তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৬৬.

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৬৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো

সিগারেটের উৎকট গন্ধ এখন আর নেই। রুমে অনেকক্ষন যাবৎ কোনো সাড়াশব্দ হয়নি। পূর্ব জানালার কাছে তখনো দাড়িয়ে রইলো, দৃষ্টি নত করে দুহাত পকেটে গুঁজে ছিলো। দখিনা বাতাস এসে মাথার ঠিক তালুর চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে পূর্বের। রাতের প্রহরগুলো আরো নিস্তব্ধতায় ধীরেধীরে আচ্ছন্ন হচ্ছে। পূর্ণতা নির্বাক হয়ে শাড়ির হ্যাঙ্কার হাতে পূর্বের দিকে তাকিয়ে আছে। কালো শার্ট পড়ুয়া মানুষটার দিকে দৃষ্টি আটকে সবকিছু যেনো থমকে গেছে। পূর্ণতা স্থিরদৃষ্টিতে শুকনো গলায় ঢোক ফেললো। কিন্তু মনের চন্ঞ্চলতা, প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় নিজেকে সামলাতে গিয়ে খুব হিমশিম খাচ্ছিলো। ধুক-ধুক করে বুকের ধুকধুকনি আরো দ্রুতবেগে চলতে লাগলো ওর। শব্দহীন পরিবেশে প্রতিটি ধুকপুকনির আওয়াজ কানের পর্দায় ধড়াস-ধড়াস করে অনুভব করলো। তাক লেগে যাচ্ছে কানের পাতলা পর্দায়। অসহ্য লাগছে শরীর-মন, পুরো দেহে। অবিরামভাবে বর্ষণের জন্য চোখের কোলে মেঘ জমেছে। যেকোনো মূহুর্তে ঝমঝমিয়ে অশ্রু-বর্ষণ হতে চলেছে পূর্ণতার। পূর্ণতা স্পষ্ট টের পেলো ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। হাতের হ্যাঙ্কারটাও কাঁপুনির জন্য মৃদ্যু-মৃদ্যু নড়ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় আরেকবার অশ্রু চোখে ঢোক গিললো পূর্ণতা। ওমনেই সিক্ত চক্ষুকোল থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো তার। ওর ইচ্ছে ছিলো অভিমানের এই শক্ত খোলসটা এতো সহজে নড়বড়ে হতে দিবেনা। কথা বলবেনা সে পূর্বের সাথে। ওর কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এ রুম থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু পূর্ণতা কিছুই ভাবার সময় ও সুযোগ পেলো না। পূর্ব ঠিক ওই মূহুর্তে নিরবতা চ্ছিন্ন করে গাঢ় গলায় অসহায় ভঙ্গিতে বললো,

– তুমি আমার কথা একটাবার শুনো পূর্ণ, আমিতো তোমার কাছে কখনো মিথ্যা বলিনি। আমার কথাগুলো না শুনে যদি দূরে দূরে থাকো, আমি কিভাবে ভুল শুধরাবো? একবার শুনো পূর্ণ, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি আমার কথা একটু শুনো।

শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ণতা। গলা দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। অনেকটা অনুভূতিশূন্য ব্যক্তির মতো নিজেকে দমিয়ে নিলো সে। চোখের পানিও মুছে ফেললো শাড়ির আচঁলে। আজ সে শুনতে ইচ্ছুক পূর্ব কি কথা বলার জন্য আকুতি-মিনতি করছে। কেনো সে তামাশা করে সিগারেট জ্বালিয়ে ঘন্টার-পর-ঘন্টা বিষাক্ত ধোয়া সৃষ্টি করেছে, সবই পূর্ণতা শুনতে ইচ্ছুক এখন। পূর্ব জানালার কাছ থেকে ঘুরে দাড়ালো। প্যান্টের পকেট থেকে দুহাত বের করে পূর্ণতার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু পূর্ণতার চাহনিতে কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই, উলটো এর পরিবর্তে প্রচণ্ড রাগ এবং ডোন্ট কেয়ার ভাব চোখেমুখে বেশ পরিদৃষ্ট। পূর্ব গলা ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লো। পুনরায় পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ সুরে বললো,

