তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৬০ ( অংশ ০১.)

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৬০ ( অংশ ০১.)
#ফাবিয়াহ্_মমো

‘নির্বাচন’ শব্দটা যতো ছোট, ততোই জটিল সমস্যায় ঘেরা এক বিশাল রহস্য ছিলো। পূর্ব জানতো না তার দলেরই কিছু লোক তার পেছনে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছে। ডানপন্থী দলের মুখ্যমন্ত্রী বিরাট চিন্তাধারা নিয়ে দেশের জন্য ভালো পরিকল্পনা রাখলেও তা যে নিজ দলের কিছু মুখোশধারী নেতার জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হচ্ছিলো সে খবর হয়তো কান পযর্ন্ত পৌঁছাতো না তার। দেশ পরিচালনার মতো বড় দায়িত্বে তিনি ব্যস্ত থাকলেও ছোট ছোট দুর্নীতিগুলো জানার উপায় কিছু ধৃষ্ট নেতারা দিতো না। পূর্ব জানতো দলের মধ্যে কিছু কিছু উর্ধ্বতন নেতা ভালো না, তারা তাদের পলিটিক্যাল পাওয়ারটা জনগণের জন্য ব্যবহার করতো না। অন্যায়ভাবে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে পাওয়ারের জোর দেখিয়ে নিজেদের কার্য হাসিল করে তারা। সেদিন পূর্ণতা ফুপিয়ে কেদেঁ যে কথাগুলো বলেছিলো সেগুলো শুনে প্রচণ্ড অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেলে পূর্ব। পূর্ণতার মধ্যে হুটহাট যে ক্ষেপে যাওয়ার বিশেষ গুণটি আছে সেটাও দেখে নিয়েছে সে। অনেকটা ঘুমন্ত বাঘিনীর মতো আচরণ করে পূর্ণতা। সবসময় চুপচাপ থাকলেও যখন রাগে তখন ভালোই ক্ষিপ্ত আচরণ করে ও। পূর্ব যখন চোখ থেকে জোর করে কবজি উঠায় তখন রেগে গিয়ে পূর্ণতা ধাক্কা মেরে মুখ ঘুরিয়ে উঠে বসে। চোখ ছাপিয়ে অশ্রু পরতে থাকলেও সে পূর্বের দিকে ফিরেও তাকায় না আর। রাতটা গভীর এবং চারপাশ জোৎস্না আলোয় নিস্তব্ধ পরিবেশ। পূর্ণতার ঠিক পেছনেই ছিলো পূর্ব। শোয়া থেকে উঠে বসে ও। মাথা নিচু করে চুপ থাকলেও ভেতরটা চুরমার হয়ে আসছিলো তখন। একদিকে পূর্ণতার জিদপূর্ণ কান্না, অপরদিকে নির্বাচনের চিন্তা। দুটোই পূর্বকে অজানা ভয়ের চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই চুপচাপ বসে থাকলে মুখ তুলে পূর্ণতার দিকে তাকায় পূর্ব। কান্নার হিড়িকে অনবরত পিঠটা কাঁপছে, মাথাটা নিচু করে রাখা ওর। পূর্ব এগিয়ে গিয়ে খোপার পিনটা টেনে চুল ছেড়ে দিলো। একহাতে চুলগুলো পিঠের উপর থেকে সরিয়ে ডানকাধের ওপাশে ফেলে দিলো।ঘাড়ের উপর গভীর আবেশে চোখ বন্ধ অবস্থায় ওষ্ঠযুগল ছুঁয়িয়ে দেয় পূর্ব। পূর্ণতা মৃদ্যু ভঙ্গিতে কেঁপে উঠতেই পূর্ব তার হাতজোড়া দিয়ে পূর্ণতার কোমর জড়িয়ে ধরলো। পিঠের উপর গাল চেপে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বললো পূর্ব,

