওর আসা দেখে জড়িয়ে ধরার জন্য প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় চন্ঞ্চল হয়ে আছে। পূর্ণতা মানুষটার কাছাকাছি যেতেই চুম্বকের মতো আকস্মিক টান অনুভব করলো। পেশিবহুল বাহুদ্বয়ের মাঝে গুটিশুটি পাকিয়ে ওমনেই আটকা পরলো। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম যেনো। কোনোভাবেই ওই শক্ত মাশেলের বাহুদুটো থেকে ছাড়া পাওয়া যাবেনা এমন ভাবে চেপে ধরেছে পূর্ব। প্রচণ্ড উদগ্রীব কন্ঠে পূর্ব বললো,
– আর কেঁদো না। একটু শান্ত হয়ে যাও। আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরো পূর্ণ। আমি জানিতো কষ্ট দিয়েছি। আমার যেনো কঠিন শাস্তি হোক। তাও তুমি কেঁদো না। চুপ করো।
কান্নার ফিসফিস শব্দ কমে আসলেও টিশার্টে ভেজা অনুভব হচ্ছিল পূর্বের। নিজেকে কান্না থেকে সামলাতে বেশ বেগে পেতে হয় পূর্ণতার। মানুষটাকে নিয়ে কতো বিশ্রী চিন্তা করছিলো, সারাক্ষন ভাবতো পূর্ব আর আগের মতো নেই। অথচ চারদিন ধরে বাড়ির মধ্যে অসুস্থ হয়ে পরে আছে, সেবা শুশ্রূষার জন্য কেউ নেই। পায়ের এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছে এই প্রশ্ন করার মতো সৎবিৎ-এ পূর্ণতা এতোক্ষন ছিলো না। নিজেকে শান্ত করার পর চট করে প্রশ্নটা করলো,
– পায়ের এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে?
পূর্ণতার মাথায় চুমু খেয়ে পূর্ব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,
– মাইনর ইন্জুরি।
পূর্ণতা বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। সেই অবস্থায় আবার জোর দিয়ে বললো,
– বলো, কিভাবে হয়েছে?
– পায়ের উপর দিয়ে টায়ার উঠে গেছে।
উত্তরের সাথেসাথেই ঝট করে মাথা উঠায় পূর্ণতা। পূর্বের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি ফেলে সংকুচিত কন্ঠে বলে,
– তুমি সত্যি ঠিক আছো?
পূর্ব হাসি দিয়ে বলে,
– ঠিক আছি তো। কিন্তু মরে গেলে হয়তো ভালো হতো।
পূর্বের কথা শুনে কিছু বলতে যেয়েও বললো না পূর্ণতা। পূর্বের দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওষ্ঠ স্পর্শ করলো সে। পূর্ব নির্বাক! সে অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পূর্ণতার অভিমান কি গুড়িয়ে গেছে? পূর্ণতার একটা হাত তখনো পূর্বের শক্ত হাতের মুঠোতে। পূর্ণতার চোখ কিছু বলার জন্য অপ্রকৃতিস্থ করছে। পূর্ব কিছুক্ষন নিরবতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু বলতে চাচ্ছো?
– হু,
– বলো পূর্ণ। আমার কাছে কেনো সঙ্কোচ করছো?
পূর্ণতা লম্বা একটা ঢোক গিললো। পূর্বের কাছে আরেকধাপ এগিয়ে বাকি দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে দিয়ে গলার কাছে মুখ গুঁজে দিলো। পূর্ব এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা। সে দুহাতে পূর্ণতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেও খুব কৌতুহল বোধ করছে। পূর্ণতা কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু সেটা কি? কি নিয়ে বলতে এতো হিমশিম খাচ্ছে ? পূর্ণতা পূর্বের কানের কাছে মুখ আনলো। পিঠের উপর থেকে পূর্বের একটা হাত নিজের হাতে নিলো। ধীরেধীরে হাতটা নিচে নামিয়ে পেটের উপর রাখতেই পূর্ব ভ্রুঁ এবার মারাত্মক কুঁচকে ফেললো। পূর্ণতা আর দেরি না করে ফিসফিস করে কানে বললো,
– বাবা হচ্ছো।
কথাটা শুনতেই পূর্বের হাত নির্লিপ্তে পূর্ণতার হাত ও পেটের মাঝ থেকে সরে গেলো। খেয়াল হতেই পূর্ণতা চোখ খুলে পূর্বের মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো, পূর্ব দুইহাতে নিজের মুখ ঢেকে নিয়েছে। এই দৃশ্য দেখে পূর্ণতার ভয় করতে লাগলো। পূর্ব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুখটাকে মাটি করতে চাচ্ছে নাকি? পূর্ব কি খুশি না? পূর্ব বাচ্চার জন্য এখনই প্রস্তুত না এরকম কিছু বলবে? কেনো সে মুখ ঢেকেছে? প্রচণ্ড রাগ উঠেছে বলে পূর্ণতার সামনে মুখ ঢেকেছে? সব এলোমেলো হয়ে উঠলো পূর্ণতার কাছে। পূর্ণতার চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো অজানা ভয়ে। বুকে ধড়ফড় করে ভয়ংকর ঘা পেটাচ্ছে। পূর্ণতা প্রচুর সাহস জুগিয়ে পূর্বের মুখ থেকে দুইহাতের তালু সরিয়ে ফেলে। পূর্ণতা এই দৃশ্য দেখে পুরোপুরি হতভম্ব!
ফর্সা নাকটা লাল। চোখ দুটো বন্ধ। নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে ঈষৎ চেপে রেখেছে। চোখদুটোর কার্নিশ থেকে অভাবনীয় জিনিস গড়িয়ে পরছে। পূর্ণতা ওর অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পূর্ব চোখ মেলে তাকায়। লালচে নাকটা মৃদ্যু ফুলাতেই আবারও ডান চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো পূর্বের। হঠাৎ অশ্রুময় চেহারায় একটুকরো হাসির আভাস ফুটতেই পূর্ণতা সেই দৃশ্য দেখে আবারও হু হু করে কেদেঁ দেয়। কান্নায় বিজড়িত হয়ে মানুষটার মাঝে লুকিয়ে পরে পূর্ণতা। সুখে আজ মরে গেলে মনে কোনো দুঃখ নেই।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
(নোট : গত পোস্টে আমাকে এডিট বিষয়ে কিছু টিপস এবং কভার নির্বাচনের জন্য উপদেশ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জনাব পাঠক❤। )