– আজ তোমার সামনে যেই পূর্বকে দেখতে পাচ্ছো, আর জেল থেকে যেই পূর্ব বেরিয়েছিলো তার মধ্যে বিশাল তফাত ছিলো পূর্ণ। যে পাচঁমাস আমি বন্দিজীবন পার করেছি সেগুলো মোটেই ভালো ছিলো না। আমি খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম পূর্ণ। বিশ্বাস করো, জেল থেকে বেরিয়ে আমি তোমার কাছে ফিরতে চেয়েছিলাম। তোমাকে দোহাই দিচ্ছি, আমি একটা কথাও মিথ্যা বলছিনা। আমি তোমার কাছে আসার জন্য ব্যকুল হয়ে ছিলাম। কিন্তু যেখানে আমিই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছিলাম সেখানে ওই বিধ্বস্ত অবস্থায় তোমার কাছে কিভাবে আসতাম? তুমি আমার সামান্য আচঁড় দেখলেই কেদেঁ উঠো, আর ওরা পাচঁ মাসে আমার কি অবস্থা বানিয়েছিলো সেটা যদি দেখতে, তুমি কি স্থির থাকতে? থাকতে না পূর্ণ। তুমি কাঁদতে কাঁদতে নিজের অসুখ ডেকে আনতে। আমি কিভাবে এই ভুল করতাম বলো? তোমার ওই মুখ দেখার সাহস আমার কিভাবে হতো? তুমি তো ওই মূহুর্তে একা ছিলেনা। তোমার পেটে আমার চিহ্নটার অস্তিত্ব ছিলো। তোমার কিছু হলে ও যে আবার হারিয়ে যেতো, সেই দুঃখ কি করে তুমি সহ্য করতে? আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করিনি পূর্ণ। আল্লাহ জানেন, আমি তোমার কথা একমূহূর্তও ভাবতে ভুলিনি। তুমি আমার জন্য কতটা পাগল আমিতো জানি, আমিতো জানি তুমি আমার অবস্থা দেখে কতটুকু অস্থির হতে পারো। তোমাকে যে বুকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে রাখবো সেই হাতটাও ভাঙা ছিলো পূর্ণ। প্লাস্টার হাতে তোমাকে একটুও ধরতে পারতাম না। আরেক হাত দিয়ে যে তোমায় আগলানোর চেষ্টা চালাবো সেটাও ক্ষতবীক্ষত ছিলো। জেলের ভেতর আমার রক্তাক্ত বিশ্রী ঠোঁটে তুমি চুমু খাও আমিতো মরার আগ পযর্ন্ত সেই দৃশ্য ভুলবো না পূর্ণ। আমার ওই করুন দশা দেখে সেদিন তুমি কাছে টানতে একটুও ভুলোনি। আজও মনে পরে সেদিন তুমি একটা মূহুর্ত্তের জন্য কান্না থামাতে পারোনি। নিকাবের আড়ালে তোমার ব্যকুল চোখদুটো বারবার আমার জন্য কেমন করে কেঁদেছে, আমি কি ভুলে যাবো? ভুলবো নাতো। সেলের বাইরে বসে দুহাত বারিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য ছটফট করেছে, সেই কাতরানোর দৃশ্য আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আজ আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, দেখো আমি তোমার মতোই ছটফট করছি, কিন্তু কোনোভাবেই তোমাকে দেখাতে পারছিনা। আমি যন্ত্রণায় ভুগছি, প্রকাশ করতে পারছিনা। তোমাকে কাছে পেয়েও দূরে থাকার দুঃখে কাতর হয়ে গেছি, অথচ জোর খাটিয়ে তোমার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা পূর্ণতা। তুমি আমার সাথে এরকম করো না। আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া আমি আর কিচ্ছুই রাখতে পারিনি। আমার সব চলে গেছে। সব আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। আমার নূন্যতম যোগ্যতাও আর নেই।

কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসলো পূর্বের। নিজেকে বিবশ অবস্থা থেকে সামলাতে গিয়ে চোখ নিচু করে ফেললো সে। সমস্ত শরীর ধীরে-ধীরে ফ্লোরে ছেড়ে দিলো হাঁটুতে ভর দিয়ে। নিস্তব্ধ রুমটার ভেতর কান্নার মৃদ্যু ফিসফাস শব্দ হচ্ছিলো। পূর্ব চোখ নিচু করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলো। ভারাক্রান্ত মনটা যেনো নিংড়ে দিয়েছে কেউ, বীভৎস যন্ত্রণায় বুকটা ছিড়ে আসতে চাইছে। নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় সামলে নিয়ে পূর্ব ঝাপসা দৃষ্টি তুলে পূর্ণতার দিকে তাকালো। পূর্ণতার দৃষ্টি তখন অটল, শান্ত, স্থির ছিলো। কিছু বলার জন্য গাঢ় করে ঢোক গিললো পূর্ব। অশ্রু বিহ্বল চাহনিতে ক্লিষ্ট কন্ঠে বললো,

– জেল থেকে কখনো বেরুতে পারতাম না পূর্ণ। আমার মতো মানুষ কখনো জেল থেকে সুস্থ সবল বের হওয়ার সুযোগ পায়না। যতবার আমার উপর অত্যাচার করতো আমি চোখ বন্ধ করে কালেমা পরে ফেলতাম। এই বুঝি আমার রূহটা চলে গেলো। আমি বোধহয় আর কোনোদিন তোমার কাছে ফিরতে পারবো না। ফার্স্ট ভিজিটটাই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। কিন্তু একদিন কি ভেবে যে আমার শত্রু আমার সামনে এসে উপস্থিত হলো আমি জানিনা। সেলের ভেতর আমি তখন অর্ধচেতন ছিলাম। মাথা ফেটে রক্ত পরছিলো। রোলারের বেকায়দা বারি খেয়ে মাথার ডানদিকটা ইন্ঞ্জুর্ড হয়ে গেছে শেষ। ইমতিয়াজ এসে চেয়ারে বসলো। আমার অবস্থা এতোই খারাপ ছিলো যে, ফ্লোর থেকে উঠার শক্তিটুকু আমার ছিলোনা। ওই লোক তখন প্রস্তাব দিলো তার শর্ত যদি পূরণ করি তাহলে আমাকে জেল থেকে বের হতে সাহায্য করবে। আমি শর্ত না শুনতেই ওকে ‘ না ‘ করে দিয়েছি। যখন জানোয়ারটা দেখলো ওর প্রস্তাবে আমি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিনা, তখন ওই কুলাঙ্গার বাচ্চা তোমাকে নিয়ে হুমকি দিলো পূর্ণ। তুমি আমার দূর্বল দিক এটাতো জানো। নাকি এটুকুও তুমি আজ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত না? আমি সব সত্যি বলছি পূর্ণ। তোমার কিছু হলে আমি কি করতাম? কিভাবে সহ্য করতাম আমি? ওই জেলের মধ্যে আমি যেখানে সুস্থ ছিলাম না, সেখানে ও যদি তোমাকে কিছু করতো? আমার পুরো জীবনে এমন অসহ্য অবস্থার মধ্য দিয়ে কোনোদিন যাইনি পূর্ণ। আমি স্বামী হয়েও তোমার ইজ্জত রক্ষার মতো অবস্থায় তখন ছিলাম না। নাহলে ওই জানোয়ারের কলিজা আমি আস্তো রাখতাম না। যদি ওই জানোয়ার তোমাকে কিছু করতো এটা ভাবলেই —-