– তুমি আমার জন্য কতটুকু মূল্যবান আমি আর কিভাবে বোঝাই? এভাবে কাঁদলে যে আমার খারাপ লাগে এটা বুঝো না? সবসময় আবেগী হলে তো চলেনা। আজ এতো সুন্দর করে আমার জন্য সেজেছো, অথচ কেদেঁ-কেটে সব নষ্ট করে দিচ্ছো। এটা কি ঠিক পূর্ণ? আমাকে ধরো, আদর করো, দরকার পরলে দুই চারটা চড় মারো আমি আজ বাধা দিবো না। কসম, আমি একটুও রাগ করবো না। আমি তোমার সাথে যা করেছি সেটার জন্য অপমান, ধিক্কার, থাপ্পড় পাওয়ার যোগ্য। তুমিতো এসবের কিছুই করোনি। কেনো করোনি? এতো সহ্য করলে কিভাবে সামনে বাঁচবে পাগল? নিজেকে শক্ত করো। আমাকে মারো-ধরো-শেষ করো তবুও মুখ গুমরে বসে থেকো না।

পূর্ণতা কথা শুনে চুপ করে থাকলেও পেটের উপর থেকে পূর্বের শক্ত হাতজোড়া টেনে সরালো। পূর্ব অবাক হয়ে কিছু বলার জন্য আর শব্দ খুজেঁ পেলোনা। পূর্ণতা তখনও মুখ ঘুরিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে, পূর্বের দিকে তাকালো না। ওর দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে দুহাতে টিশার্ট খুলে পাশে শুয়ে পরলো। আজ এই প্রথম তার মেজাজ খারাপ হলো না, পূর্ণতার উপর রাগ উঠলো না, কড়া শব্দে চিল্লানোর জো হলো না। নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে পূর্ব চোখের পাতা বুজে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। হাত উল্টো করে মাথার নিচে হাতের তালু রেখে দিলো। ঠান্ডা বাতাস। সেই সাথে গা কাঁপিয়ে দেয়া হিম প্রহর চলছে। পূর্ণতা এতোক্ষন শীতটা টের না পেলেও আচমকা ওর শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ণতা আচঁলে ভেজা গাল মুছে নিলো। বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক গলে রাতের কয়েক টুকরো চন্দ্রকিরণ পূর্বের মুখে পরছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎ মনের উপর অদ্ভুত বাসনা চেপে বসে পূর্ণতার। অনেকটা লোভীর মতো কিংবা কাঙালের মতো সে পূর্বের ঠোঁট ও চোখটা স্পর্শ করার জন্য উন্মুখ হয়ে যায়। ওই মুখটা ঘুমের আদালতে উপস্থিত হতেই কেমন নিষ্পাপ ছায়াতলে ডুবে যায়। যেনো দুনিয়ায় সে অনেক অপরাধ করে শেষে ক্ষমার জন্য মুখ অসহায় করেছে। পূর্ণতা এগিয়ে যায়। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে পূর্বের একদম সন্নিকটে চলে যায়। দুহাতে পূর্বের মাথাটা বালিশ থেকে উঁচু করলে চট করে চোখ খুলে তাকায় পূর্ব। কিন্তু পূর্ণতার মধ্যে কোনো চমকানো ভাব দেখা গেলো না, সে পূর্বকে ছেড়েও দিলো না। ওইভাবেই পূর্বের চোখের উপর অধর ছেড়ে দিলো পূর্ণতা। টপটপ করে সিক্ত বর্ষনটা পূর্ব টের পাচ্ছিলো কপালে। পূর্ণতার ওর মৃত্যু সংবাদ শুনে ভয়ংকর ভাবেই চুপসে গেছে। একটু আগের যেই আবেগময় ভাবটা ছিলো সেটা ভয়ের কোঠায় ঢুকে গেছে। পূর্ব হাত উঠিয়ে পূর্ণতার ভেজা গাল স্পর্শ করলো। বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখের নিচে অশ্রুপানির স্রোতটা বাধা দিলো। দুই নেত্রপল্লবে পরপর ঠোঁট ছুঁয়িয়ে লালচে অধরজোড়ায় নিজের ওষ্ঠদুটো মিলিয়ে দিলো। আকাঙ্ক্ষীত জিনিস পেলে মানুষের মন যেমন আপ্লুত হয়, পূর্বের ভেতরের ভয়টা পূর্ণতার ওষ্ঠস্পর্শে হঠাৎই যেনো গুটিয়ে গেলো। মন যেনো তীব্ররূপে জানান দিলো, পূর্ণতার জন্য হলেও জীবনের মূল্য দিতে হবে। পরের জন্য তগবগ জীবনটা বিলানোর আগে একজন অপেক্ষমাণ নারীর জন্য আকন্ঠ জীবিত থাকতেই হবে। যুদ্ধে যেহেতু নেমে গেছে, কাপুরুষতা দেখিয়ে নয় বরং বীরবেশে তাকে মোকাবেলায় অংশগ্রহন করতে হবে। জীবন তো যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। কালকের জন্য চিন্তা পুষে আজকের দিনটা কেনো ভুলে বসবে? জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত এখন ভীষণভাবে দামী। পূর্ব আনমনে নিজের উত্তেজিত মস্তিষ্কে এসব চিন্তা করতেই পূর্ণতার পিঠ আকড়ে তাকে বুকে চেপে ধরলো। অধরমিলন ছেড়ে দিয়ে পূর্ণতার কালো শাড়ির আচঁলটা তার হাতে পেঁচাতেই পূর্ণতার চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,

– আমি কখনো অন্যের ক্ষতি করিনি যে আল্লাহ্ আমার জীবনে কোনো অসহনীয় দুঃখ দিবেন। যদি দিয়েও থাকেন হয়তো সেগুলো আমার কোনো-না-কোনো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত থাকবে।

পূর্ণতা চুপ করে শুধু পূর্বের কথাগুলো শুনছিলো। কোনো সায় বা বাধা কিছুই দিচ্ছিলো না পূর্বের কথায় ও কাজে। পূর্ণতার কান থেকে টপের হুক খুলতেই পূর্ব বলতে লাগলো,

– পূর্ণ, তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ একা, নিঃস্ব, বিহ্বল। এটুকু বিশ্বাস করে আমাকে তোমার মাঝে আবদ্ধ করার অনুরোধ করছি। আমার বুকটা চিড়লে হয়তো দুঃখের সাথে কিছু সুখকর অনুভূতি দেখবে। সেটা তোমার জন্যই জম্মেছে এবং ওই জায়গাটার অধিকারিনী কেবল তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি কারোর মধ্যে নিজেকে খুজেঁ পাবো না। হয়তো হারিয়ে যাবো নয়তো ভালোবাসতে পারার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবো। আমার এই কাঠিন্য স্বভাবের মাঝে তুমি যদি ভালোবাসা খুজেঁ পাও আমি এও বিশ্বাস করি একমাত্র তুমি আমার সর্বেসর্বার বিষয়গুলো বুঝবে।

কথা চলমান হলেও পূর্ণতার গলা থেকে চিকন হার, হাতের চুড়ি এবং সর্বশেষ শাড়ির সেফটিপিন খুলে নিলো। বাহুর মাঝে আবদ্ধ করতেই পূর্ব বলে লাগলো,

– তোমার পূর্ব তো সবার জন্য মজুত থাকতে চায় কিন্তু তোমার কাছেই সে নিজের বন্ধ দরজাটা খুলে দেয়। এভাবে যদি ভেঙ্গে পরো তাহলে তো আমি দরজাটা খুলতে সাহস পাবো না। ভয় পাবো। মনে হবে তুমি আমার ব্যাপারগুলো শুনে ভেঙ্গে পরবে, কষ্ট পাবে, দুশ্চিন্তায় ভুগবে। তুমি মাঝেমাঝে যেই রাগ দেখিয়ে রূপটা দেখাও না? আমি ওই মাঝেমাঝে ব্যাপারটা সবসময় দেখতে চাই। আমার জন্য তুমি এটুকু নিজেকে পরিবর্তন করো। আমি আমার ইচ্ছের ঝুলিকে এখানেই ইতি টানবো। আর কখনো তোমার কাছে কিছুই চাইবো না।