গলা আটকে এলো পূর্বের। নিশ্বাস নিতেও হাঁশফাস করছে। চাপা কান্নার জন্য গলা শুকিয়ে এলে আচমকা জোরে জোরে কাশতে থাকে সে। নাক বন্ধ হওয়ার কারনে মুখ খুলে অনবরত নিশ্বাস নিচ্ছে পূর্ব। তবুও বুকের অবস্থা বেগতিক হয়ে উপর-নিচ করছে ওর। পূর্বের এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে পূর্ণতা অস্থির হয়ে উঠলো। হাতের হ্যাঙ্কার ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পানি নিয়ে পূর্বের সামনে ফ্লোরে বসে পরলো। পূর্বের ঠোঁটের কাছে গ্লাস ধরে সম্পূর্ণ পানি খাইয়ে দিলো। পানি খাওয়া শেষে চোখ বন্ধ করে ফেললো পূর্ব। পূর্ণতা ততক্ষণে গ্লাসটা আগের জায়গায় রাখতে গিয়েছে। পূর্ব একটু শান্তি বোধ করলে আবার বাকি কথাটুকু চোখ খুলে বলতে শুরু করলো,

– ওর প্রস্তাব ছিলো, আমি যেনো ওর পা ধরি। ওর কাছে আকুলিবিকুল করে নিজের সমস্ত কীর্তিকলাপের জন্য ক্ষমা চাই। যদি ওর এই প্রস্তাব আমি মেনে নেই তাহলে ও তোমাকে কিছুই করবেনা। খুশী হয়ে বখশিশ হিসেবে আমাকে জেল থেকে বের করার সুপারিশও করবে। আমার যা কিছু আটকে রেখেছে সব ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আর যদি নিজের আর্দশ ক্ষুণ্ণ করে মাফ না চাই তাহলে ও তোমাকে বি-ব-স্ত্র করে —

কথা শেষ করতে পারলোনা পূর্ব, অসহ্য যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে আবারও দৃষ্টি নত করে ফেললো। বুকের উপর ভারী চাপ অনুভূত হচ্ছে ওর। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছেনা পুরোনো দিনগুলো স্মরণ করে। বারবার ওই দৃশ্যটা মাথায় ঘুরছে। চোখের পাতায় না চাইতেই পূর্ণতার করুন দশার চিত্র ভাসছে। যদি ইমতিয়াজ পূর্ণতার সাথে এমন কিছু করতো, তাহলে কি পূর্ব মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারতো? এদিকে পূর্ণতা যতো শান্ত আচরণ করছিলো, ভেতরে-ভেতরে যেনো কালবৈশাখীর ঝড় ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ওকে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। বুকের হৃৎপিন্ড প্রচণ্ড অস্থিরতায় দম আটকে ফেলছে। পূর্ণতা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না ওই মূহুর্তে, দৌড়ে পূর্বের সামনে এসে ফ্লোরে বসে পরলো তখন। নিচু করে রাখা পূর্বের মাথাটা শক্ত দুহাতে ধরে নিজের দিকে তুললো। পূর্বের অশ্রুপূর্ণ লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটোর দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড়ে এলো পূর্ণতার। মূহুর্তেই সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো তুমুল কান্নায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পরতে লাগলো বড় বড় ফোটায়। পূর্ণতা পূর্বের দিকে তাকিয়ে কান্নারত অবস্থায় ধীরগতিতে ডানেবামে মাথা নাড়ালো। পূর্ব তখন ভেজা পাপড়ির অসহায় দৃষ্টিতে পূর্ণতার দিকে তাকালে ওর ‘ না ‘বোধকের ইশারাটা বুঝতে পারে। কান্না না করার জন্য পূর্ণতা ‘ না ‘ করছিলো। ব্যাপারটা বুঝতেই পূর্বের ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির আভাস দেখা দিলো। হাসির ওই মূহুর্তটুকু দেখে পূর্ণতার ভেতর কাপঁন শুরু হয়ে যায়। থেকে-থেকে চাপা কান্নার জন্য পূর্বের অধরজোড়া কাঁপছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না গেলার জন্য অধরদুটো লাল হয়ে আছে। পূর্বের মাথা থেকে ধীরে-ধীরে হাতদুটো গালে নামালো পূর্ণতা। দুহাতের মাঝে পূর্বের মুখটা আবদ্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই গালে চার আঙ্গুল বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল এগিয়ে চোখের নিচটুকু মুছে দিলো। নিজের নরম ওষ্ঠ এগিয়ে পূর্বের বদ্ধ চোখের উপর প্রগাঢ়ভাবে চাপ দিলো ও। বহুদিন পর পরমভাবে উষ্ণস্পর্শ পেলো পূর্ব। অস্থির হয়ে উঠা হৃৎযন্ত্র আস্তে-আস্তে শান্ত হতে লাগলো। একে-একে দুই চোখের উপর অধরযুগল ছুঁয়িয়ে দিলো পূর্ণতা। কপালও পরমাহ্লাদে চুমু খেলো। গাল ছেড়ে পূর্বের ঘাড়ের কাছে হাত রেখে দিলো। আরেকহাতটা এগিয়ে পূর্বের কপালের কাছে ডানদিকটায় ব্যান্ডেজটা স্পর্শ করে দেখলো। আঙ্গুলে ক্রস ব্যান্ডেজটা দেখতেই শান্ত সুরে বললো,