পূর্ণতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তরের জন্য ভ্রুঁ নাচায়। খানিকটা সময় ওইভাবে উত্তরের আশায় থেকে পূর্ব যখন মুখ উদাস করবে অকল্পনীয় ভাবে পূর্ণতার ঠোঁটে তখন ভোরের আলোর মতো একটুকরো হাসি খেলে যায়। পূর্বের গালে চুমু দিতেই পূর্ব বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বেহুঁশ হবার ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে বললো,

– তুমি ছুঁয়ে হায়… আমার কি যে হয়ে যায়।

পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে পূর্বের মাথায় চাট্টি মারলে পূর্ব আগের স্টাইলে গম্ভীর ভঙ্গিতে রাগ দেখাতে গিয়ে আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। অজস্র হাসির মূহুর্তে পূর্ণতাকে দুহাতে জাপটে ধরে ভালোবাসার এক বর্ণিল প্রহরে ডুবে যায়। যেখানে শুধু ক্ষণিকের সুখ দিয়ে স্মৃতির ডায়েরি আবদ্ধ হয়। পূর্বের ভাষায়, পূর্বদিগন্তে গভীর আবেশীভূষায় লিপ্ত হয় প্রিয়তমা পূর্ণতা।
.

দিনগুলো বড় অদ্ভুত ভাবে কাটতে লাগলো। হুরহুর করে সময়ের পাল্লা দ্রুততার সাথে চলে যেতে লাগলো। মানুষের সুখের মূহুর্ত যতো স্বল্প হয়, দুঃখের মূহুর্ত ততো দীর্ঘ হয়। পূর্ব জানতো না তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়াবহ দিনগুলো দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। অনুমানও করতে পারেনি কতোটা বীভৎস চিত্র তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানোর জন্য অপেক্ষায় আছে। একদিকে পূর্ণতাকে আবারও কাছে পেয়ে আগের মতো আচরণ করতে শুরু করে পূর্ব। আয়েশা, পলাশের সাথে যোগাযোগটাও দৃঢ় হয়ে উঠে ওর।পার্টির প্রতিটা কাজ শেষে পূর্ণতা-সহ মা-বাবাকেও সময় দিতে শুরু করে। এদিকে পূর্ণতার জন্য সবকিছু মেলবন্ধন হয়ে যায় দুই পরিবারের মধ্যে। খোদেজা ও কবির মাঝে মাঝে সবাইকে দেখতে আসেন ওয়াসিফ ভিলায়। সবসময়ের মতো নির্বাচনের প্রচারণার জন্য পূর্ব বাইরে থাকলেও খোদেজা যেনো শান্তি পান। এখনো তিনি পূর্বের কিছু ব্যাপার সহজ ভঙ্গিতে মানতে পারেন না। তবে চেষ্টা করছেন পূর্বকে মনেপ্রাণে মেনে নেওয়ার।