– এখনো ব্যথা করে?

পূর্ব নির্লিপ্তে মাথাটা ‘ না ‘ সুচকে মৃদ্যু নাড়লো। পূর্ণতা উত্তরটা পেয়েও আবার ব্যান্ডেজটার উপর আঙ্গুল স্পর্শ করলো। ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো সে। পূর্বের দুটোহাতের তালুতে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিতেই পূর্ব ওকে বললো এখন ঘুমিয়ে পরতে। রাত বেশ হয়েছে এবং ঔষুধগুলো খেয়ে এখুনি শুয়ে পরতে। পূর্ণতাকে বিছানায় শুতে বলে ছেলের জন্য একবার বেরুলো পূর্ব। কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা সেটা দেখার জন্য পূর্বিকার রুমে নক করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলতেই সে দেখলো, কাঙ্ক্ষিত শিশুটা পূর্বিকার কোলে ঘুমাচ্ছে। পূর্ব একগাল হেসে দিয়ে ওর কোল থেকে ছেলেকে নিলো। সাদা বেবি ওয়েপারে ছোট্ট নবজাতক চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। পূর্বিকা বিছানার দিকে রাবার ক্লথটা ঠিক করতেই ভাতিজার শোয়ার জায়গাটা ঠিক করে বললো,

– তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস?

প্রশ্ন শুনে ছেলের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পূর্বিকার দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ব। জিজ্ঞাসু সুরে প্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,

– রাগ করলে আমার ছেলেকে নিশ্চয়ই তোর কাছে পাঠাতাম না।

পূর্বিকা হোচট খেলো। ভাতিজির বালিশটা ঠিক করতে যেয়ে হাত থামিয়ে ওমনেই পূর্বের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,

– তাহলে আসার পর থেকে কেনো আমার সাথে কথা বলছিস না?

পূর্ব ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। পূর্বিকার ঠিক করা ছোট্ট নরম বিছানার মধ্যে ছেলেকে শুইয়ে দিলো পূর্ব। পূর্বিকা একদৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত পেরিয়ে গেলে পূর্বিকা ভাতিজির দিকে তাকিয়ে শান্ত সুরে হেসে বলে,

– লাল টুকটুকে হয়েছে। গালদুটো একদম লাল। ওর নাম ভেবেছি লাল্টুস রাখবো, কি বলিস বজ্জাত?

পূর্ব এমন বিদঘুটে নাম শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো। সঙ্গে এখন ছেলে না থাকলে পূর্বিকার অবস্থা ভালোই টাইট করতো ও। পূর্ব রাগ সংবরন করে স্বর নামিয়ে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– তোকে কে বলেছে আমার ছেলের নাম রাখতে? ভুলেও ওই নামে ডাকবিনা! ডাকলে তোর বরের চুল একটাও মাথায় থাকবেনা!সাবধান হ!