আয়মান তার চাকরিজীবনে যথেষ্ট ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ভার্সিটির রেজাল্ট পাবলিশ হবার পরে এব্রডের জন্য ভালো ভালো অফারও পেয়েছে। কিন্তু এখনো ওই অফারে বেশ সময় আছে তাই দেশে থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। আফিয়া তার ছেলের সিদ্ধান্ত শুনে কপাল কুঁচকে মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন। ঠিকমতো কথাবার্তা তিনি আয়মানের সাথে বলেন না। আয়মানও বিষয়টা কয়েকবার লক্ষ করলেও ওই ‘বিয়েশাদি’ ব্যাপারে মত দিতে রাজি না। শ্রেয়ার পর শূন্য জীবনটায় আর কাউকে স্থান দেয়ার মানে হয়না। সবাই ওই জায়গাটা পাওয়ার কাবিল না। আফিয়া এতোদিন আয়মানের পছন্দসই ব্যাপারটা জানতেন না কিন্তু মনেমনে ঠিকই একটু-আধটু বুঝে গিয়েছেন শ্রেয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে কিজন্যে বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার কারণটা জানতে গিয়ে তিনিও রীতিমতো অবাক এবং বাকরুদ্ধ হয়েছেন। শ্রেয়া যেই নীতিহীন কাজটা করেছিলো সেটা পূর্ব,পূর্ণতা ও আয়মান দারুণভাবে ধামাচাপা দিয়েছিলো। কিন্তু সত্য কখনো গোপন থাকেনা। তাই পূর্ণতাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই পূর্ণতা সবকিছু আফিয়াকে খুলে বলতে বাধ্য হয়। শেষে আফিয়াকে বলার ঘটনাটা পূর্ব ও আয়মানের কাছেও বলে দেয় পূর্ণতা। পূর্ব ঠান্ডা মাথায় রাখলেও আয়মান যেনো চেতে গিয়েছিলো। কেনো মায়ের কসম মেনে সত্যটা বলতে গেলো এ নিয়ে আয়মান কঠিন কিছু বলতে গিয়েও কড়া ভাষায় তেমন কিছু বলতে পারেনি। এরপর থেকেই হন্য হয়ে ছেলের জন্য মেয়ে খুজতে লেগে পরেন আফিয়া। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন বাসার গেটে একটা মেয়ে এসে দাড়ায়। আফিয়া অপরিচিত মেয়েটাকে চিনতে না পেরে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা নাম জানায় সাবিহা এবং সে আয়মানের কিছু টাকা পরিশোধ করতেই অনেক দূর থেকে এখানে এসেছে। সাথে অনুযোগ করে এটাও বললো, ঠিকানাটা পেতে একটু ভোগান্তিতে ফেসেছে। আফিয়া সাবিহার আপাদমস্তক সবকিছু দেখার আগেই সাবিহার গ্রামের ঠিকানা ও বাবা-মায়ের নাম্বার নিয়ে নেয়। সাবিহার কাছে খটকা লাগলেও সে মুখে কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারলোনা। কিন্তু চমক হিসেবে এটাই হলো সাবিহার বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠায় আফিয়া। সাবিহা আশ্চর্য হয়ে খুশি হলেও আয়মানের একমুখো স্বভাবের কথা চিন্তা করে সাথেসাথে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু গরীব বাবা-মা শিকদার পরিবারের স্ট্যান্ডার্ড দেখে সাবিহার মতের চিন্তা না করেই রাজি জানিয়ে দেয়। সাবিহার চিন্তা যেনো বাড়তে থাকে সময়ের সাথে। আয়মানের মতো এমন একটা মানুষ যার সাথে ওই ছিনতাইকারীর ইন্সিডেন্স ছাড়া আর কোনো যোগসূত্র নেই সেই মানুষ সত্যি কি মা-কে দিয়ে সম্বন্ধ পাঠিয়েছে? নাকি সবই ধাপ্পা?

সাবিহা আমরিন সহজাত গ্রাম্য পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার আচার-আচরণ যথেষ্ট মার্জিত এবং সুন্দর। যার চুলে তেল ছাড়া বাড়তি প্রসাধনী মাখার সার্মথ্য নেই তাকে আল্লাহ্ দিয়েছেন ঝলমলে সমান চুলের বাহার। মুখে কৃত্রিম জিনিস মাখাটা ছোট থেকে সুযোগ না হওয়াতে বড় হয়েও অরুচি ধরেছে ওসবে। সামান্য লিপস্টিক জাতীয় জিনিসটাও শহরে এসে দিচ্ছে। এমন একটা গেঁয়ো মেয়েকে আফিয়া কিভাবে আয়মানের জন্য পছন্দ করলো? প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তরগুলো সবই অজানা। কিন্তু এদিকে আয়মানকে প্রচণ্ড বাধ্য করতে থাকেন আফিয়া। বিয়ে যদি করে সাবিহাকেই করবে এবং মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী। আয়মান বুঝেই পায়না মা কিভাবে সাবিহার খোঁজ পেলো। অবশ্য আয়মান সকলের অগোচরে একটা সুক্ষ সত্য লুকিয়ে রেখেছিলো। সাবিহা দেখতে সুন্দরী হলেও ওর একটা বিশেষ দিক শ্রেয়ার সাথে মিলে। শ্রেয়া যখন চুল ছাড়তো ঠিক সাবিহার চুলের মতো ঝলমলানি দিয়ে উঠতো। ফাজলামির বশে শ্রেয়ার রেশমতুল্য চুল যখন টান মারতো আঙ্গুলের ফাঁক গলে সব চুল চলে যেতো। হয়তো আফিয়া সবদিক বিবেচনা করে সাবিহাকেই যোগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু আয়মান কি করবে তা নিয়ে এখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

.

ভোর পাঁচটা থেকে তীব্র উত্তেজনায় উত্থাল-পাত্থাল হয়েছে ঢাকা শহর। বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকরা মাইক হাতে ক্যামেরাম্যান নিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট করছে টিভির পর্দায়। ভোটকেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং টহল পুলিশ ঢুকেছে। সেই সাথে দুই দলের এজেন্সীও ভেতরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। হৈচৈ রাজপথ একটু পরপর তুমুল মিছিলের স্লোগান দেয়। পূর্ব ভোর চারটার দিকে আযানের আগেই পান্ঞ্জাবী গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চিন্তার জন্য পুরো রাতটা ওর নির্ঘুমে কেটেছে। পূর্বের চিন্তিত মুখের এমন করুণ অবস্থা আগে কখনো দেখেনি পূর্ণতা। কোনোভাবেই পূর্বের চিন্তা কমাতে সক্ষম হয়নি ও। গতরাত থেকে মোমিন গুম হয়ে আছে। শত চেষ্টা করেও কোনো খোঁজ মেলেনি। আজ ভোটের দিন বলে পূর্ব মোমিনের খোঁজে নিজে যুক্ত হতে না পারলেও কৈলেশদের লাগিয়ে দিলো। ঘড়ির ঘন্টা ঢংঢং করে আটটার কাটায় পৌঁছলো। পূর্ব ভোটকেন্দ্রের ভেতরকার অবস্থা সম্বন্ধে খবর নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক এবং কারচুপির অবস্থা নেই কোনোস্থানে। ইবরাহিম খানের দল বেশ উদগ্রীব হয়ে আছে। মনোভাব এমন যেনো তিনিই বিজয়ী হবেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বেশিকিছু বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেছেন। পূর্বকে ঘিরে যেই সাংবাদিকের জটলা ছিলো সেটা ছাড়াতে কিছু মানুষের প্রয়োজন পরে গিয়েছিলো। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর ঝড়ের বেগে ঠিকঠাক মতো দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে। টেনশনে মাথাব্যথাটা আবার না উঠলেও চলে। ড্রাইভার হিসেবে বর্তমানে সবুজ গাড়িতে বসে আছে। পূর্বের অশান্ত চোখদুটো তারও দৃষ্টি এড়ানি। অনেকবার চিন্তা করেছে পূর্বকে সান্ত্বনা দিয়ে সাহস জুগাবে কিন্তু পরক্ষনে পূর্বের মেজাজের অবস্থা চিন্তা করতেই চুপটি মেরে যায়। আর মাত্র পয়ত্রিশ মিনিট। এরপরই ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ওয়াসিফ ভিলায় পূর্ণতা নাওয়া-খাওয়া সব যেনো বন্ধ। সে নিশ্চিত পূর্ব অতিমাত্রায় টেনশন করছে এবং না খেয়ে বসে আছে। পূর্বকে কল করেও লাভ হয়নি। পূর্ব কল রিসিভ না করলেও মেসেজে জানিয়ে দিয়েছে, ‘I’m busy in election area’. এরমানে পূর্ব ব্যস্ততার অজুহাতে কিছুই খাবেনা। আয়েশা ভোরে সকালে উঠে নামাজটা পরে বাদামী রঙের তসবী নিয়ে সোফায় বসেছেন। টিভির সামনে বসে মাথা-সহ পুরো শরীরটাই হিজাব ঢেকে রেখেছেন। ছেলের দীর্ঘ সংগ্রামের ফল আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রথমে তিনি রাজনীতির ব্যাপারে নারাজ থাকলেও ছেলের অদম্য ইচ্ছাটা নাকোচও করতে পারেননি। পলাশ ওয়াসিফ ঘুমের ঔষুধে নিদ্রামগ্ন। বাড়ির প্রতিটি চাকর যেনো চুম্বকের মতো টিভির পর্দায় চোখ লাগিয়ে রেখেছে। কাজের ফাঁকফোকরে হুটহাট এসে পর্দায় বুলিয়ে যায়।