পূর্বিকা কপাল কুঁচকে রাগ দেখাতে গিয়ে আচমকা মুখে হাত চেপে হেসে দিলো। অনেকদিন পর পূর্বিকার মুখে প্রাণখোলা দেখে পূর্বের শৈশবের কথা মনে পরলো। ছোট থেকেই পূর্বিকা ছোট ভাইয়ের শাষন খেয়ে বড় হয়েছে। স্বাভাবিক ভাইবোনের মতো ঝগড়া করেছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে, মারামারি অবশ্য ওরকম কখনো করেনি। পূর্ব পুরোনো দিনের কথা ভেবে স্নিগ্ধ হলো। পূর্বিকাও হাসিটা অল্প-অল্প কমিয়ে পূর্বের কাছে এগিয়ে গেলো। মাথায় হাত রেখে চুলে আঙ্গুল চালাতেই কেমন আবেগের সুরে বলে উঠলো,

– তোর জেলে যাওয়ার কথা শুনে প্রচুর কষ্ট হয়েছে পূর্ব। তোর কাছে এই প্রথম থাকতে পারলাম না ভাই। তোকে কোনোদিন আমি দুঃখ পেতে দেইনি, আব্বুর বকুনি থেকে কতবার বাঁচিয়েছি। কিন্তু শকুনের কাছ থেকে তোকে বাঁচাতে পারিনি রে। তোকে কতবার বলেছি এসব রাজনীতি তুই করিস না। তুই ভালো ছাত্র, লেখাপড়া কর, ভালো একটা রেজাল্ট করে বিদেশে চলে যা। এই দেশে থাকিস না। তুই আমাদের কারোর কথাই শুনলি না। আমার বিয়ের মধ্যেও পূর্ণতার যেই ঘটনা ঘটলো বিশ্বাস কর, এখনো রাতের বেলা ঘুম না ধরলে ওই দৃশ্য ভাসে। তোকে ওইভাবে চিৎকার করতে জীবনেও দেখিনি পূর্ব। ছোট থাকতে তোর ডান পায়ে তারকাটা ঢুকেছিলো। ওই ব্যথায় তুই যতটা না কেদেঁছিস, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি পূর্ণতার রক্তাক্ত বেহুঁশ দেখে তুই কেদেছিলি পূর্ব। তোর জীবনটা এমন কেন রে? তোর জীবনের কষ্টগুলি কি আমাকে দেওয়া যায়না? আমাকে দিয়ে দে ভাই। তুই আমার সুখগুলী নিয়ে নে। তোর কষ্টের কথা চিন্তা করলে আমি ওই বিদেশের মাটিতে শান্তিতে থাকতে পারিনা। যদি আল্লাহ্ আমাকে এমন কিছুর ক্ষমতা দিতো তাহলে তোকে আমি কোনোদিন কষ্ট পেতে দিতাম না পূর্ব। তোর মতো ভাই কারোর কপালে পাওয়াও ভাগ্য। তুই আর কোনোদিন ওইপথে যাস না ভাই। তোর সন্তানটার দিকে খেয়াল দে, একটু স্বার্থপর হওয়ার চেষ্টা কর। সমাজের মানুষ নিয়ে আর মাথা ঘামাস না। ওরা তোর উদারতা পাওয়ার যোগ্য না পূর্ব।

পূর্বিকা সাথেসাথে দুচোখে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী চাপলো। পূর্বের মাথা থেকে হাত সরিয়ে ওড়না টেনে চোখ মুছে ফেললো। পূর্ব তখন গাঢ়দৃষ্টিতে পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে পূর্বিকা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলে তাড়াতাড়ি নিজের আবেগান্বিত অবস্থা ঢাকার জন্য ভাতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

– বললি না ছেলের নাম কি রেখেছিস?

পূর্ব ওর কাছ থেকে চোখ সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালো। ছোট্ট আঙ্গুলের হাতটা এনে প্রতিটা আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বললো,

– ওয়াসিফ প্রণয়।

পূর্বিকা আশ্চর্য হতে গিয়ে হেসে দিয়ে বললো,
– প্রণয়? কি ভেবে এই নাম রাখলি?

পূর্ব ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললো,

– প্রণয় অর্থ ভালোবাসা। ও আমার ভালোবাসার চিহ্ন আপি। অনেক কষ্টের পর ও দুনিয়ার আলো দেখেছে। ওকে নিয়ে আমার আর পূর্ণতার স্বপ্ন আছে। আমি চাইনা ও বাবার মতো হোক। আমি চাইনা ও মায়ের মতো নরম হোক। আমাদের দুজনের সব ভালো গুণ নিয়ে ও পৃথিবীর আলোতে বেড়ে উঠুক। আমার জীবনে তোর মতো বড় বোন, মায়ের মতো আর্দশ নারী, বাবার মতো বলিষ্ঠ মানুষ পেয়েছি। আমার প্রণয় যেনো সবার ভালোবাসায় বড় হোক আপি। আমার জীবনে আর কিছুই আমি চাইনা।

কথাটুকু শেষ করতেই পূর্ব প্রণয়ের কপালে চুমু খেলো। পূর্বিকার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো ছেলের প্রতি ধ্যান রাখতে। এরপর চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিজের রুমে এসে দেখলো পূর্ণতা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরেছে। ঘুমিয়ে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। পূর্ব নিরবে রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে শার্টটা খুলে ফেললো। আলমারি খুলে টিশার্ট বের করে সেটা পরে নিলো। বিছানার দিকে আসতেই দখিন দিকে জানালাটা খুলে শুয়ে পরলো। শহরে এখন আর জাঁকিয়ে শীত নেই। ঠান্ডার রেশ বক্ষস্থল পযর্ন্ত কাঁপিয়ে দেয়না এখন। গায়ের কম্বলটা এজন্য পাতলা। ভারী কম্বল নামাতে হয়না। পূর্ব মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছে পূর্ণতার জন্য। পূর্ব বামপাশে তাকালে। পূর্ণতা আজ অদ্ভুত ভাবে শুয়েছে। কোলবালিশ টেনে মুখ লুকিয়ে রেখেছে পূর্বের একটু রাগ হলো। স্বামী পাশে রেখে বালিশকে জাপটে ধরার মানে কি? পূর্ব তৎক্ষণাৎ পূর্ণতার বাহুটা টেনে এমনভাবে নিজের ঘুরালো যে, পূর্ণতার দিকে তাকাতেই পূর্ব ভ্রুঁ কুঁচকে উদগ্রীব কন্ঠে বললো,

– কাঁদছো কেন পূর্ণ? আসো, কাছে আসো। আসো জলদি!

পূর্ব দ্রুত দুহাত বারিয়ে পূর্ণতাকে বুকের কাছে টানলো। মুখের উপর থেকে পূর্ণতার চুলগুলো সরিয়ে দিলো। কম্বলটা টেনে গা ঢেকে দিতেই পূর্ব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

– এখন আমি আছি তো। কাঁদতে চাইলে আমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদো। আমি একটুও কষ্ট দিবো না। আর ওভাবে বালিশ টেনে ঘুমাবেনা পূর্ণ। আমাকে ধরে ঘুমাবে।

আবছা অন্ধকারে পূর্ণতা মুখ তুলে পূর্বের মুখের পানে তাকালো। শেষে হাত বারিয়ে পূর্বের পিঠ আকড়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। গুটিশুটি হয়ে পূর্ণতা চোখ বন্ধ করলে পূর্ব ওর মাথায় থুতনি রেখে ঘুমিয়ে পরলো।

.