অপেক্ষাকৃত সময় সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা নাগাদ একটানা ভোটগ্রহণ কার্যসূচী পালিত হলো। পূর্ব পুরোটা সময় দলের সঙ্গে থাকলেও মাঝে মাঝে সাংবাদিকের প্রশ্নের জালে ফেঁসে যাচ্ছিলো। নিজের উদ্বিগ্ন চেহারা, চিন্তাপ্রবণ মন দুটোই সকলের আড়ালে রেখে কাঠিন্য মুখ বজায় রেখেছিলো। ভোটের প্রক্রিয়া শেষ হতেই গণনাকার্য শুরু হলো। দলের কিছু অন্যান্য নেতাসহ সাইফুল খন্দকার, মাসুদ আলমগীর, ইমতিয়াজ উদ্দিনও আজ উপস্থিত ছিলো। তাদের একপ্রকার জোরাজুরিতে পূর্ব দুপুরের খাবারটা খেতে একটু স্পেস পেলো। কিন্তু গলা দিয়ে এক বোতল ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ছাড়া কিছুই নামলো না। সবুজের তোষামোদে টংয়ের দোকানে বসে এক কাপ চাও খেলো পূর্ব। কিন্তু টংওয়ালা টাকা নিতেই চাইলো না। সাধারণ টংওয়ালা ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বললো,

– আপনেই জিতবেন দেইখেন। আমিও গিয়া ভোট দিয়া আইসি। আমার ছোডু পোলারেও ভোট দেওনের লিগা পাঠায়া দিছিলাম। চিন্তা কইরেন না বাজান।

পূর্ব সৌজন্য হাসিতে দিতে গিয়েও প্রশান্তমনে হেসে দিলো। চুপচাপ গাড়ির দিকে আবারও যাত্রা ধরলো। আকাশের দিকে একপলকের জন্য চোখ রাখলো পূর্ব। নীলচে আকাশটা বিকেলের প্রহরে গোলাপী রঙে ছেয়ে গেছে। দেখতে ভারী সুন্দর লাগলেও মনের ভেতর কেমন কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করে বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছে আজ যা হবে সব ভালোর জন্যে হবে। আল্লাহ পাক এবং জনগণের উপর বিশ্বাস রাখলেই চলবে। কিন্তু চোখ খুললেই ভয়ে মনটা গুটিয়ে থাকে। অস্বস্তিকর মনটা শেষমেশ পিছু ফিরে সবুজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

– অস্থির লাগলে কি করা উচিত বলতো? কোনোভাবেই টেনশন মুক্ত থাকতে পারছিনা। তোদের ভাবীকে এখানে ডাকবো?

সবুজ পুরো ব্যাপারটা ধরতে পেরে পূর্বের দিকে নম্র কন্ঠে বললো,

– ভাই আপনি টেনশন করেন কেন? আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনি জিতবেন। আর ভাবীরে ডাকলে বোধহয় ভালো হয়। সিকিউরিটির টেনশন আপনি নিয়েন না। আমি গাড়ির কয়েক সীমানা পযর্ন্ত লোক লাগিয়ে দিতেছি।

পূর্ব তাতে সায় দিলো। আজ মন কোনোভাবে মঙ্গলকর ব্যাপারে সায় দিচ্ছেনা। পূর্ণতার সঙ্গটা পেলে হয়তো মনের উপর থেকে চিন্তার ছাপটা নেমে যাবে। সবুজ নিজেই গেলো পূর্ণতাকে আনতে। পূর্বের নির্দেশমতো কালো বোরখায় কবিরের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। কেউ যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করুক ওয়াসিফ পূর্বের স্ত্রী এখানে এসেছে। সচরাচর চোখ দুটো বের করে নিকাব করলেও আজ সেই চোখদুটোও কালো রঙের পাতলা কাপড়ে ঢাকা। কবিরের গাড়ি থেকে নেমে পূর্ব আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একপ্রকার সবার চোখে ধূলো মেরে কবিরের গাড়িতে উঠলো। পূর্ণতার পাশে বসতেই পূর্ব গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলো। পূর্ণতার দিকে ফিরে তাকাতেই পূর্ণতা চোখের উপর পাতলা কাপড়টা সরিয়ে বললো,

– তোমার কি টেনশনে আবার মাথাব্যথা হচ্ছে?

পূর্ব এসির সুইচে টিপ দিতেই পূর্ণতার জন্য বললো,

– না।

পূর্ণতার দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বসলো পূর্ব। পূর্ণতার মুখ থেকে নিকাবটা উঠিয়ে ওর দুইগাল ধরলো। প্রচণ্ড অস্থির এবং বিহ্বল কন্ঠে বললো,

– আমার মন যে কেমন করছে। কেমন যে কু ডাকছে আমি বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা আমি যদি না জিতি তুমি কি অভিমান করে চলে যাবে? এই রাজনীতির জন্যই তো হাসপাতালে তোমাকে একা ফেলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সেদিন রাজনীতিটা চুজ করলেও আমার মনটা তোমার জন্যই পরে থাকতো। পূর্ণ, তুমি কি কোনো কারনে আমাকে ছেড়ে যাবে?

পূর্ণতা অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হুট করে পূর্বের গাল থেকে পূর্বের হাত নামিয়ে চেপে ধরলো। আশ্চর্য কন্ঠে বললো,

– আমি কেনো তোমায় ছাড়তে যাবো? তোমার কি হয়েছে? আমার কাছে এই ইলেকশনের কোনো মানে নেই। আমার জন্য তুমি আগে। কেনো ভয় করছো?

পূর্ব ঢোক গিলে তীব্র উৎকন্ঠায় কিছুই বলতে পারলো না। মাথা নিচু করে দুইবার জোরে শ্বাস ছেড়ে পূর্ণতাকে জানালায় পিঠ লাগিয়ে হেলান দিতে বললো। পূর্ণতা অবুঝের মতো জানালার পিঠ লাগিয়ে হেলান দিলে পূর্বের ওর গলার মাঝে নিচে মুখ ডুবিয়ে গা ছেড়ে দেয়। পূর্ণতা একের পর এক ঝটকা খেয়ে অবাক হওয়াও যেনো ভুলে গেছে। পূর্ব আগে কখনো এমন কান্ড করেনি। পূর্ণতা আর নিজেকে শান্ত অবস্থায় রাখতে পারলো না। ভয়টা সংক্রামকের মতো ওকেও ঘিরে ধরলো। পূর্বের মাথায়, গালে, পিঠে বারবার হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললো। এই ভয়টা নির্বাচনকে ঘিরে হলেও মূখ্য যেনো পূর্ণতা ছিলো। আজ পূর্বের অবস্থা বড্ড আশ্চর্যজনক। এই রূপটা চোখের সামনে কোনোভাবেই মানতে চাইছেনা। পূর্ব চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে পূর্ণতার মাঝে এমনভাবে গুটিয়ে গেছে যেনো পূর্ণতার ছায়াতলে গা ঢাকা দিচ্ছে। বোরখার উপর পিঠের জায়গায় আঙ্গুল ক্রমান্বয়ে ডেবে যাচ্ছে পূর্বের। পূর্ণতাকে লতাপাতার মতো আকড়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা যেনো জেগেছে। আজকের মতো এমন উদ্ভট আচরণ কখনো করেনি পূর্ব। কেনো কু ডাকছে পূর্বের মন?

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

( নোটবার্তা : আমার একেকটা বড় পর্ব দুই ভাগ করলে দুইদিন দেওয়া যেতো। তাই মাঝেমাঝে একদিনের যে গ্যাপটা নেই সেটা মাথাব্যথার জন্য। আপনাদের সবাইকে ভালোবাসা❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here