ঘড়ির কাটায় ‘ সময় ‘ এবং ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ দিন ‘ দুটোই পেরিয়ে গেলো বহুদিন। ওয়াসিফ ভিলায় এখন আর খা খা শূন্যতা বিরাজ করেনা। মানুষের হৈচৈ এবং প্রণয়ের কান্নাকাটিতে বাড়ির মধ্যে শব্দের ধারা চলতেই থাকে এখন। আজ পূর্বের কাছে প্রচুর ঝারি খেয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছে পূর্ণতা। সেই সঙ্গে পূর্ণতা স্থির করেছে এখান থেকে চলে যাবে সে এবং সোজা গিয়ে খোদেজা ও কবিরের কাছে উঠবে। পূর্ব সাফসাফ বলে দিয়েছে, যেতে চাইলে যাও কোনো বাধা নেই। কিন্তু প্রণয়কে সঙ্গে নিয়ে কোত্থাও বের হওয়ার সাহস না দেখায়। পূর্বের এমন কথা শুনে পূর্ণতা মনেমনে ঠিক করলো সে ইচ্ছে করে পূর্বের সাথে কথা বলতে যাবেনা। যদি পূর্ব নিজ থেকে কথা বলে বা কাছে আসে তাহলে সেটে অন্য কথা। প্রণয়কে পেয়ে অন্যমাত্রায় রূপ পেয়েছে পূর্বের ব্যক্তিত্ব। সে এখন আর বাইরে যাওয়ার জন্য খুব সকালে উঠেনা, পার্টির নাম মুখ থেকে বেরুয় না, কোনো দলবল নিয়ে চলার কথাও সে উচ্চারণ করেনা। আগের মতো কোনোকিছুতেই সে আর নেই। জেলে থাকাকালীন পূর্ব তার সদস্যপদ হারিয়ে ফেলে এবং দল থেকেও তাকে বহিস্কার করা হয়। এরপর জেল থেকে বের হয়ে সে অন্য জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করেছে। তাও সেটা চুপিচুপি, চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। পলাশ ওয়াসিফ পুরোপুরি সুস্থ কখনো না হলেও এখন একটু-আধটু পরিস্কার কথা তিনি বলতে পারেন। নাতীর লাল মুখটা দেখে তার অন্তরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। ছেলের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে পরান জুড়িয়ে যায়। তিনি কান্নায় নিজের সুখটাকে এখন বেশি প্রকাশ করেন। আগের মতো ধমক বা উচ্চস্বরে কথা তিনি বলেন না। পূর্বিকা কয়েক মাস কাটিয়ে আবার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে পূর্বিকার স্বামী কয়েকবার এসে সবার সাথে দেখা করে গেছে।

.

পড়ন্ত বিকেলের কমলাভ সূর্যটা পশ্চিমে হেলার প্রস্তুতি নিয়েছে। আকাশে একঝাঁক পাখি অনেকক্ষন ধরে উড়ছে। পরিবেশটা শান্ত ও কোমল হয়ে এসেছে। পূর্ণতা শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে আলমারিতে রাখছে। পূর্ব সকাল থেকেই বাড়িতে নেই, আসার নামগন্ধও প্রায় বোঝা যাচ্ছেনা। ফোন দিলে সেই আগের মতো ফোন ধরছেনা। প্রণয় আয়েশার কাছে ঘুমাচ্ছে, পূর্বিকা পলাশের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু চিন্তিত পূর্ণতা আজ হঠাৎ করেই বেশি চিন্তায় বিভোর হলো। পূর্বকে নিয়ে শুধু একটাই চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খায়, যেনো কখনো ওই রাজনীতির পথে ও ফিরে না যায়। ঘড়িতে আরেকবার চোখ রেখে হতাশার শ্বাস ফেললো। চারঘন্টা শেষ হয়ে পাঁচঘন্টা হতে চললো। এবার যেনো ধৈর্য্য রাখতে পারলো না পূর্ণতা। আলমারি বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিলো। পূর্বকে কল দিয়ে প্রচণ্ড খারাপ কথা শোনাবে এটাই মনেমনে স্থির করলো। কল দিলো ঠিকই কিন্তু পূর্ব রিসিভ করলো না। পরপর আটটা কল শেষে পূর্ণতা যখন রাগে,অভিমানে ফোন বিছানায় ছুঁড়বে ওই মূহুর্তে ফোন বাজতে লাগলো। রাগের উত্তেজনায় স্ক্রিনে না তাকিয়ে পূর্ণতা রিসিভ করে ফেললো। মুখ খুলে যেই অশ্রাব্য কথা উচ্চারণ করবে ঠিক ওই মূহুর্তে ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে কেউ কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– আমাকে উদ্ধার করো, ও চলে যাচ্ছে। ও আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। আর নাকি ফিরবেনা। মুখও দেখাবেনা। আমাকে উদ্ধার করো…

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here